ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প 

শানু সর্দ্দার

 

ধর্ম সম্পর্কিত যে কোন আলোচনাই বিতর্কিত বিষয় হিসাবে পরিনত হতে পারে স্বভাবতই অনেকেই এই জাতীয় আলোচনা থেকে বিরত থাকতে চানধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, তার আগে ধর্মের ইতিহাস, প্রয়োজনিয়তা ও প্রচলিত রিতি ভিত্তিক ধর্ম আচরনের প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করা চলে নাধর্মের ব্যবহার প্রধানত দুই কারণেঃ ১) আধ্যাতিক- অজানা এক মানব শক্তির উর্ধের সৃস্টিকর্ত্তার সান্নিধ্য লাভের অভিলাষ, এবং ২) সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুশাসনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করাএই অন্তর্নিহিত  আধ্যাতিক প্রেরনায়, যুগে যুগে মহাপুরুষেরা ঘর ছেড়েছেন, সাধনা করেছেন, অজানাকে জানবার জন্য নিজেদের জীবনকে উসর্গ করেছেনএবং পরিশেষে মানুষের কল্যানের জন্যই নানা প্রকারের বাহ্যিক রিতি ও বিধিমালার নির্দেশ দিয়েছেন

 

অবশ্য, মানব জাতির ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক মঙ্গল ও শৃঙ্খলার পাশে পাশে, ধর্মের নামে হয়েছে অজস্র রক্তক্ষয়, হয়েছে গ্লানিকর লুটতরাজ আর মানবতার অপমানএর একটি প্রধান অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে ধর্ম-ভিত্তিক গোস্টিদের নিজেদের আচরিত রিতি ও বিধানকে সম্পুর্ন ভাবে অপরিবর্ত্তন যোগ্য, সর্ব্বোত্তম এবং সর্ব্ব প্রধান বলে বিবেচনা করা যুগযুগের রাজা, বাদশাহ্‌, সম্রাটরা এবং রাস্ট্রনায়করা করেছেন এই মানষিকতার চরম দুর্ব্যবহারতাদের ক্ষমতার প্রতাপ, শক্তির প্রাধান্য, বা রাজ্যের আয়তন বাড়াতে ধর্ম হয়ে গেছে এক অপরিহার্য্য হাতিয়ারতাই সাম্প্রতিক বিশ্ব-সংবাদে সদা মঙ্গলময়, শান্িতর প্রতিক না হয়ে, ধর্ম হয়ে উঠেছে এক অবর্ণনীয় অসহনশীলতার প্রতিক

 

সাধারণ মানুষের জীবনে ধর্ম এনেছে দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রামে আশার আলো আর তৃপ্তির পরিপুর্নতা নিজেদের বাচবার তাগিদে বা অজ্ঞতার কারণে, তারা চেয়েছে সবসময় তাদের জন্মগত পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতেতথা কথিত ধর্মধারকরা আচার, রিতি ও অনুশীলনীর কাঠামোতে বেধে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের জীবনসেই আচরনমালার মধ্যে যেমন ছিল উপাশনা ও সৃস্টিকর্ত্তার গুনকির্তন; তেমনি ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক  বা রাজনৈতিক প্রয়োজনে বানানো বাধা নিষেধ।  যুগযুগান্তরের ব্যবহ্রিত ধারাই তখন হয়েছে স্বাভাবিক ও মূল্যায়নের মাপকাঠি কুসংস্কার এবং কুপ্রথার এটিই একটা প্রধান কারণএর শীকার হয়েছে সাধারণ মানুষ, কিন্তু তারাই বহন করেছে এই রিতিমালার প্রবাহনসে গন্ডি থেকে বেরোবার বা প্রশ্ন করবার শক্তি, সাহস বা অধিকার অধিকাংশ মানুষেরই ছিল না

 

