আলোর খেয়া
রিফাৎ আরা
গলায় দড়ি বাঁধা ছাগলের খুঁটিটাকে একটুকরো ইট কুড়িয়ে এনে ভাল করে মাটিতে গেঁথে দিল রমিজা। মাঠে প্রচুর ঘাস। এখানে ছাগলটা ইচ্ছেমত ঘাস খাবে আর এই সুযোগে রমিজাও কিছুক্ষণ পড়তে পারবে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা নিয়ে ছায়া বিছানো জামগাছটার একটা মোটা শিকড়ের উপর এসে বসল সে। তারপর ব্যাগ থেকে বইটা বের করে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো। কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা। সূর্য ডোবার আগেই পড়াগুলো একবার অন্তত দেখে নিতে হবে। মলিন ছেঁড়াখোঁড়া বইটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রমিজার বুক থেকে। বইটা এত নরম হয়ে গেছে যে হাত দিয়ে পাতা উল্টাতে গেলে ভয় লাগে। মনে হয় এই বুঝি ছিঁড়ে গেল। আহা! যদি একটা নতুন বই থাকত! ক্লাসে তো নিজের বইগুলো পারতপক্ষে বের করে না রমিজা। অন্যদের বই দেখে পড়ে। ওদের ঝকঝকে বইগুলোর কাছে নিজেরগুলো দেখতে নিজেরই কেমন লজ্জা লাগে। তবু তো এই বইগুলো হাশেম স্যার পুরণো একজন ছাত্রীর কাছ থেকে জোগাড় করে দিয়েছিলেন বলে পড়তে পারছে।না হলে কী হত? থাক। রমিজা আর ভাবতে চায় না কী হত। বরং ভাববে কী হবে।
হঠাৎ ছাগলটা ম্যা ম্যা করে ডাক দিতে চমকে উঠল সে। বই রেখে দৌড়ে ছাগলের কাছে যেতেই দেখল একটা জোঁক ছাগলটার প্রায় নাকের কাছে ঝুলছে। তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে টেনে জোঁকটাকে ছাড়িয়ে দূরে ছুঁড়ে দিল। ইস্, এখন একটু নুন হলে জোঁকটার দফা রফা করে দেয়া যেতো। ছাগলটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিল। তারপর চোখ তুলে বেলার দিকে চাইল। সূর্য পশ্চিমের দিকে হেলে গেছে। এখন যেটুকু বেলা আছে তার মধ্যে পড়াটা শিখতে হবে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে এসে গাছের তলায় বসে বইটা খুলে পড়ায় মন দিল রমিজা।
সন্ধ্যাবেলায় কুপি বাতিটা জ্বালানোর কিছুক্ষণ পরেই ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিলেন মরিয়ম। ঘরে সন্ধ্যাবাতি দেয়া হলো। রমিজা, সালাম আর নজরুল তিন ভাইবোন ওদের ঝুপড়ি ঘরটার ঝাঁপ ছাড়া রুমটাতে ঢুকল। এখানে রাতে ওরা তিন ভাইবোন মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমায় একপাশে। অন্যপাশে গেরস্থালির জিনিসপত্র থাকে। ঘরের অন্যধারটাতে বাবা-মা থাকে। আর একপাশে মাচানের নিচে মরিয়মের দু-তিনটে হাঁস-মুরগি আর মরিয়মের পোষা ছাগলটা থাকে। ঘরে ঢুকেই রমিজা মা-কে ডাকল – মা, মা-
— কিরে, ডাক পাড়স ক্যান?—
— বাবা আহে নাই অখনও?
— না।
— মা, আইজ রাইতে ভাত খামু না? কথার মাঝখানে ছোটভাই নজরুল জানতে চায়।
— এখনও কইতে পারিনারে বা’জান।তোর বাবায় আইলে, চাইল আনলে খাইতে পারস।
— হুঁ – মা, আমার বুঝি খিদা লাগে না? কাইল রাইতেও ভাত খাই নাই। প্যাটটা খালি জ্বলে আর জ্বলে। মা, আমি ভাত খামু, আমারে ভাত দেও।
নজরুল মায়ের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলে রমিজা আদর করে ভাইকে ডাকে – নজরুল, আমার কথা হুন।আস বুবু তোমারে কিচ্ছা কমু।
- না, খালি পেডে কিচ্ছা হুনতে আমার ভালা লাগে না। মায় আমারে ভাত না দিলে আমি-
- লক্ষ্মী ভাই না আমার। আস বাবায় আইলে আমরা ভাত খামু।
- সইত্য!
