সৈনিক নজরুলের গল্পঃ চলতি রীতি ঘরোয়া মেজাজ
সাদ কামালী
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাল্যকথা’ ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩১৯-এর কোনো সংখ্যায়। ‘বাল্যকথা’র রচনা ভঙ্গী ঘরোয়া, ভাষা চলতি, অপরকে গল্প বলার মতো সহজ কথায় বলা। কিন্তু ‘ঢাকা রিভিউ’ তখন এক আলোচনায় এই রীতির সমালোচনা করে লেখে- “সুযোগ্য লেখক এবং সুপ্রসিদ্ধ মাসিকের উপযোগী নয়।” কারণ, “রচনার নমুনা যে প্রকারের ঘরওয়ালা ধরণের, ভাষাও তদ্রপ। ... মুদ্রিত সাহিত্যে আমরা ‘করতুম’ ‘শোনাচ্ছিলুম’ ‘ডাকতুম’ ‘মেশবার’ প্রভৃতি প্রাদেশিক শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী নহি।” সাহিত্যে চলতি ভাষা ব্যবহারের প্রবল প্রবক্তা বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী ‘ঢাকা রিভিউ’ সম্পাদক মশায়ের সমালোচনা করে জবার দেন ‘ভারতী’ ১৩১৯ চৈত্র সংখ্যায়। প্রমথ চৌধুরী লেখেন, “ভাষা যদি বক্তব্য বিষয়ের অনুরূপ হয়, তাহলে অলঙ্কারশাস্ত্রের মতে সেটা যে দোষ বলে গণ্য, এ জ্ঞান আমার পূর্বে ছিল না। আত্মজীবনী লেখবার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ঘরের কথা পরকে বলা। ঘরাও ভাষা-ই ঘরাও কথার বিশেষ উপযোগী মনে করেই লেখক, লোকে যেভাবে গল্প বলে সেই ভাবেই তাঁর ‘বাল্যকথা’ বলেছেন। স্বর্গীয় কালী সিংহ যে ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’র ভাষায় তাঁর মহাভারত লেখেননি, এবং মহাভারতের ভাষায় যে হুতোম প্যাঁচার নক্শা লেখেননি, তাতে তিনি কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেননি” (বঙ্গভাষা বনাম বাবু-বাংলা ওরফে সাধুভাষা, প্রবন্ধসংগ্রহ, প্রমথ চৌধুরী)। তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভিতর নয়, বাঙালির মুখে” (কথার কথা, প্রবন্ধসংগ্রহ)। যৌবনের প্রারম্ভে করাচী সেনানিবাসে বসে গদ্য সাহিত্য রচনায় বেশ ব্যস্ত ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেনানিবাসে বসে রচনা করেন ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী,’ ‘স্বামীহারা,’ ‘হেনা,’ ‘ব্যথার দান,’ ‘মেহের-নেগার,’ ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পসমূহ। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাল্যকথা’র মতো আত্মজীবনী না হলেও বাল্যকালের স্মৃতিনির্ভর গল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নজরুল মাত্র উনিশ বছর বয়সে লেখেন। বাংলা মুল্লুকের সাধু চলতি রীতির বিতর্ক থেকে দূরে, প্রায় বাঙালি বর্জিত ভূখণ্ড করাচী সেনানিবাসে বসে রচিত বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী নজরুল লেখেন চলতি ভাষায়। ঢাকা রিভিউ’র সম্পাদকের নাখোশ হওয়া ‘বিভক্তি’ এবং তথাকথিত ‘প্রাদেশিকতা’-দুষ্ট ‘তুম’ ‘লুম’ ইত্যাদি ক্রিয়াপদের শেষে বসিয়ে নজরুল মুখের কথার মতো সহজ ভঙ্গিতে লিখেছেন- “... আমি তখন অট্টহাসি হেসে বোতলের পর বোতল উড়াতে লাগলুম। তারপর ততক্ষণে পল্টনে এসে সেঁধিয়ে পড়লুম বোম কেদারনাথ বলে। আর এক গ্লাস জঁল দিতে পারো ভাই ?” অনিত্য শব্দকে নিত্য করবার ইচ্ছে থেকেই যে অক্ষরের সৃষ্টি, তা কিশোর নজরুল জানতেন, তাঁর সাহিত্যে অনিত্য শব্দের নিত্য করার যথার্থ প্রয়োগ বিস্ময়কর।
