অনুভব
রিফাৎ আরাপা টিপে টিপে চার তলার সিঁড়িতে উঠে এলো বুবুন। এখন দুপুর। চারদিকে সুনসান নীরবতা। স্কুল ব্যাগের সাইড পকেটের চেন খুলে ঘড়িটা বের করে আনলো। দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি। তার মানে মামা ফিরতে এখনো প্রায় দেড়ঘন্টা বাকি। হুর্রে! এতক্ষণ কী ভয়ই না পাচ্ছিলো। যদি ঘরে এসে দেখে মামা তার আগেই এসে বসে আছে। আর যদি বুঝতে পারতো বুবুন স্কুলে যায়নি!
পকেট থেকে চাবিটা বের করে ঘরে ঢুকতে বুবুনের মনে হলো হঠাৎ দিনের আলো থেকে রাতের অন্ধকারে ঢুকে পড়লো সে। অন্ধকারটা চোখে সয়ে যেতে আস্তে আস্তে সবকিছু স্পষ্ট হতে লাগলো। হাত বাড়িয়ে বাতি জ্বালালো। বুবুনদের বাসাটার চারপাশে এতো উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি যে দিনের বেলাতেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। বুবুনের ভীষণ বিচ্ছিরি লাগে। বাইরে এতো আলো, সারাটা পৃথিবী আলোয় ভাসছে। আর ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকার। যেন গুহায় ঢুকে পড়া। ব্যাগটা নামিয়ে রেখে জুতো জোড়া খুলে খাটের তলায় ছুঁড়ে দিলো। স্কুল ড্রেসটাও খুলে ছড়িয়ে রাখলো। ইস্, ঘামে সারা গায়ে নুন জমে গেছে। কেমন সাদা সাদা বালি বালি হয়ে আছে ঘাড়ে বুকে। বেডরুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। মুখটা কালচে হয়ে আছে। আয়নার খুব কাছে মুখ নিয়ে নিজেকে ভেংচি কাটলো- একবার, দু’বার, তিনবার। তারপর দেয়ালঘড়িটার দিকে চোখ পড়তেই এক লাফে আলনা থেকে তোয়ালে তুলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। বাপরে! মামা এসে যদি দেখে এখনো গোসল খাওয়া হয়নি, তাহলে হয়তো সারা দুপুর এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে। তাছাড়া কালকে যে হোমটাস্কগুলো দিয়েছিল আজ সন্ধ্যার আগেই করে ফেলতে হবে। ইস্রে, জীবনটা একেবারে কালি করে দিলো। এসব পড়াশোনা যদি না থাকতো। হঠাৎ বুবুনের মনে হলো- আচ্ছা, মা যদি জানতে পারে সে আজও স্কুলে যায়নি! স্কুলে যাবার কথা বলে আজও সে সোনাডাঙ্গার মাঠে ক্রিকেট খেলেছে আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে।
বেশ কিছুদিন থেকেই বুবুন এভাবে স্কুল ফাঁকি দেয়। অবশ্য কাজটা করতে হচ্ছে খুব সাবধানে। ওরা ক’জন বন্ধু বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ব্যাগ পিঠে নিয়ে বেরোয়। তারপর স্কুলের আগের মোড়টাতে সবাই একসাথে হয়ে চলে যায় রেল স্টেশনের পিছনে সোনাডাঙ্গার মাঠে। তারপর স্টেশনের পাশে সাইকেল রিক্সা মেরামতের দোকানে গচ্ছিত রাখা ব্যাট-স্ট্যাম্প নিয়ে খেলা আর খেলা। উহ্! কী যে মজা! ব্যাট করতে খুব ভালো লাগে বুবুনের। ইস্ সে যদি ল্যান্স ক্লুজনারের মতো হতো! কিন্তু মা যদি কোনভাবে টের পায় বুবুন স্কুল ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলে তাহলে কী হবে? ভাবতে ভাবতে আনমনে শাওয়ারটা ছেড়ে নিচে দাঁড়িয়েই বাবার কথা মনে হলো। বাবা প্রায়ই ছুটির দিনে বুবুনকে গোসল করে বাবার হাত ধরে মসজিদে যেতো। তারপর সবাই মিলে খাবার টেবিলে বসা। মা সেদিন নানারকম রান্না করতো। ছোটমামা নানুর বাড়ি থেকে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছে। মা আর মামাকে সারাক্ষণ ক্ষ্যাপাতো বাবা। কতো হাসি-ঠাট্টা মজা! তারপর বিকেলে বেড়াতে যেত ওরা। কী সুন্দর জীবন ছিলো। আর এখন! বুবুনকে হট ক্যারিয়ার খুলে মায়ের সকালে রান্না খাবার খেতে হবে একা একা। ভালো লাগে না। বাবার কথা মনে হতে জল এলো চোখে। মনে পড়লো সে দিনটির কথা। মাত্র তিন বছর আগে। তখন সে ক্লাস ফাইভে পড়ে।
বাবা যে গার্মেন্টসে চাকুরি করতেন সে গার্মেন্টসের টাকা তুলতে গিয়েছিলেন ব্যাংকে। টাকা নিয়ে ফেরার সময় কতগুলো লোক টাকাগুলো ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা কিছুতেই দিতে চায়নি। টাকার ব্যাগটা দু’হাতে চেপে ধরেছিল। তখন ওরা বাবার বুকে গুলি করে। পাশের বাসার তপু ভাইয়া হঠাৎ সেদিন স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসে বুবুনকে। বাসায় অনেক লোক দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই বাবাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছিল মা, ছোটমামা আরও কতগুলো মানুষ। পাথরের মতো নির্বাক মা বুবুনকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তারপর ও দেখল বাবাকে খাটিয়ায় চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছোটমামা ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন কবর দিয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত। বুবুন যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলো না কি ঘটলো শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল কেন ওরা আমার এতো ভালো বাবাটাকে মেরে ফেললো! আর দেখবো না বাবাকে?
