দূরে কোথাও
রিফাৎ আরা
অন্তুর ভীষণ বিপদ। এ পর্যন্ত তিনটি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে একটাতেও টিকেনি। অথচ গত একটা বছর সে স্কুলের পড়ার পাশাপাশি একটি বিখ্যাত কোচিং সেন্টারে কোচিং করেছে। মা সংসারের সব কাজ রেখে অন্তুকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে ছুটোছুটি করেছেন। তাদের প্রচন্ড ইচ্ছে ছেলেকে একটি ভাল স্কুলে পড়াবেন। এদিকে সব স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে। অন্তুর বন্ধুদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে শহরের নামকরা স্কুলে ভর্তি হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর লেখাপড়া শুরু করেছে। আবার কেউ কেউ তার মতোই এখনো দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় বাবা নতুন বইপত্র নিয়ে এলেও অন্তুর পড়ায় মন বসে না। মা এ নিয়ে যখন তখন বকাবকি করেন। বেশি রেগে গেলে তেড়ে এসে গুম গুম করে পিঠে কয়েক ঘা লাগিয়ে দেন। অন্তুরও তখন গোঁ উঠে যায়। বলে - যাও পড়ব না আমি। একদম পড়ব না।
- পড়বি কেন? লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হবি কেন? হবি তো একটা গরু-গাধা। ইস্ কত স্বপ্ন ছিল- এবার মায়ের কন্ঠে রাগের সঙ্গে একটা হতাশা ফুটে উঠে।
অন্তুও সঙ্গে সঙ্গে কেমন মিইয়ে যায়। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী অপরাধী লাগে। সত্যিই তো বাবা-মা তাকে কত আদর করে। ছোটবেলা থেকে অন্তু যখন যা চেয়েছে সাধ্য মতো কিনে দিয়েছে। তাছাড়া গত একটা বছর তাকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে মা-কে কম ছোটাছুটি করতে হয়েছে। কিন্তু মা কেন বুঝতে চায় না অন্তুও কম চেষ্টা করেনি। বাসার কাছে যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে অন্তু পড়ত সেখানেও তার রোল নম্বর দশের মধ্যে ছিল। অথচ তাদের ক্লাসের ফারহান যার রোল নম্বর ছিল ঊনত্রিশ সেও শহরের একটা ভাল স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে সে বাবার সাথে তাদের গাড়িতে করে স্কুলে যায় তখন অন্তু তাদের বারান্দার গ্রিলটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ফারহান কখনও চোখ পড়লে অন্তুর দিকে হাত নাড়ায়, আবার কখনও মজা করে ভেংচি কাটে। অন্তুর বুকের ভিতরটা তখন কেমন যেন টনটন করতে থাকে। মনে হয় একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে একছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে।
বুকের ভেতর ব্যথার কষ্টটা নিয়েও অন্তু এসে পড়ার টেবিলে বসে। ষষ্ঠশ্রেণীর একটা নতুন বই টেনে নেয়। তারপর কিছুক্ষণ বইটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ফরফর করে পাতাগুলো উল্টে যায়। তারপর বইটা নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস টেনে গন্ধ নেয়। নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে অন্তুর খুব ভাল লাগে। বইটা টেবিলে রেখে এবার পঞ্চম শ্রেণীর পুরণো সমাজ বইটি নিয়ে পড়তে বসে। বইয়ের প্রায় সবগুলো পাতা একরকম