- হ, সইত্য, সইত্য, সইত্য। তিন সইত্য কাড়লাম।
- আইচ্ছা, তাইলে কিচ্ছা কও ।
- কিচ্ছা না, আইজ তোমারে একজন সইত্য মানুষের কথা কমু।
রমিজা ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর শত জীর্ণ কাঁথাটা বিছায়। তার উপর পুরণো কাপড় দলা করে বানানো পুরনো তেল চিটচিটে বালিশটা বিছানায় রাখতেই নজরুল এসে বুবুর গলা জড়িয়ে ধরে। রমিজা আদর করে ভাইয়ের গায়ে হাত বুলায়।তার মনে পড়ে নজরুলের নাম রাখার কথা। সে তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুল থেকে এসে ভাই হয়েছে শুনে মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়েছিল। মা বার বার বলছিল – আগুন ছুঁইয়া আয় ।বাইরে থেইকা আইসা আতুড়ে ঢুকলে ছাওয়ালের বালা-মুসিবত অয়। রমিজা মায়ের কথা না শুনেই ভাইকে ছুঁয়ে দেখেছিল। তারপর মা-কে বলেছিল - মা, ভাইয়ের নাম রাখমু নজরুল। কাজী নজরুল ইসলাম।এখন রমিজা ক্লাস টেনে পড়ে, আর নজরুল ক্লাস টুতে।
- অ বুবু, গল্প কইবা না?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ কই – আইজ তোমারে বিদ্যাসাগরের কথা কমু।
- বিদ্যাসাগর কেডা বুবু?
- বিদ্যাসাগর আমাগো দ্যাশের খুব একজন বড় মানুষ আছিল। কিন্তু ওনার বাবা ছিলেন খুব গরিব। মানুষের বাড়িতে ভাত রান্ধার কাম করত।
- ধুর বুবু, কি যে কও । ব্যাডা ছেলে আবার ভাত রান্ধেনি!
- ক্যান রানবো না? মিয়া বাড়ির শানু আপার বিয়ার সময় শহর থেইকা বাবুর্চি আইন্যা কত বড় বড় ডেকচিতে রানছিল না? আমরা না দেখতে গেছিলাম।
- হ, হ। তয় এখন কিচ্ছা কও ।
- এইডা কিচ্ছা না নজরুল। এইডা সইত্য ঘটনা। আমাগো রহমান স্যারে কইছে।
রমিজা বলে যেতে থাকে — তো উনি যখন ছোট ছিলেন তখন ওনার বাবায় লেখাপড়া শিখাইতে কোলকাতায় নিয়া আসছিলেন। তখন তো এত্তো গাড়ি-ঘোড়া ছিল না, আর ওনারা ছিলেন গরিব। তাই বাবার হাত ধইরা সেই গেরাম থেকে হাঁটতে হাঁটতে কোলকাতায় আসছিলেন ছোট্ট বিদ্যাসাগর। আসতে পথে পথে রাস্তার পাশে মাইলের হিসাব লেখা পাত্থর দেখতে দেখতে ইংরেজি ওয়ান টু শিখ্যা ফালাইছিলেন। তারপরতো শহরে আইস্যা আরো কষ্ট। আমাগো মতো ঘরে বাত্তি জ্বালাইবার তেল নাই, আন্ধারে পড়তে পারেন না। কিন্তু লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা। শেষে করলেন কি – রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে বইস্যা পড়তে শুরু করলেন।
নজরুলের হাতদুটো রমিজার গলা থেকে খুলে ঢলে পড়ে আছে। ভাইয়ের মুখের দিকে অন্ধকারে তাকিয়ে ডাক দিল রমিজা – নজরুল,অ নজরুল। নজরুল ঘুমিয়ে পড়েছে। রমিজা উঠে বসল। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। আহা। চাঁদের আলোতে যদি পড়া যেতো। তাহলে সারা রাত জেগে পড়ত সে। তবু তাকে পড়তে হবে। প্রতিজ্ঞায় কঠিন হল রমিজা। মনে পড়ল রহমান স্যারের কথা – শিক্ষা ছাড়া মুক্তি নাই।তারপর বিকেলে ছাগল চরাতে গিয়ে বিজ্ঞানের যে পড়াটা পড়েছিল সেটাই আবার বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করল।
