প্রসঙ্গঃ ভাষারীতি
স্বাক্ষর শতাব্দ
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরমোন্নতি আর তার ফলস্বরূপ পাওয়া দু-দুটো মহাযুদ্ধের কল্যাণে মানুষের মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আকস্মিক আঘাত যেন মানুষকে করে দেয় শ্রেণীচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন। এতদিন শ্রেণীসংগ্রামের বিরুদ্ধে যে লড়াই ছিলো তার মধ্যে নতুন উপাদান হিসেবে যোগ হয় অস্তিত্বের শংকা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হতাশা, উদ্বেগের দ্বন্দ্ব। পুঁজিবাদ এর মধ্যে হাজির হয়ে যায় তার অজস্র পণ্য নিয়ে। সম্প্রসারণ ঘটে টেলিভিশন আর চলচ্চিত্র কেন্দ্রিক এক মহাজগতের। ঠিক যেন আরেকটা মহাবিস্ফোরণ, আরেকটা বিগ ব্যাং।
শিল্পকলা ও সাহিত্যকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা চললো। তবে প্রজন্মান্তরে এর ফলাফল রীতিমত ভয়াবহ। বিষম এই প্রতিযোগীতায় আজকে সকলেই পরিবেশনীয় কিছু সৃষ্টি করে দর্শনীয় ও নন্দনীয় হতে ছুটছে। বিচ্ছিন্নতার সুত্রকে পুঁজি করে যে জগতের বিকাশ তাতে প্রায় সবগুলি মানুষ ডুবে আছে অবিচ্ছিন্ন মোহজালে। সবার হাতে পৌঁছে গেছে এক একটি আড়শীর টুকরো যাতে সে দেখে নিজেকে আর দু-চোখে তার বাকী জগতকে। দৃষ্টির এই পার্থক্য ব্যর্থ করে দিচ্ছে মানুষের নিজস্ব উদ্ভাবনের পদ্ধতি এবং ক্রমাগত ক্ষতিসাধন করে চলেছে তার চেতনা ও বোধের উন্নতিকল্পে।
মানুষের মনন ও সৃজনশীলতার উন্নতিকে ব্যাহত করার যে প্রক্রিয়া তা আঘাত করছে ভাষারীতির স্বাভাবিক বিবর্তনকেও। স্বাধীনতার নামে হচ্ছে যাচ্ছে-তাই, বিপ্লবের নামে তৈরী হচ্ছে ফ্যাশনের বুদ্বুদ। পরিতাপের বিষয় এই কেউ ইতিহাসের দিকে চোখ তুলেও আর তাকান না। অতীতেও এইসব প্রতি-বিপ্লবী-প্রতারকদের দেখা গেছে, হয়েছে সংগ্রাম। পার্থক্য শুধু কালের ব্যাপ্তিতে। এরা আজ পেয়ে গেছে বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক পত্তন।
‘ব্রিটিশরাজ কর্তৃক বাংলাভাষার সংস্কার সম্ভব’ এরকম তত্ত্বে যারা বিশ্বাস করতেন তারা আজ বিস্মৃতির গর্ভে। গদ্যসাহিত্যে সে প্রচেষ্টাকে রহিত করা গেছে এ আমাদের সৌভাগ্য। এরপর ঘটেছে বিদ্যাসাগর কর্তৃক গদ্যরীতির বিনির্মাণ এবং উৎকর্ষ সাধন। বড় পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত আমরা শরৎ-রবীন্দ্র-বঙ্কিমের পথেই হেটেছি। প্রমথ চৌধুরীর সাফল্য আর এর পরেই হঠাৎ দেশভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা। দুই বাংলায় পৃথক ও স্বতন্ত্র ভাষারীতির চর্চা আরম্ভ হতে থাকে। পাকিস্তানবাদও আমাদেরকে টলানোর অশুভ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তবে স্বাধীনতার পর আমরা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছি অভিভাবকহীন। অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি, স্বৈরাচারী শাসনতন্ত্র, গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী রাজনীতিবিদদের এবং আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রসাদপ্রসূত পেটিবুর্জোয়াদের সাথে খলযুদ্ধে লড়তে লড়তে আমাদের সেনাপতিরাও আজ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুখ প্রায় ফিরিয়েই নিচ্ছেন। রাজনীতির সাথে যুদ্ধে তারা বিজয় পতাকা উড়িয়েই ছিলেন, বাধ সাধল অর্থনীতি।
মোহ আর মায়াজালে আবদ্ধ করে দ্রুত স্বীয় প্রাপ্তিলাভের আশায় আজ হাজির হয়েছে একদল জ্ঞানপাপী, যাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছে তথাকথিত মিডিয়া দানব। নেই তাদের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক কিংবা অন্য যেকোন ধরণের দায়বদ্ধতা। Reformation এর নামে তৈরী হচ্ছে প্রায় কলঙ্কিত এক রূপ। আশংকার বিষয় একটাই- এদের বিরুদ্ধে anti-establishment অতি-দুরহ। শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতি এতটাই দূষিত হয়ে আছে যে একে ধ্বংস করা বিপদবাহী, আবার system-এর মধ্যে থেকে কিছু করতেও আজ রুচিতে বাঁধে। তবে বাঁচতে হলে নাক চেপে ধরেই এই আবর্জনার স্তুপ সরাতে হবে, মহামারীর হাত থেকে রক্ষা প্রাপ্তি একান্ত প্রয়োজন। এক্ষণে কাম্য শুধু- যোগ্য লোকদের বোধোদয়।
[ কয়েক মাস আগে সংবাদমাধ্যমে ভাষারীতির বিবর্তন নিয়ে যে তর্কযুদ্ধ চলছিলো সে প্রসঙ্গে নিজস্ব মতামত ]
ছাত্র
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়