বুবুন টের পেল সে কাঁদছে। হ্যাঁ এখনো বুবুন যখন তখন বাবার জন্য কাঁদে। বাবাকে হারানোর শূন্যতা পূরণ হবার নয়। বাবার অফিস থেকে মাকে যখন চাকরী দেয়া হলো তখন সবকিছু আরও শূন্য হয়ে গেলো। মা সকালে অফিসে যায়, ফেরে কখনো সন্ধ্যায় কখনো রাতে। বুবুন লক্ষ্য করেছে অফিস থেকে ফেরার পর মাকে খুব ক্লান্ত দেখায়। একটুতেই রেগে যায়। কিন্তু রাতে ঘুমের ঘোরে ও টের পায় তাকে জড়িয়ে ধরে মা কাঁদছে। একেকবার ইচ্ছে করে মাকে বলে- মা, চাকরীটা ছেড়ে দাও তুমি। আবার মাঝে মাঝে এতো জিদ লাগে, ইচ্ছে করে ভেঙ্গে সব গুড়িয়ে দিতে। বলতে ইচ্ছে হয়- আমি পড়বো না। আমার ইচ্ছে করে না। হঠাৎ ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো- করবো না, করবো না। তারপর কেমন যেন রাগ হতে লাগলো সবার ওপর- বাবা, মা, মামা, এমনকি খেলার মাঠের বন্ধুদের ওপর। কী করবে বুঝতে না পেরে এক মোচড়ে শাওয়ারটা বন্ধ করে দুমদাম বেরিয়ে এলো। মাথাটা মুছে ভিজে তোয়ালেটা ছুঁড়ে দিল বিছানার ওপর। তোয়ালেটা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াবে, মা রাগ করবে। করুক গে। টুং টাং শব্দ হতেই চমকে ঘড়ির দিকে তাকালো ও। তিনটে বাজে। মামা আসতে তো আরও আধঘন্টা। আর ইউনিভার্সিটির ট্রেন লেট হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এসে যদি পড়ে- তাহলে বুবুনকে বকা শুনতে হবে- এতো দেরি করে ভাত খাওয়ার জন্য। উফ্, ভাল্লাগে না।
খাওয়ার টেবিলে এসে হটবক্সটা খুলতেই ঢং করে কলিং বেল বেজে উঠলো। বুকটা ধক্ করে উঠলো। মামা আজ এতো তাড়াতাড়ি! দরজার ফুটোয় চোখ রাখলো বুবুন। কেউ নেই। তবে বোধ হয় কেউ দুষ্টুমি করেছে। ফিরে আসতে আবার ঢং। বুবুন অবাক হলো। ভুতুড়ে ব্যাপার! দরজাটা খুলতেই দেখলো ৯/১০ বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। খেঁকিয়ে উঠলো বুবুন-
- কি রে কলিং বেল বাজালি কেন?
- চাইড্যা ভাত দেন না!
বুবুন চেয়ে দেখলো। ছেলেটার অপরিচ্ছন্ন শরীর দেখলে মনে হয় পাউডারের মতো ধুলো মেখেছে। চুলগুলো জট বাঁধা। ছেঁড়া প্যান্ট আর গেঞ্জি। কিন্তু চোখ দুটো খুব করুণ আর মায়াময়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে হাঁপাচ্ছে। দেখে খুব মায়া হলো বুবুনের। ডাকলো- ভেতরে আয়।
- না, একখান পলিথিনে কইরা দ্যান্। আমিও খামু, মায়েও খাইবো।
- ক্যান্ তোর মা কাম করে না? তোর বাপ কই?