মুখস্থ হয়ে গেছে অন্তুর। কিন্তু পরীক্ষা দিতে এমন হয় কেন? যতবারই পরীক্ষা দিতে যায় তার আগের রাত থেকে একটা অস্বস্তি অন্তুকে চেপে ধরে। ঘুম আসতে চায় না। সকাল বেলা নাস্তা খেতে পারে না। তারপর পরীক্ষার সময়টা যতই এগিয়ে আসে ততই অন্তুর অশান্তি লাগতে থাকে। ভয় হয় পরীক্ষা ভালো হবে না। এবারও টিকব না। তাহলে কী হবে। ভয়ে দুশ্চিন্তায় গলাটা শুকিয়ে যায়। হাত দুটো তিরতির করে কাঁপতে থাকে। কিন্তু এ কথাটা লজ্জায় কাউকে বলতেও পারে না। অথচ প্রথম প্রথম দু-তিনটে পরীক্ষা অন্তু ভালই দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও টিকেনি। বাবা বলেছিল, ওয়েটিং লিস্টে আছে। যদি স্কুল ফান্ডে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেয় তাহলে ওরা ভর্তি করে নেবে। কিন্তু এত টাকা বাবার ছিল না। মা তবু বলেছিল - আমার গয়নাগুলো বিক্রি করে দাও। বাবা রাজি হয়নি। বলেছিল, দেখা যাক। এখনও আরো স্কুল রয়ে গেছে।
অন্তুদের এ ছোট্ট ফ্ল্যাটটায় দুটো রুম। একটাতে বাবা-মা থাকে। আরেকটাতে একটা সিঙ্গেল খাটে অন্তু ঘুমায়। আর একপাশে অন্তুর ছোট্ট টেবিলটা, অন্যপাশে এক সেট সোফা। এরই মাঝে হাঁটাচলা করতে ধাক্কা খেতে হয়। পড়তে বসে অন্তু প্রায়ই বাবা-মার কথা শুনতে পায়। এইতো কয়েক মাস আগে মা বাবাকে বলছিল- আমিতো ঘরেই থাকি। এখন আর ছুটা বুয়া রাখার দরকার নেই। সংসারের কাজগুলো আমিই করে নিতে পারব। বাবা হেসে বলেছিলেন, ওতে আর কত টাকা বাঁচবে।
- হোক না। পাঁচশো টাকাই বা কম কি। তিল তিল করেই তো তাল হয়। মা বলেছিল।
তারপর মা সত্যি সত্যি বুয়াটাকে ছাড়িয়ে দিল। এগার বছরের অন্তু সব জেনেও মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মা বুয়া না এলে তোমার কষ্ট হবে না?
- কিসের কষ্ট। এইটুকু সংসার আমি নিজেই সব করতে পারব। এখনতো আর তোকে নিয়ে কোচিং-এ যেতে হচ্ছে না। তুই ভাল করে পড়। তারপর স্কুলে ভর্তি হলে তখন দেখা যাবে।
অন্তুর কান্না পাচ্ছিল মায়ের কথা শুনে। তাড়াতাড়ি সরে এসেছিল।
পড়ার টেবিলে বসে ভাবতে ভাবতে এখনও অন্তুর কান্না পেল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে অন্তু পড়ায় মন দেয়।
খুব সুন্দর একটা স্কুল। সামনে খোলা মাঠ। ফুলের বাগান। টিফিনের ঘন্টা বাজল। অন্তু আর তার বন্ধুরা একছুটে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এল। আদিত্য আর রাইয়ান ডাকছে- এই অন্তু আয়- আমরা এক সঙ্গে টিফিন খাব। স্কুলের পেছনের মাঠে বকুল গাছটার নিচে বসব। তাড়াতাড়ি আয় অন্যরা আগে গিয়ে দখল নেবে। অন্তু টিফিন বক্সটা নিয়ে ছুটে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ ফারহান চেঁচিয়ে ওঠে, অন্তু, তুই এখানে কেন? তুই তো এ স্কুলে ভর্তি হোসনি। আদিত্য রাইয়ান চোঁখ কুঁচকে তার দিকে চেয়ে আছে। অন্তু দৌড়াতে গিয়ে পড়ে যায়। চিৎকার করে বলতে চায়- আমিও এ স্কুলে ভর্তি হয়েছি। তোরা জানিস না।
- কি রে অন্তু। ঘুমের মধ্যে এমন গোঁ গোঁ করছিস কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? ইস্ গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।
