মৌলবাদী শক্তির চূড়ান্ত বিজয়ের সম্ভাবনা কতখানি?

রুদ্রাক্ষর 

সাপ যেমন তার বিষাক্ত-হিংস্র স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণে অক্ষম, মৌলবাদীরাও তাদের হিংস্র স্বভাব লুকিয়ে রাখতে পারে না তার প্রমাণ, বায়তুল মোকাররমে নারী নীতি নিয়ে মৌলবাদীদের তান্ডবের ফলে দেশবাসীর কাছে এই গোষ্ঠীর অসহিষ্ণু ও হিংস্র স্বরুপ এবং সেই সাথে নারীবিদ্বেষী, নারীকল্যাণবিরোধী অবস্থানও প্রকাশ হয়ে পড়েছে এই ঘটনায় এবং জঙ্গী উত্থাণ তথা তাদের বিভিন্ন নেটওয়ার্কগুলি ক্রমশ শক্তিশালী হওয়ার পটভূমিতে, প্রগতিশীল মুক্ত চিন্তার বুদ্ধিজীবীরা মৌলবাদী শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের আশংকায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেও, আমি এই ঘটনায় মৌলবাদী শক্তির পতনের আলামত দেখতে পাচ্ছি সেন রাজাদের সময় ব্রাহ্মণ্যধর্ম রাজপৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সত্ত্বেও এই ধর্মকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি কোন ধর্ম বা মতবাদ যখন রাষ্ট্রীয় ও বিদেশী পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন বোঝা যায় যে সমাজে এর উপযোগিতা এবং নৈতিক ও গণভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে বৌদ্ধ, জৈন ও ইসলাম ধর্মের প্রসার আমাদেরকে সেই শিক্ষা দেয় এখন, পদার্থ বিদ্যার (নিউটনের) সূত্র অনুযায়ী, প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নিম্নবর্গের মানুষদের জাতিভেদ প্রথার মাধ্যমে যে নিপীড়ন চালানো হয়েছিল, তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি আমরা জানি, যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে   'বাংলা সাহিত্যের উপক্রমনিকা' শীর্ষক গবেষণামূলক ও একাডেমিক প্রবন্ধে ডক্টর আহ্‌মদ শরীফ লিখেছেন, 'রাজধর্ম বলে সেন বংশীয় শাসনকালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুসৃত হলেও, আসলে ধর্মগ্রন্থ, মন্দির, দেবতা, প্রভৃতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ও সম্পর্ক ব্রাহ্মণের মারফত হত বলে তা কখনও অকৃত্রিম হয়ে ঊঠেনি'(*) আবার ইসলামের আবির্ভাবের প্রভাবে হিন্দু সমাজে যে বিদ্রোহ দেখা দেয়, তার প্রতিক্রিয়ায় আবার প্রথমে গৌতম বুদ্ধ ও পরে চৈতন্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তারা উভয়েই জাতপাত প্রথাকে বেদবিরোধী ও মনুষ্যত্ববিরোধী বলে আখ্যা দিয়ে মানবপ্রেমের জয়গান গেয়েছিলেন বুদ্ধ ' সব ধরণের দেবদেবীপূজা ও স্বর্গ-নরককে ভুয়া বলে রায় দিয়েছিলেন এই দুই মহাপুরুষ যা করেছিলেন, তা আসলে ছিল বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব ধর্মের আবরণে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আমূল সংস্কার ও সমন্বয়ের আন্দোলন তথা সমাজবিপ্লব তেমনি, এক, বায়তুল মোকাররমের ঘটনায় আপাতদৃষ্টিতে মৌলবাদীদের শক্তি-আস্ফালন প্রদর্শিত হলেও, আপন অধিকারসচেতন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীদেরসহ সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের নারীপুরুষের মধ্যেই দ্বান্দ্বিক নিয়মে আপন স্বার্থে হলেও এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য কারণ, একটি গোষ্ঠীর মনোলিথিক (monolithic) উত্থাণে প্রাকৃতিক বা দ্বান্দ্বিক নিয়মেই বিশাল একটি ক্ষতিগ্রস্ত-হুমকিগ্রস্ত সচেতন জনগোষ্ঠীর  মধ্যে ডিফেন্স মেকানিজ্‌ম সৃষ্টি হয়ে যায় (কোন পরিবাহীতে একদিকে ঋণাত্নক চার্জের প্রাধান্য অন্য প্রান্তে সমপরিমাণ ধনাত্নক চার্জের জন্ম দেয়) বাজার অর্থনীতির নামে মেরুকরণ ও উদারীকরণের ফলে ক্রম অবনতিশীল অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নিম্ন ও মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণী তার শ্রেণীগত অবস্থান হারিয়ে যথাক্রমে গরীব ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর পর্যায়ে ইতিমধ্যেই নেমে আসতে শুরু করেছে, বর্তমান  লুটেরা-ধনিকবান্ধব ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের আমলে একটি পত্রিকায় দেখেছিলাম, আড়াই কোটি লোক বেকার হয়েছে এই সরকারের আমলে, সামরিক-বেসামরিক এষ্টাব্লিশ্‌মেন্টের প্রভু আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেস্‌ক্রিপশন অনুযায়ী তথাকথিত অর্থনৈতিক সংস্কার বা উদারীকরণের নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তো এই বাঙালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের চিরন্তণ মজ্জাগত সুবিধাবাদী স্বভাবের কারণেই, নিজেদের এই অর্থনৈতিক  ও শ্রেণীগত অবস্থান হারানোকে সহজভাবে মেনে নেবেনা সুবিধাবাদী শ্রেণীচরিত্রের কারণে তাঁরা যেমন বামপন্থার দিকে ঝুঁকবেন না, আবার এই শ্রেণীস্বার্থের কারণেই চরম দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও অগণতান্ত্রিক কোন সরকারকেও মেনে নেবে না তো সেই পটভূমিতে উক্ত শ্রেণীর নারীসমাজ সঙ্গত কারণেই আগের চেয়ে অনেক বেশী অধিকারসচেতন হবে, আর তাঁদের সহযোগী পুরুষ পক্ষ নিজেদের অস্তিত্ত্বের স্বার্থেই, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক নারীসংগঠনগুলোর ভবিষ্যত আন্দোলনগুলিতে বেশী মাত্রায় শরীক হবে একটা মোটাদাগের উদাহরণ দিলে এই মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি বুঝতে সহজ হবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলিতে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির পুরুষরা নিজেরা না এসে মহিলাদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সামাজিক মর্যাদার ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করে এতে বোঝা যায় যে, অর্থনৈতিক বাস্তবতার বস্তুগত শর্ত (objective factor) অনেক সময় শ্রেণীগত আত্মমর্যাদা ও রক্ষশীলতা তথা আধাসামন্তবাদী-মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণার উপরে  স্থান পায় সোজা কথায়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পুরুষরা মেরুকরণকৃত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ত্বের স্বার্থেই একসময় পরিবারের নারীদের চাকরীবাকরী তথা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নেবে দুই, আর এই মননিক চেতনাগত পরিবর্তন(আমি এটাকে রেনেসাঁ বা এনলাইটেনমেন্ট বলবোনা) সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে তাই, মোল্লারা যেভাবে এখন একচেটিয়া সামাজিক সম্মান ও প্রভাব উপভোগ (enjoy) করছেন, ভবিষ্যতে সেই সামন্ত-মননিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তি  বা পটভূমি অক্ষুণ্ণ থাকবে বলে মনে হয়না যে কারণে মোল্লাপ্রভাব সমাজে হ্রাস পাবে, সেই একই কারণে মৌলবাদী প্রভাবও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে হ্রাস পাবে                   

তিন, বায়তুল মোকাররমে মৌলবাদী তান্ডবে প্রত্যক্ষ একটি ফল হবে, নারীসমাজের পক্ষে তাঁদের বিকশিত হওয়ার, ক্ষমতায়নের, সর্বোপরি  তাঁদের কল্যাণের শত্রু চিহ্নিত করতে সুবিধা হবে কারণ, প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে গোপন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেক কঠিন সে কথা কে না জানে ? নারীসমাজের পক্ষে এখন লড়াইটা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে যাবে চার, নারীরা সমাজের ও পরিবারের অর্ধেক হওয়ায়, গৃহকর্তারা যতই পূণ্যলোভে মৌলবি সাহেবদেরকে কথায় কথায় মীলাদ-তাফ্‌সীর প্রভৃতি অনুষ্ঠানে দাওয়াত করার চেষ্টা করেন, নতুন প্রজন্মের নারীদের অনীহা ও প্রতিরোধের কারণে এক ধরণের সামাজিক প্রতিরোধ ভিতরে ভিতরে অচিরেই শুরু হয়ে যাবে বলে আমার জোরালো বিশ্বাস রয়েছে কারণটি আর কিছুই নয়, আমাদের দেশে নারীরা যতই দাসীগিরি করুক, একই কারণে প্রায় সব শ্রেণীর পরিবারেই পুরুষরা সাংসারিক কাজের ক্ষেত্রে স্ত্রীদের উপর প্রায় ষোল আনাই নির্ভরশীল রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রাণী”-নজরুলের এই কথাটি আমাদের সমাজে-সংস্কৃতিতে অত্যন্ত বাস্তব আর এই জায়গাতেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সমাজের মেয়েদের সাথে আমাদের সমাজের মেয়েদের মৌলিক পার্থক্য এটি হচ্ছে আধা আর্থিক-আধা সাংস্কৃতিক  বাস্তবতা সামাজিক এই প্রতিরোধের কারণে এমন এক দিন আসবে যখন, মোল্লা-মৌলবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে নিজেদেরকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করবে অর্থা বাস্তব-বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে তাদের মত করে হলেও নারীকল্যাণের বুলি আওড়াবে, নারী-পুরুষের সমতাকে মৌখিকভাবে হলেও স্বীকার করে নেবে, অন্তরে বিশ্বাস করুক আর নাই করুক পাঁচ, সমাজে উপযোগিতা না থাকলে, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-লোকাচার ও সমাজ-মানস প্রভৃতির জারক রসের সাথে পরিপাকের ঐক্য না ঘটলে শুধুমাত্র পেশী-শক্তির আস্ফালনের মাধ্যমে যদি কোন ধর্ম বা মতবাদ উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়, তার প্রভাব বা গ্রহনযোগ্যতা এক সময় না এক সময় ক্ষয় বা ধ্বংস হতে বাধ্য-যার সাক্ষ্য ইতিহাসে ভুরি ভুরি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রটেষ্টান্ট ধর্মের আবির্ভাব আমাদের সেই শিক্ষাই দেয় তাই বলছিলাম যে, আমাদের এতটা হতাশ ও আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই মৌলবাদীরা রণকৌশলে যতই চালাক বা ধূর্ত হোক, মনে রাখতে হবে, যে চালাকি-ধূর্ততা আর জ্ঞান-বুদ্ধি এক জিনিস নয় চালাকির মাধ্যমে সাময়িক ফল লাভ করা যায়, কিন্তু জ্ঞান ও পান্ডিত্যের অধিকারী প্রগতিশিল চিন্তাবিদরা শঠতা ধরতে অপটু ও সরল মনের অধিকারী হলেও, তাঁদের দূরদৃষ্টি মৌলবাদী ও মোল্লাদের চেয়ে অনেক বেশি তাই চূড়ান্ত বিচারে, নিজেদের কূপমন্ডুকতা প্রভৃতি সীমাবদ্ধতার  কারণেই মৌলবাদীদের পরাজয় ঘটবে এবং মানবাধিকার ও সাম্যের জয় হবে কারণ শ্রেয়বোধের যে সত্য, (যেমন মানবাধিকার, নারীপুরুষ-সমতা, সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্য ইত্যাদি) তার একটা নিজস্ব গতি আছে, শক্তি আছে-এটা কোন তত্ত্ব কথা নয়, সমাজ বিকাশের ইতিহাসের ইচ্ছানিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক নিয়ম-সূত্রের মধ্যেই(উপরে বর্ণিত এক নম্বর পয়েন্টের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য) আমার উপরোক্ত কথার সত্যতা নিহিত রয়েছে  

