নারী স্বাধীনতা বিষয়ক লেখা বিষয়ে
সালমান সুলতান
পুরুষ শাসিত সমাজে, কোনো কোনো নারীর বিস্ময়কর অবদান দেখে বোঝা যায় যে নারী দুর্বল নয়, সে টিকে থেকে সংগ্রাম করতে জানে, এবং কেউ কেউ রোমহর্ষক অত্যাচারের মধ্যে বেঁচে থেকেও কখনো কখনো বিস্ময়ও সৃষ্টি করে; কিন্তু শুধু টিকে থাকাই তো জীবন নয়। যদি টিকে থাকাই সবকিছু হতো, তবে ক্রীতদাসেরা কখনো বিদ্রোহ করতো না, আর নারী আন্দোলনও ইতিহাস সৃষ্টি করতো না। জীবন সৃষ্টিশীলতা, ইন্দ্রিয়ের স্বাধীনতা, সুখের সন্ধানে পথ চলা, প্রতিটি মুহূর্ত স্বাধীনভাবে উপভোগ করা, স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করা, ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠার সংগ্রাম ও আরো অনেক অনেক কিছু।
আমি প্রায়ই কিছু কিছু নারী স্বাধীনতা বিষয়ক লেখা, পড়ার সময়ে লক্ষ্য করি যে লেখাটিতে লেখিকা/লেখক অনেক সুন্দর যুক্তি ব্যবহার করলেও বিষয়টি সম্পর্কে তাদের নিজস্ব ধারণা বা অবস্থান খুব একটা পরিস্কার করে তারা আলোচনা করেন না। এর ফলে অনেক ভন্ডও নারীবাদী লেখক হিসাবে নিজেকে চালিয়ে দিতে পারেন; এবং এও সম্ভব যে নারী স্বাধীনতা ব্যাপারটা যে আসলে কি তা সঠিকভাবে না বুঝেও একজন হয়তো কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। নারী স্বাধীনতার মূল বিষয়গুলো শুধু গ্রন্থে বন্দী হয়ে থাকার জন্য নয়, জীবনের প্রতিটি এলাকায় যদি তার কোনো প্রতিফন না ঘটে, তবে তা মূল্যহীন। নিদেনপক্ষে নিম্নবর্ণীত দু’টি প্রশ্ন সম্পর্কে নারী স্বাধীনতা বিষয়ক লেখায় লেখিকা/লেখকের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা উচিৎ, যদি তিনি নিজেকে নারীবাদী হিসেবে দাবী করেন, এর ফলে এ বিষয়ে লেখিকা/লেখকের অবস্থান সম্পর্কে পাঠক কিছুটা নিশ্চিত হতে পারেন:
১) নারী স্বাধীনতা বলতে লেখিকা/লেখক কি বোঝেন?
২) নারী কি?
খুব সংক্ষিপ্তভাবে, প্রাথমিক স্তরে, নারী স্বাধীনতা বলতে আমি যা বুঝি তা হলো:
১) নারী ও পুরুষ দু’জনেই মানুষ, কাজেই একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের অধিকারে থাকতে পারেনা।
২) নিজের মন, শরীর ও স্বপ্নের উপর নারীর পূর্ন অধিকার থাকতে হবে।
৩) সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকতে হবে।
৪) নারীকে পূর্ন অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে হবে।
৫) নারীর মন ও শরীর ধর্মের শাসন থেকে সম্পূর্ন মুক্ত হতে হবে।
নারী স্বাধীনতা ও নারীবাদ সম্পর্কে জানার জন্য, যারা সবে শুরু করছেন, ডঃ হুমায়ুন আজাদের নারী ও দ্বিতীয় লিঙ্গ (অনূদিত) বই দু’টি পড়ে শুরু করতে পারেন। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত, সিমোন দ্য বোভোয়ারের দি সেকেন্ড সেক্স বইটি ইংরেজিতেই পড়া ভালো (তবে পাশাপাশি বাংলাটিও পড়লে কোনো কোনো পাঠক উপকৃত হতে পারেন), কারণ ডঃ আজাদ অনূদিত দ্বিতীয় লিঙ্গ বইটি, গ্রন্থটির আংশিক তবে চমৎকার আনুবাদ। আমি আরো তিনটি বই এর নাম উল্লেখ করতে চাই:
১) বেটি ফ্রাইডেনের দি ফেমিনিন মিষ্টিক
২) কেইট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিক্স
৩) মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের এ্য ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওম্যেন
আরো দু’টি বইয়ের নাম উল্লেখ না করে পারছি না।
১) এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটনের দি ওম্যানস বাইবেল
২) নওঅল এল সাদাউয়ির দি হিডেন ফেস ওফ ইভ: ওম্যেন ইন দি আরব ওয়ার্লড
উপরে উল্লেখিত সাতটি গ্রন্থ উৎসাহীদের সামনে মেলে ধরবে এক নতুন বিশ্ব, যে বিশ্বের জ্ঞান ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠার জন্য অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। তবে এই সাতটি গ্রন্থই শেষ নয়, শুরু; এই নতুন বিশ্বকে উৎসাহী কিভাবে গ্রহন করবেন, তা তাকেই নির্ধারণ করতে হবে।
আমি, নিজের সম্পর্কে, একথা বলতে পারি যে নারী স্বাধীনতা বলতে আমি যা বুঝি তার শতকরা একশ ভাগ প্রতিফলন আমার নিজের জীবনেও নেই, আমি এখনও সে পর্যন্ত পৌছাতে পারিনি; ব্যাপারটা খুবই লজ্জার বিষয় (যার জন্য আমার কিছুটা হলেও ঘৃণা প্রাপ্য), কিন্তু সত্য। দু’কলম লিখে বাহাদুরী দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়, বরং ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠাই আমার লক্ষ্য; সুখের কথা আমি সে পথেরই পথিক। আমি নিজেকে আর মুসলমান বলে মনে করিনা, যদিও একদিন তা মনে করতাম। মুসলমান পরিবারে জন্ম হওয়ার কারণে আমাকে বাধ্য হয়ে একবার কোরআন পড়তে হয়েছে আরবীতে, কিছুই না বুঝে (পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা খুঁজে পাইনি); পরে অবশ্য আমি নিজের গরজে, এই গ্রন্থটি বেশ কয়েকবার পড়েছি বাংলা ও ইংরেজি আনুবাদে, এবং হতাশ হয়েছি। কোনো গ্রন্থ না পড়ে সেই গ্রন্থ সম্পর্কে কোন রকম মন্তব্য করা বা সেই গ্রন্থ সম্পর্কে শুধুমাত্র নিজের ধারণাকে প্রশ্রয় দেয়া আমার স্বভাবে নেই, কারণ সেটা ভন্ড ও মৌলবাদীদের স্বভাব। যেহেতু বর্তমান লেখাটি নারী ও পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ক, সেহেতু সুরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতটিকে উল্লেখ করতে চাই, যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে ‘পুরুষের অবস্থান নারীর উপরে।‘ আমি মানুষ হিসেবে এই মতের পক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পাইনি। অবশেষে একটি প্রশ্ন দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই:যদি ধরে নেয়া হয় পুরুষ নারী আপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বা পুরুষের অবস্থান নারীর উপরে, তবে নিকৃষ্ঠতম পুরুষটিও কি শ্রেষ্ঠতম নারীটি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ?
সালমান সুলতান
সান হোসে, কালিফোর্নিয়া