একজন বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের আত্মোপলব্ধি
রাশেদুল আলম
[অকুস্থল: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; কাল: ঘটমান বর্তমান]
আমি একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক। আরো কয়েক বছর আগে হলে ‘পাবলিক’ শব্দটা জুড়ে দেওয়া লাগত না। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বিশাল বাজার যে নামের আগে ব্র্যান্ড উল্লেখ না করলে সম্ভ্রম রক্ষা করাই দায়। যদিও এর আগে নামে মহাদেশীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম, কিন্তু তখন ‘প্রাইভেট’ শব্দটা উল্লেখ করতাম না; বলতাম, আমি বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক। লোকজন ধন্দে পড়ে যেত। আঁতেল লোক হলে জিজ্ঞাসা করত, “কোন বিশ্ববিদ্যালয়?” আর আমার মতো পাবলিক হলে জিজ্ঞাসা করত, “তা-ই! কোন বিষয়ে পড়ান?...” বলা বাহুল্য, আমি এ-শ্রেণীর লোকদেরই পছন্দ করি, কারণ আমিও এদের মতো, অন্যদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি না। আর এ-শ্রেণীর লোক জানে কম, অবাক হয় বেশী। এদের সামনে আমি বেশ গরব অনুভব করি। আর আঁতেলদের সামনে এলে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। তখন আমার অবস্থা হয় ভাইভা-বোর্ডের ছাত্রের মতো। ভাইভা-বোর্ডে কিছু কিছু ছাত্রকে এত Critical প্রশ্ন করা হয় যে তখন আমি নিজেই ঢোক গিলি। তখন এই ভয়ে থাকি যদি ছাত্রটা আঙুল দেখিয়ে বলে বসে, “আমাকে জিজ্ঞাসা না করে ওনাকে করেন।” ছাত্রদের মধ্যেও কিছু আঁতেল আছে। ক্লাসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, “স্যার, প্রবাদ আর প্রবচনের মধ্যে পার্থক্য কী?” ওর ভঙ্গিতেই বোঝা যায় প্রশ্নটার উত্তর তার জানা আছে, আমি জানি কিনা পরখ করছে। প্রবাদ আর প্রবচনের মধ্যে আসলেই কোনো পার্থক্য আছে নাকি? দুটাইতো নীতিবাক্য। হুমায়ুন আজাদ প্রবচনগুচ্ছ লিখেছেন, প্রবাদগুচ্ছ কেন লেখেন নি? প্রবাদগুচ্ছ লেখাটাই তো স্বাভাবিক ছিল। উনি তো আবার নিজেকে ব্যতিক্রম মনে করতেন, বহুমাত্রা নিয়ে লিখতেন, এ-কারণেই প্রবচনগুচ্ছ লিখেছেন। ...এ-রকম বেয়াদব সব ক্লাসেই দু-একটা থাকে। আমাদের সময়ে আমরা তো মকতবের শিক্ষকের দিকে চোখ তুলেই তাকাতাম না, প্রশ্ন করাতো দূরের ব্যাপার। শিক্ষকদের আমরা সম্মান করতাম। তাঁদের দোয়া (আর কিঞ্চিৎ দলীয় লবিং) ছিল বলেই আজ আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক। তো ক্লাসে অপ্রস্তুতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ওই সব ছাত্রের নাম জিজ্ঞাসা করি; তারা ভয় পেয়ে যায়, না বুঝলেও জানতে চায় না। কিন্তু এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। ক্লাসে চুপ থাকলেও তারা বাইরে চুপ থাকে না। কিছু বদমায়েশ ছাত্র শিক্ষকদের ব্যঙ্গ করে ‘গুরুচণ্ডাল’ নামে চটিবই বের করেছে। ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররা হুড়োহুড়ি করে কিনেছে সেসব বই। এভাবে টাকা নষ্ট না করে কোনো ছাত্র সংগঠনকে দান করলেও অনেক ফজিলত হতো। তাদের কে বোঝাবে কোনটা ভালো, কোনটা নাউজুবিল্লাহ? তো সে-বইয়ে এক বেয়াদব কীর্তন করেছে আমার নামে-
“একগুরু মহারাগী শত্র“দল মতো।
জ্ঞান-শর দান দেন শিষ্যগণে যত ॥
সাহসে দুর্জয় তিনি ‘কালকেতু’ হেন।
কণ্ঠ তাঁর মহাত্রাস ফাটা বাঁশ যেন ॥”