এতক্ষণ পর্যন্ত কেবল শুভ সম্ভাবনা ও বাস্তব শর্তগুলি (real factors) নিয়ে আলোচনা করা হলো এবার আসি নেতিবাচক বা ধ্বংসাত্নক (negative) দিকগুলির প্রভাব ও ক্রিয়া-বিক্রিয়া সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনায় 

আমার উপরোক্ত যুক্তিগুলির বিরুদ্ধে দুটো অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি তথা বস্তুগত শর্ত রয়েছে একটি, খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ডক্টর আবুল বারাকাত তাঁর 'মৌলবাদের অর্থনীতি' শীর্ষক প্রবন্ধে যথার্থই তুলে ধরেছেন তিনি দেখিয়েছেন, যে 'ক্রমবর্ধমান দারিদ্রের কারণে বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে এবং শহুরে তরুণদের একটি অংশের মধ্যে মধ্যে হতাশা, অসহায়ত্ব ও সর্বোপরি অদৃষ্টবাদিতার জন্ম হচ্ছে যা এদেরকে মৌলবাদীদের প্রতি অকৃষ্ট হওয়ার  ক্ষেত্রে ক্যাটালিষ্টের ভূমিকা রেখেছে' কিভাবে তা' হয়, তা তিনি খুব বেশী স্পষ্ট করেননি হতাশা ও অদৃষ্টবাদিতা এই দুইয়ে মিলে সৃষ্টি করে ক্রোধ বা বিক্ষোভ অদৃষ্টবাদিতা ও হতাশার সাথে ধর্মান্ধতা ও ইসলামের অতীত গৌরবের স্মৃতি যোগ হয়ে এদের মধ্যে একদিকে অতীতের কল্পিত স্বর্ণযুগকে ফিরে পাওয়ার এবং অন্যদিকে প্যান ইসলামিজ্‌মের প্রতি আকর্ষণের এক অদম্য উত্তেজনা সৃষ্টি করে এধরণের  আদর্শিক বিক্ষোভ স্বভাবের নিয়মেই প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়, যখন দেখে যে বিদ্যমান ব্যবস্থা তাদের ঐ ইয়োটোপীয় চিন্তাধারার অনুকূল নয় এর মধ্যেই উত্তর খুজে পাওয়া যায়, কেন জঙ্গীরা বিচারকদের উপর আঘাত করেছিল দ্বিতীয় শক্তিশালী যুক্তিটি হচ্ছে, একটি দেশের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে যখন নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তথা মানুষের পার্থিব চাওয়াপাওয়ার হিসেব মেলেনা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা সাধারণের চোখে পড়ে, তখন এই শূণ্যস্থান পূরণ করার সরল সমীকরণ অনুসরণ করে বিকল্প হিসেবে 'ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদে (Islamic revivalism for the restoration of the 'so-called' or myth of golden age of Caliphate')  সমস্ত সমাধান নিহিত আছে'-এই ঔষধ বা নেশাদ্রব্যের প্রতি হতাশাগ্রস্ত ঐ শ্রেণিটি ঝুঁকে পড়ে এই দুর্বল মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকেই কাজে লাগিয়েছে উগ্র জঙ্গীবাদ ও পেছন থেকে তার মৌলবাদী নাটের গুরুরা তা ছাড়া বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মত তৃতীয় বিশ্বের মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে, যেখানে পুজিবাদী অর্থনীতির ব্যর্থতা তথা অপরিণত পুজিবাদ ও আধা সামন্তবাদী উপাদন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে বুর্জোয়া রাজনীতিকদের আদর্শগত ও নৈতিক দুর্বলতা বা দেউলিয়াপনা এবং অন্যদিকে সামরিক আমলাতন্ত্রের পক্ষ থেকে বারবার দেশের অর্থনীতি-রাজনীতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে পেটিবুর্জোয়া বা বুর্জোয়া গণতন্ত্র অথবা সামাজিক গণতন্ত্র (social democracy) কোনকিছুই বিকশিত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ নিতে পারেনি, বরং 'গনতন্ত্র' 