বাউণ্ডেলের কাহিনীটি বয়সগুণে আবেগাশ্রিত, অথবা সদ্য তরুণের নেশার ঝোঁকে বর্ণিত গল্পে বাউণ্ডেলের জীবনে ঘটনা কিছু দ্রুতই ঘটে ! গল্পের শুরুতে নজরুল ব্র্যাকেটের ভিতর জানিয়ে দেন- “বাঙালি পল্টনের একটি বওয়াটে যুবক আমার কাছে তাহার কাহিনী বলিয়াছিল নেশার ঝোঁকে ঃ নীচে তাহাই লেখা হইলো। সে বোগদাদে গিয়া মারা পড়ে।” গল্প বয়ানের এই ভণিতা যদিও নতুন নয়, নজরুলের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এমন আঙ্গিক অনেক গল্প রচনায় প্রয়োগ করেছেন। সাত পৃষ্ঠার মধ্যে নজরুল ওই বওয়াটে যুবকের কাহিনী বর্ণনা করেন স্বচ্ছন্দ, সরল চলতি ভাষায়। ফার্সি উর্দু আরবী শব্দ বাংলা বাক্যে যুৎমতো প্রয়োগে নজরুল যেমন তুলনাহীন, তেমন এই আদি গল্পে দেখা যায় সচরাচর ব্যবহৃত কিছু ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করেছেন সাবলীল ভাবে- “নব পরিণীতা সখিনার এ’সব গুণ থাকা সত্ত্বেও আমি তাকে ভালোবাসতে পারলুম না। অনেক ‘রিহার্স্যাল’ দিতুম, কিছুতে কিছু হলো না।” সেই কালের প্রেক্ষিতে বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। যাইহোক, ওই ‘বওয়াটে’ যুবকের স্কুল শেষ করার আগেই দু’বার বিবাহ, দু’স্ত্রীর মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু এমনকি ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার কাহিনী নজরুল সাত পৃষ্ঠার পরিসরের মধ্যে কৌতুক ছলে লিখে ফেললেও পাঠকের মন দুঃখ অনুভূতিতে বিমর্ষ হয়ে ওঠেই। আর্ট ফরম হিসেবে ছোট গল্পের যে মর্যাদা ‘বাউণ্ডেলে... ’ সেই মানের গল্প না হলেও কবি নজরুলের এই প্রথম প্রকাশিত গল্পের কাহিনী, আবেগ পাঠককে স্পর্শ করে। কাহিনিটি পাঠে আমন্ত্রণের অভাব হয় না। “গল্প-বলার সর্বজনীন আদর্শটাই ফলাও ক্ষেত্রে সকল লোককে ডাক দিয়ে আনে। সেই আদর্শটা খাটো হলে নিমন্ত্রণটা ছোটো হয় ; সেটা পারিবারিক ভোজ হতে পারে, স্বজাতের ভোজ হতে পারে, কিন্তু সাহিত্যের যে-তীর্থে সকল দেশের যাত্রী এসে মেলে সে-তীর্থের মহাভোজ হবে না।” (সাহিত্যে নবত্ব, রবীন্দ্রনাথ)। ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গল্প। গল্পটি ‘রিক্তের বেদন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে ‘সওগাত’-এর জৈষ্ঠ সংখ্যায় ১৩২৬ (১৯১৯) সনে প্রকাশিত হয়।
নজরুলের দ্বিতীয় প্রকাশিত গল্প ‘স্বামীহারা’ও ‘সওগাত’ পত্রিকায় ভাদ্র ১৩২৬ সংখ্যায় প্রকাশিত এবং ‘রিক্তের বেদন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘বাউণ্ডেলে ...’ থেকে ‘স্বামীহারা’ গল্পে উনিশ বছরের নজরুলের আবেগ তুলনায় নিয়ন্ত্রিত, সহংত ও চলতি ভাষায় বর্ণিত গল্পে অভিজ্ঞতার নিপুণ নির্মাণ দেখে বিস্মিত হতে হয়। মহামারী পীড়িত গ্রামবাংলার করুণ গল্প বয়ানে মিত্ আবেগ ও চলতি ভাষার যুৎসই ব্যবহারে গল্পটি ওই সময়ের দলিল হয়ে ওঠে। তরুণ নজরুল সহ বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের চলতি ভাষায় গল্প ও উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা হাতেগোণা দুই একটি। রবীন্দ্রনাথের ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’ বা প্রমথ চৌধুরীদের গদ্য পাঠ সম্ভব হলেও কথা সাহিত্য ১৯১৮-১৯১৯-এ অত্যন্ত বিরল। ‘স্বামীহারা’ গল্পটি বলার ভঙ্গিও সেই কালের বিবেচনায় অভিনব কলেরা বসন্ত প্রপীড়িত গ্রামের স্বজনহারা এক নারী পাসের গ্রামের আর একটি মেয়ে সলিমাকে তার দুঃখের, নিঃস্ব হওয়ার গল্প, স্বামী ও স্বজন হারানোর গল্প বলে। কথক নারীটির কথা বা সংলাপ এবং স্বগতোক্তি ছাড়া গল্পে আর কোনো চরিত্রের সংলাপ বা লেখকের বর্ণনা নেই। তবে “চারাধানের ক্ষেতের আলের উপর দিয়ে কাঁচা আম খেতে খেতে একটি রাখাল বালক কোথা হতে শেখা একটা করুণ গান গেয়ে যাচ্ছিল” তার ভাবার্থ কথক শোনায়। আবার কবি ও সঙ্গীত শিল্পী নজরুল কথকের অছিলায় শুনিয়ে দেন খেয়াপারের ক্লান্ত মাঝির বিদায়গীত,
“দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি,
ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে,
এবার তবে গভীর করে ফেলগো মোরে ঢাকি
অতি নিবিড় ঘন তিমির তলে। ”
সলিমাকে বলা কথকের নিজের কথারও কিছু নমুনা শোনা যেতে পারে। “... এই যে দীঘির গোরস্থান আর এই যে হাজার হাজার কবর, এগুলো কি তবে আমাদের গাঁয়ের একটা নীরব মর্মন্তুদ বেদনা - অন্তসলিলা ফল্গু নিঃস্রাব - জমাট বেঁধে অমন গোর হয়ে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে ? না কি আমাদের মাটির মা তাঁর এই পাড়াগাঁয়ে চির-দরিদ্র জরাব্যধি প্রপীড়িত ছেলেমেয়েগুলোর দুঃখে ব্যথিত হয়ে করুণ প্রগাঢ় স্নেহে বিরামদায়িনী জননীর মত মাটির আঁচলে ঢেকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছেন ? তাঁর এই মাটির রাজ্যে ত দুঃখ-ক্লেশ বা কারুর অত্যাচার আসতে পারে না। এখানে শুধু একটা বিরাট অনন্ত সুপ্ত শান্তি - কর্মক্লান্ত মানবের নিঃসাড় নিস্পন্দ সুষুপ্তি।” প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে সৈনিক নজরুল করাচীর সেনানিবাসে বসে লেখা এই গল্পে ‘মা’ ‘তাঁর’ ‘আমাদের গাঁ’ ‘জননী’ কি স্বদেশ বাংলা বা ভারতবর্ষই রূপকের আড়ালে চিহ্নিত হচ্ছে না ! আবার ‘কলেরা’ ‘বসন্ত’ জরাব্যধি তো বৃটিশ রাজের নিগড়ও হতে পারে ! সংক্রামক ব্যধি ক্ষত বাংলার ‘প্রপীড়িত ছেলেমেয়েগুলোর’ জীবন নাশের গল্প যেমন স্বাভাবিক, তেমন ইতিহাসের ওই পর্বে বিদেশী রাজের অত্যাচার-নিধনের গল্পও হওয়া সম্ভব। ওই সময়ে লেখা ‘ব্যথার দান’ গল্পের দু’টি চরিত্র সয়ফুল্-মুল্ক ও দারা যোগ দেয় লালফৌজে। মুজফ্ফর আহমদ ‘কাজী নজরুল ইসলাম ঃ স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন “নজরুল ইসলাম যখন ‘ব্যথার দান’ গল্পটি আমাদের নিকটে পাঠিয়েছিল তখন তাতে এই দু’জনের লালফৌজে যোগ দেওয়ার কথাই ... ছিল। আমিই তা থেকে ‘লালাফৌজ’ কেটে দিয়ে তার জায়গায় ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’ বসিয়ে দিয়েছিলেম। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ ভারতে ‘লালফৌজ’ কথা উচ্চারণ করাও দোষের ছিল। সেই ‘লালফৌজে’ ব্রিটিশ ভারতের লোকেরা যে যোগ দেবে, তা যদি গল্পেও হয়, তা পুলিশের পক্ষে হজম করা মোটেই সহজ হতো না।”