মায়ের ধাক্কা খেয়ে অন্তু জেগে ওঠে। বাবা-মা মশারি তুলে তার পাশে বসে আছে। অন্তু চোখ মেলতেই মা অন্তুকে জড়িয়ে ধরে।
- ভয় পেয়েছিস বাবা? আমার অন্তু সোনা।
অন্তু মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।
- পানি খাব মা।
বাবা তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা এনে দেয়। অন্তু মায়ের হাতের ওপর আধশোয়া হয়ে আস্তে আস্তে পানি খায়। তার শরীরটা এখনও কাঁপছে। মনে পড়ে কাল সকালে তার পরীক্ষা আছে। গলার ভেতরটা আবার কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আরও এক গ্লাস পানি খেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু লজ্জায় অন্তু বলতে পারে না। মা অন্তুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। ছোট্ট খাটে মা আর অন্তু। অনেকদিন পর মায়ের গায়ের গন্ধে অন্তুর কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। তারপর একসময় দু’চোখে ঘুম নেমে আসে।
সকালে মা ডেকে তোলেন অন্তুকে। চোখ কচলে তাড়াতাড়ি উঠে বসে। মা জিজ্ঞাসা করেন- কি রে, কাল রাতে ভয় পেয়েছিলি?
- হুঁ! অন্তু মাথা নামিয়ে বলে।
- কী স্বপ্ন দেখেছিস?
মায়ের প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে অন্তু বলে - মা, তুমি এখন থেকে আমার সাথে ঘুমাবে।
মা অবাক হয়ে তাকান অন্তুর দিকে। আজ দু’বছর অন্তু একা ঘুমায়। কিন্তু কোন দিন এরকম অনুরোধ করেনি। মায়ের বুকটা ব্যথায় ভারি হয়ে যায়। চোখেও পানি এসে যায়। কোন মতে মা বলেন- ঠিক আছে বাবা, আজ থেকে আমি তোর সাথে ঘুমাবো। এখন ওঠ্। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যেতে হবে। দশটায় পরীক্ষা।
পরীক্ষার কথা মনে পড়তেই অন্তুর বুকের ভিতর সেই শিরশিরে ভয়টা ফিরে আসে। গলাটা শুকিয়ে যায়। বাবা একটা ট্যাক্সিতে করে অন্তুকে আর মাকে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যান। সারা রাস্তা দোয়া পড়ে মা অন্তুর মাথায় ফুঁ দিয়েছে। স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকতে মা বার বার সাহস দেন - একটুও ভয় পাবি না অন্তু। দেখিস, এবার তোর পরীক্ষা ভাল হবে। স্কুলের দারোয়ান মাকে ঢুকতে দেয় না। অন্তুকে হাত তুলে দেখিয়ে দেয় কোথায় গিয়ে বসতে হবে।
দরজা দিয়ে ঢুকতেই অন্তু দেখল আরো পাঁচটি ছেলে ক্লাসরুমের বেঞ্চিগুলোতে বসে আছে। একটা ছেলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে হঠাৎ অন্তুকে চোখ টিপ দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল- কত নম্বর?
অন্তু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
- কী কত নম্বর?
- না জানতে চাচ্ছি ভর্তি পরীক্ষায় এটা তোমার কত নম্বর স্কুল।
এবার অন্তু বুঝতে পারে এবং বেশ মজা পায়। বলে- পাঁচ নম্বর।
- ও। আমার এটা সাত নম্বর। কিন্তু সিট তো মোটে একটা।
- মানে?
- মানে বুঝছ না? একজনকে নেবে। পরীক্ষা-ফরীক্ষা এসব আসলে ভাঁওতাবাজি। যার বাবা বেশি টাকা দিতে পারবে তাকেই নেবে।
- তুমি কীভাবে জানলে?
