গজবে আকবর

ছগীর আলী খান

সিডরের পরের দিন আমার গুরু নুরুল ইসলাম হুজুর তার পবিত্র দাড়ি মোবারকে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন- আল্লাহর গজবদ্যাশ পাপে ভইরা গেছেমানুষ আর মানুষ নাই, সব জন্তু-জানোয়ারএসব আল্লাহপাকের নিশানাএর পরেও যুদি মানুষের হুশ না হয়, সব ধ্বংস হইয়া যাইব

শুধু আমার হুজুর না, জাতীয় মসজিদের নতুন খতিব সাবও জুম্মার নামাজে অনুরূপ ইরশাদ ফরমিয়েছেন- ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবীর কারণেই আল্লাহপাক নাখোশ হয়ে সিডরকে বাংলাদেশের দিকে চালান করে দিয়েছেন 

বিশ্বাস করি আর না করি, হুজুরদের রিমার্ক নিয়ে সামান্য আলোচনা করার স্কোপ আছে বলে মনে হলো আমার রাজনীতির মাঠ এখন ঠান্ডা প্রতিশ্রতিশীল এবং ক্যারিশম্যাটিক নেতা নেত্রীদের সিংহভাগই ফাটকে আটকা আছেনলো প্রোফাইলের দুচারজন যাও বা বাইরে আছেন- তারাও শুধুমাত্র বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমেই অস্তিত্ত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেনধর্ম ও রাজনীতি- এ দুটো হচ্ছে কলাম লেখিয়েদের প্রিন্সিপাল র ম্যাটেরিয়াল বা সর্বোত্তম কাঁচা মালপাবলিক হট কেকের মতো লুফে নেয় রাজনীতি বন্ধ আছে, যদি ধর্মটাও অন্ততঃ চালু থাকতো (অর্থা ধর্ম নিয়ে রাজনীতিটা) তাহলেও পপুলার দুএক পিস লেখা পাঠকদের উপহার দেয়া যেতোকিন্তু বড়োই পরিতাপের বিষয়, ধর্মব্যবসায়ীরা এখন খুব একটা মাথা বের করছেন না মাওলানা নুরানী, মোমতাজি, সাঈদি, আমিনি ইত্যাদি জাদরেল জিহাদীরাও কেন যেন এক্কেবারেই খামুশ মেরে গেছেন কাদিয়ানীদের মসজিদগুলি এখন পর্য্যন্ত বাংলাদেশের বুকে বহাল তবিয়তে আছে, তবুও কেন যে তারা তাদের পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসছেন না এবং মসজিদগুলিকে গুড়িয়ে দেয়ার কর্মসুচী দিচ্ছেন না বুঝা যাচ্ছে না ডান্ডার ভয়ে? তাই বা কি করে বিশ্বাস করা যায়? এই তো মাত্র কিছুদিন আগে কার্টুন ইস্যুতে জরুরী আইন ভঙ্গ করে টুপী-দাড়ির জঙ্গী মহড়া হয়ে গেল, সরকার চুপটি করে রইলেনশুধু তাই নয়, মানিক মিয়ার সুপুত্র বারিষ্টর মইনুল হোসেনের পরিচালনায় তোফা একটা মাগফেরাত-মাহফিলের আয়োজন করা হলো যেখানে প্রথম আলোর প্রখ্যাত সম্পাদক মতিউর রহমান আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ে পুনরায় মর্দ্দে মুমিনের খাতায় নাম লেখালেনহিজবু তাহরিত নামক জঙ্গী সংগঠনটি জরুরী আইন ভঙ্গ করে প্রায়ই রাজপথে মিটিং টিটিং করছে; গত শুক্রবারও (২৩-১১-২০০৭) বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে মার্কিনী সাহায্য জাহাজের আগমনকে কন্ডেম করে সমাবেশ করেছে তারাএতে করে জরুরী আইন লঙ্ঘন হয়নি, হুজুরদের সমাবেশ জরুরী আইনের আওতায় পড়ে নাএসব ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট মেসেজ পাওয়া যায় যে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের নামে কেউ যদি জিহাদী কর্মসুচী দেয়, হযরত মাওলানা মইনুল হোসেনদের সরকার কিছু বলবে নাএর পরেও কি নুরানি-মমতাজি সাহেবানরা চুপচাপ থাকবেন! তাদের স্মরণ রাখা দরকার যে বেশীদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলে তাদের ইমেজ জনগণের মন থেকে চিরতরে মুছে যেতে পারে