এর পরের গল্প ‘হেনা,’ প্রকাশকাল কার্তিক ১৩২৬-এর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য়। প্রেম ও যুদ্ধের গল্প হেনা’য় নজরুল বিশেষ কল্পনা শক্তির পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কোনো রণাঙ্গনে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকলেও সৈনিক নজরুল এই গল্পের কথকের ইউরোপ এশিয়ার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধের বর্ণনা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘হেনা’ লেখেন। ডায়ারি লেখার আঙ্গিকে বিভিন্ন রণাঙ্গনের ঘটনার মধ্য দিয়ে গল্প হয়ে ওঠে। যেমন - ‘ভার্দুন ট্রেঞ্চ, ফ্রান্স।’ ট্রেঞ্চে থেকে কথক গুড়–ম, দ্রুম-দুম গোলাবারুদের শব্দ শোনে। “গোলা আর বোমা ফেটে আগুনের ফিন্কি এত ঘন বৃষ্টি হচ্ছে যে, অত ঘন যদি জল ঝরত আসমানের লাল চক্ষু বেয়ে, তাহলে একদিনেই সারা দুনিয়া পানিতে সয়লাব হয়ে যেত। ... আজ শুধু আমাদের সিপাহীদের সেই হোলিখেলার গানটি মনে পড়ছে,
“আজ তল্ওয়ার-সে খেলেঙ্গে হোরি
জমা হো গেয়ে দুনিয়া কা সিপাঈ
ঢালোঁও কি ডঙ্কা বাদন লাগি,
তোপোঁও কে পিচকারী, গোলা বারুদকা রঙ্গ্ বনি হেয়, লাগি হেয় ভারি লড়াঈ। ”
ওই কথক সৈনিক ‘সিঁন নদীর ধারের তাম্বু, ফ্রান্স’ রণাঙ্গনের কথা লেখে এরপর। ভার্দুন ট্রেঞ্চে “পাশের মরা বন্ধুর গায়ে ঠেস দিয়ে দিব্যি একটু আরাম করে নেয়া’র” পর অজানা বিদেশিনী ছোট্ট কিশোরী মেম “খানিকটা আচার আর দুটো মাখন-মাখা রুটি দিয়েছিল। . . . ঐ তের চৌদ্দ বছরের কচি মেয়েটা যখন আমার গলা ধরে চুমু খেয়ে বললে ‘দাদা এ লড়াইতে কিন্তু শত্তুরকে খুব জোর তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে,’ তখন আমার মুখে সে কি একটা পবিত্র বেদনা মাখা হাসি ফুটে উঠেছিল।” ‘সিঁন নদীর ধারের তাম্বু’তে আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে কথক বলে, “এখন আবার ধরা-চূড়ো প’রে বেরোতে হবে খোদার সৃষ্টি নাশ করতে। এই মানুষ-মারা বিদ্যে লড়াইটা ঠিক আমার মত পাথর-বুকো কাঠখোট্টা লোকেরই মনের মত জিনিস।” এই তাম্বু থেকে সেই বিদেশিনী তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। এর পরে ‘প্যারিসের পাশের ঘন বন,’ ‘হিণ্ডেলবার্গ লাইন,’ ‘বেলুচিস্তান, কোয়েটার দ্রাক্ষাকুঞ্জস্থিত আমার ছোট্ট কুটির,’ ‘ডাক্কা ক্যাম্প, কাবুল’ রণাঙ্গনের কথা কথক লেখে, আর পাঠক যুদ্ধের অভিজ্ঞতাহীন নজরুলের সে-সব কাঁচা বর্ণনা পরে অবিশ্বাসী হয়ে উঠলেও শুধু ভাষার গুণে পাঠ সমাপ্ত করে নজরুলকে রেহাই দিতে পারে। কাবুলের মেয়ে হেনা’র প্রতি মমতায় সিক্ত হয়ে হয়তো, “আমি চলে এলুম। হেনা ছায়ার মতো আমার পিছু পিছু ছুটল। এত ভালবাসা, পাহাড়-ফাটা উদ্দাম জলস্রোতের মত এত প্রেম কি করে বুকের পাঁজর দিয়ে আটকে রেখেছিল হেনা।” এ বিস্ময় পাঠকেরও।