- আমি বাবার কাছে জেনেছি। বাবা এই স্কুলের হেডস্যারের সাথে হট লাইন তৈরি করেছেন যাতে আমাকে নেয়। আর টাকা যা লাগে তাই দেবেন। আমার বাবা ব্যবসা করেন কি না।
অন্তু অবাক হয়ে যায়। ছেলেটা কেমন বড়দের মতো কথা বলছে। ‘হটলাইন’ মানে কী? বাকি চারজনও কাছাকাছি এসে ছেলেটাকে ঘিরে ধরে।
অমিত হাসান নামে ছেলেটি বলে যায়- আমি ছ’টা স্কুলে পরীক্ষা দিয়েছি। একটাতেও পাশ করতে পারিনি। আরে পাশ করব কীভাবে? আমি কি পড়ালেখা করি! আমার একটুও পড়তে ইচ্ছে করে না। বাবা-মা প্রায়ই পার্টতে যায়। ব্যস্ত থাকে। আমিও খুব ফাঁকি দিই। আমার ঋত্বিকের মতো নাচতে ভাল লাগে। আর এশ্তো দারুণ! ধুম-টু দেখেছ তোমরা? কি ফাটাফাটি ছবি! আমি বড় হয়ে সিনেমার হিরো হবো। কিন্তু এখনতো স্কুলে পড়তে হবে। তাই বাবা হেডস্যারকে ধরে আমার জন্য প্রশ্ন আউট করেছেন। আমার প্রাইভেট টিউটর সব প্রশ্নের উত্তর আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। এখন একটাই শুধু সমস্যা, আমার লিখতে ইচ্ছে করে না। তবে এবার লিখতেই হবে। না হলে বাবা বলেছে, খুন করে ফেলবে। এমনিতেও যে মার মেরেছে পরশুদিন। অমিতের কথা শুনতে শুনতে অন্তুরা ভুলে যায় যে তারা পরীক্ষা দিতে এসেছে।
হঠাৎ ধমক শুনে পেছন ফিরে দেখে খাতা-প্রশ্ন হাতে একজন স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিই তাদেরকে বেঞ্চিগুলোতে দূরে দূরে বসিয়ে দেন। অন্তুর কেমন যেন লাগছে। মাথার ভেতর অমিতের কথাগুলো কিলবিল করছে। এবারও কত বেশি পড়াশোনা করেছে সে। প্রশ্নের সরল অঙ্কটাতো অন্তঃত ত্রিশবার করেছে। অথচ কিছুই মনে পড়ছে না এখন। অন্তু লেখে আর কাটে।
খাতা জমা নিতে এসে স্যার অন্তুকে ধমক লাগান - এই ব্যাটা গাধা। তুই তো নিজের নামই লিখিস নি। অন্তু ভয়ে ভয়ে নিজের নাম লিখে খাতাটা জমা দেয়।
আজ সোমবার। অন্তু ভয়ে ভয়ে আছে। ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে আজ। বাবা অফিসে যাওয়ার পথে খবর নিয়ে যাবেন। অন্তু টিকলে মা-কে ফোন করে জানাবেন। অন্তু সকাল থেকে একফোঁটা পানিও গলা দিয়ে নামাতে পারে নি। সে তো জানে সে টিকবে না। তারপর? তারপর কী হবে?
বারোটার দিকে দরজার কলবেল বাজতেই মা ছুটে গেল। দরজা খুলতেই বাবা। বাবার মুখটা অসম্ভব কালো। অন্তুকে দেখেই রাগে ফেটে পড়লেন। ‘বেরিয়ে যা হারামজাদা, বেরিয়ে যা। গাধা কোথাকার। তোর পেছনে এত খরচ করলাম আর তুই এই করছিস’! বাবা ছুটে এসে অন্তুর চুলের মুঠি ধরে টান দেন। আচমকা ধাক্কা খেয়ে অন্তুর মাথাটা পাশের দেয়ালে ঠুকে যায়। মা ছুটে এসে বাবার হাতটা ছাড়িয়ে নেন। বাবা রাগে হাঁপাতে থাকেন। মা বাবাকে জোর করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেন। অন্তু চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরে এসে টেবিলে মাথা রেখে বসে থাকে। তার চোখে অঝোর ধারায় জল ঝরতে থাকে। বাবা তাকে এভাবে মারল! এরকম গাল দিল!