এইরকম একটা ডাল্-সিজনে হঠা করেই যেন সিডর নামক মেগা-সাইক্লোনটি ঈসরাফিলের শিঙ্গার হুঙ্কার নিয়ে উপকুলভাগে আছড়ে পড়েছে গরীবগুর্বো হাজার হাজার লোক প্রাণ হারাবে সেটা বড়ো কথা নয়, কারণ এসব প্রাকৃতিক দুর্য্যােগগুলির টার্গেট গ্রপ প্রধানত গরীব গুর্বোরা টার্গেট গ্রপ বাদ দিয়ে সিডর যদি আমাদের মতো অট্টালিকাবাসীদের উপর আঘাত হানতো- সেটা হতো আন-ইথিকাল, অনৈতিক প্রকৃতি এরূপ অনৈতিক কাজ করে না কখনও, তাই আমরা মহাসুখে অট্টালিকা পরে থাকতে পারিবিশ্ব হেরিটেজ সুন্দরবনের উপরও তা মারাত্মক আঘাত হেনেছে, গাছগাছালির সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অগনিত পশুপাখি, বাঘহরিণসিডরের কর্মকান্ডে এ কথা পরিস্কার যে তার চোখে উপকুলীয় গরীবগুর্বো আর পশুপাখিতে কোন ইতরবিশেষ নেই!  

হুজুরদের কল্যানে শিশুকাল থেকেই জেনে এসেছি যে বন্যা, জলোচ্ছাস, ঘুর্ণিঝড়, ভুমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আল্লাহ পাকের গজব মানবগোষ্ঠি যখন পাপে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পরে, তখনই আল্লাহর তরফ থেকে নেমে আসে গজব সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এরূপ গজব অসংখ্যবার মানবসমাজে নেমে এসেছে এবং তাকে শুচিশুদ্ধ করে রেখে গেছে কাছাছুল আম্বিয়া, তাজকেরাতুল আওলিয়া ইত্যাদি পবিত্র গ্রন্থসমুহে এসব গজবের বিস্তারিত বর্ণনা আছেনুহের (আঃ) সময় যে মহাপ্লাবন হয়েছিল, সে প্লাবনেও তাব বদ্লোক নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, বেচেছিল শুধুমাত্র পুন্যবানেরানুহের এক ছেলে (নাম খুব সম্ভবত শাম) ছিল মহা বদ্সে এতটাই লম্বাচুড়া ছিল যে খোদ্ নীল দরিয়ায় তার হাটু পানি হতোদরিয়া থেকে দু আঙ্গুলে একটা করে তিমি মাছ ধরে সুর্য্যরে গনগনে আগুনে রোষ্ট করে লাঞ্চ সারতো সে স্বভাবতই বাপের নিরামিশ উপদেশের তোয়াক্কা করতো না সে ফলস্বরূপ মহাপ্লাবনে ডুবে মরতে হয়েছিল তাকেলুতের (আঃ) আমলেও সেই একই ঘটনাসমাজের সব লোক সমকামীতায় মেতে উঠলো, একেবারে mass-sodomism. লুতের হাজারো চিল্লাচিল্লিতেও কোন কাম হলো নাএকবার দুজন ফেরেশতা তশরিফ আনলেন লুতের বাড়ীতেহাজার হলেও স্বর্গের জীব তেনারা, চেহারায় স্বর্গীয় জেল্লানগরের লোকেরা তাদের দেখে খেঁপে উঠলো এবং তাদেরকে দখলে নিতে লুতের বাড়ী অবরোধ করে বসলোবেচারা লুত বহুত কাকুতি মিনতি করলেন, সম্মানিত মেহমানদের পরিবর্তে নিজের দুই সুন্দরী কন্যাকে দিতে চাইলেনকিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী, তারা কিছুতেই স্বর্গদুতদের হাত ছাড়া করবে নাসুতরাং আল্লাহপাক সঙ্গতভাবেই নাখোশ হলেনযতবড় দয়াশীলই হোন, এমন খবিশি কাম কিছুতেই সহ্য করা যায় নাতিনি লুতকে নির্দেশ দিলেন স্ত্রীকন্যা সহ নগর ছেড়ে চলে যেতে, নগরটাকে তিনি মাটির নীচে দাবিয়ে দেবেন আল্লাহপাকের নির্দেশ মোতাবেক লুত তার স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ নগর পরিত্যাগ করে চলে গেলেননগর দুটিকে আল্লাহপাক মাটির নীচে দাবিয়ে দিলেন যেখানে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান কালের ডেড্ সিসব পাপী অক্কা পেললুতের স্ত্রী শুধুমাত্র পেছনে ফিরে তাকানোর অপরাধে মারা গেল. কন্যা দুজন নিয়ে লুত নিকটবর্তী এক পাহাড়ে (আদ্দিকালের সাইক্লোন শেল্টার হবে হয়তো) আশ্রয় নেওয়াতে  কোনমতে প্রাণে বেচে পেলেন 

