না বলা গল্প
তানবীরা তালুকদার
হঠাৎ করে ভীষন কাছে কোথাও বাংলায় কথা শুনে নিশি আর অয়ন দুজনেই চমকে উঠল, এতো দূরের এই দেশে এতো কাছে প্রিয় বাংলায় কথা। ওরা দুজনেই একসাথে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল ওদের খুব কাছ দিয়েই প্রিন্টেড জর্জেট শাড়ি পড়া এক ভদ্রমহিলা আর সাধারণ প্যান্ট - শার্ট পড়া এক ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে তারা বাংলায় গল্প করতে করতে হাটছেন। যে মূহুর্তে তারা নিশিদেরকে ক্রস করছিলেন, তখনই ওরা তাদের কথা শুনতে পেলো। নিশিদের পেছন দেয়া থাকায় তারা ঠিকভাবে তাদেরকে দেখতে পায়নি অথবা হয়তো দেখতে পেলেও গা করেনি। আপাত দৃষ্টিতে যুগলটাকে দেখে বেশ প্রীতই হলো অয়নরা। একেবারেই কথা বলা যায় না এমন ক্ষ্যাত টাইপ বাংলাদেশীদের মতো নয় তারা। ভদ্রমহিলার শ্যামলা গায়ের রঙ্গের উপর মোটামুটি গোলগাল মিষ্টি মুখ, একটু মুটিয়ে গেলেও মন্দ নয় দেখতে, ভদ্রলোক কালো গায়ের রঙ্গে, একটু ভুড়ি বের করা সুখী সুখী চেহারার। দেশের খোলা প্রান্তর থেকে বিদেশের খাচায় এসে আটকে পড়া নিশি বাংলায় কথা শুনে, এবং নিশির কারণে অয়নও আগ্রহী হয়ে ছুটে গেলো আলাপ করতে তাদের সাথে। যেয়ে দেখল ওরাও স্বামী - স্ত্রী দুজন অয়নদেরই মতো ওস্টএন্ডের সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেছে। তবে অয়নরা এসেছে বেশ কিছুটা দূর থেকে আর তারা এই ওস্টএন্ডের কাছেই নামুর শহরে থাকে। ইউরোপের এই পাশটাতে বাঙ্গালী কিংবা বাংলাদেশী এতো কম যে সমমনা লোক পেয়ে আলাপ জমে উঠতে খুব বেশী সময় লাগলো না। আর এতো বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত নয়, এখানে ঝিনুকের মালা কেনা নিয়ে পীড়াপীড়ি করার জন্য নেই কোন সদ্য ফোটা কিশোর মলিন মুখ, নেই ঝালমুড়ি কিংবা বুট-বাদামওয়ালাদের উৎপাত। অখন্ড অবসরে বিনা বাধায় গল্প চালিয়ে যাও তীর বেগে, কে বাধ সাধছে। গল্পে গল্পে জানা গেলো তারা দুজন বেশ কিছুদিন আছেন এখানে, নিশি অয়নদের মতো সদ্য বিবাহিত কিংবা সদ্য বাংলাদেশ থেকে আগত দম্পত্তি নয়, বয়সেও তারা বেশ কিছূটা বড়ই ওদের থেকে। সমুদ্রতীর থেকে একটু দূরে ক্যাফে রেস্তোরা আছে, সেখানে সমুদ্রের তাজা মাছ ভাজা, ফিশ এন্ড চিপস, চা কফি যার যা ইচ্ছে খেতে পারো। ক্যাফেতে বসে কফি খেতে খেতে প্রচুর গল্প হতে লাগল, দু পক্ষই কথার জোয়ারে ভেসে যেতে লাগল। নিশি আর অয়নের সেদিন ওস্টএন্ডর সমুদ্র দেখা শেষ করে লেক আর ব্রীজের জন্য বিখ্যাত শহর ব্রুজ দেখতে যাওয়ার কথা কিন্তু গল্পে আর আলাপে সে পরিকল্পনা প্রায় ভেস্তে যাওয়ার জোগার। নিশি অয়নকে গোপনে চিমটি কেটে একটু তাড়া দিলো, ওদের যাবার কথা শুনেই ফারুক ভাই আর কলি ভাবী ভীষন চেপে ধরলেন তাদের সাথে তাদের বাসায় যেতে। কিন্তু নিশি এতোদিন বিদেশে এসেছে, সেভাবে কোথাও অয়নের সাথে বেড়াতে যেতে পারেনি বলে, সেদিন ও অয়নের সাথেই একা ঘুরতে চাইছিলো যদিও আড্ডা সেও খুব উপভোগ করছিল। অয়ন নিশির মনের ভাব বুঝতে পেরে ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা কাটিয়ে দিয়ে ঠিকানা এবং টেলিফোন নাম্বার আদান - প্রদান করে উঠে পড়ার যোগার করলো। সদ্য সদ্য ছ মাসের বিয়ে করা তাজা বউ এর মনের বিপক্ষে যায় এমন সাধ্য খুব কম ছেলেরই হয়তো আছে। তারউপর নিশির অনেক পীড়াপিড়িতে, অয়ন অনেক ডেট ঘুরিয়ে তারপর নিশিকে নিয়ে আজ বাইরে বেরিয়েছে। নিশির প্ল্যানের মতো ঘোরা না হলে বউযে আর বাড়ি নিয়ে অয়নকে আস্ত রাখবে না, সে কথা অয়ন অন্তত ভালোভাবেই জানে। আর কিছু না পারুক কেদে কেটে না খেয়ে থাকতেতো পারবে বউ।