'দুর্নীতি' সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে বা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, সেখানে উপরোক্ত অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনা ও নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা মিলে রাষ্ট্রীয়-সামাজিক জীবনে যে অহল্যা বা উষর  জমিন সৃষ্টি হয়েছে সেটাও কিন্তু উল্লেখযোগ্য তরুণ সম্প্রদায়কে তথাকথিত 'মৌলবাদী নৈতিকতা বা জীবনবোধের অন্বেষায়' 'পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন-মরীচিকা'র দিকে ধাবিত হতে প্ররোচিত করেছে যে বিশাল প্রত্যাশা ও স্বপ্ন-সাধ নিয়ে এদেশের কৃষক-মজুর প্রভৃতি সাধারণ খেটে-খাওয়া শ্রেণীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়েছিল, তারা নিজেদেরকে সম্পূর্ণ প্রতারিত হিসেবে আবিষ্কার করেছে বিএনপির জন্ম এবং মৌলবাদীদের উত্থান বা শক্তির কার্যকারণগত উস সম্ভবত এখানেই নজরুল লিখেছিলেন, "দেবতার পাপপথ দিয়ে পশে স্বর্গে অসুর দল!" আমি জানি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বন্ধুদের এই বিশ্লেষণ মেনে নিতে কষ্টই হবে এ ব্যাপারে তাঁদের ফর্মূলা অন্য, তারা সহজ সমীকরণ হিসাবে দাবী করে থাকেন যে, বিএনপি'র জন্ম সামরিক ছাউনি থেকে-জিয়া গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব-বঞ্চিত নেতাদেরকে ভয় ও অর্থ দ্বারা বশীভূত করে (বুর্জোয়া রাজনীতির দুর্বলতাকে ব্যবহার) নিজ দলে ভিড়িয়ে এবং কিছু হতাশ অতিবাম ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে একত্রিত করে, নিজের দল গড়েছিলেন কিন্তু, এ বিশ্লেষণ হচ্ছে উপরিস্তরে (superficially) সংগঠিত কতগুলি রাজনৈতিক-বৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চ (politico-scientific phenomenon) মাত্র, যেগুলির পেছনে আবার বহু সামাজিক-অর্থনৈতিক কার্যকারণ রয়েছে, পটভূমি রয়েছে কিন্তু আমাদের দেশের সুবিধাবাদী বুর্জোয়া নেতারা সঙ্গত কারণেই সেসব দিকে চোখ বন্ধ করে রাখতে চান যেকোন ক্রিয়ার পেছনে একাধিক কারণ বিরাজমান থাকে আবার ঐ কারণগুলিও সৃষ্টি হয় বেশ কিছু ক্রিয়ার মাধ্যমে কারণ ও কার্যের এই পরম্পরা চলতেই থাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন অওয়ামী নেতাদের যে শুভানুধ্যায়ী সাংবাদিক-কলামিষ্টদের কলাম পড়ার বা ইতিহাস পড়ার সময়-ধৈর্য হয়না, এটা শুধু তাঁদের অজ্ঞতার কারণে নয়, তাঁদের সুবিধাবাদী শাসক শ্রেণীসুল্ভ কায়েমী স্বার্থবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীচরিত্রের কারণেই গাফফার  চৌধুরীদের কলামে লিখিত উপদেশে তাঁরা কর্ণপাত করেন না-গণভিত্তির উপর আস্থার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদ-তোষণ নীতিকেই  তাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান ভিত্তি বলে গণ্য করেছেন এই আস্থার সংকটের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধপন্থী দলটির নৈতিক দেউলিয়াপনা যার উকট প্রকাশ আমরা দেখতে পাই জে এম বি'র সঙ্গে দলটির জোটগঠনের উদ্দ্যোগে, যেকোন অভ্যন্তরীন সমস্যায় (সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূ)-ইস্যুতে কূটনীতিকদের কাছে দৌড় দেওয়ার মধ্যে বা তাদেরকে যেকোন ইস্যুতে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়াতে ইত্যাদি  

