ডারউইনের (বা)নরতত্ত্ব
রাশেদুল আলম
[ভাষা: মানবীয়; ভাব: বানরীয়; ঢঙ: ঈশপীয়]
বানর মানুষের নিকটাত্মীয়। ধরে নিই, আত্মা-ঘটিত ব্যাপার-স্যাপারেও বানর ও মানুষে মিল আছে। আর যদি বানর থেকেই ডারউইন সাহেবের উৎপত্তি হয়, তবে প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমরা বানরের উত্তরপুরুষ। তো আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রেম কেমন ছিল? বর্তমানে আমাদের প্রেমের যাবতীয় কলাই কি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বানর-সমাজ থেকে প্রাপ্ত? কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় না গিয়ে আমরা একটু কল্পনাভিত্তিক রসায়নে প্রবৃত্ত হই। গল্পের খাতিরে আমরা আরো ধরে নিই যে, বানরগণ এখনও বানরই আছেন, মনুষ্যসমাজে উন্নীত বা পতিত হন নি। তার মানে ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ মানুষের অস্তিত্বকে আমরা আপাতত ভুলে যাই এবং কিছুক্ষণের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের মালাটা তাদের গলায় পরিয়ে দিই। যদি তা-ই হয়, এখন আমি একজন বানর, লেখক-বানর। বানরদের জন্য আমি লেখালিখি করি। যেহেতু আমি নিজেও বানর, সেহেতু আমি আমার জন্যেও লিখি। আমার আগ্রহ প্রধানত বানর-সমাজের প্রেম নিয়ে। আজ আমি এক বানর ও বানর-রানির প্রেমগাথা বয়ান করব।
সৌরজগতের গ্রহমণ্ডলীর একটি গ্রহে বানরগণ থাকে। এই বিশাল গ্রহের নাম চিড়িয়াখানা। এ-চিড়িয়াখানার এক বানর কলেজ পাশ করে উচ্চতর বানরবিদ্যার জন্য বিশ্ববনালয়ে ভর্তি হলো। এখানে এসে সে মহা খুশি। চারদিকে গাছ আর সবুজ পাহাড়। সেখানে তার মতো অনেক বানর, বানর-রানি ঝুলে ঝুলে প্রেম করছে। বানর মনে মনে গাছের মগডালে নিজেকে কল্পনা করে। শিহরিত হয়। বানর ভর্তি হয় ‘ক্যাঁ ক্যাঁ কুঁ কুঁ’ বিভাগে। সেখানকার বানর-রানিদের দিকে তাকায়। অনেকগুলো থেকে একটাকে বেছে নেয়। তার চেহারায় কী যেন আছে! বানর কল্পনায় হারিয়ে যায় তারা দুজনে গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, লেজে ঝুলে দোল খাচ্ছে, ভেংচি কাটছে...। এখন বানর-রানি রাজি হলেই হয়। একসাথে পড়ে বলে একসময় তার সাথে বানরের আলাপ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখিত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু মনের কথা বলতে না পারায় বানর মনে মনে অদ্ভুত ধরনের কষ্ট পায়। বুঝতে পারে কথাটা না বলা পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। সইতে না পেরে একদিন সত্যি সত্যি সে বানর-রানিকে বলে, “শোন, তোমার জন্য আমার মন কেমন কেমন করে। আমি, মনে হয়, তোমাকে ভালোবাসি।” শুনে বানর-রানি গম্ভীর হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “এটা সম্ভব না।” বানর জিজ্ঞাসা করে, “কেন?” বানর-রানি বলে, “আমাদের দুজনের ধর্ম আলাদা।” বানর অবাক হয়, ধর্মটা কী জিনিস! সে নাবানরের মতো জানতে চায়, “ধর্ম কী?” বানর-রানি উত্তর দেয়, “আমরা ‘বুদ্ধুবানরের’ অনুসারী, আর তোমরা ‘মহাবানরের’। এ-কারণেই সম্ভব না।” বানরের বিস্ময় বাড়তে থাকে। এ-ধরনের কথা সে নতুন শুনছে। সে গাছের দিকে তাকাল। কেউ কলা খাচ্ছে, কেউ হাত তালি দিচ্ছে, কেউ তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। সে বলল, “তুমি যে-দুজনের কথা বললে, তারা কি বানর না? তাদের মধ্যে পার্থক্য কী? আর আমরা দুজনও বানর, আমাদের মধ্যে তফাৎ কী?” বানর-রানি বলল, “তোমাকে অত বোঝাতে পারব না, আমার পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব না। তবে তুমি যদি বন্ধু-বানর হয়ে থাকতে চাও, থাকতে পার।”
বানর বেকুব হয়ে যায়। বানর-সমাজ সম্পর্কে তার মনে ভয়-বিস্ময়-বিবমিষা চলে আসে। ‘বানর বানরের জন্য’ কথাটা ভণ্ডামি মনে হয়। বানর-রানিকে না পেয়ে বানরের বাঁদরামি বন্ধ হয়ে যায়। সে আর গাছে চড়ে না, লেজে ঝুলে খেলা দেখায় না, কলা খায় না...। একদিন বুদ্ধু-বানরের এক অনুসারীর সাথে তার বানর-রানীর বিয়ে হয়ে যায়। এরপর থেকে তার বাক্ও রুদ্ধ হয়ে যায়।
বানর-বৃত্তান্ত এখানেই শেষ। এবার মালাবদলের পালা। বানরের গলায় তো মুক্তার হার মানায় না, তাই মনুষ্যসমাজের গর্বিত একজন হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের খেতাবটা বানরের গলা হতে উদ্ধার করে মনুষ্যসমাজের গলায় পরিয়ে দেই, আর ডারউইন সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই তাঁর অসাধারণ থিয়োরি কিংবা আত্মোপলব্ধির জন্যে।
২০ মার্চ ২০০৮
মিরপুর ১৩, ঢাকা।
Email: [email protected]