অপেক্ষায় থাকি......... একটি নির্মল সকালের....
সালমা ইয়াসমিন নিতি
এইতো সেদিন ১১ ও ১২ ই নভেম্বর'০৭ দুদিনব্যাপি বিশাল সমারোহে অনুষ্ঠিত হল চেঞ্জমেকার সম্মেলন, পারিবারিক পর্যায়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্ঠি এবং দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি; পারিবারিক নির্যাতনকে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসাবে চিহ্নিত করে এ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে জাতীয় এই সমস্যা সমাধানের মহতী উদ্যোগ নিয়েছে অক্সফাম জিবি ও দেশের নেতৃত্বদানকারী আরো কয়েকটি উন্নয়ন সংগঠন। এ বছর আয়োজিত এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কার্যক্রমের অগ্রগতি তথা সফলতা পর্যালোচনা ও সম্প্রচার, বাস্তবায়নে গৃহীত নতুন কৌশল ও উন্নয়নের দিকসমূহ। আর এই সম্মেলনকে সাধুবাদ জানিয়ে পত্রিকায় এসেছে বিশাল বিশাল নিউজ কাভারেজ, অনেক সফল ঘটনার বিবরণ, আলোচনা সভা, রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টাদের ভাষণ, কত না আশার বানী! ঠিক এমনই এক মূহূর্তে নিউজ চ্যানেলগুলি, পত্রিকা অফিসগুলি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল আরেকটি নিত্য পরিচিত অতি পুরাতন ঘটনা নিয়ে নিউজ কাভারেজ করতে, যা প্রশ্নের সম্মূখীন করেছে এই সম্মেলনকে তথা এর সফলতাকে..
“যৌতুকের দায়ে আত্মাহুতি দিতে হল আরেকজন নারীকে, স্ত্রীকে, মাকে.......... মাহমুদা খাতুন টপি। তার বিবাহিত জীবন শুরু হয়েছিল আজ থেকে ২০০৪ সালে আজ থেকে বছর তিনেক আগে, টপির বিয়ের শর্তই ছিল হবু জামাতাকে দিতে হবে বিএলআরইএ( বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট) চাকুরী, কারন টপির নিজের মামা চাকুরী করেন বিএলআরআইএ বড় কর্তা হিসেবে, বিয়েতে ইন কাইন্ড যৌতুক আর কি! যেহেতু টপির হবু স্বামী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশুসম্পদ বিভাগে পড়াশুনা করে সর্বোচ্চ ডিগ্রী হাতিয়েছেন। এত দামী ছেলেকে পাত্র হিসেবে পাওয়া, সেতো রীতিমত ভাগ্যের ব্যপার! তাকে দি অদামে কেনা যায়? তাই টপির বাবা-মা রাজী হলেন হবু জামাতাকে চাকুরী দেবার শর্তে, বাড়ীর ছোট মেয়ে, ভাইয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত, বাবা তাই মহা ধুমধামের সাথেই টপিকে তুলে দেন পশুরুপী পশুর ডা: আব্দুল্লাহ আল মামুনের হাতে। তখন কি টপির বাবা জানতেন পশুর চিকিৎসাবিষয়ক পড়াশুনা পড়তে গিয়ে মামুন নিজেই একটা সাক্ষাৎ পশু হয়ে গেছেন।
শর্ত মতে বিয়ে হলেও শেষ হয়নি মামুনের পাওয়ার চাহিদা, চাকুরী নিয়েই সন্তষ্ট ছিলেন না টপির স্বামী দেবতা, তার আরো চাই নগদ (পাঁচ লাখ টাকা) অর্থ, আসবাবপত্র... ইত্যাদি ইত্যাদি, টপির বাবার কাছ থেকে সে টাকা আদায়ের জন্য মামুন টপির উপর চালাত অমানুষিক নির্যাতন, প্রায়ই চাপ দিত টপিকে বাবার কাছ থেকে টাকা আনার জন্য, টপি অপারগতা স্বীকার করলেই লেগে যেত ঝগড়া এবং পরিনাম মারপিট, এভাবেই কোনমতে টিকে ছিল টপির সংসার নামক নরক যন্ত্রটি......... আর এ নির্যাতনের কথা জানত পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু- বান্ধব, এমনকি অফিসের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দও, মামুন যে কোর্য়াটারে থাকত তার পাশের প্রতিবেশীরা পর্যন্ত প্রতি রাতে টপিকে মারধরের শব্দ পেত। টপি নিজেই মামুনের অফিসে একবার নালিশ জানিয়েছে, কোন লাভ হয়নি। টপির বাবা, ভাই বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে সাধারণ ডায়েরী করেছেন, তারা স্থায়ী সমাধান চাননি। ভেবেছেন মামুন একদিন ভাল হয়ে যাবে, আবার টপি ও তার তিন বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে ঘর সংসার করবে, এত ভাল ছেলেকে জামাই বানিয়েছেন বলে কথা, সেখানে অশান্তি করে কি লাভ? যেভাবে মিলে মিশে থাকা যায় সে চেষ্টা করাই ভাল, টপি নিজেও তাই চেয়েছিলেন, স্বামীর সংসার ছেড়ে যাবেন না কোথাও.......সমাজ কি বলবে, পুরুষরাতো এমন একটু আধটু হয়ই, ভুলত্র“টি হলে মারধর হবেই তাই বলে সংসার ত্যাগ? এমন কথা চিন্তা করাও যে পাপ! অবশেষে এসিডে পুড়ে মেডিকেলের বেডে যন্ত্রনায় ছট্ফট্ করে ধুকে ধুকে সাতটি দিন মুত্যৃর সাথে পাঞ্জা লড়ে একটি নির্বোধ শিশু (টগর) কে অনাথ-আশ্রয়হীন করে চলে যেতে হল সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে। এই ছিল টপি কাহিনীর সাতকাহন। এবার শুনুন ঘটনার বিবরণ.............