‘মেহের-নেগার’ গল্পটি ওই বছর ১৩২৬-এর মাঘ মাসে ‘নূর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রেম-বিরহ-বেদনার গল্প ‘মেহের-নেগার’-এর ভাষা ও গল্প বয়ান অনেক পরিণত। মানবিক মুহূর্ত, অনুভূতি এবং প্রতিবেশ বর্ণনায় কবি নজরুল গল্পের মেজাজ অনুকূল রোমাণ্টিক ও ধ্বনিময়। ঝিলম নদীর পটভূমিকায় করাচীতে বসে লেখা ‘মেহের নেগার’ গল্পের প্রেয়সী মেহের-নেগার অবাঙালি, বিদেশিনী, কিন্তু প্রসাদগুণ সমৃদ্ধ ভাষায় বাংলার শাশ্বত প্রিয়া নারীর রূপ লাবণ্য ও স্বদেশের প্রাকৃতিক রূপের বর্ণনায় তরুণ নজরুল শিল্প নৈপুণ্য দেখান। বাংলা ভাষায় আধুনিক চলতি রীতিতে গল্প রচনার এমন নিদর্শন তখন বিরল। স্বপ্নে দেখা প্রেয়সীকে পাওয়ার আকাক্সক্ষা এবং না-পাওয়ার বেদনায় মেহের নেসারও পরাধীন প্রিয় স্বদেশের প্রতীক হয়ে ওঠে। মনোজগত নির্মাণেও নজরুল এই প্রথম তাঁর সাফল্য দেখান। প্রমথ চৌধুরীর ‘সতীর্থ’ লেখক ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যারতœ এম.এ. ‘সাধুভাষা বনাম চলতি ভাষা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পুস্তিকাকারে প্রকাশ করলে প্রমথ চৌধুরী ওই প্রবন্ধ কেন্দ্র করে বিস্তারিত আলোচনায় নিজের মত প্রকাশ করেন। ললিতবাবু তাঁর প্রবন্ধে “বহু অনুসন্ধান করে সাধুভাষার সপক্ষে দু’টি যুক্তি আবিষ্কার করেছেন ১। সাধুভাষা আর্টের অনুকূল। ২। চলিত ভাষার অপেক্ষা সাধুভাষা হিন্দুস্থানি মারাঠি গুজরাটি প্রভৃতি ভিন্নজাতীয় লোকদের নিকট অধিক সহজবোধ্য। আর্টের দোহাই দেওয়া যে কতদূর বাজে, এ প্রবন্ধে আমি সে সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করতে চাই নে। এ দেশে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় যে যুক্তি যখন কোনো দাঁড়াবার স্থান পায় না, তখন আর্ট প্রভৃতি বড়ো বড়ো কথার অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করে। ... তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে আমার প্রধান আপত্তি এই যে, ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোনো স্থান নেই।” প্রমথ চৌধুরী এরপর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙগলা ভাষা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করে লেখেন, “রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন, সরলতা এবং স্পষ্টতা” লেখায় সেই গুণটি আনবার জন্য যথেষ্ট গুণপণার দরকার। আর্টহীন লেখক নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে কৃতকার্য হন না।” (প্রমথ চৌধুরী, প্রবন্ধসংগ্রহ)। প্রমথ চৌধুরী এই প্রবন্ধ লেখেন চৈত্র ১৩১৯, অর্থাৎ নজরুল এর পরপরই কথা সাহিত্য চর্চায় ব্যস্ত হন ওই চলতি ভাষায়। প্রসঙ্গতঃ নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ ফাল্গুন ১৩২৮, প্রথম প্রকাশিত রচনা ও গল্প ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’র প্রকাশ কাল কার্তিক ১৩২৯।