সারাটা দুপুর অন্তু টেবিলে মাথা রেখে এক ঠাঁই বসে রইল। মা অনেক টানাটানি করল। অন্তু যেন পাথর। কিছুতেই উঠল না। বাবা-মা সারাদিন আলাপ করেছে কী করা যায়। পাথর অন্তু সব শুনেছে। বাবা বলেছেন, হেডমাস্টার আশ্বাস দিয়েছেন যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা স্কুল ফান্ডে দিতে পারে তাহলে ভর্তি করাতে পারেন। মা বলেছে, তাহলে বাড়ির কিছু জমি বিক্রি করে দাও না। বাবাও ভাবছেন। সন্ধ্যার দিকে মা-কে বলেছেন ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকাটা জোগাড় করতে হবে। মার্চমাস এসে যাচ্ছে।
অন্তুর কাছে সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। বাবা-মা’র এত কষ্ট তার জন্য। কেন পারল না সে ভর্তি হতে কোথাও। অন্তু না থাকলে বাবার এত কষ্ট হতো না। কষ্টের জন্যই আজ বাবা তার গায়ে হাত তুলল।
রাতে মা ডাকার আগেই অন্তু টেবিলে। গেল বাবাকে ডাকতে। সবাই মিলে ভাত খেল। অন্তু মা-কে বলল, মা, আজ আমি একাই শোব। ছোট্ট খাটে খুব গরম লাগে।
সারারাত বিছানায় ছটফট করে অন্তু। ছোট্ট জীবনের সুন্দর স্মৃতিগুলো একের পর এক ছবির মত ভেসে ওঠে। ফ্যান্টাসি কিংডমে যাওয়ার জন্য আবদার। তারপর কত্তো মজা। অন্তু ফুচকা খাচ্ছে। উহ্ ঝাল। মা, আইসক্রিম খাব। দাদুর বাড়ি। অন্তুকে বাবা পুকুরে সাঁতার শেখাচ্ছেন। বাবার হাত ধরে অন্তু ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে আসার সময় দাদী কাঁদছেন, আবার অন্তুর মাথায় ফুঁ দিচ্ছেন তাঁর অন্তুসোনা যেন ভাল থাকে। পয়লা বৈশাখের মেলা - অন্তু বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে।
- কত নম্বর? কে যেন অন্তুর কানের কাছে বলে ওঠে। ধড়ফড়িয়ে ওঠে অন্তু। আজান হচ্ছে। তার মানে ভোর হয়ে গেছে। দারোয়ান চাচা গেট খুলে দেবে। সবাই নামাজে যাবে। কাকগুলো ডাকছে - কা কা।
অন্তু বিছানায় উঠে বসে। খাট থেকে নেমে ডাইনিং-এর দিকে যেতে যেতে পাশের রুমের দিকে তাকায়। বাবা-মা ঘুমাচ্ছে। বাইরের দরজার ছিটকিনিটা খুলতে আস্তে আস্তে ডাইনিং-এর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর চারদিকে তাকিয়ে দরজার ছিটকিনিটা নিঃশব্দে খুলে বাইরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দেয়। তারপর বাড়ির খোলা গেটটা দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়।
চারদিকে আজান হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদটা এখনো আবছা আলো ছড়াচ্ছে। তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে অন্তু। অন্তু চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে জানে না।
রিফাৎ আরা। চট্টগ্রাম শাহীন কলেজের বাংলার অধ্যাপক।