কিন্তু, এটি মুদ্রার একদিকের পিঠ মাত্র অন্য পিঠও আছে কোন কিছুই নিত্য নয় বরং সময় ও অবস্থার সাথে বিবর্তনশীল সেটা আমরা জানি উপরে বর্ণিত এই স্বপ্নচারিতার একটা সময়কাঠামো (time frame) রয়েছে স্বপ্নচারিতা বেশীদিন স্থায়ী হয় না-তরুণ বয়সের আবেগের মাত্রা যতদিন তীব্র থাকে, ততদিন এই আদর্শিক ধ্যানধারণা স্থায়ী থাকে 

আবার আজকালকার তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে মেকিয়াভেলী-চাণক্যের যোগ্য সমন্বয়কারী ও অনুশীলনকারী জিয়া তরুণ সমাজের মধ্যে সুবিধাবাদিতা ও প্রতিষ্ঠাবাদীতার যে সাংস্কৃতিক ধারা চালু করেছিলেন, সেই পটভূমিকে বিবেচনায় না ধরলেও, স্বাভাবিক জৈবিক ধর্ম, এ যুগের প্রতিযোগিতামূলক উচ্চাকাঙ্খার সংস্কৃতি, এবং বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগত আত্মপরতা-এ সবকিছু এবং পূর্ব-বর্ণিত ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলি মিলে বাঙালী চরিত্রে যে বিভিন্ন বিরুদ্ধগুণের বাস্তব শর্ত রয়েছে, তা এডভেঞ্চারিজ্‌মের সাধকে, মৌলবাদী নৈতিক জাগরণ, ধর্মীয় জাতীয়তার বা প্যান ইসলামিজ্‌মের বায়বীয় আদর্শকে অনিশ্চিত, দুরুহ ও জটিল করে তুলেছে মজবুত নৈতিক-আদর্শিক ভিত্তি ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের উপর প্রণিত পার্টিলাইন বা গঠনতন্ত্র না থাকলেএবং তত্ত্ব-আদর্শের সাথে সমকালীন সমাজ-মানস ও সংস্কৃতির গভীর সামঞ্জস্য না থাকলে এবং কর্মীদের আচরণের মধ্যে উক্ত গঠনতন্ত্রের বা আদর্শের প্রতিফলন না থাকলে একটি মনোলিথিক আদর্শের মিলিট্যান্ট চরিত্রের দলের পক্ষে যে বৃহত্তর পরিসরে আবেদন সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না-তার প্রমাণ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাফল্য-ব্যর্থতা ও উত্থাণের ইতিহাসটি ভাল করে ষ্টাডি করলে বুঝা যাবে যে সুধী ও বিজ্ঞজনরা ছাত্র শিবিরের উত্থাণ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রমশ বিস্তারে আতঙ্কিত বোধ করেন, তাঁদের প্রজ্ঞা-অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই,যে তাঁরা সম্ভবত একটা দিকই দেখেছেন-এদের আগ্রাসী অগ্রাভিযান বা প্রসারের দিক কিন্তু, সবকিছুরই দ্বান্দ্বিক দিক রয়েছে-তাই এধরণের প্রপঞ্চগুলিকে দ্বান্দ্বিকভাবে বিশ্লেষণের দাবী রাখে যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র শিবির আধিপত্য বিস্তার করেছে, তার কোনটিতেই তারা জনপ্রিয়তার জোরে সেটি করেনি, তার তথ্য-প্রমাণ আমার হাতে আছে সেগুলি লিখতে গেলে, আরেকটি বিরাট ইতিহাস হয়ে যাবে শুধু এটুকুই বলব যে নানা কিসিমের হীন ও প্রতারণামূলক কলাকৌশল তারা প্রয়োগ করে যেখানেই তাঁরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে,তা করেছে মূলত বিদ্যমান রাষ্ট্রাযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা, সৌদি রাজপরিবারের আর্থিক আনুকূল্য এবং কখনও কখনও অন্য ছাত্র সংগঠনগুলির নেতৃত্বের দেউলিয়াত্বের কারণে ভ্যাকুয়াম বা শূণ্যস্থান-পূরণের প্রকৃতিক নিয়ম অনুসারে বিকল্প শক্তির দিকে ছাত্রসমাজের দ্বিধাগ্রস্ত-হতাশাগ্রস্ত সমর্থন বা ঝুঁকে যাওয়ার কারণে কিন্তু এধরণের সমর্থন বা ঝুঁকে যাওয়া ঠিক আদর্শগত কারণে ঘটেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকে থাকা, নিরুপদ্রবে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করা এবং হলের সিট নিয়ে নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে ছাত্ররা শিবিরের রাজনীতি করতে বাধ্য হয় আবার