হারামজাদা তোর হাতে এ কি বই?
সালমান সুলতান
আমাদের সমাজে এরকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে: বিতর্কিত বই না পড়াই ভালো, পড়লে অনেক ক্ষতি হতে পারে; বিতর্কিত বই পড়লে মন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, কাজেই ও সব বই না ধরাই ভালো। আমি অনেককেই দেখেছি, যে তারা ভয়ে নিষিদ্ধ, বিতর্কিত ও প্রথাবিরোধী বই পড়েন না; তারা ভয় পান যে তাদের মন হয়তো বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারে। সত্যকে তারা এক প্রকার বিভ্রান্িত বলে মনে করেন। অনেকে আবার, যারা এ ধরণের বই পড়েন তাদেরকে, মনে মনে বা প্রকাশ্যে, পাগল বলে উড়িয়ে দিয়ে সুখ পান। মুত্তমনার উদ্যোগে ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম - সংঘাত নাকি সমন্বয়?' প্রকাশিত হতে চলেছে আগামী বছর। আমার ঐ একটাই ভয়, অনেকে হয়তো তাদের মন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে বলে বইটা পড়বেই না; এমনকি হয়তো নেড়েচেড়েও দেখবে না। অনেকে নিজেদেরকে মুক্তমনের মানুষ বলে মনে করেন, আবার একটা ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন; তারা শুধু সত্যের সন্ধানে থাকার একটা অভিনয় করেন মাত্র, সত্য তারা অনেক আগেই পেয়ে গেছেন, তাদের ঈশ্বর বিশাস তা-ই প্রমান করে।
‘হারামজাদা তোর হাতে এ কি বই? এ সব বই মানুষে পড়ে! ক্লাশের বই পড় বুঝলি, জীবন কিন্তু শেষ হয়ে যাবে; এখনও সময় আছে, আল্লাহ আল্লাহ কর।‘ আমার এক নানা আমাকে এ কথা বলেছিলেন, হুমায়ুন আজাদের ‘নারী' পড়তে দেখে। আমি বলেছিলাম, ‘ক্লাশের বই তো পড়িই। আর সব সময় ক্লাশের বই পড়তে কি ভালো লাগে?‘ তিনি বলেছিলেন, ‘একটা দাগের উপর বারবার দাগ কাটলে দাগটা ক্রমেই গাঢ় হয়।‘
আমার বড়োমামা একদিন আমাকে হঠাৎ বলেন, ‘নজরুল ইসলাম কিন্তু ভগবানের বুকে পদচিহ¡ আঁকতে গিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। যারা নাস্তিক তারা বয়সকালে পাগল হবেই। সাবধান কিন্তু।‘ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তাই নাকি?‘ তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, লোকে অবশ্য বলে নজরুল ভগবান বলতে ব্রিটিশদের বুঝিয়েছিলেন; কিন্তু ব্রিটিশরা তো অশুভ শক্তি আর ভগবান তো শুভ শক্তি, আর শুভ শক্তির বুকে সে পদচিহ¡ আঁকতে যাবে কেনো?‘
মনে পড়ে, ক্লাশ নাইনে, আমাদের স্কুলের ফার্ষ্ট বয়, স্যার কে বিবর্তন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে শুনে বলেছিলো, ‘ডারউইন নিজেই বাঁদরের মতো দেখতে।‘
তখন খুব প্রবীর ঘোষের বই পড়ছিলাম। একদিন আমার এক বান্ধবি, যে বর্তমানে আমার ভাবী ও একজন ডাক্তার (যশোর শহরে সেই প্রথম সাইকেল ও মোটরসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে শুরু করে), আমাকে বলেছিলো, ‘তুই এসব বই পড়ে সময় নষ্ট করিস? তুই কিন্তু এ সব পড়তে পড়তে আস্তে আস্তে ও সবে বিশ্বাস করতে শুরু করবি।‘
আমার দুই বন্ধু, যারা দু’ভাই ও খুবই ভালো ছাত্র; যাদের পিতা একজন বাংলার শিক্ষক, খবরের কাগজে ধষর্নের খবর না থাকলে ওদের মাথা খারাপ হয়ে যেতো, ছুড়ে ফেলে দিতো কাগজ, অসুস্থ হয়ে উঠতো ওরা। ওদের পিতা ওদের বলতেন, ‘পরিক্ষায় ভালো করার জন্য প্রয়োজনে যা ইচ্ছে পড়ো, কিন্তু বিশ্বাস করো না।‘ ‘কাফেলা‘ পড়ার ব্যাপারে তিনি এ কথা বলতেন।
আমার বেষ্টফ্রেন্ড অলিদ খুব নামাজি ছিলো; ও ভয়ে নিষিদ্ধ, বিতর্কিত ও প্রথাবিরোধী কোনো বই পড়তো না, পাছে ওর মন পালটে যায়। একদিন বললাম তোর পায়ে ধরি এই বইটা অন্তত পড়ে দেখ। তার আগের রাতে, আমি আর আব্বু, সারারাত জেগে দু’জনে বইটা পড়ে শেষ করেছি। বইটা ছিলো, আরজ আলী মাতুব্বরের রচনা সমগ্র (প্রথম খন্ড)। অলিদ বইটা নিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে বিকেল পাঁচটার দিকে, পরদিন ভোর ছয়টার দিকে ও হাঁফাতে হাঁফাতে আমাদের বাড়ি আসে,বলে, ‘আমি নাস্তিক।‘ এত দ্রুত আর কেউ কখনও হয়তো নাস্তিক হয়ে যায় নি। ওর মন ছিলো মুক্ত, তাই ও সত্যকে বিভ্রান্িত বলে মনে করে নিজেকে বোকা বানায়নি।
আমার একার জীবনে এরকম আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে। এই ছিলো অবস্থা, আমার বেড়ে ওঠার সময়ে; আশা করি তা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বাংলায় ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম - সংঘাত নাকি সমন্বয়?'-এর মতো এমন উদ্যোগের বই আর আগে দেখা যায় নি। একটি চমৎকার শুরু! আমার বারবার শুধু মনে হচ্ছে, যে এমন একটা বই যদি আমার হাতে থাকতো, যখন আমি বেড়ে উঠছিলাম; জীবন কতো পবিত্র আর ভয়মুত্তই না হতো।
সান হোসে, কালিফোর্নিয়া