বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
বিবর্তন তত্ত্বের কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ নেই
১) ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের প্রভাব আজ এতোই বেশি যে এটি আজ কেবল জীববিজ্ঞানের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি প্রভাবিত করেছে বিজ্ঞানের বহু শাখাকে। এমনকি ডারউইনীয় বিবর্তনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে বিজ্ঞানের নতুন শাখাও। আর বিবর্তন তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের তো কোন শেষ নেই।
বিবর্তনবাদ না বুঝলে ওষুধ কোম্পানিগুলো ভাইরাস প্রতিরোধক কোন ওষুধই তৈরি করতে পারতো না। বিবর্তনীয় চিকিৎসাবিদ্যা (evolutionary medicine) বা ডারউইনীয় চিকিৎসাবিদ্যা (Darwinian medicine) ক্রমশঃ চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটা প্রধান শাখা হয়ে উঠছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিবর্তন পাঠের প্রয়োজনীয়তা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে আবশ্যিক কোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান। আমেরিকার কোষ জীববিদ Carlo Maley তার গবেষনায় দেখিয়েছেন কিভাবে স্থান এবং সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে দেহে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যান্সার সেলের বিবর্তন ঘটে। শুধু তাই নয়, ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো ঔষধের প্রতিক্রিয়া থেকে কিভাবে রেজিস্টেন্ট হয়ে উঠছে সেটাও স্পষ্ট হয়ে উঠে এ ধরনের গবেষণায়। আবার বিবর্তন চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকেই ডারউইনীয় নির্বাচন স্ট্রেটেজী থেকে কিভাবে সমাধান পাওয়া যায়, তার উপায়ও বাৎলে দিয়েছেন জীববিজ্ঞানী গ্রেগ উইন্টার ১৫।
বিবর্তন তত্ত্ব প্রাণীদের ভেতরকার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য, জীবাশ্ম, জৈবভূগোল, মাদক প্রতিরোধক্ষমতা, যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে ময়ূরের পুচ্ছের বৃদ্ধি, পরজীবীদের শক্তিমত্তা এবং আরও অনেক কিছুকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। বিবর্তন তত্ত্ব ছাড়াও জীববিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে, কিন্তু বোঝা যাবে না।
১) এ ছাড়াও বিবর্তন তত্ত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে।১, ২ যেমন:-
· ক) জৈব তথ্যবিজ্ঞানের মত বিলিয়ন ডলারের শিল্প গড়ে উঠেছে যার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বিভিন্ন প্রজাতির জিনের অনুক্রমের তুলনা করা। এই কর্মের পেছনের অন্যতম মৌলিক অনুসিদ্ধান্ত হল ডারউইনের Descent with modification বা পরিবর্তনসহ উত্তরাধিকার।
· খ) জীবাণু ও কীট-পতঙ্গীকটা সময় পরে আমাদের ব্যবহৃত ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে, এটা আমাদের জানা কথা। ওষুধশাস্ত্র এবং কৃষিবিজ্ঞানে এই প্রতিরোধক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিবর্তন তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়।২ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগলে আমরা ডাক্তারকে টেট্রাসাইক্লোন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করতে থাকি। ইনফ্লুয়েনজা বা ঠান্ডার কারণ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া নয়; আর অ্যান্টিবায়োটিক শুধুমাত্র ব্যকেটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এর কোন ভুমিকাই নেই। ফ্লু বা ঠান্ডার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক তো কোন কাজে লাগেই না, বরং আমাদের শরীরের ভিতরের দুর্বল ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলে শক্তিশালী কিছু ব্যাকটেরিয়াকে জিইয়ে রাখতে সহায়তা করে। তারপর ক্রমশঃ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি অনেক বেশী প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এই ব্যাকটেরিয়াগুলো আমাদের শরীরে বংশবৃদ্ধি করে এবং ভবিষ্যতে অসুস্থ হলে আরও কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া কোন কাজ হয় না। বাংলাদেশের অনেক ডাক্তারই যে কোন অসুখের চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয়ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক এবং একাধিক ওষুধ দিয়ে থাকেন। যেনো ভাবটা হচ্ছে, একটা না একটা ওষুধ তো কাজ করবেই। কিন্তু এর ফলে রোগীর শরীরে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ভবিষ্যতে রোগ সারানোর জন্য অনেক কড়া ওষুধের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, আমাদের শরীরে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে ওষুধের উপর নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাকটেরিয়ার বিবর্তন মাইক্রো-বিবর্তনের উদাহরণ। Staphylococcus aureus নামের ব্যাকটেরিয়াটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ভ্যাক্সোমাইসিন-এর বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। বিবর্তন তত্ত্ব ছাড়া আমরা এটি ব্যাখ্যা করতে পারতাম না।
· গ) মৎস্যচাষে উচ্চ ফলনের জন্য সাফল্যের সাথে বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানো হয়।৩
· ঘ) কৃত্রিম নির্বাচন অনাদিকাল থেকেই ব্যবহার করা হয়ে আসছে। উচ্চফলনশীল ধান, বেশি দুধ প্রদানে সক্ষম গাভী, ছোট বড় নানা জাতের কুকুর এবং কবুতরের বিভিন্ন প্রজাতি মানুষের দ্বারা তৈরি কৃত্রিম নির্বাচনেরই ফল। বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার প্রান্তিক কৃষক হরিপদ কাপালি সম্প্রতি কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমেই তৈরি করেছেন একটি নতুন প্রজাতির ধান - হরিধান১৭। মাত্রাগত স্থানীয় প্রলক্ষণ জরিপনের (quantitative trait locus mapping) কারণে এই প্রক্রিয়াটির কার্যকারিতা এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
· ঙ) জনগোষ্ঠীতে পরজীবিদের শক্তিমত্তার বিবর্তন সম্পর্কে জ্ঞান একটি কার্যকরী জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়নে সাহায্য করবে।৪
· চ) লিঙ্গ বন্টন তত্ত্ব, যার ভিত্তি বিবর্তন তত্ত্ব, ব্যবহার করে বিলুপ্তপ্রায় kakapo পাখি কোন পরিবেশে অধিকতর স্ত্রী সন্তান প্রসব করবে তা নির্ধারণ করা গিয়েছিল, এর ফলে এই পাখিটিকে অবধারিত বিলুপ্তির দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে।৫
· ছ) আমরা সিকেল সেল এনিমিয়ার উদাহরণ অনেকেই জানি। ‘সিকেল সেল এনিমিয়া’ নামের একধরণের ত্রুটিপূর্ণ হিমগ্লোবিনজনিত রোগ আফ্রিকার ম্যালেরিয়া-প্রবণ অঞ্চলে টিকে আছে কারণ, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সিকেল সেল এনিমিয়ার রোগীরা সুস্থ কোষের চেয়ে একটু বেশি ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে সক্ষম। আফ্রিকার যে অঞ্চলগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেসমস্ত জায়গাগুলোতেই সিকেল সেল এনিমিয়ার রোগী অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। কোন একসময় মিউটেশনের ফলশ্রুতিতে আফ্রিকাবাসীদের মধ্যে এই বিকৃত রোগের উৎসের জিনটা ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম মেনে দেখা গেলো, যে অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশী সেখানে সিকেল সেল এনেমিয়ার একটা জিন ধারণকারী লোকের টিকে থাকার ক্ষমতাও বেড়ে যাচ্ছে, কারণ হিমোগ্লোবিনের এই রোগ বহনকারী জিন ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধে বেশী কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারছে। অন্যদিকে যাদের মধ্যে দু'টিই সুস্থ জিন রয়েছে তারা ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে অনেক বেশী হারে। সেজন্যই প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম মেনে এখানে এই ত্রুটিপূর্ণ জিনবহনকারী মানুষগুলোই শেষ পর্যন্ত ম্যালেরিয়া রোগের চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে বেশীদিন টিকে থাকতে পারছে এবং বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে। এই টিকে থাকার দায়েই শত শত প্রজন্ম পরে দেখা গেলো আফ্রিকাবাসীদের একটা বিশাল অংশের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে বিকৃত সিকেল সেল এনেমিয়ার জিন। বিবর্তনের মাথায় কিন্তু সিকেল সেল এনিমিয়াকে রক্ষা করার কোন পরিকল্পনা আগে থেকে ছিলো না। এটা স্রেফ টিকে গেছে আফ্রিকায় ম্যালেরিয়ার উপদ্রবের কারণেই। বিবর্তনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো না জানলে বিজ্ঞানীদের পক্ষে ব্যাপারটার রহস্যভেদ করা সম্ভবপর ছিলো না।
· জ) বিবর্তনের হাইজিন হাইপোথিসিস বলতে পারে কেন পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে (যেমন, অতিরিক্ত কৃত্রিম রাসায়নিকদ্রব্য এবং সুগন্ধী ব্যবহার করে) আমরা ধীরে ধীরে ইমিউনিটিকে কমিয়ে ফেলেছি - ফলে আধুনিক বিশ্বে লোকজন ভাইরাস- ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
· ঝ) একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে বাংলাদেশ ভারত প্রভৃতি গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে রান্না বান্নায় অনাদিকাল থেকেই প্রচুর মশলা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু শীতপ্রধান দেশগুলোতে রান্না বান্নায় মশলার ব্যবহার কম। এর কারণ, হল- গরম দেশে ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে খাদ্য সহজেই পঁচে যায়। মানুষ তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আসলে খাবারে আমাদের মশলাগুলো আমাদের দেহকে পঁচা খোঁজা খাবারের বিষ্ক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। আসলে রোগ প্রতিরোধ করতেই এই কৌশলের আশ্রয় নেয়া। এ ব্যাপারটিকে বলা হয়, ডারউইনীয় গ্যাস্ট্রোনমি।
· ঞ) হোক্স জিন, প্যাক্স ৬ জিন সংক্রান্ত এভো ডেভোর সাম্প্রতিক গবেষণা অন্ধত্ব নির্মূল সহ বহু জটিল রোগের চিকিৎসায় আশার আলো দেখাচ্ছে। স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা ক্লাউদিয়া ক্যাস্টিলোর মত মৃত্যুপথযাত্রী রোগিদের বাঁচিয়ে তুলছে। এগুলো প্রকারন্তরে বিবর্তন তত্ত্বেরই পরোক্ষ প্রয়োগ। এ ছাড়া প্রতিদিনই কিভাবে বিবর্তনের তত্ত্বের নানা ধরণের সফল ব্যবহার হচ্ছে জীববিদ্যা, ভূগোলবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, অংগ সংস্থানবিদ্যা, তুলনামূলক শরীরসংস্থানবিদ্যা, বাস্তুসংস্থানবিদ্যা, বংশগতিবিদ্যা, কোষবংশগতিবিদ্যা, প্রাণরসায়ন, আনবিক জীববিদ্যা থেকে শুরু করে অপরাধী সনাক্তকরণেও, তা জানার জন্য পড়া যেতে পারে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় প্রকাশিত ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমী অব সায়েন্সের ডীন দেভিড মিন্ডেলের Evolution in the Everyday World (২০০৯) প্রবন্ধটি।
২) বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের অনেক উপাদান বিজ্ঞানের অন্য অঙ্গনেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন,
· ক) পরিসংখ্যানের অনেক কৌশল, যেমন প্রকারণ এবং রৈখিক পশ্চাদগমন, রোনাল্ড ফিশার এবং কার্ল পিয়ারসনের মত বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানিদের দ্বারাই উদ্ভাবিত হয়েছিল।