সেদিন কলি ভাবী আর ফারুক ভাইদের বাসায় না বেড়াতে গেলেও তারপরে ফোনে আলাপ জমে উঠতে সময় লাগল না। আলাপে ছেলেদের ভূমিকা খুব কমই ছিল। আলাপ চলছিল সপ্তাহে দু / তিন বার করে সাউথ নেদারল্যান্ডস আর প্রায় সাউথ বেলজিয়ামের দুই শহরের, দুই প্রান্তের, দুই ফ্ল্যাটের মধ্যে। সদ্য দেশ থেকে আসা আনাড়ি নিশি, রান্না - বান্নার, কি ঘর - কন্নার কোন অভিজ্ঞতাই যার নেই, সে তার চেয়ে অভিজ্ঞ এবং মোটামুটি পারদর্শী কারো সাহচর্য পেয়ে একেবারে বর্তে গেলো। তখন কার্ড ফোনের এতো রমরমা ছিল না, ডাইরেক্ট লাইনে লং ডিসটেনস কল নিশিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তার হুশ হলো মাস শেষে টেলিফোন বিল পেয়ে যখন অয়ন আর্ত চিৎকার করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার পর। তবুও নিশির মন পাখি হয়ে রইলো এই আনন্দে সুপার মার্কেটে, ডাচ ভাষায় বানান করে সে সুজি কিনে আনতে পেরেছে এবং সূরা - কালাম, আয়াতুল কুরসী পড়ার কষ্ট এবং টেনশান ছাড়াই সহজে ফোন কানে নিয়ে তা দিয়ে হালুয়া বানিয়ে ফেলছে কিংবা বেগুন পুড়িয়ে ভর্তা করে ফেলছে। আগের মতো টেনশান নিয়ে রেধে অয়ন আসার আগে আগেই লুকিয়ে সেই কুখাদ্য রান্না আর গারবেজে ফেলে দিতে হচ্ছে না। এ গর্ব কি কম? অয়নের নাক ব্যকা আর দেখতে হচ্ছে না? যা হোক নিশির ভীষন আগ্রহে, অয়নরা এবার প্রথম পরিচয়ের প্রায় এক দেড়মাস পরে কলি ভাবিদের বাসায় নামুর বেড়াতে যাচ্ছে। নিশির আনন্দের আর আগ্রহের সীমা নেই। অবশেষে মনের মতো কাউকে বন্ধু পাওয়া গেলো, হোক না বয়সে বড় কিংবা একটু বেশী মেয়েলীপনায় ভর্তি, তাতে কি একটু ভালো করে গল্পতো করা যায়, আশে পাশের বাঙ্গালী মহিলাগুলোর সাথেতো শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার সুখটাই নেই। যাই হোক, এটা সেটা সব ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে, ঠিকানানুযায়ী ম্যাপ প্রিন্ট করে নিয়ে পুরো উইকএন্ড কাটানোর আনন্দময় পরিকল্পনায় বিভোর নিশি, আর তার পাশে অয়ন চলল শুক্রবার রাতে নামুরের পথে। গাড়িতে জোরে বেজে চলছে অয়নের পছন্দের নজরুল গীতি, আলগা করোগো খোপার বাধন - - - - । ডিসেম্বরের অন্ধকার শীতে নেদারল্যান্ডসের ফç্যাটে এসে বন্দী হওয়া নিশি এই মধ্য এপ্রিলের সূর্য ওঠা আকাশ আর ভোরের ধান ক্ষেতে লেগে থাকার মতো মিষ্টি রোদ পেয়ে যেন ডানায় ভর করে উড়ছিলো। প্রায় আড়াই ঘন্টা ড্রাইভ করে, সামান্য খোজাখুজি করে রাত প্রায় সাড়ে নটার দিকে নামুরে কলি ভাবীদের ফç্যাটের বেল টিপল অয়ন আর নিশি। ওদের দেখে হৈ হৈ করে উঠল কলি ভাবী আর ফারুক ভাই। লম্বা ড্রাইভ আর সারাদিনের কাজের ক্লান্িত ভুলে চলল বেদম আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া, রাত প্রায় দুটো - তিনটের দিকে ঘুমাতে গেলো ওরা। পরদিন সকালে বেশ দেরী করেই ঘুম থেকে উঠল সবাই, এরপর নাস্তা টাস্তা খেয়ে সবাই একসাথে ‘নামুর’ শহরটা ঘুরতে বেরোল। ‘নামুর’ বেশ সুন্দর পাহাড়ী শহর। সুন্দর সিটি সেন্টার, লেক, ক্যাথিড্র্যাল আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অতুলনীয়। ইউরোপের মোটামুটি সব জায়গাই শীতের তান্ডব শেষ হওয়ার পর গাঢ়ো সবুজের চাদর গায়ে পড়ে নেয়, সে সবুজ চাদরের গা জুড়ে আছে নানা রঙ্গের ছোট ছোট বুটি তোলা ফুল। যতদূরে চোখ যায় জুড়িয়ে যায়। পাহাড়ের উপরে পরিস্কার নীল আকাশ, আকাশের গা ফুরে দিয়ে একে বেকে চলে যাওয়া সাদা মেঘের ভেলা, চার পাশে নানা রঙ্গের ফুলের বাহারী পশরা। এখানে সেখানে পাহাড়ের গা থেকে ঝরে পড়ছে ঠান্ডা পাহাড়ি ঝরনা। চারধার নিস্তব্ধ, ঝরনার ঝিরঝির শব্দ আর দু চারটা পাখির ডাক ছাড়া কোন শব্দ নেই কোথাও। সারাদিন শহরে ঘুরে প্রাণভরে সে সৌর্ন্দয চোখে, বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে কি করা যায়, কি করা যায় এই সন্ধ্যায় সে আলোচনা করছিল, কাপড় - চোপড় ছেড়ে, ঘরের জামা - কাপড় পরে সবাই বেশ আয়েশী মন নিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ তখন ঠিক হলো চারজনে মিলে তাস খেলা হোক।
সাথে সাথে সবাই হৈ হৈ করে বসে পড়ল তাস নিয়ে। ছোট গোল ডাইনিং টেবল ঘিরে বসে পড়ল চারজন নিজেরাও গোল হয়ে। নিশির একপাশে অয়ন আর একপাশে কলি ভাবী, উলটো পাশে ফারুক ভাই । খেলা চলছে খুব দ্রুত গতিতে, কল ব্রীজ। চার / পাচ মাস আগে বাংলাদেশ থেকে আসা নিশির কাছে এই সপ্তাহান্তটাকে স্বপ্নের মতো লাগছে। যৌথ পরিবারে অনেক দিন থাকা নিশি নেদারল্যান্ডসের একা সংসারের একা ফ্ল্যাটে বড্ড হাপিয়ে উঠেছিল। মনের আনন্দে বাকবাকুম নিশি কলব্রীজে সমস্ত মনোযোগ ঢুকিয়ে খেলছিল। হঠাৎ ফারুক ভাইয়ের পায়ে যেনো নিশির পা লেগে গেলো। নিশি তাড়াতাড়ি তার পা সরিয়ে নিল হন্তদন্ত হয়ে, মুখে ‘সরি’ বলল। নিশি এটাকে নেহাত দুর্ঘটনা ভেবে আবার খেলছিল। ভাবল ছোট টেবল সবাই এতো কাছে কাছে বসা তাই হয়তো পায়ে পা লেগে গেছে। কিন্তু একটু পর আবার ফারুক ভাইয়ের পায়ের সাথে নিশির পা লেগে গেলো। এবারও নিশি ‘সরি’বলল আর পা অনেক দূর সরিয়ে নিয়ে বেশ সাবধান হয়ে বসল। খেলা, গল্প, আড্ডা, হাসি, চা - কফি চলছিল ধুমসে। প্রায় পনর মিনিট পর আবার ফারুক ভাইয়ের পা, আস্তে আস্তে এসে নিশির পা কে ছুলো। নিশির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হঠাৎ তারস্বরে বেজে উঠল। মনে হলো এ শুধুই নিছক দুর্ঘটনা নয়। নিশি পা এমনভাবে এমন জায়গায় সরিয়ে রেখে সজাগ হয়ে বসেছিল যে হঠাৎ পায়ে পা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা এবার খুবই ক্ষীন ছিল। যাহোক এবার নিশি আর এতো দ্রুত পা সরিয়ে নিল না। কিন্তু তাসের দিকে চোখ রেখেই তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মেয়েদের যে ঘাড়ে দুটো চোখ থাকে সেই চোখ দিয়ে ফারুক ভাইকে ভিতরে বাইরে ফালা ফালা করে দেখার চেষ্টা করছিল নিশি। কিন্তু একি দেখছে নিশি!!! ফারুক ভাই চূড়ান্ত স্বাভাবিকভাবে অয়নের সাথে খোশ গল্প করছেন, মাঝে মাঝে তার বউয়ের সাথে খুনসুটি করছেন। কোন বিকার নেই তার। নিশি এবার আর পা সরিয়ে না নেয়াতে, ফারুক ভাই কি বুঝলেন জানি না, কিন্তু নিশির মনে হলো তার আর্কন বিস্তৃত ভালোমানুষরীর হাসি যেনো আরো দিগন্ত বিস্তৃত হলো। তার পা নিশির পায়ের পাতা ছাড়িয়ে এখন পায়ের আঙ্গুলে এসে পৌছে নানারকম ঢং এর জলতরঙ্গ খেলা শুরু করেছে। নিশি হঠাৎ বোবা হয়ে গেলো, কয়েক মূহুর্তের জন্য। কি করবে ভেবে পেলো না। এখানেও এই!!! এই যে কলি ভাবী আর ফারুক ভাইয়ের সুখী সংসারের ছবি নিশি এতোক্ষন দেখছিলো তা হঠাৎ ফাকা আর অসার লাগলো নিশির চোখে। মনে হলো এর সবই মেকী, ঘর সাজানো আর সংসার সাজানো এক কথা নয়। রাগে অপমানে হঠাৎ নিশির মাথাটা ঝা ঝা করতে লাগল। আজীবন ঝট করে রেগে যেয়ে কড়া কিছু বলে ফেলা স্বভাবের নিশি তারপরও অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরন করে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আপনি আপনার পা দিয়ে বারবার আমার পায়ে ধাক্কা দিচ্ছেন কেনো’? ফারুক ভাই আর যাই আশা করে থাকুন সেই মুর্হুতে এই ধাক্কা তিনি নিশির কাছ থেকে আশা করেননি। একটু ধরা পরা অস্বস্তির গলায় ‘সরি’ ‘সরি’ বলে তিনি আপাতত উনার পা সরিয়ে নিলেন। নিশি অগ্নি দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকালো, দুঃখে কষ্টে নিশির চোখে পানি এসে গেলো, রাগে অপমানে পাগল পাগল লাগছে তখন। সব রাগ যেয়ে সে সময়টা অয়নের উপরই পড়ল। অয়ন তখন একমনে তাস সাফল করে যাচ্ছে, কারো দিকেই তাকাচ্ছে না, এমন ভাব তার, এ পৃথিবীতে কি হচ্ছে তাতে অয়নের অন্তত সে মুর্হুতে কিছু যায় আসে না। তার চেয়ে অনেক বেশী অবাক হলো নিশি কলি ভাবীর প্রতিক্রিয়া দেখে, ভাবীর মুখে একটি রেখাও পড়ল না, হাসিটার রংও একটু বদলালো না। এটা যেনো খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তিনি আগের মতোই গল্প, হাসি চালিয়ে যাচ্ছেন। নিশি হঠাৎ সব ভদ্রতা ত্যাগ করে তাসের টেবল থেকে উঠে পড়ল, ক্লান্িত আর মাথা ব্যাথার অজুহাত দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো।
এই বেড়ানো হাসি গল্প তখন সব অসহ্য লাগতে শুরু করল। বাড়ি ফেরার জন্য, একটি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নিশি ব্যাকুল হয়ে পড়ল। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে অয়নের অপেক্ষা করতে লাগল, কখন অয়ন আসবে ঘরে আর ওরা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবে। আর এক মুহুর্ত এই নোংরা লোকের বাড়িতে নয়। নিশির গায়ে এক ধরনের ঘিনঘিন ভাব লাগতে লাগল। এ ঘর থেকে ওঘরের টুকটাক কথা এবং হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো। অয়ন কেনো আসছেনা আরো রেগে যাচ্ছিলো নিশি। খোলা জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিলো, কিন্তু এই নিঝুম রাতে আকাশটাকে নীল কম কালোই বেশী লাগছিলো। কালো আকাশের ক্যানভাসে জ্বলে থাকা তারা গুলোকে হাজার বুটি শাড়ির বুটির মতো মনে হচ্ছিলো। শুয়ে শুয়ে নিশি এলোমেলো অনেক কথা ভেবে যাচ্ছিলো। দেশ থেকে এতো দূরে এতো উন্নত সুন্দর পরিবেশে থেকেও কেনো মানুষগুলো পরিবর্তন হয় না। কি হলে তাহলে লোকে বদলাবে ? হঠাৎ নিজের অজান্েতই তার অতীতের সেই ক্লাশ নাইনের ক্লাশ রুমে হারিয়ে গেলো। প্রায় পঞ্চাশটির মতো ছাত্রী ছিলো তারা, তৃতীয় পিরিয়ডে ইংরেজী ক্লাশ নিতে আসতেন বকশী বাবু স্যার। দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ হওয়া মাত্র সব বান্ধবীদের মধ্যে একটা ধাক্কাধাক্কি পড়ে যেতো কে দেয়ালের পাশে যেয়ে বসবে, স্যার এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এতো গরম ঢাকাতে, পঞ্চাশটা মেয়ের জন্য মাত্র তিনটে ফ্যান ঘুরছে, টিম টিম গতিতে, বেশীর ভাগ সময় হয়তো লোডশেডিং কিন্তু তাতেও কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই তাদের সে সময়ে। গরমে মরে যাই যাই কিন্তু শরীরে কারো কোন অনাকানখিত স্পর্শ চাই না। স্যার ক্লাশে ঘুরে ঘুরে পড়াতেন। ভাবটা এমন যেনো সব্বাইকে সমান এ্যাটেনশন দিচ্ছেন। হ্যা, তা দিচ্ছেন বটে, তবে এই আন্তরিক এ্যাটেনশনের কারণে সব মেয়েরা অস্থির হয়ে থাকতো। কোনদিন স্যারের সুনজরে অথর্যাৎ কুনজরে কে পরে যায়। পড়াতে পড়াতে ঘুরতে ঘুরতে যেকোন একটা টেবিল স্যার পছন্দ করে ফেলবেন, এক এক দিন এক একটা, মেয়েদের বসার যে বেঞ্চি তাতে, মেয়েদের গায়ের বিশেষ অংশের সাথে লাগিয়ে পা তুলে রাখবেন সারাক্ষন আর পড়াতে পড়াতে মেয়েদের খাতা চেক করার অজুহাতে, মেয়েদের পিঠে হাত দিবেন। কতো আন্তরিক তার ভঙ্গী, কি রে এট কি লিখেছিস, এটাতো এটা হবে না, সবই বলছেন বটে তবে পিঠের বিশেষ জায়গায় হাত রেখে আর এতো ভুলো মন যেনো স্যারের পিঠ থেকে হাততো নামাতে ভুলে যেতেনই, বরং হাত পিঠে স্যারের অজান্েতই যেনো নানা ভাবে এ্যাকটিভ হতো। ক্লাশের অনেকেই রাগে ফুসতো, স্যারকে নানাভাবে অসন্েতাষ জানানোর চেষ্টা করতো। স্যার মেয়েদের অসন্েতাষ টের পেয়ে কেমন যেনো মজা পেয়ে অßান বদনে ফিক ফিক করে হাসতেন। তাই সবার মধ্যে আমাদের প্রতিযোগিতা থাকতো কে কতো দেয়ালের পাশে সরে বসতে পারে, স্যার এর নাগালের থেকে দূরে আরো দূরে। চতুর্থ পিরিয়ডের পর টিফিনের ব্রেক, তখন আমরা মোটামুটি পঞ্চাশখানা মেয়েই একযোগ হয়ে স্যারের বউ এর কাছে কখনো কিংবা হেড মিসট্রেস ম্যাডামের কাছে স্যার এর কুকির্তীর বিরবন দিয়ে চিঠি লিখতাম। স্যার এর ইমমোরালিটি ও পানিশমেন্টের বিস্তারিত ব্যাখা থাকতো আমাদের তরফ থেকে, আমাদের সাজেশান সহ। কিন্তু কোন অজানা কারণে সে চিঠি গুলো কোনদিনও পোষ্ট করা হয়নি। অজানা লজ্জা, ভীরুতা সে বয়সটাকে কাবু করে রাখে মেয়েদের। হয়তো সদ্য কিশোরী বয়সের শারীরিক পরিবর্তনগুলোও এর একট বড় কারণ। পর্দা প্রথার কারণে ঢাকো ঢাকো লজ্জা লজ্জা জিনিসটা সে বয়সে এতো শুনতে হয় যে মেয়েদের, দ্বিধায় পড়ে যায় মেয়েরা কি করা আর কি বলা উচিত আর উচিত না সেটা নিয়ে। প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত ঘরেই মেয়েদের সব সহ্য করে, মুখ এটে, মাটির দিকে তাকিয়ে চলা শেখানো হয়। নিশি ভাবছিলো সেই নিশি মাত্র পাচ / ছয় বছরের পার্থক্যে এতো শক্তি কোথা থেকে অর্জন করলো যে মুখের উপর ফারুক ভাইকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেলতে পারলো? এধরনের ঘটনাা জীবনে প্রথম ঘটল তাতো না। অসংখ্যবার এই অনাকানখিত ছোয়ার সাক্ষী আছে
বাথরুমের আয়নাটা, যেটার সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে নিশি কেদেছে অসংখ্য বার, ব্যর্থ রাগে কষ্টে। যেকোন দুঃখেই বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, জোরে সব গুলো কল ছেড়ে দিয়ে তোয়ালেতে মুখ ঢুকিয়ে ফুপিয়ে কাদা নিশির অভ্যাস, তাতে অন্য কেউ শব্দ শুনতে পাবে না। অসংখ্য বার গরমের অজুহাতে গোসল করে করে অনাকাঙ্খিত সব স্পর্শ জল ধারা দিয়ে মিটিয়ে দিতে চেয়েছে। যে মা এতো বন্ধু, তাকে না বলে এমন কোন গোপন কথা নেই, সে মাকেও চেষ্টা করে অনেক সময় অনেক কিছু বলতে পারেনি।
শুয়ে শুয়ে এমনি আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যেনো একটু তন্দ্রামতো এসে গেলো। হঠাৎ কোন শব্দে চোখ মেলে নিশি দেখল অয়ন বিছানায় এসে বসেছে নিশির কাছে। নিশি সমস্ত ঘটনা অয়নকে বলল যদিও অয়ন নিজেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো কিন্তু অয়ন কিছুতেই এ ব্যাপারটা সামনে আনতে চাচ্ছিলো না। অয়নের কথা যা হবার হয়ে গেছে, কালকের দিনটাইতো কোন রকমে পার করে দিয়ে হাসি খুশী ভদ্রতা বজিয়ে রেখে আমরা চলে যাবো। এক্ষুনি এক্ষুনি চলে যাওয়া ভালো দেখায় না, এটা সামাজিক ভদ্রতাতে পরে না। তারচেয়েও বড় কথা ওরা এখানে অনেকদিন আছেন, আমরা মাত্র মাত্র এসেছি, এ ধরনের কোন কিছু কেউ জানলে