‘মেহের- নেগার’ গল্পে মনোজগত ও প্রকৃতির সমন্বয়ে বিরহ হৃদয়ের কাতরতা নির্মাণে উনিশ বছরের তরুণ নজরুল অভিভূত করেন, “উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সমস্ত স্তব্ধ ময়দানটার আশেপাশে পথ হারিয়ে গিয়ে তারই উদাস প্রতিধ্বনি ঘুরে মরছিল। দুষ্ট দয়িতকে খুঁজে খুঁজে বেচারা কোকিল যখন হয়রান পেরেশান হয়ে গিয়েছে, আর অশান্ত অশ্র“গুলো আটকে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় বারম্বার চোখ দুটোকে ঘষে ঘষে কলিজার মতো রক্ত-লোহিত করে ফেলেছে, তখন তরুণী কোয়েলিটা তার প্রণয়ীকে এই ব্যথা দেওয়ায় বোধহয় বাস্তবিকই ব্যথিত হয়ে উঠছিল, কেননা তখনই কলামোচার আম গাছটার আগডালে কচি আমের থোকার আড়ালে থেকে মুখ বাড়িয়ে সকৌতুকে সে কুক দিয়ে উঠল, কূ-কূকূ। সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল সাবলীলভাবে বিরহ ভাব প্রকাশে শাস্ত্রীয় রাগেরও উপমা ব্যবহার করেন। “আমাদের ছাড়াছাড়ি হল তখন, যখন বৈশাখের গুমোটভরা উদাস-মদির সন্ধ্যায় বেদানাতুর পলু-বারোঁয়া রাগিণীর ক্লান্ত কান্না হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বেরুচ্ছিল।” অথবা ঝিলমের ওপার হতে কার আর্ত আর্দ্র সুর এপারে এসে আছাড় খাচ্ছিল,
‘ আর্গ মেয় বাগ্বাঁ হোতে তো গুলশান
লুটা দেতে।
পাকড়্ র্ক দস্তে বুল্বুল্ কো চমন মে জাঁ
মেলা দেতে ॥’
“তুই যদি মালী হতিস্, তা’হলে বুলবুলের হাত ধরে ফুলের সঙ্গে মিলন করিয়ে দিতিস্।”
‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা’য় ‘ব্যথার দান’ গল্পটির প্রকাশ মাঘ ১৩২৬ সংখ্যায়। ‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থে এই নাম গল্পটি অন্তর্ভুক্তির সময় নজরুল কিছু উল্লেখযোগ্য সম্পাদনা করেন, গল্পটি আয়তনে ছোট করা ছাড়াও এর প্রধান একটি চরিত্রের নাম বদলিয়ে দেন। বঙ্গীয় মুসলমান পত্রিকায় যিনি নূরন্নবী গ্রন্থে তিনি হন ‘দারা’। তবে নুরুন্নবী নামের প্রতি নজরুলের কিছু দুর্বলতার খবর জানা যায় মুজফ্ফর আহ্মদের স্মৃতিকথা’য়। বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস কাজী নজরুলের ‘বাঁধন-হারা’তেও নূরু নাম রয়েছে। নজরুল “চিঠিপত্রে কোনো কোনো সময়ে নিজের নূরু নাম স্বাক্ষর করেছে। শ্রীযুক্তা গিরিবালা দেবী ও বিরজাসুন্দরী দেবী তাকে নূরু ডাকতেন। শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে নজরুলের র্পাসী শিক্ষকের নাম ছিল হাফিজ নূরন্নবী” (কাজী নজরুল ইসলাম ঃ স্মৃতিকথা)। ব্যথার দান গল্পের ভূগোল বেলুচিস্তানে নূরন্নবী নামটি থেকে দারা নামটি বেশি মানানসই, এই কারণেও বদল করে থাকতে পারেন। তবে দারা নামটিও নজরুলের প্রিয় একান্ত সুহৃদ মুজফ্ফর আহ্মদের কন্যার ছেলের নামও নজরুল দারা রেখে দিয়েছিলেন। আর ব্যথার দান গল্পের ‘লালফৌজ’-এর পরিবর্তে ‘মুক্তিসেবক সৈন্যদের দল’ লেখার প্রসঙ্গ আগেই উল্লিখিত হয়েছে। এই সৈন্যদের দলে যোগ দেয় তরুণ দুই প্রেমিক দারা এবং সয়ফুল্-মুল্ক। প্রেমের নাম বেলুচকন্যা বেদৌরা। রোমাণ্টিক নজরুলের ‘ব্যথার দান’ গল্পে ত্রিভূজ প্রেমের কোনো সুখ সমাপ্তি ঘটে না, না-পাওয়ার বেদনায় বিষণœ সুরে প্রেমের অমর সঙ্গীত ধ্বনিত