অনেক রাতে রমিজাদের বাবা করম আলি আসে। শুক্লপক্ষে পঞ্চমীর চাঁদের আলোটা ততক্ষণে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। কাঁধের কোদালটা নামিয়ে রেখে প্লাস্টিকের ব্যাগটা মায়ের হাতে দিয়ে ঘরের পিছনে ছোট্ট ডোবাটার দিকে চলে যায় হাতমুখ ধুতে।রমিজাও আসে মায়ের কাছে। রমিজার মা চাল ঝাড়ার কুলাটা এনে থলেটা উপুড় করে দেয়। কুলার উপর একসঙ্গে রাখা চাল-আলু-পিয়াঁজ জমা হয়। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় জিনিসগুলো আলাদা করতে করতে মা রমিজাকে কুপিটা ধরাতে বলে। রমিজা কুপি এনে ধরায়। মা চাল মেপে ডোবার দিকে পা বাড়ায়। রমিজা বলে – মা, আমারে দেও। আমি ধুইয়া আনি।
- না, রাত-বিরাতে জংলার ধারে যাইয়া তোর কাম নাই।কত আলাই-বালাই আছে।
- এসব একদম ভুল কথা মা। কিচ্ছু নাই।
- হ নাই। দুই পাতা পইড়া তুমি হাকিম হইয়া গেছ।
মা রেগে যায়। রমিজা আর কিচ্ছু বলে না। ছোট্ট বটিটা নিয়ে চুলার পাশে আলু কাটতে বসে। তার মনে পড়ে ছোট ভাই ছালামের কথা। আহারে, ভাইটার পড়াশুনার দিকে মন ছিল। কিন্তু ক্লাস থ্রিতে উঠতেই বাবা ওকে মিয়া বাড়িতে রাখালের কাজে দিয়ে দিল। এখনও বাড়ি এলে ছালাম রমিজার বইখাতাগুলো নাড়াচাড়া করে দেখে। মাঝে মাঝে কলমটা নিয়ে ছোটবেলায় শেখা কবিতাগুলো লিখতে চায়। রমিজার তখন খুব কষ্ট হয়। শুধু মনে হয় – আল্লাহ যদি মানুষই বানাইল – মানুষের এত কষ্ট কেন?
মা চাল ধুয়ে ফিরে,বাবাও আসে। তারপর ভাত আর আলুভাজি হয়ে গেলে মাথার উপর ছাউনি দেয়া রান্নাঘরটা থেকে সব কিছু ঘরে এনে ওরা খেতে বসে। রমিজা নজরুলকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে। ঘুমে কাদা নজরুল কিছুতেই চোখ খোলে না। তবু জোর করে তুলে তাকে নিজের হাঁটুর উপর ঠেস দিয়ে রেখে ভাতের গ্রাস তুলে দেয়। এভাবেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে নজরুলের। খাওয়া শেষে সবাই শুয়ে পড়লে – রমিজা শুয়ে শুয়ে আবার পড়াগুলো মনে করতে চায়। নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটদুটো বিড়বিড় করে।
- অ রমি, কী কস বিড়বিড় কইরা।মা বেড়ার ওপাশ থেকে ডাক দেয়।
- কিছু না মা, দোয়া দরুদ পড়ি।
- হ, দোয়া পইড়া বুকে ফুঁ দিয়া ঘুমা। নজরুলরেও একটু ফুঁ দিয়া দিস।
রমিজা সাবধান হয়ে যায়। তার মনে পড়ে ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষার আগে দিনের বেলায় শেখা পড়াগুলো বিড়বিড় করে পড়তো বলে তাকে নিয়ে কত কান্ডই না ঘটেছিল। রমিজা এই উপায়টা তখনই বের করেছিল। হঠাৎ একদিন মাথায় এসেছিল রাতে যখন ঘরে বাতি জ্বলে না ও তখন দিনের বেলা পড়াগুলো ভাল করে পড়ে রাতে অন্ধকারেই আবার সেগুলো গুণগুণ করে শিখত। কিন্তু তার এই গুণগুণ শুনে বাবা-মা ভয় পেয়ে গেলেন। তারা ভাবলেন মেয়েকে ভূতে ধরেছে। তারপরতো মায়ের কান্নাকাটি। শেষে হুজুর এনে ঝাঁড়ফুঁক। রমিজা যতই বোঝাতে চায় তার কিচ্ছু হয়নি, হুজুর আরো বেশি করে ধমকান। ভূতকে ভাগানোর জন্য বাঁশের কঞ্চি দিয়ে রমিজার পায়ে-গায়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকেন। মারের চোটে একদিনতো প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। শুনে স্কুল থেকে ছুটে এসেছিলেন রহমান স্যার।