· খ) জীববিজ্ঞানের জন্য প্রণীত জাতিজনি (phylogeny) বিশ্লেষণের কৌশল ব্যবহার করে একই পান্ডুলিপির একাধিক অনুলিপির ইতিহাস অনুসন্ধান করা সম্ভব।৬ ভাষার ইতিহাসও এভাবে বের নির্ণয় করা যায়।৭
· গ) ডারউইনীয় বিবর্তনবাদের প্রয়োগে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে মনোবিজ্ঞানের এক নতুন শাখা - বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান (Evolutionary Psychology)। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মুলতঃ বিজ্ঞানের দুটো চিরায়ত শাখাকে একীভুত করেছে; একটি হচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান (evolutionary biology) এবং অন্যটি বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান (Cognitive Psychology)। সামাজিক বিভিন্ন প্যাটার্নের সাফল্যজনক ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে এই শাখাটির সাহায্যে। বিজ্ঞানীদের অনেকেই আজ বলছেন, ডারউইনীয় মডেলকে গোনায় ধরে কাজ শুরু করায় বিবর্তনীয় মনোবিদ্যা হয়ে উঠেছে মনোবিজ্ঞানকে বিশ্লেষণের প্রথম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান – “Evolutionary Psychology is the first natural science of psychology”।১৬
· ঘ) জিনোম ইভলুশন, মলিকিউলার এবং সেলুলার ইভলুশন, বিবর্তনীয় চিকিৎসাবিদ্যা, ডারউইনীয় গ্যাস্ট্রোনমি, এমনকি সোশিওবায়োলজি, কালচারাল ইভলুশন (মীম তত্ত্ব) - সামাজিক বিজ্ঞানগুলোতেও ডারউইনবাদের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটছে। দর্শনে আছে ইভলুশনারী এপিস্টমলজি কিংবা লিঙ্গুইস্টিকে আছে ম্যানুস্ট্রিপ্ট ইভলুশন ইত্যাদি। এমনকি পদার্থবিজ্ঞানেও ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ব্যবহার শুরু হয়েছে। পদার্থবিদ লি স্মোলিন মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য ডারউইনের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং গড়ে তুলেছেন 'কসমোলজিকাল ন্যাচারাল সিলেকশন' তত্ত্ব।১৫, ১৬
ঙ) প্রাকৃতিক নির্বাচন, প্রকারণ এবং সমন্বীকরণের (genetic recombination) মত বিবর্তনীয় নীতিগুলো হল জেনেটিক আলগরিদমের ভিত্তি। এই আলগরিদম মহাকাশ প্রকৌশল, স্থাপত্যবিদ্যা, জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা, তড়িৎ প্রকৌশল, হিসাব ও ব্যবস্থাপনাবিদ্যা, ভূপদার্থবিদ্যা, সমরকৌশল, নকশা শনাক্তকরণ, রোবোটিক্স সহ বিভিন্ন অঙ্গনে ব্যবহৃত হচ্ছে।৮
৩) নির্দেশিত বিবর্তনের মাধ্যমে অণুর 'বৃদ্ধি' ত্বরান্বিত করে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা অথবা বিরাজমান কোন বস্তুর মানোন্নয়ন করা সম্ভব, যেমন:
· জৈব প্রভাবক বা এনজাইম৯
· রঞ্জক পদার্থ৯
· জীবাণু-নাশক
· জৈবপলিমার
· বিপদজনক দ্রব্যাদি বিয়োজিত (decompose) করার জন্য ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেইন তৈরি
৪) জাতিজনির বিশ্লেষণ বহু জায়গায় উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে, যেমন -
· ক) পরিচিত জিনের সাথে অপিরিচিত জিনের তুলনা করে অপরিচিত জিনের কাজ আন্দাজ করা সম্ভব, এটি নতুন ওষুধ উদ্ভাবনে খুবই সহায়ক১০, ১১
· খ) জাতিজনির বিশ্লেষণ এপিডেমিওলজির খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ কারণ এটি রোগের উৎস ও রোগটির ছড়িয়ে পড়ার প্রত্যেকটি পর্যায় অনুসরণ করতে পারে। উদাহরণস্বরুপ, জাতিজনির বিশ্লেষণ নিশ্চিত করেছিল যে ফ্লোরিডার এক দন্তচিকিৎসক তাঁর রোগীদেরকে এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত করছিলেন, যে এইচআইভি ১ ও ২ শিম্পাঞ্জী ও mangabey বানর দ্বারা বিংশ শতকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।২ ২০০২ সালে এই জাতিজনি বিশ্লেষণ ব্যবহার করে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যার বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল।১২ একই পদ্ধতি ব্যবহার করে জীবাণুঅস্ত্র খুজে বের করা সম্ভব।১৩