প্রায় রুটিন মাফিক ঝগড়া-বিবাদের কারণে সংসার বড় বেশী অসহনীয় হয়ে ইঠেছিল টপির, টপি তাই অক্টোবর’০৭ মাসে চলে গিয়েছিল তার বাবার বাড়ী, মামুন পরিকল্পনামাফিক তখন তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠায় যদিও ডাক বিভাগ যথাসময়ে সে চিঠি পৌছাঁয়নি টপির হাতে, তাই কোনো ধরণের প্রতিউত্তরও আসেনি টপির কাছ থেকে, ইতোমধ্যে টপি আবারও ফিরে এসেছে স্বামীগৃহে। এদিকে অফিসের কাজের অযুহাতে নিয়মিত বাসায় ফেরে না মামুন, টপি ফিরে আসার পরে সামান্য কিছু হাত খরচ দিয়ে চলে গেছে মামুন অনেকদিন, তার অপেক্ষায় থেকে টপি মামুনকে ফোন করে জানাল যে বাসায় কোনো বাজার নেই, তার হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই, মামুনের আসা উচিৎ, মামুন জানাল সে আসছে রাতে। ৪ই নভেম্বর ঠিক রাত সাড়ে বারোটার সময় গেটে কড়া নাড়ার শব্দ, টপি জানে তার স্বামী আসবে তাই সে দরোজা খুলে দিয়ে আবার সোজা বিছানায় ঘুমন্ত শিশুর (টগর) কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ল, মামুন তার এক দুলাভাই সহ ঘরে ঢুকল, যেহেতু টপির সাথে প্রায়ই ঝগড়া বিবাদ হয়, তাই টপি স্বামীর উপস্থিতিকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেননি । টপি শুয়ে থাকা অবস্থাতেই মামুন টপিকে মারধর শুরু করে, টপির অপরাধ ডিভোর্স পেপারে সাইন না করা। বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে চায় টপিকে, টপি তখন মামুনকে বিছানা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে টপির গায়ে এসিড ঢেলে দিয়ে মামুন ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়, টপি জ্বালা পোড়ায় অস্থির হয়ে গিয়ে বাচাঁও বাচাঁও বলে চীৎকার করলে পাড়া-প্রতিবেশী এসে দেখল টপি ও টগর দুজনই মারাত্মকভাবে এসিডে পুড়ে গেছে, উল্লেখ্য, টপিকে চিকিৎসার জন্য বিএলআরআইএর অ্যাম্বুলেন্স চাওয়া হলে তা পাওয়া যায়নি, হয়তো সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি করা গেলে টপি প্রাণে বেঁচে গেলেও যেতে পারত, প্রতিবেশীরাই সেই রাতে সাভার ক্লিনিকে পাঠায় এবং সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ৭ দিন জরুরী চিকিৎসার পরে ১১ই নভেম্বর’০৭ তিনি মারা যান।
মারা যাওয়ার সময় টপি জবানবন্দী দিয়ে গেছেন.......বলে গেছেন, “আমি চলে গেলাম, মামুন আমায় শাস্তি দিয়েছে, এবার আইন মামুনকে শাস্তি দেবে........... আইন মামুনকে কি শাস্তি দেবে আমি জানিনা, তবে ছোট্ট ওই শিশুটি মাকে হারিয়ে যে শাস্তি পাচ্ছে, যে শাস্তি পাচ্ছে টপির বাবা মা, যে যন্ত্রনা পেয়ে চলে গেল টপি নিজে তার জবাব নেই সত্যি!
মামুন সুশিক্ষিত(?), বুদ্ধিমান(!) বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী যুবক, পশু চিকিৎসক, পশুচিকিৎসা বিজ্ঞান বলেছে বৈ কি “পশুদের ভাষা বুঝতে পারলেই ভাল পশু চিকিৎসক হওয়া যাবে”, কিন্তু পশুর আচরণ রপ্ত করে নিজেকেই পশু বনে যেতে হবে এমন কথা কোথাও বলা আছে কিনা আমার জানা নেই......
‘শিক্ষা মানুষকে মহান করে’ জয়তু হে শিক্ষা! মামুনের মতো এমন মহান যেন আর কাউকে না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা। পত্রিকার পাতা খুলে আর যেন চোখ বন্ধ হয়ে না যায়, উবে না যায় চোখ ভরে দেখার সাাধ সকালের সুনির্মল আলো....
ঢাকা, বাংলাদেশ