- আব্বায় তো নাই। রিক্শা চালাইতো। দুই বছর আগে টেরাকের তলে পইড্যা মইরা গেছে। মায়ের হাঁপানি- কাম করতে পারে না।
বাবার কথা মনে পড়লো বুবুনের। ভাবতেই কান্না পেল। জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলেটাকে ডাকলো সে। একটু যেন আদর করেই- আয় ভেতরে আয়। তোকে খেতে দেব, তোর মায়ের জন্যও দেব। ছেলেটার করুণ চোখ দুটোতে একটু যেন আনন্দ ছলকে উঠলো।
বুবুনের পেছন পেছন ঘরে ঢুকলো ছেলেটা। ঢুকেই শোকেসে রাখা বুবুনের খেলনাগুলো দেখতে লাগলো। রান্নাঘর থেকে একটা পিঁড়ি এনে বসতে দিলো বুবুন। বাথরুম দেখিয়ে বললো- যা হাতমুখ ধুয়ে আয়। এতো ময়লা হাতে খাবি না কি! এবার আর না গিয়ে পারলো না ছেলেটা। খুব আড়ষ্টভাবে ঢুকলো বাথরুমে।
হাতমুখ ধুয়ে এসে ছেলেটা একটু সহজ হলো। ওকে খেতে দিয়ে বুবুন মোড়া নিয়ে ওর কাছাকাছি বসলো।
- নাম কী রে তোর?
- রতন।
ভাতের দলাটা গিলতে গিলতেই জবাব দিল। তারপর খেতে খেতেই রতন বললো ওর বাবার কথা। বাবা যখন ছিল রতন স্কুলে যেত। ক্লাস টু-তে পড়তো। তার মানে এখন পড়ার কথা ক্লাস ফোরে। মা কাজ করতে পারে না। মাঝে মাঝে এদিকে ওদিকে ভিক্ষে করে আনে আর হাঁপানির টান উঠলে একটানা কয়েকদিন বিছানায় পড়ে থাকে। রতন খুঁজে পেতে কিছু এনে দিলে খায় নয়তো উপোস করে।
রতনের মায়ের কথা শুনতে শুনতে বুবুনের চোখে নিজের মায়ের ছবিটা ভেসে উঠলো। অন্ধকার- ভোরে উঠে মা রান্না করছে। তাড়াহুড়ো করে খাবার গুছিয়ে রাখছে। বারবার ডেকে তুলছে ওকে। যাবার সময়ও ওকে অনেকবার বলে যাচ্ছে- বুবুনসোনা, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। আবার সন্ধ্যায় ফিরে এসে রাতের জন্য রান্না। মাঝে মাঝে কাপড় ধোয়। যেদিন বেশি কাজ করে সেদিন রেগে যায়- ঘরে বাইরে এতো কাজ সহ্য হয় না। ছেড়ে দেব চাকরিটা। তারপর আবার নিজেই বলে- ছেড়ে দিয়ে খাবো কী? কোথায় পাবো চাকরি? তারপর কাঁদছে মা। ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ঘুমের ঘোরেও টের পায় বুবুন। অথচ সকালে উঠে মনে থাকে না।
হঠাৎ বুবুনের মনে হয় ওর মা যদি রতনের মায়ের মতো হতো! তাহলে ওদের কী করে চলতো? তাহলে বুবুনও কি রতনের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো? আচ্ছা, মা যদি জানতে পারে প্রায়ই ও স্কুল ফাঁকি দেয়! পড়াশোনা করে না। মা তো ভীষণ দুঃখ পাবে। পরশু রাতেও মা বলছিল- এ মাসে বেতন পেলে তোকে গ্লাভ্স কিনে দেব। এতো শখ তোর ক্রিকেটের। মা এতো কষ্ট করে আর বুবুন ফাঁকি দেয়! মায়ের ওপর রাগও করে মাঝে মাঝে। চাকরি করে বাসায় থাকে না। বুবুন কেন বোঝেনি মায়ের কষ্ট? বুবুনের ভেতরটা তোলপাড় করে ওঠে। মনে হয় এক্ষুনি ছুটে যায় মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরে বলে- মা, আমি তোমাকে ফাঁকি দিয়েছি। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায় ওর।
- আমি যাই।
রতনের কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় বুবুন। তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে পলিথিন এনে বাকি খাবারগুলো ঢেলে দেয়। রতন খুশি হয়ে চলে যায়।
শোবার ঘরে এসে ভেজা তোয়ালেটা বারান্দায় ছড়িয়ে দেয় বুবুন। টিন খুলে ক’টা বিস্কুট নিয়ে পড়ার টেবিলের কাছে যায়। ইস্ কী এলোমেলো হয়ে আছে। সব গুছাতে হবে। আর ফাঁকি নয়। মাকে কক্খনো কষ্ট দেবে না ও। মা আছে বলেই তো বুবুনের জীবনটা এতো সুন্দর।
রিফাৎ আরা। চট্টগ্রাম শাহীন কলেজের বাংলার অধ্যাপক।