অকারনে নিশিরই বদনাম হবে। কেউতো আর নিশিকে চেনে না। কি দরকার অহেতুক ঝামেলা বাড়িয়ে। কিন্তু অবুঝ নিশির একই গো চলো এক্ষুনি চলো, এখানে আর এক মুহুর্ত না। অয়নের বোঝানোকে নিশি আরোই উলটো করে দেখতে লাগল। কেনো অয়ন ওদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে, কেনো অয়ন যেয়ে ফারুক ভাইকে ডেকে তার এই নোংরা আচরনের কথা জিজ্ঞেস করছে না, কিছু বলছে না। এ সমস্ত তর্ক বিতর্কে অনেক সময় চলে গেলো। যে রাত আদর, সোহাগ, আর প্রেমে কাটার কথা ছিল সে রাত কাটল কান্নায়, অভিমানে, ঝগড়ায়। অয়ন কিছুতেই এটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলো না আর নিশি অবুঝের মতো তা নিয়ে অয়নের সাথে যুঝেই যাচ্ছিলো। অয়ন বারবার বলছিলো যা বলার তুমিতো বলেছই এবং যথেষ্ট ভালোই বলেছো, এর চেয়ে বেশী কিছু আর বলার দরলার নেই, অয়নের এতে জড়ানো ঠিক হবে না, নিশিতো একা হ্যান্ডেল করেছেই ব্যাপারটা। আর নিশির কথা হলো তুমি আমার স্বামী, আমার দ্বায়িত্ব তোমারও, তুমি কি করে এমন একটা বড় ব্যাপার এড়িয়ে যেতে পারো? তোমার সামনেই তোমার বউকে এতো বড়ো অপমান আর তুমি বলছো তোমার জড়ানো উচিৎ নয় ?!?! অয়ন কিছুটা নিশিকে বুঝতে পারলেও নিশি পুরোপুরিই অয়নের ভিউ বুঝতে অপারগ সে সময়ে। সদ্য একুশে পা দেয়া নিশির মনে তখনও ইউনিভার্সিটির রেশ পুরোদমে। বন্ধুদের সাথে ভার্সিটির মাঠে বসে, টি।এস।টিতে বসে পৃথিবীকে বদলে দেয়ার, হেন কারেঙ্গা, তেন কারেঙ্গার ঝাঝ তখনও সারা চোখ জুড়ে। নিশির কান্নাকাটি আর অবুঝপনায় অয়ন শেষ পর্যন্ত বলল ঠিক আছে, আমি অফিসের কাজ আছে বলে কাল ব্রেকফাষ্ট করেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দিব, সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা থাকবো না। তুমি আমি দুজনেই সাবধানে থাকবো, আর যেনো এধরনের কিছু না ঘটে। এরমধ্যে নিশিকে একটু খোচা দিতেও ভুললনা অয়ন, এখানে আসার জন্যতো ব্যস্ত ছিলে তুমিই, আমিতো আসতে বলিনি। আসতেও দেরী নেই আবার চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হতেও দেরী নেই। আরো নানা রকমের মিষ্টি ভালো কথা বলে সাত / আট মাসের নব পরিনীতা স্ত্রীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করল অয়ন, এরপর ওরা ঘুমোতে গেলো একসাথে।
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই রওয়ানা দেবে ভেবে রাখলেও দেখা গেলো অনেক রাতে শুয়েছে বলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই বেলা বারোটায় গড়িয়ে গেলো। তারপর নাস্তা টাস্তা সেরে ওরা রওয়ানা
দেবার তোড়জোড় করতেই কলি ভাবী একদম তেড়ে মেড়ে আসলেন। উনি আজকে ওদের জন্য মাছ রাধবেন, সব রেডী না খেয়ে ওরা কিছুতেই আসতে পারবে না। থাক অফিসের কাজ, রাতে যেয়ে করলেই হবে ইত্যাদি নানা অজুহাত। এরমধ্যেই অয়ন কাউকে ফোন করেছিলো, অয়নের কথা শেষ হওয়ার পর তারা নিশিকে চাইলো। নিশি গেলো করিডোরে ফোন ধরতে। নিশি হয়তো খুব জোর কথা বললে ফোনে আট থেকে দশ মিনিট কথা বলেছে, সেই আট - দশ মিনিটে দেখা গেলো ফারুক ভাইয়ের রান্না ঘরে ভীষন কাজ পড়ে গেছে। তিনি সেই অপ্রশস্থ করিডোর দিয়ে নিশির গায়ের সাথে গা ঘেষিয়ে ঘেষিয়ে বার বার রান্না ঘর আর তার বেডরুম করে যাচ্ছেন। সমস্ত বাড়িতে আর কোন কাজ নেই, সব কাজ সেই আধো অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোরে সে সময়। নিশির মনে সে সময় আরো ক্র• প্রতিক্রিয়া হলো। ভাবলো এভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না, কিছু একটা সাজা তাকে পেতেই হবে। যে ভাবা সে কাজ। মনে মনে পরিকল্পনা এটে নিশি ফোন ছেড়ে রান্নায় সাহায্য করার উছিলায় রান্না ঘরে যেয়ে দরজা ভিজিয়ে দিয়ে কলি ভাবীর সাথে গল্প আরম্ভ করে দিলো। এ কথা সে কথা, এ গল্প সে গল্পের বাহানা করে নিশি বারেই বারেই ফারুক ভাইয়ের এই ছ্যাচড়া স্বভাবের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিলো কলি ভাবীকে কিন্তু তিনি নির্বিকার। কলি ভাবী কিছুই যেনো গায়ে মাখছেন না, তিনি কিছুই বুঝতে চাইছেন না। তখন নিশির কেনো যেনো মনে হলো কলি ভাবী আসলে তার স্বামীর এ স্বভাবের কথা জানেন। মেয়েরাই সবচেয়ে প্রথম তাদের স্বামীর দুর্বলতা টের পায়। নিশির কাছে কেমন যেনো এ অঙ্কটা গোলমেলে ঠেকলো তখন। বাস্তব বুদ্ধি ছাড়া শুধু বই পড়া নিশির জ্ঞানের ও অসাধ্য এরকম কিছু ভাবা যে সব জেনে শুনেই কলি ভাবী ফারুক ভাইয়ের সাথে আছে এবং আপাত দৃষ্টিতে ধরতে গেলে যাকে বলে একপ্রকার সুখেই জীবন যাপন করছেন। এধরনের মেনে নেয়ার ঘটনা শুধু বাংলাদেশের যেসব মেয়েদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাদের বেলাই চলে বলে নিশির ধারণা ছিল, এই প্রথম বিশ্বে যেখানে মেয়েদেরকে রক্ষা করার জন্য অনেক অনেক আইন আছে। টাকা পয়সা দেয়ার জন্য সরকার আছেন, আইনের আশ্রয় নিতে পয়সাতো লাগবেই না, উপরন্তু সমস্ত ভরন - পোষনের দ্বায়িত্ব সরকারের। চাকুরী খুজে দেয়ার স্কুলিং থেকে শুরু করে অসুখ বিসুখ সব সরকার দেখবে তাহলে কেনো একটা সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়ে একটা দুশ্চরিত্রের সাথে পড়ে থাকবে তা নিশির বোধগম্য হলো না।
পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা সবোর্পরি বিশ্বাসই যে সর্ম্পকের ভিত্তি সেটাই যদি না থাকলো তাহলে এই ইমারত দাড়িয়ে আছে কিসের উপড়ে?
আসার পথে গাড়িতে নিশি বেশ চুপচাপ বসে অনেক কথাই ভাবছিলো। নিজের দেশ, পর দেশ, কাছের চেনা মানুষ - অচেনা দূরের মানুষ সবাই তার ভাবনার বস্তু ছিল। বোকা নিশি জানতো না যে এসব ঘটনা শুধু দেশের সংবাদপত্রেই ঘটে না। আশে পাশে বহু ঘটে যাচ্ছে হরদম শুধু মা বা বাড়ির গার্জেনরা সবসময় সব আড়াল করে রাখতো বলে সেভাবে দেখার বা বোঝার দৃষ্টি তখনও তৈরী হয় নি। এখন এই পরদেশে আড়াল করার আর কেউ নেই, তাই দেখার জীবনের সবে শুরু। এই ঘটনাগুলো আস্তে আস্তে ছোটবেলার গল্প শুনে কল্পনা করা দৈত্যকে সরিয়ে বাস্তবের মানুষের কুৎসিতরুপটা দেখাবে। আজীবন নিশির ধারণা ছিল মেয়েদেরকে অপমান করার এ ধরনের ঘটনা শুধু পাড়ার বখাটেরাই ঘটায় যা পরে সংবাদপত্রে আসে। পুরো দস্তুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী পকেটস্থ করা, বাহ্যিক চেহারায় বা বিশেষনে যাকে পুরো ভদ্রলোক বলে ধরা হয় সে ধরনের কেউ এ দৃষ্টিতে অন্যের বউকে দেখতে পারেন বা এধরনের ব্যবহার করতে পারেন তা নিশির কল্পনার দূর দূরান্তেও ছিল না। সদ্য একুশে পা রাখা নিশি অবশ্যও তখনও জানতো না ভদ্রতার আড়ালে এ অভদ্র খেলার সবেতো শুরু। সমস্ত ধরনের নোংরার নোংরামোও ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে ‘মজা করা’ শব্দের অতি আধুনিকতার তলায় তলিয়ে যেতে পারে। সে ঘটনার পর অনেক অনেক দিন কেটে গেছে। সমুদ্রের অনেক লোনা ঢেউ অনেক বালিকে তার স্থানচ্যুত করিয়ে দিয়েছে। আকাশ তার বুকে থাকা অনেক মেঘকে বৃষ্টি করে ঝরিয়ে দিয়েছে। এক সময়ের ভাত রাধা নিয়ে