সেকালের গজবগুলির প্যাটার্ন ষ্টাডি করলে দেখা যায় যে পাপী লোকদের ধ্বংস করে পুন্যবানদের রিহ্যাবিলেট করাই ছিল সেসব গজবের মূল উদ্দেশ্য (এ যেন হিন্দু শাস্ত্রোক্ত শ্রীকৃষ্ণের বাণী- ধর্ম সংস্থাপনায় অধর্ম বিনাশশ্চ সম্ভবামি যুগে যুগে) পক্ষান্তরে বর্তমান কালের গজবগুলির প্যাটার্ণ যেন এক শ আশী ডিগ্রি বদলে গেছেদুবলার চরের যে হতদরিদ্র জেলেটি পুত্রকন্যাদের মুখে আহার যোগাতে সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছিল, কতটুকু পাপ করার স্কোপ ছিল তার জীবনে? চুরি করলেও এক সের চালের বেশী কিছু চুরি করার সুযোগ নেই তার সমাজেঅথচ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে ভুমিকম্পপ্রফ দালানে নিকিতাদের মতো সুন্দরী উপপত্নীর নরম বুকে শুয়ে প্রলয়রাত নির্বিঘ্নে পার করে দিয়েছে অনেক পুন্যবান গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে আমেরিকা চীন, ফলভোগ করে বাংলাদেশের শরণখোলা পাথরঘাটা গ্রামের তোমেজ মিয়ারা! বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির মিশন নিয়ে গণহত্যা চালিয়েও বুশব্লেয়াররা আল্লাহপাকের রহমতের দুইনায় বুক ফুলিয়ে বিচরণ করে, আর সুনামি ভুমিকম্পে প্রাণ হারায় ইন্দোনেশিয়া পাকিস্তানের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি! এই হলো কলিযুগের গজবকান্ডের স্বরূপ পাপীদের গায়ে তা বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটে না, দুর্বল অসহায় যেসব লোকদের পাপ করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়এসব দেখেশুনে কথিত গজবের উপর থেকে সাধারণ মানুষের ভক্তিশ্রদ্ধা উবে যেতে বসেছে-, মনে হচ্ছে আল্লাহপাকের শেষ চিকিৎসা যে গজব- তার মধ্যেও ভেজাল ঢুকে গেছে 

বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা দরকার হুজুরদেরশুধু জেহাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই চলবে নাকেন গজব তার রূপ পাল্টাল, কী করলে তা আবার তার আদি রূপ ফিরে পাবে, কোন্ পন্থা অবলম্বন করলে সিডর-নার্গিস নামধারী গজববৃন্দকে কাফের মুশরেকদের দিকে পরিচালনা করা যাবে - এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইজতিহাদ করে একটা নোখ্সা বাতলানো জরুরীতা না করলে আম্ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়তেই থাকবে, উম্মার সামগ্রিক উন্নতির জন্যে যা খুবই ক্ষতিকরডক্টর শমসের আলীদের মতো প্রখ্যাত চিন্তাবিদ এবং গবেষক থাকতে এর একটা যুক্তিগ্রাহ্য উপায় বেরুবে না তা হতে পারে না

আমরা একটা গজবের প্রতীক্ষায় আছি- গজবে আকবরের প্রতীক্ষায়- আদি কালের মতো যা বেছে বেছে শুধু ঘুষখোর-মুনাফাখোর, অস ব্যবসায়ী-ধর্ম ব্যবসায়ী - সমাজদেহের এইসব ক্যান্সারদের নির্মুল করবে, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হবে না ওয়ান-ইলেভেনের পর এরুপ একটা মিনি গজব অবশ্য নাজেল হয়েছিল, কলামিষ্ট গাফফার চৌধুরি যার নাম দিয়েছিলেন এ্যাক্ট অব গডতবে এখন মনে হচ্ছে- দিনকে দিন তা দুর্বল হয়ে পড়ছেএই তো মাত্র সপ্তাখানেক আগে ফুলের মালা গলায় পড়ে আব্দুল আওয়াল মিন্টু সহাস্যে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলেনশোনা যাচ্ছে- সালমান এফ রহমান, আবুল হাশেম প্রমুখ হেভি ওয়েটদের জন্যেও নাকি ফুলের মালা রেডি হচ্ছেএসব দেখে ভয় হচ্ছে, আবার না ফালু ভাই, দুলু ভাই, মামুন ভাই, বাবর ভাই, আব্বাস ভাই ইত্যাদি ভাইয়েরা পুষ্পমাল্য গলে চাঁদের হাসি নিয়ে সগৌরবে প্রত্যাবর্তন করেন আমাদের মাঝে

ঈশান কোন্ সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে না তো?

আল্লাহ ভরসা

২৫শে নভেম্বার-২০০৭