· এই পদ্ধতি দিয়ে রোগবহনকারী জীবাণুর বৈচিত্র্য নির্ণয় করে একটি বিশেষ অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত টিকা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।১৪
৫) বিবর্তনের এতো ধরণের ব্যবহারিক প্রয়োগ না থাকলেও কোন সমস্যা ছিলো না। জ্যোতির্বিদ্যা, ভূবিদ্যা, জীবাশ্মবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক ইতিহাসের মত অনেক বিজ্ঞানেরই ব্যবহারিক প্রয়োগ খুবই কম। জ্ঞানপিপাষুদের কাছে বিশুদ্ধ জ্ঞানই যথেষ্ট। বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক এবং সামাজিক অভিব্যক্তি এতোই বিশাল যে সেটার চর্চাও হতে পারে বিদ্যানুরাগীদের জন্য মহার্ঘ্য বস্তু।
৬) বিবর্তনবিরোধী ধারণাগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ছড়িয়ে রয়েছে কোন ধরণের ব্যবহারিক প্রয়োগ ছাড়াই।
তথ্যসূত্র:-
১) Futuyma, D. J. 1995. The uses of evolutionary biology. Science 267: 41-42.
২) Bull, J. J. and H. A. Wichman. 2001. Applied evolution. Annual Review of Ecology and Systematics 32: 183-217.
৩) Conover, D. O. and S. B. Munch. 2002. Sustaining fisheries yields over evolutionary time scales. Science 297: 94-96. See also pp. 31-32
৪) Galvani, Alison P. 2003. Epidemiology meets evolutionary ecology. Trends in Ecology and Evolution 18(3): 132-139
৫) Sutherland, William J., 2002. Science, sex and the kakapo. Nature 419: 265-266
৬) Barbrook, Adrian C., Christopher J. Howe, Norman Blake, and Peter Robinson, 1998. The phylogeny of The Canterbury Tales. Nature 394: 839
৭) Dunn, M., A. Terrill, G. Reesink, R. A. Foley and S. C. Levinson. 2005. Structural phylogenetics and the reconstruction of ancient language history. Science 309: 2072-2075. See also: Gray, Russell. 2005. Pushing the time barrier in the quest for language roots. Science 309: 2007-2008
৮) Marczyk, Adam. 2004. Genetic algorithms and evolutionary computation. http://www.talkorigins.org/faqs/genalg/genalg.html
৯) Arnold, Frances H. 2001. Combinatorial and computational challenges for biocatalyst design. Nature 409: 253-257.
১০) Branca, Malorye. 2002. Sorting the microbes from the trees. Bio-IT Bulletin, Apr. 07. http://www.bio-itworld.com/news/040702_report186.html
১১) Eisen, J. and M. Wu. 2002. Phylogenetic analysis and gene functional predictions: Phylogenomics in action. Theoretical Population Biology 61: 481-487
১২) Vogel, Gretchen. 1998. HIV strain analysis debuts in murder trial. Science 282: 851-852
১৩) Cummings, C. A. and D. A. Relman. 2002. Microbial forensics-- "cross-examining pathogens". Science 296: 1976-1979
১৪) Gaschen, B. et al.. 2002. Diversity considerations in HIV-1 vaccine selection. Science 296: 2354-2360
১৫) Mark Pallen, The Rough Guide to Evolution, Rough Guides, 2009
১৬) বন্যা আহমেদ, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডারউইন, কালস্রোত, দৈনিক সমকাল, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১০
১৭) হরিপদ কাপালি, এ ধানই আমার সন্তান, কালের কন্ঠ, ২০১০; হরিধানের স্রষ্টা হরিপদ কাপালি, জনবিজ্ঞান, সংখ্যা ৩, ২০০৯