টেনশনে থাকা নিশিও আজকাল ভাত ছাড়িয়ে পোলাও রান্না শিখে গেছে। অনেক কিছু একা জানালার পাশে বসে নিজের মনে বিশ্লেষন করার জগৎ তৈরী হয়েছে। আজকাল অনেক কিছু দেখে একা নিজের মনেই হাসে সে। যেকোন পার্টিতে ড্রিঙ্কসের পর দু একজন কিছু না কিছু কান্ড ঘটাবেই। সে সব কান্ডের মধ্যে অতি প্রচলিত হলো মাতালের ভান করে অন্যের বউকে জড়িয়ে ধরা বা অন্যের সুন্দরী বউকে বিরক্ত করা। পরেতো ড্রিঙ্কসের অজুহার আছেই, তাতে যতো অপমানিতই কেউ অনুভব করুক সেটাকে মিটিয়ে না ফেলে এবং মিটিয়ে ফেলাকে উপলক্ষ্য করে আবার ডিনারে না ডেকে ভদ্র সমাজেতো রক্ষা নেই। ড্রিঙ্কসের অজুহাতের মাফ মিলবে না সেটাতো হতেই পারে না। সেটা মোটামুটি গ্রহনযোগ্য প্রতিষ্ঠিত সত্য আজকের সমাজে। কিন্তু নিশি ভাবে মাতালই যদি কেউ হয়ে যায়, হুশই যদি না থাকে তাহলে আজ পর্যন্ত কোন ছেলে কোন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে না কেনো? সেটুকু হুশতো তাদের ঠিকই থাকে। আর জড়িয়ে ধরবেতো শুধু তাদেরকেই জড়িয়ে ধরবে যাদের উপর অনেকদিন থেকে চোখ থাকে, আকর্ষনীয়, সুন্দরী - স্মার্ট কাউকে। দেখতে শুনতে সাদা মাটা, আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ বাংলায় যাকে ‘ক্ষ্যাত’ বলে সে ধরনের মেয়েকে কেউ জড়িয়ে ধরে না কিংবা নিজের বউকেও জড়িয়ে ধরে না। মাতাল হয়ে যে সাধারণ ‘সেন্স’ হারিয়ে ফেলে তার উপর এই অসাধারণ ‘সেন্স’ কোথা থেকে এসে ভর করে কে জানে। মাতাল হয়ে দেখা যায় চুমু খাচ্ছে কিন্তু চড় মারছে না। আজব লাগে ভাবলে। মাতাল হওয়ার পর যতোগুলো কাজ করে সব মাতালের নিজের পক্ষে যায়, তাহলে মাতাল থাকাই ভালো, সজ্ঞানে থাকাই বরং অসুবিধাজনক, লোককে কৈফিয়ত দিতে হয় নিজের কাজের। এসব কান্ডের থেকেও ভালো লাগে সে সব ঘটনা ঘটানো মাতাল নায়কদের লক্ষ্মী পয়মন্ত স্ত্রীদের ব্যাখা। কি অগাধ ভক্তি বিশ্বাস তাদের স্বামীর উপর। আমার স্বামী একদমই শিশুর মতো, সে কিছুই বুঝে না, তার মনে কোন পাপ নেই, এমনিতেই নিস্পাপ ভাবে চুমু খেয়ে নেয় কিংবা জড়িয়ে ধরে, সে কিছুই ‘মীন’ করে না। এসব গল্প বলে কি লোককে
বোঝাতে চায় না নিজেকে বোঝায় কে জানে? এসব কথা যখন বউদের মুখে শুনে তখন অকারনেই কলি ভাবীর মুখটা নিশির মনের আঙ্গিনার উকি দিয়ে মিলিয়ে যায়। মনে হয় ফিরে এসে আর সেভাবে নিশি তার সাথে যোগাযোগ রাখেনি, সেটা হয়তো অন্তত কলি ভাবীর উপর কিছুটা অন্যায় হয়েছে। ফারুক ভাইয়ের রাগ কলি ভাবীর উপরও অনেকটাই গড়িয়ে ছিল নিশির মনে মনে। তখন ফারুক ভাইয়ের দুস্কর্মের জন্য কলি ভাবিকেও সে মনে মনে দায়ী করেছিল। আজকালতো নিশি দিব্বি অন্য সবার সাথে হাসি মুখে সামাজিকতা চালিয়ে যায় তাহলে তখন কেনো অতো রাগ হয়ে গেছিল সেটার ব্যাখা আজ আর নিশির জানা নেই কিংবা নিশি আজকাল আর মন খুলে হয়তো নিজেকে হাতড়ে পাতড়ে সব ব্যাখা জানতেও চায় না। মাঝে মাঝে মনের ঘোড়াটা দুলকি চালে যে কিছু বলে যায় না তা নয়। ঘোড়াটা আস্তে বলেও যায় সংসার অনভিজ্ঞতাই তখন হয়তো মুর্খের মতো নিশিকে কলি ভাবীর প্রতি এতো অকুরন করে তুলেছিলো। তবে ঘোড়াটাকে নিশি বেশী সামনে আসতে দিতে চায় না, ভেবে নেয় জীবনের অসংখ্য ভুলভ্রান্তির সাথে করেছে কিছু অন্যায় নিশ্চয়ই কারো কারো সাথে কি হবে সে সব মনে করে আর দুঃখ পেয়ে, তার চেয়ে এই বেশ আছে - - --
গল্পের ঘটনা ও চরিত্রগুলো কল্পনাপ্রসূত। বাস্তবের কারো সাথে মিলে যাওয়া নিতান্তই দুর্ঘটনা।
তানবীরা তালুকদার
০৩।০১।০৮