এতকিছুর মাঝেও রমিজা পড়া ভোলেনি। শেষে পাড়া-পড়শির পরামর্শে মা-বাবা ঠিক করলেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন। তখন রহমান স্যার বোঝালেন – বৃত্তি পরীক্ষার পর বিয়েটা দিতে। ট্যালেন্টপুলে রমিজা যখন বৃত্তি পেলো তখন হেডস্যার বাবাকে ডেকে পাঠালেন।বললেন আপাতত বিয়ে না দিতে। কারণ সরকারের আইন আছে ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবে না। কিন্তু রমিজা জানে সুবিধামতো ঘর পেলেই বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। শুধু টাকার জন্য পারছে না। কোন কোন রাতে বেড়ার ওপাশে বাবা-মায়ের আলাপ রমিজার ঘুম হারাম করে দেয়। তবুও একসময় চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসতে রমিজা স্বপ্ন দেখে –অপূর্ব সুন্দর সে স্বপ্ন, জীবনের মত নয়। তখন আবার প্রতিজ্ঞা করে – সব বাধা জয় করার।
টেস্ট পরীক্ষায় রমিজা প্রথম হলো। কিন্তু এস-এস-সি পরীক্ষার জন্য বোর্ডের ফরম পূরণ করার টাকা কোথায়? রমিজার ক্লাসের সবাই ফরম পূরণ করছে। গত ক’দিন থেকে রমিজা আর স্কুলে যায় না। এতদিন অনেক দুঃখেও তার কখনও কান্না পায়নি। না খেয়ে খালি পায়ে রোদে জ্বলে বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়েছে, কিন্তু স্কুল ছাড়েনি। কিন্তু আজ ক’দিন রমিজা স্কুলে যায় না। শুধু তাদের অন্ধকার ঝুপড়ি ঘরটাতে মাটিতে উপুড় হয়ে দিনরাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা-বাবাও কাঁদছে। অসহায় তারা কান্না ছাড়া আর কিইবা করতে পারে। তাদের পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাদের মত গরিব। তারাও আসে, কিন্তু দুঃখ করা ছাড়া তাদেরই বা কী করার আছে। হেডস্যার, রহমান স্যার খবর পাঠান। রমিজা যায় না। যাবে না সে। আর কোথাও যাবে না। এ মুখ কাউকে দেখাবে না। গরিব হয়ে জন্ম নেয়া যে কত বড় অভিশাপ তা রমিজার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।
গত তিন দিন রমিজা ঘর থেকে বের হয়নি। এক ফোঁটা পানিও মুখে তোলেনি। আজও বেলা গড়িয়ে যেতে মা এসে ডাকলেন – রমি, রমি উঠ মা। কিছু মুখে দে। আমার যে বুকটা ফাইটা যায় তোর লাইগ্যা। আমিও আইজ দুইদিন কিচ্ছু খাই না। তোর বাপ মিয়া সাহেবের কাছে গেছিল। মিয়া সাহেব কইছে দিব টাকা। মা, মাগো।
কিন্তু মায়ের কান্নাও রমিজাকে টলাতে পারে না। পাথরের মত মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে সে।আচ্ছন্নের মত পড়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রমিজার মনে হয় তাদের ছোট্ট উঠানটাতে যেন অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পায়। কারা যেন কথা বলছে। কে ও? রীমা না! মনে হচ্ছে রীমা-রোকেয়া-স্বপ্না কথা বলছে। স্বপ্ন দেখছে রমিজা,স্বপ্ন। স্বপ্ন এমন হলে তো খুব ভাল রমিজা আর উঠবে না। শুধু স্বপ্ন দেখে যাবে।