অন্যদিকে, বিদেশী অর্থের আনুকূল্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ছত্রছায়া এই গোষ্ঠীর দুর্বল দিক ও গণভিত্তির অভাবকেই প্রমাণ করে তারই বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এদেরকে সাধারণ ছাত্রদের এমনকি কোথাও কোথাও ছাত্রদের সাথে মিলে স্থানীয় জনসাধারণের প্রবল প্রতিরোধের মুখে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছে যেখানে সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলনের যোগ দিয়েছিল, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে তাদের পরাজয়ের প্রধান কারণগুলি ছিল নৈতিক-আদর্শিক অবস্থান যা পপুলার সাপোর্ট পায়নি যেমন, শাহ্‌জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির দুর্নীতিবাজ ভিসির এবং অনৈতিক নগ্ন-দলীয়করণের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় সাধারণ ছাত্ররা তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল পরে রাষ্ট্রযন্ত্রের সমর্থন নিয়ে শিবির ক্যাডাররা পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয় দখল  করে ঐ বহিস্কৃত ভিসিকে প্রত্যাবর্তন করায় কিন্তু, প্রকৃত বিচারে এটা ছিল তাদের নৈতিক পরাজয়-এতে দীর্ঘমেয়াদে তাদের রাজনৈতিক ক্ষতিই বেশী হয়েছে, কারণ, তাদের জেদের জয় হলেও দুর্নীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ন্যায়বিচারবঞ্চিত ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যাপারে সাধারণ ছাত্রদের আহত সেন্টিমেন্ট এবং ভিসির সীমাহীন অন্যায়ের প্রতিকারহীনতা যে তরুণ বয়সের ছাত্রদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ছাপ রেখে দেবে এতে কোন সন্দেহ নেই আর, ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটলেই দেখা যাবে যে সাধারণ ছাত্রদের রুদ্ররোষে শিবির-সন্ত্রাসীরা ইঁদুরের মত গর্তে গিয়ে লুকাতে বাধ্য হচ্ছে 

একটা প্রশ্ন অনেকের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি মারতে পারে, যে বাম ছাত্র সংগঠনগুলির ' আমার তাত্ত্বিক ফর্মূলা অনুযায়ী শক্তিশালী আদর্শিক ভিত্তি রয়েছে, সুস্পষ্ট আদর্শ ও লক্ষ্যসম্বলিত গঠনতন্ত্র রয়েছে, তাহলে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা এত দুর্বল হওয়ার কারণ  কি? তার একটি উত্তর আমার উপরে প্রদত্ত বক্তব্যে পরের লাইনটিতেই রয়েছে তা হলো, তত্ত্ব-আদর্শের সাথে সমকালীন সমাজ-মানস ও সংস্কৃতির গভীর সামঞ্জস্য না থাকলে, যোগ না থাকলে, সেই আদর্শ যতই মহ হোক না কেন, তা সফলতার মুখ দেখেনা ইসলামী ছাত্র শক্তি বা শিবিরের মত মনোলিথিক* না হলেও, ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্র ঐক্য বা জাসদের মত সংগঠনগুলিও মোটামুটি মনোলিথিক পর্যায়েরই, তবে সেটা বিপরীত প্রান্তে প্রগতিশীল চেতনাগত অর্থে কিন্তু, বাঙ্গালীর রক্তের মধ্যে যেমন বহু জাতির রক্ত এসে মিশ্রিত  হয়েছে, তেমনি বহুমতবাদ-ধর্ম-দর্শনের চারণক্ষেত্র হয়েছে এই ভারতর্ষ ও বাংলাদেশতাই, কয়েক হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে বাঙালী যেমন জেনেটিক বা নৃতাত্ত্বিকভাবে বৈচিত্রপূর্ণ অবয়বের অধিকারী হয়েছে, তেমনি মননের দিক থেকেও বহুমুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রতিভার বিচিত্র সমাবেশ বাঙালীর ব্যক্তিসত্ত্বার মধ্যে শেকড় গেড়েছেতাই আমরা দেখি, যে লোকটি লালনগীতি শোনে মগ্ন হয়ে, সেই একই লোক বৈধ-অবৈধ যেকোন উপায়ে বৈষয়িক ও প্রতিষ্ঠা ও উচ্চতর সামাজিক অবস্থানের পেছনে ছুটছে 