হাজারো বছরের ইতিহাসে দেখা যায় যে, যারা কোনো অযৌক্তিক ধর্মিয় অনুশাসন অথবা কুসংস্কারের বিরূদ্ধে রূখে দাড়াতে চেয়েছেন, তাদেরকে প্রবল ভাবে বাধা পেতে হয়েছে হয় ধর্ম প্রধান বা রাস্ট্রপ্রধানদের কাছ থেকেআর তার মাশুলও ছিল চরমএর দ্বারা শুধু এই তথাকথিত দুরবৃত্তদেরকেই শায়েস্তা করা হোতো তাই না, ভবিষ্যতে আর কারো এ রকম দুঃসাহস না হয়, তার জন্য এটা একটা নতিজা হয়ে থাকতএই  পদ্ধতির সফলতার পিছনে একটা মুখ্য কারণ সবসময় কাজ করত, সেটা হচ্ছে মানুষের অজ্ঞতা এবং মৃত্যুর পরের অজানা রহস্যএই অজ্ঞানতার অন্ধকারই ছিল, বহু ধার্মিক অনুশাসনের ভিত্তিমুল

 

বহু কুসংস্কারই এসেছে অজ্ঞতা থেকেএ অজ্ঞতাকে পুজি হিসাবে ব্যবহার করেছে অনেক ধর্ম-নায়কেরা বিজ্ঞানের আলোয় যখন এসব মিথ্যার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, তখনই ধর্মান্দ্ধরা সহিংসতার সাথে এর বাধা দিয়েছেতাই গ্যালিলও কে ভুগতে হয়েছে , পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে বলে প্রমান করায়তাই প্রথম বিজ্ঞান ভিত্তিক ডাক্তাররা পেছেন গঞ্জনাঃ যখন তারা বলেছেন অসুস্থতা আসে জীবানু থেকে, কোনো ভুত প্রেত বা ধর্মীয় অনুশাষনের অবাধ্যতার জন্য নয়এ রকম নজির ভুরি ভুরি ইতিহাসের পাতায় পাতায়আসলে, রিতি ও আচার-ভিত্তিক  (রতিুালসিতচি)  ধর্মাচরন-ই হচ্ছে ধর্ম্ম অ-নিরেপক্ষতার মুলযখনই ধর্ম্মের মূল নিবন্ধে মানুষ চিন্তা করবে, তখনই নিজেদের জ্ঞানের সীমিত পরিস্তিতিকে বুঝতে পারবে এবং তার সাথে আসে সরল সহনশীলতা

 

বাংলাদেশের লোক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর  সব ধর্মের প্রচলিত কুসংস্কার নিয়ে যুক্তি ভিত্তিক প্রশ্ন করেছেন, অনেক অযৌক্তিক আচরনের মুল কারন যে অজ্ঞানতা সেটাই বুঝিয়েছেনএবং এই মুক্তমনা মানসিকতার জন্য মৌলবাদিদের কাছ থেকে পেয়েছেন মৃত্যুর হুমকিতার একটি মুখ্য পর্য্যালোচনার ভাবার্থ দাড়ায় অনেকটা এরকমঃ

 

