আমি যদি মুক্তিযোদ্ধা হতাম

রাশেদুল আলম

আমার জন্ম হয়েছে যুদ্ধের অনেক পরে। মাঝে মাঝে ভাবি, যদি যুদ্ধের সময় আমার সত্তা থাকত, আমি কি যু্দ্ধে যেতাম? প্রত্যেকবারই উত্তরটা ইতিবাচক হয়। আর সে যুদ্ধটা যদি এখন হত কিংবা এখন যদি আরেকটা যুদ্ধ শুরু হয়, তবে কি আমি যুদ্ধে যাব? এবার কিন্তু উত্তরটা নেতিবাচক। এ দুভিন্নসময়ের মেরুদণ্ডের বিবর্তনের কারণ আমি চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারব না। শুধু এটা মনে হয়, এখন যুদ্ধ হলে যাব না; এবং আমার মতো আরো অনেকে যাবে না। শত্রুপক্ষকে গেরিলা-আক্রমনের ভয়ে তটস্থ থাকতে হবে না, আর জামায়াত-বাহিনীকেও কষ্ট সয়ে আগের মতো লিস্ট বানাতে হবে না। আমরা সবাই ঘরমনের সবকটা জানালা লাগিয়ে টেলিভিশন খুলে দুলহান দেখব, ক্যানভাসার জাকির নায়কের দিগ্বিজয়ী প্রসাদি বক্তৃতা শুনব কিংবা ম্যাসেঞ্জারের বাজারে বয়সভিত্তিক লিঙ্গ খুঁজে বেড়াব।  

যেহেতু নিজের কাপুরুষোচিত বর্তমান-মানসতা নিজের কাছে পীড়াদায়ক, তাই কল্পনা করিআমি যদি ৭১-এর মুক্তিযোদ্ধা হতাম! তাহলে নিশ্চয় আমি এখন বুড়া- বুড়া মুক্তিযোদ্ধা। যখন দেশ স্বাধীন করেছিলাম তখন জোয়ান মাথা উঁচু করে হাঁটতাম। মনে হত, এ মাটি আমার জন্মে ধন্য। এ মাটির ফসল আমি। আমাকে কাটলে রক্ত নয়, বের হবে মাটি। মাটিকে, মাটির গন্ধকে বুকভরে ভালোবাসতাম। বুকে বড় স্বপ্ন ছিল তখন। স্বপ্নে কাঁপিয়ে সবাইকে যুদ্ধের গল্প বলতাম। এরপর কীভাবে যেন বদলে গেল সব। আমিও বদলে যাই। রক্তের স্রোতে বুকের মাটি ভেঙে পড়ে । স্বপ্নযুদ্ধের কথা কাউকে বলি না, কেউ শুনতে চায় না; স্বপ্নের ঘ্রাণ হারিয়ে যায়। এখন টেলিভিশনে যখন মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখি তখন নিজেরই বুক কাঁপে ভয়ে, আর দেখি না। যখন নাটকে দেখি মাস্তানরা মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে বেড়ায় কিংবা কোনো নারীকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করে, তখনও আতঙ্কে পাল্টে ফেলি চ্যানেল। এখন গোবরময় বাংলাদেশের টেলিভিশনে, পত্রিকায়, মসজিদে, রাস্তায়সবখানে পদ্মশুভ্র রাজাকার (রাজ+আকার= রাজা)। দেশের পঙ্কিল জনগণকে তারা পদ্ম বানাতে চায়। ৭১-এর পর ওরা পালিয়ে থাকত যাতে আমাদের চোখে না পড়ে। এখন তারা চ্যানেলে চ্যানেলে দাবড়িয়ে বক্তৃতা দেয়। আমাদের সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের মূল্যবান সাক্ষাকার নেওয়ার জন্য, তাদের বদনের ফটো তোলার জন্য। সংবাদপাঠিকারা সুমিষ্টকণ্ঠে তাদের নাম নির্ভুল উচ্চারণ করে। রাজাকারমুক্ত কোনো দিন নেই আজ আমাদের জীবনে। আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কেউ আসে না। মুক্তিযোদ্ধারাই তো এখন ভয়ে লুকিয়ে আছে, সাংবাদিকরা তাঁদের কোথায় খুঁজবে? এর চেয়ে রাজাকার সহজলভ্য। প্রতি বর্গকিলোমিটারে তাদের গড় ঘনত্ব বেশি। কারণ রাজাকারের ছেলে রাজাকার হয় কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হয় রিকশাওয়ালা। ৭১-এর পর ফি বছর কত রাজাকারের জন্মে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে সে-জরিপ কেউ না করলেও অনুমান করতে কষ্ট হয় না।  