বাঙালীর এই বিচিত্র সত্ত্বার জন্যই সম্ভবত কোন ধরণের মনোলিথিক আদর্শই, তা সে যতই আদর্শবাদী বা প্রগতিশীল হোক না (মৌলবাদী ও বামপন্থী), প্রচলিত সমাজ-মানসের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ না করে পরিপুষ্টি লাভ করতে পারবে না ইতিহাসে আমরা দেখি, আরবের ইসলামে তার উন্মেষপর্বে এত বিভিন্ন ধরণের তরীকা ছিলনা কিন্তু, এই ইসলাম যখন পারস্য, ভারতবর্ষ, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে এল, তখন সেসব দেশের স্থানীয় লোকাচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে দার্শনিক মতবাদের প্রভাবে  সমৃদ্ধ হয়ে নতুন নতুন চিন্তাধারার উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং নতুন নতুন উসব, প্রার্থনারীতি, মেলা ইত্যাদির প্রচলন ঘটেছে ইরানের নওরোজ উসবসহ বিভিন্ন প্রাচীন উসব ও নৃত্যের প্রচলন রয়েছে যা ইসলামী বিপ্লবের পরও লুপ্ত হয়নি           

আরেকটি কথা, যে যুগে কোন ইন্টারনেট, ফোন, সংবাদপত্র প্রভৃতি প্রচলিত ছিল না, কলাম পড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বা মানসিক ক্ষুধা মেটানোর সুযোগ ছিলনা, সেই যুগে শুধুমাত্র পদব্রজে প্রচারের মাধ্যমে নতুন নতুন ভাব-বিপ্লব, সমাজ-সংস্কার আন্দোলন এসব দ্রুতগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সেক্ষেত্রে, আজকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে যে মৌলবাদবিরোধী প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলন আরো দ্রুত গতিতে অচিরেই ছড়িয়ে পড়বে তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে এই নিবন্ধের লেখক বা আমাদের অনেকেই হয়তো সেটা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবনা

সুতরাং, ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়দিকের বিচার বিবেচনায় আমার মনে হয়, ইতিবাচক বস্তুগত শর্তের পাল্লাই বেশী এধরণের মনোলিথিক আদর্শের পরিপুষ্টি যুগ বা কালনিরপেক্ষ নয়, তাই এদের শ্রীবৃদ্ধির একটি চূড়ান্ত সীমা আছে যা সম্ভবত অতিক্রান্ত হয়েছে মনে রাখতে হবে, যে বিশ্বায়ন ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে পার্শ্ববর্তী ভিয়েতনাম, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পরে সর্বশেষে পশ্চাদ্‌পদ নেপালও যখন প্রতিযোগিতায় আমাদের পেছনে ফেলে বহুদূর এগিয়ে যাবে, এবং এসব দেশের  সাফল্য-অগ্রগতির সংবাদ চেপে রাখা যাবেনা, সবকিছুর জন্য (শ্রম-রপ্তানী, বাণিজ্য-ভারসাম্য, চাল সরবরাহ ইত্যাদি ইত্যাদি) আমাদেরকে উক্ত দেশগুলির কাছে কথায় কথায় ধর্ণা দিতে হবে, তখন নতুন প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান যুগোপযোগী স্বপ্ন-আকাঙ্খার বিপরীতে যে হীনমন্যতা-বঞ্চনাজাত বিক্ষোভের সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে সময় অত্যন্ত পরিবর্তনশীল, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, গরীব দেগগুলির সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে টিকে থাকাও তেমনি কঠিন হয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে খাদ্যসংকট, এনার্জিসংকট ইত্যাদি বেড়েই চলছে পৃথিবীর বার্ধক্যের কারণে এই প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন বা সমানাধিকার, বিজ্ঞানমনস্কতা, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্র ও সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্য ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা, প্রতিযোগিতা, উন্নতি ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে এতটা আবশ্যক বলে বোধ হবে, যে মানুষের ক্রমবর্ধমান সচেতনতা ও চাওয়া-পাওয়া বা আশা-আকাঙ্খার পরিপ্রেক্ষিতে এসবের প্রতিবন্ধক মৌলবাদী ও সামন্ত মূল্যবোধ, বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল ধারাটি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রশক্তি উভয়েই নতুন স্রোতের মুখে হয় অপাংক্তেয় হয়ে পড়বে নয়তো খড়কুটোর মত ভেসে যাবে এখানে 'শিখা' খ্যাত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা এবং 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে'র সংগঠক প্রগতিবাদী আবুল হোসেনের(১৮৯৬-১৯৩৮) অবদান ও যুগোত্তীর্ণ চিন্তাধারার মূল্যায়ন করতে গিয়ে  একটি প্রবন্ধে(*) তাঁর উন্নত মননশীলতার যে ছবি এঁকেছেন ডক্টর আহ্‌মদ শরীফ তার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ আহ্‌মদ শরীফ লিখেছেন, ধর্ম ও শাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁর ধারণা-'মানুষের প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে নবী-অবতার বা কৌম-প্রধান আরোপিত দেশ-কালোচিত কিছু নিষধের সমষ্টি মাত্র

