হুমায়ূন আহমেদের প্রতি

সালমান সুলতান

বস্তু, ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কে প্রতিটি মানুষেরই, তার ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের স্বাধিনতা রয়েছে, তা সে বক্তব্য যতো আপত্তিকরই হোক না কেনো।  আমি মনে করি এই মৌলিক স্বাধিনতাহীন মানুষেরা ঠিক মানুষের মতো ঁেবচে থাকেন না, কেননা তারা বাধ্য হয় কৃত্তিম জীবন-যাপনে।  হুমায়ূন আহমেদকে ধন্যবাদ, অকপটে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের জন্য।  সমকালে তাঁর সাক্ষাকারটি পড়ে আমি বিষ্মিত হয়েছি।  আমি যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে চাই, সেটা বোঝার জন্য প্রথমে সাক্ষাকারটির একটি অংশ একবার দেখে নেওয়া জরুরি 

সাব্বির রহমান খান - বাংলাদেশের লেখকরা কি স্বাধীন?

হুমায়ূন আহমেদ - হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন

সাব্বির রহমান খান - তাহলে ডক্টর হুমায়ুন আজাদকে মরতে হলো কেনো?

হুমায়ূন আহমেদ - কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুসিত যে, যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে।  তার জন্য মৌলবাদী হতে হয় না।   

বাংলাদেশে কি লেখকদের সত্যিই কোনো স্বাধীনতা রয়েছেথাকলে সেই স্বাধীনতা ঠিক কি ধরণের হুমায়ুন আজাদের নারী বইটি, এবং তসলিমা নাসরিনের বেশ কয়েকটি বই কিন্তু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে।  কেউ যদি সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেস-এর অনুবাদ প্রকাশ করতে চান, তবে কি তাকে সে অনুমতি দেবে বাংলাদেশ কাজেই, যখন হুমায়ূন আহমেদ বলেন যে বাংলাদেশের লেখকরা স্বাধীন, তখন তিনি মঞ্চে তুলনাহীন নির্বোধের রুপে আত্মপ্রকাশ করেন।  কারো মন মতো মতামত প্রকাশ করা স্বাধীনতা নয় 

সাব্বির রহমান খানের দ্বিতীয় প্রশ্নটি কিন্তু সঠিক নয়।  হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর কারণ কিন্তু অন্য, যার সাথে লেখকের স্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেইখান সাহেব জিজ্ঞেস করতে পারতেন, ‘তাহলে ডক্টর হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণ হলো কেনো?‘  কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ, খান সাহেবের এই ভুলটি না ধরে যে উত্তর দিলেন তা আমার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।  প্রথমেই কুসিতশব্দটি নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।  কুসিত শব্দটির ব্যবহার কি ব্যক্তি নির্ভর নয়কেউ যদি মনে করেন যে হুমায়ূন আহমেদের চেহারা বড়ই কুসিত‘, তবে তার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে গালি দেওয়া কি হাস্যকর হবে না অথবা হুমায়ূন আহমেদের ধংস কামনা করা কি ঘৃণাযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না হুমায়ূন আহমেদ যখন পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটিকে কুসিতমনে করেন, তখন তাঁর সাহিত্যবোধ সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়।  আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তাকে জিজ্ঞেস করতে স্যাটানিক ভার্সেস, দ্য লাষ্ট টেম্পটেশন অব খ্রাইষ্ট, এবং দ্য গসপেল এ্যকোরডিং টু জেসাস খ্রাইষ্ট বই তিনটিকেও তিনি কুসিতবলে মনে করেন কি না।   

তিনি যখন বলেন, ‘যে কেউ বইটা পড়লে আহত হবে‘; তখন আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় যে কেউ শব্দ দুটি ব্যবহারের অধিকার তাকে কে দিলো? আমি তো বইটি পড়ে আহত হইনি।  আমি ব্যক্তিগতভাবে ধর্মিয় গ্রন্থগুলোকে অপবিত্র, অমানবিক, অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর বলে মনে করি; কিন্তু আমি কাউকে কখনই বাধ্য করতে পারি না, ঐ গ্রন্থগুলো থেকে দূরে থাকতে।  ভয়ে বা কেউ আহত হবে ভেবে আমার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করা থেকেও দূরে থাকতে পারি না।  ডক্টর হুমায়ুন আজাদ তাঁর পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটি নিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ে শোনান নি, বা কাউকে রাস্তায় জড়িয়ে ধরে, বইটি পড়তে বাধ্যও করেন নি; কিন্তু দুঃখের বিষয় তার পরও তাকে হিংস্র আক্রমণের স্বীকার হতে হয়েছে।  হুমায়ূন আহমেদ মনে করেন, হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর কারণ তাঁর পাক সার জমিন সাদ বাদ বইটি।  তিনি আসলে কি বলতে চান?                  

তবে কি লেখকদেরকে ঐ ধরণের বই লেখা থেকে বিরত থাকতে হবে? আর সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের লেখকদেরকে কি স্বাধীন বলা যাবেএ কথা সত্য যে মৌলবাদী না হয়েও, বইটি পড়ে কেউ কেউ আহত হতে পারেন; কিন্তু যে কেউ শব্দ দুটির ব্যবহারের মাধ্যমে যখন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজের আহত হওয়ার কথা স্বীকার করেন, তখন অন্তরে ভয়ের উদয় হয়আর এও লক্ষ্যনীয় যে তিনি, তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে, সূকৌশলে নিজেকে মৌলবাদী চিন্তা-ভাবনা থেকে পৃথক করে নিচ্ছেন, তাতে করে মনে আমার অনেক রকম সন্দেহ বাসা বাঁধতে শুরু করেছে।