শৈশবে শিশুরা সম্পুর্ন  ভাবে পিতা মাতার উপর নির্ভরশীলসেটা জৈবিক আত্ম-সংরক্ষার জন্যই হোক বা প্রকিতিগত আকর্ষনের জন্যই হোক, শিশুরা পিতা মাতাকেই এক মাত্র আদর্শ বলে জেনে বড় হতে থাকেতারা একই ধরনের খাদ্য খেতে অভ্যস্ত হয়, একই ভাষায় কথা বলে, যে নির্দ্দেশ তারা বাবা মায়ের কাছ থেকে পায়, সেটাই বিনা প্রশ্নে পালন করেযে আদর্শ বা অনুশাশন শিশুরা পায়, সেটাকেই একমাত্র অমোঘ ও অপরিবর্ত্তনিয় বলে গ্রহন করেএই পর্য্যায়ে, শিশুদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান ভিত্তিক কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকে না বলেই, তারা এই নির্দেশ মালা গুলোকে সানন্দে পালন করেসময়ের সাথে তাদের অভিজ্ঞতা এবং স্বাধিন চিন্তা করবার শক্তি বাড়লে, তারা অনেক আচরনেরই যৌক্তিকতা বা নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে অথবা সেটা পরিবর্ত্তন করেএটা স্বাভাবিক ও তার পূর্ণাঙ্গতা প্রাপ্তির লক্ষনমানব সভ্যতাও এ পর্য্যায়ে তার শৈশবে রয়েছে, তার জন্য অনেক অযৌক্তিক আচরন ও নিতিমালা বিনা প্রশ্নে গৃহিত হয়কিন্তু, বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে, যুক্তি, পরিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার প্রশারে অনেক অজ্ঞানতাই দুর হয়ে গেছে এবং যাবে পরিশেষে, মানব সভ্যতা যখন পরিপুর্ন ভাবে  একটি বয়স্ক মানুষের পর্য্যায়ে পরিনত হবে তখন হয়ত ধর্মের আর প্রয়োজন হবে নামানুষ কুসংস্কার ও ধর্ম ভিত্তিক সামাজিক অত্যাচার থেকে মুক্ত হবে

 

এই আলোচনায় আরজ আলি আরো লক্ষ্য করেন যে বিজ্ঞান সব সময়ই প্রমান ভিত্তিক নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহন করেতাই এখানে আছে প্রশ্ন করবার অবকাশ, আছে নবায়ন, পরিবর্ত্তন ও সদা প্রবাহনতার সুজোগঅন্য দিকে যখনই মৌলবাদিরা ধর্মের দোহাই দিয়ে আলোচনা ও পরিবর্ত্তনকে বাধা দেন, তখনই ধর্মান্ধতার অন্ধকারকেই প্রসার করা হয়

      

সবশেষে এটাই মনে হয় যে, যারা মুক্ত মনে যুক্তিসাপক্ষে চিন্তা করতে সক্ষম, তারা ধর্মের আধ্যাতিক ও মঙ্গলময় দিকটাকেই দেখতে পাবেন এবং এটাও বুঝতে পারেন যে তাদের জানার পরিধি অত্যন্ত সীমিত, তাই তার জীবন পদ্ধতি বা চিন্তা ধারাই যে একমাত্র সত্য- তা নয়এই জ্ঞানই তাকে বাধ্য করে ধর্ম নিরপেক্ষ হতেঅপর পক্ষে, যারাই স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে অনিচ্ছুক, তারা পর্য্যায়ক্রমে স্বাধীন চিন্তায় হয়েছেন অপারগআর তার পরিনাম হচ্ছে নিজের চিন্তা বা মতবাদকে সর্ব্বোত্তম ও অপরিবর্ত্তনশীল বলে দাবি করাএই ভাবেই তৈরি হয়েছে মৌলবাদি ব্যক্তি, গোষ্ঠি, সমাজ ও রাস্ট্রসাধারণ মানুষ অসামাজিক হবার দুর্গতি থেকে বাচতে অনেক তর্কের মধ্যেই যেতে চান নাতার ফল হয়, ধর্ম কে অনেকটা মাদক দ্রব্যাশক্তির মতো ব্যবহার করা।  ধর্ম থাকবে আধ্যাতিক অনুশীলনের জন্য, মানবিক প্রশান্িত লাভের জন্য- তার অযৌক্তিক ব্যবহার ও রাস্ট্রিয় কাঠামোতে স্থান পাওয়া হবে সম্পুর্ন অবান্তর অযৌক্তিক ভাবে যেকোনো লোকাচার বা রীতি-ভিত্তিক অন্ধ বিশ্বাস প্রকৃত পক্ষে মঙ্গলকামি ধর্মের পরিপন্থি পরিশেষে বলতে হয়, মানুষের চিন্তা ধারার পুর্ন বিকাশ হলে এবং মানুষ প্রকৃতভাবে স্বাধীন চিন্তা করবার সমর্থ হলে ধর্ম নিরেপক্ষতা ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প থাকবে না

 

হিউস্টনমে ৯,২০০৮