এ নিষেধসমষ্টি এক বিশেষ দেশ, কাল, ও জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে সৃষ্ট তাই, কালান্তরে, দেশান্তরে ও জনান্তরে তার প্রয়োজন ফুরায় ফলে মোহগ্রস্ত বন্ধ্যামনের মানুষ স্বকালের, স্বদেশের, স্বসমাজের বাস্তব চাহিদা পূরণ করতে অসমর্থ হয়ে ব্যক্তিগতভাবে মানসজীবনে ও ব্যবহারিক জীবনে জরার, জড়তার ও জীর্ণতার শিকার হয় ফলে ধার্মিকের যান্ত্রিক জীবনেও দেখা দেয় অবচেতন বিদ্রোহ জীবন-জীবিকার বাস্তব প্রয়োজনে এর ফলে শাস্ত্র-বিরোধী আচার-আচরণে আসক্ত হয় আনন্দ হয়  আনন্দ ও বৈচিত্র সন্ধানী ভোগ-উপভোগ লিপ্সু মানুষ

তাই, সাময়িকভাবে মৌলবাদীরা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করেও, সেটা তাঁরা বেশীদিন ধরে রাখতে পারবেনা কারণ, মৌলবাদ মানুষের প্রকৃতি-বিরুদ্ধ তাই সেটাই  তাদের প্রথম ও শেষ উত্থাণ হবে বলে আমার বিশ্বাস কারণ, সময়টা যতই তাদের অনুকূল ও আমাদের জন্য(মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের জন্য) প্রতিকূল বলে মনে হোক না কেন, সার্বিক বিচারে যুগ তাদের অনুকূল নয়, সেকথা মনে রাখতে হবে

---

(*)-নির্বাচিত প্রবন্ধ, ডক্টর আহ্‌মদ শরীফ

*-মনোলিথিক (monolithic), বা  monolithism-1) এমন একটি ধারণা বা আদর্শকে নির্দেশ করছে যার অনুসরণে কোন কমিউনিষ্ট পার্টি শুধু একই মতে কথা বলতে পারে এই ধারণাটি ১৯২৫ সালে কমিউনিষ্ট আন্তর্জাতিকের বলশেভিকীকরণের (Bolshevization*)  মধ্য দিয়ে    প্রতিষ্ঠিত হয়, যে আন্তর্জাতিকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জিনোভিয়েভ

) মনোলিথিজ্‌ম, যার শাব্দিক অর্থ একত্ববাদ, হচ্ছে এমন একটি ধারণা যার দ্বারা মানুষকে শুধু পাপ-পূণ্য দিয়ে বিচার করা হয় অর্থা একজন মানুষ হয় সম্পূর্ণ পাপী হবে, নয়তো পূণ্যবান হবে মানুষের বহুমাত্রিক সত্ত্বাকে এই ধারণার মাধ্যমে অস্বীকার করা হয় প্রতিটি ধর্মই মানুষকে মনোলিথিক আদর্শে বিচার করে

তুমি যদি আমাদের পক্ষে না হয়ে থাক, তুমি নিশ্চয়ই আমাদের শত্রু”-বুশের এই উক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিশ্চিয়ান মৌলবাদীদের মনোলিথিক আদর্শকে তুলে ধরে, যাদের সমর্থনে বুশ ক্ষমতাসীন হয়েছিল এবং ইরাক যুদ্ধের পেছনে যাদের প্রভাব ও সমর্থন কাজ করেছিল

*বলশেভিক-জারের রাশিয়ায় যারা ১৯০৩ সালে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টি ভেঙে বেরিয়ে আসে এবং পরে 'কমিউনিষ্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নে' রুপান্তরিত হয়

*-'শিখার প্রাণপুরুষ প্রগতিবাদী আবুল হোসেন' (শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে); নির্বাচিত প্রবন্ধ, আহ্‌মদ শরীফ; পৃষ্ঠা ৮৭