মুক্তিযোদ্ধারা এখন আর বিশ্বাস করে না যে তাঁরা যুদ্ধ করেছে। ৭১ তাঁদের কাছে একটা দুঃস্বপ্নের নাম। ৩৭ বছরের পুরানো আত্মমর্যাদাহীন ঘটনা ভুলে গিয়ে তাঁরা কোনো মতে পেট চালিয়ে টিকে আছে। কিন্তু কিছু স্মৃতিকাতর মুক্তিযোদ্ধা বংশমর্যাদার মতো স্বাধীনতার গৌরব, আত্মমর্যাদা এখনো ভুলতে পারে না। তাঁরা তাঁদের স্বপ্নের কথা বলে চিকার করে, রাজাকারদের গালি দিয়ে ভদ্র সমাজের পরিবেশ নষ্ট করে, দুনিয়ার আদালতে বিচার চেয়ে তাদের আল্লাকে ছোট করে। আর সেটার শাস্তি আল্লা হাতেনাতেই দিয়েছেন একজনকে। চড়-থাপ্পড়-লাথি-টাথি খেয়ে মর্যাদাকে রাজাকারদের রাজহাতে তুলে দিয়ে কোনো মতে আত্মাকে নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে সে মুক্তিযোদ্ধা। বেচারা মুক্তিযোদ্ধা, আস্ফালন দেখানোর আর জায়গা পেল না! তাও আবার বাংলাদেশে! 

আমি শুধু আশপাশের মানুষ দেখি, তাদের চোখে পুরো দেশ দেখি। না, তারা সুখে আছে। কোথায় কোন মুক্তিযোদ্ধা লাথি খেয়ে পড়ে আছেএ নিয়ে তারা ভাবিত না। একটু নির্ঝঞ্চাট বেঁচে থাকাকোনো ঝক্কি-ঝামেলায় তারা জড়াতে চায় না। বুঝতে পারি, মুক্তিযুদ্ধ-দেশপ্রেম-বিবেক শব্দগুলোকে চোখ বেঁধে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ওরা ফিরে আসবে না, কখনো আর।  

হে প্রজন্ম, আমরা কি একটা রাজাকারকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করেছিলাম? হে সন্তান, যুদ্ধ করে কি আমরা দোষ করেছিলাম? কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ তোমরা? হে সংবাদকর্মী, তোমরা কি শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? তবে শোন, আমি একটা ঘোষণা দিতে চাই: আগামী ১৬ ডিসেম্বরে সকল মুক্তিযোদ্ধা ৩৭ বছর পর তাদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবে। প্রিয় দেশবাসী, রাজাকাররা আমাদের লাঞ্ছিত করেছেএতে আমাদের দুঃখ নেই। আমাদের দুঃখ একটাই যা শুধু আপনারা পারেন দূর করতে। আমাদের এখন বাকি আছে শুধু আপনাদের লাথি খাওয়ার। তাই আগামী ১৬ ডিসেম্বরে সম্মিলিত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে আপনাদের পবিত্র পদযুগলের সদয় লাথি উপহার দিবেন। আমরা কৃতজ্ঞতায় আভূমি নত হয়ে আপনাদের দেশ আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিব। এরপর আমরা বিষপানে গণআত্মহত্যা করব। আমরা আপনাদের মুক্তিযোদ্ধামুক্ত একটা মুক্ত দেশ দিয়ে যাবএ আমাদের অঙ্গীকার।  

Email: [email protected]