আরেকজন আমার ব্যাকরণ-জ্ঞান নিয়ে একেবারে ‘বেইজ্জত’ করে ছেড়েছে। আরে ব্যাটা, চল্লিশ-পঞ্চাশজনের সামনে এসে তোরা লেকচার দে না...তখন কোনটা ‘উপমিত’, কোনটা ‘উপমান’ আর কোনটা তোর ‘নিজের নাম’ সব একাকার করে ফেলবি। তাছাড়া তাদের বোঝা উচিত আমি পি.এইচ.ডি. করেছি কারক-বিষয়ে, সমগ্র ব্যাকরণ নিয়ে নয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চেয়ে কোচিং সেন্টারের ছাত্ররা অনেক ভালো, বিনয়ী। এ-কারণে কোচিং সেন্টারে আমি সময় দিই বেশি, নগদ টাকা পাওয়া যায় আর সংগঠনের কোচিং সেন্টার বলে বেয়াদবি করার দুঃসাহস কেউ এখানে করে না। ভাগ্য ভালো যে ‘গুরুচণ্ডাল’-এ শুধু আমাকেই বাঁশ দেওয়া হয় নি, ডিপার্টমেন্টের আরো ছয়-সাতজন আঁতেল+কবিকেও ‘নিস্তনাবুদ’ করা হয়েছে। বলা যায়, যোগ্যতার মাপকাঠিতে আমিও এসব ‘শ্রদ্ধেয়’ শিক্ষকদের সমগোত্রীয় হয়ে গেলাম। অবশ্য প্রথম পড়ে মাথায় খুন উঠে গিয়েছিল, পিটিয়ে ওদের পাছার চামড়া তুলে ফেলা দরকার। পরে দেখলাম সিনিয়র শিক্ষকরা ব্যাপারটা হজম করে গেছেন। তাই আমিও ছেড়ে দিলাম। আর সংগঠন থেকে নির্দেশ আছে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদের পেটান না। এটার দায়িত্ব সংগঠনের ব্রতী কর্মীদের। আর স্কুল-কলেজের ছাত্রদের পেটানোর সময় পশ্চাদ্দেশে পেটানো যাবে না, ওই জায়গাটা অক্ষত রাখা উচিত।...” এ সংগঠন আমার জন্য অনেক করেছে, এর জন্য আমি জীবন দিতে পারি। আমার এক প্রতিদ^ন্দ্বী নাস্তিক (অ)সহকর্মী কীভাবে যেন আমার ১৫ বছর আগের একটা কলঙ্ক জেনে গেছে। তারপর পত্রিকার লোকদের টাকা খাইয়ে তা প্রকাশ করে দিয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলাম। আমার তখন প্যান্ট ভিজে যায় যায় অবস্থা। অনেক অনুনয়-বিনয় করে, পায়ে পড়েও লাভ হয় নি। স্যার আমাকে ‘বহিষ্কার’ করলেন। এসব জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর একটু শঙ্কায় ছিলাম আমার এত গরবের চাকরিটাই না চলে যায়। কিন্তু সংগঠন আমার পাশে ছিল। তারা প্রশাসনকে পরম শাসনে রাখল। না, ছাত্রদের সামনে আমার লজ্জা লাগে না। আমি জানি ওরা নিজেরাও নকল করে। ওরা আমার ব্যাপারটা বুঝবে। আর চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা এঁটে এমন গম্ভীরভাবে চলি যে লোকজন বিশ্বাসই করবে না আমি নকল করেছি এবং ‘বহিষ্কৃত’ হয়েছি। তাছাড়া আমি পি.এইচ.ডি. হোল্ডার; তার মানে, আমি একজন উচ্চশিক্ষিত; সমাজে, কোচিং সেন্টারে আমার অনেক দাম। ভালো মানুষের জীবনে বাধা আসবেই, কিন্তু আল্লাহ্ই তাঁর প্রিয় বান্দাকে রক্ষা করেন। ওই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস আসছে। আমার সামনে আসলেই দাঁড়িয়ে যাবে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস-ড্রাইভার পর্যন্ত আমাকে চেনে! আর বাসে উঠে যখন বসি, তখন আমার সামনে-পিছে, ডানে-বামে থাকে কয়েক ডজন কাঁচা-পাকা-টেকো মাল-ভরা মাথা। ভাবতেই ভালো লাগে আমি এদের একজন। বাইরের লোকজন যখন চলন্ত বাসের দিকে তাকিয়ে আমাদের দেখে, তখন নিশ্চয় তারা বলাবলি করে, “ওই দেখ, এক বাস বুদ্ধিজীবী যায়।” কিন্তু এত প্রশান্তির মাঝেও মাঝে মাঝে অদ্ভুত মেয়েলি বিমার দেখা দেয় আমার মধ্যে। মনে হয় সব ফাঁকা, মনে হয় ‘বেঈমানি’ করছি- ছাত্রদের প্রতি, জ্ঞানের প্রতি, জাতির প্রতি। তখন এক ধরনের অস্থিরতা আমাকে ঘিরে থাকে, উন্মাদ হয়ে যাই। তখন ইচ্ছে হয় অসৎভাবে দখল করা এই পেশাকে আর অসম্মান না করি, ইচ্ছে হয় এ আত্মগ্লানিকর পেশা ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বেছে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করি। তখন বিবেকের কাঁটা থেকে, চারপাশে তাকিয়ে থাকা অসংখ্য অদৃশ্য চোখের লজ্জা থেকে তো বাঁচতে পারব।
---
মিরপুর ১৩, ঢাকা।
Email: rashed_pti@yahoo.com