- রমিজা, রমিজা।
কার গলা? রহমান স্যার না? মায়ের কথাও শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ ধুপধাপ শব্দে মুখ তুললো। ঝাপসা চোখে কাদের দেখছে সে? রীমা, রোকেয়া, স্বপ্না, পারুল। তবে কি সত্যি! ওরা এসে চারপাশ থেকে টানাটানি শুরু করলো। রমিজা ওঠ্। দ্যাখ্ আমরা ক্লাসের সবাই এসেছি। স্যার এসেছেন।
রমিজা ওদের টানাটানিতে উঠে বসতে চায়। কিন্তু তার মাথাটা টলছে। তবু বলে – তোরা কেন এসেছিস? আমি যাব না। যা – বলতে বলতে রীমার কাঁধে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বন্ধুরা তুলে ধরে ওকে।ওদের কাঁধে হাত দিয়ে কোন রকমে বাইরে আসে। অবাক হয়ে দেখে তাদের ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর বসে আছেন রহমান স্যার। আর তাকে ঘিরে ক্লাসের সহপাঠি হাশেম, জলিল, ফারুক, সামাদরা সবাই বসে আছে।
স্যার ডাকলেন – এদিকে আয় পাগলি। এমন করে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস, ভাবছিস আমরা কষ্ট পাচ্ছি না, তাই না? এই দ্যাখ, কারা এসেছে। ওরা সবাই তোর অপেক্ষায় বসে আছে। তোকে ছাড়া ফরম পূরণ করবে না। তুই ক্লাসে প্রথম। ওরা হেডস্যারকে বলেছে তুই প্রথম ফরম পূরণ করবি।
- কিন্তু আমার বাবাতো টাকা জোগাড় করতে পারে নি স্যার।
- ধুর পাগলি। এতদিন তাহলে কি শেখালাম তোকে। পড়িস নি দশের লাঠি একের বোঝা। ওরা সবাই মিলে তোর টাকাটা দেবে। আর আমরা সবাইতো তোকে পড়াব। তুই ভাল রেজাল্ট করলে স্কুলের নাম হবে না?
রমিজা আর দাঁড়াতে পারে না। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে।উঠোনে শুয়ে থাকা বিকেলের কমলা রোদ্দুরে তার কাছে সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
রহমান স্যার রমিজাকে কাছে ডাকেন। সে একরকম হামাগুড়ি দিয়ে স্যারের কাছে যায়। স্যার তাঁর পাশে রাখা বাক্সটা খোলেন। প্যাকেট থেকে বের করেন একটা হ্যারিকেন। সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে। স্যার হ্যারিকেনটা রমিজার হাতে দেয়। হাশেম একটা প্লাস্টিক ক্যান এগিয়ে দেয় – এখানে পাঁচ লিটার কেরোসিন। তোমার রাতে পড়ার জন্য। রমিজার সব কষ্ট যেন এক মুহূর্তে উধাও হয়ে যায়। গত তিনদিনের মৃত্যু আকাঙ্খা পরাজিত হয়ে জেগে ওঠে প্রচন্ড জীবনতৃষ্ণা। প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয় তার হাতের মুঠো। হ্যাঁ, ভাল করতেই হবে। তার একার জন্য নয়, সবার জন্য।
সন্ধ্যায় হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসে রমিজা। একপাশে নজরুলও বসে। নতুন আলোয় তাদের ভাঙা বেড়ার ঝুপড়ি ঘরটা আলোকিত হয়ে ওঠে। রমিজা আলোর শিখাটির দিকে তাকিয়ে ভাবে – এ আলো আর কোনদিন নিভতে দেব না।
রিফাৎ আরা। চট্টগ্রাম শাহীন কলেজের বাংলার অধ্যাপক।