হয় আবহমান। “পুষ্পিত সেব গাছ থেকে অশ্র“লেপা কণ্ঠে পিয়া পিয়া করে বুলবুলগুলো উড়ে গেলো।” ‘দারার কথা,’ ‘বেদৌরার কথা,’ সয়ফুল্-মুল্কের কথা’ শিরোনামে বিভক্ত ‘ব্যথার দান’ গল্প বয়ানটিও সে কালের প্রেক্ষিতে অভিনব, চলতি-ভাষারীতি ব্যবহৃত এই গল্পেও আছে সঙ্গীতের ব্যবহার - উপমা হয়ে উঠেছে রাগ, “ভালবাসায় কি বিরাট শান্ত স্নিগ্ধতা আর করুণ গাম্ভীর্য, ঠিক ভৈরবী রাগিণীর কড়ি-মধ্যমের মত। আর ... বাসনার ভোগে যে সুখ, সে হচ্ছে পৈশাচিক সুখ। এতে শুধু দীপক রাগিণীর মত পুড়িয়েই দিয়ে যায় আমাদের। অথচ এই দীপকের আগুন একবার জ্বলে উঠবেই আমাদের জীবনের নব-ফাল্গুনে। সেই øিগ্ধ মেঘ-মল্লারের মত সান্ত্বনার একটা কিছু পাশে না থাকলে সে যে জ্বলবেই - দীপক যে তাকে জ্বালাবেই।”
অল্প সময়ের সৈনিক জীবনে নজরুলের করাচী অবস্থান কালে রচিত গল্প সমূহের প্রেক্ষাপটে, পটভূমি, চরিত্র পরদেশ এবং পরদেশী হলেও আবেগপ্রবণ নজরুলের বর্ণনায় প্রিয় স্বদেশ আর স্বদেশের নারী পুরুষ মূর্ত হয়ে ওঠে। আফগান, বেলুচিস্তান, প্যারিস বা বীরভূমের প্রকৃত প্রকৃতি মানসলোকের স্বদেশ মূর্ত হয় কাব্যিক অলঙ্কার জড়িয়ে। হেনা, মেহের-নেগার, বা দারা, সয়ফুল্-মুল্ক বাঙালির রূপ-লাবণ্য-আবেগ নিয়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে নজরুলের সাহিত্যে। ‘ব্যথার দান’ গল্পে দারার মনে আসে বাঙালি কবির গানের চরণ, নজরুলের গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের গান,
“তুমি আমারি যে তুমি আমারি
মম বিজন-জীবন-বিহারী।”
আবার প্রেমে মশগুল, অভিভূত দারা গান ধরে, গুরুদেবেরই গান,
“যদি আর কারে ভালবাস, যদি আর নাহি ফিরে আস
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো।”
বেদৌরার মৌন-বিষাদ-নীরব সন্ধ্যায়ও দারার ভারি কণ্ঠ ছেপে একটা ক্লান্ত রাগিণী ও-পার হতে কাঁদতে কাঁদতে এ-পারে এসে বলে,
“আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন
আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন !”
ছোটগল্পের ললাটে কুলীন শিল্পমর্যাদা জুটেছে। মহাজন শিল্পবোদ্ধা ও লেখক শিল্প-আঙ্গিকের যে ধারণা, এবং নির্মাণের কলাকৈবল্যে প্রকাশ করে আসছেন সৈনিক নজরুলের কৈশোর উত্তীর্ণকালের এই সব গল্প হয়তো সেই কলাকৈবল্যের’র কুলীন পিঁড়িতে আসন পাবে না। গল্প বয়ানের প্রচলিত দেশজ রীতি ও আধুনিক ছোটগল্প প্রকরণের বিশেষ করে বিলেতি রীতি মিলিয়ে যে প্রকরণ ও ব্যাকরণ বাংলায় গৃহীত হয়ে উঠছিল স্বভাবশিল্পী নজরুল সে সব প্রকরণের দরজায় কুর্ণিশ করতে আগ্রহী হননি। সার্বভৌম শিল্পী প্রয়োজনে নিজেই ব্যাকরণ করে নিতে পারেন, সঙ্গীত ও কবিতায় নজরুল করেছেনও। প্রথাগত জীবনের মতো প্রচলিত ব্যাকরণ ও প্রকরণ নজরুল কেয়ার করেছেন সামান্যই। আলেক্জান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরি মুসলমানরা ভস্মসাৎ করেছে বলে লোকে দুঃখ করে থাকে, কিন্তু প্রসিদ্ধ ফরাসি লেখক ম’তেইন্ (Montaigne)-এর মনোভাব এই যে, ‘ও ছাই গেছে বাঁচা গেছে ! কেননা সেখানে অভিধান ও ব্যাকরণের এক লক্ষ গ্রন্থ ছিল’।