বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
বিবর্তন-প্রক্রিয়ার ফলে প্রাণীকুল প্রতিনিয়তই উন্নত হচ্ছে
১) অনেকেই বিবর্তন বলতে মনে করেন জীবজগতের 'ক্রমউন্নতি'। ব্যাপারটি একেবারেই ঠিক নয়। এর কারণ হচ্ছে, বিবর্তন কখনো সরল রেখায় ঘটে না, বিবর্তন ঘটে ঝোপঝাড়ের মতো আঁকাবাঁকা পথে[1] কিংবা উপরের ডানদিকের ছবিতে দেখানো গাছের শাখা-প্রশাখার মতো। একটি ঝোপের কিংবা গাছের শাখা-প্রশাখা বিভিন্ন দিকে তিন মাত্রাতেই বৃদ্ধি পেতে পারে, এবং নতুন শাখা পুরনো শাখার কাছের গুঁড়ি হতে অধিক দূরবর্তী কোন গুঁড়ি সৃষ্টি হতে পারে। একটি সদ্য নতুন গজানো শাখা পুরানো কোনো শাখা হতে যেমনি বেরিয়ে আসতে পারে, তেমনি বিভিন্ন প্রজাতি প্রাচীন কোন প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু তা কোনো অগ্রগতি বা উন্নতি নির্দেশ করে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
২) বিবর্তনকে অনেকেই খুব ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করেন ‘নীচু থেকে উঁচু স্তরে গমনের কোন সিঁড়ি’ হিসেবে। বিবর্তনের সিঁড়ি ধারণার মূলে রয়েছে প্রাচীন গ্রিক এবং মধ্যযুগীয় ইউরোপের বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে ‘গ্রেট চেইন’-এর ভ্রান্ত ধারণার প্রভাব। গ্রেট চেইন-এর এই ধারণাটি মোটেই বিবর্তনকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়নি। ঐ সময় বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর বহু বছর আগে প্রত্যেক জীবকে একেবারে নিখুঁতরূপে আধুনিক গঠনে সৃষ্টি করেছেন[2]। গ্রেট চেইনকে বর্ণনা করা যায় শ্রেণীবিন্যাসের একটি প্রাচীন পদ্ধতি হিসেবে এবং ডারউইনিয় বিপ্লবের আগেই এটি জনসমর্থন হারাতে থাকে। পরবর্তীতে ডারউইনের তত্ত্ব ও এর পরিমার্জিত রূপ গ্রেট চেইনকে বাতিল করে দেয়। আধুনিক জীববিজ্ঞানে বিবর্তন প্রকৃতির ঊর্ধ্বমুখী উদ্দেশ্যের পানে কোনো অগ্রগামিতাকে নির্দেশ করে না।
৩) গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের ডারউইনের ফিঙ্গে পাখি (Finch) গুলোর উদাহরণগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক। ডিএনএ নিয়ে পেটার্ন পরিচালিত একটি গবেষণায় অত্যন্ত চমৎকারভাবে জানা গেছে, ‘কেন অগ্রগামিতা বা উন্নতির ধারণা বিবর্তনের সাথে মেলে না।’[3] গবেষণার ফলাফল হতে দেখা যায়, প্রথম যে ফিঙ্গে পাখিগুলো (ওয়ার্বলার ফিঙ্গে) এই দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলো, তীক্ষ ঠোঁট তাদেরকে ভাল পতঙ্গভূক বানিয়েছিলো। ওয়ার্বলার ফিঙ্গে থেকে পরে কিছু সংখ্যক ফিঙ্গে পাখি বিবর্তিত হয়েছিলো, যাদের মধ্যে একটি হল Geospiza ভূমি ফিঙ্গে, তাদের বড় ও প্রশস্ত ঠোঁট বীজ ভাঙার উপযুক্ত; আরেকটি Camarhynchus গেছো ফিঙ্গে পাখি, তাদের ভোঁতা ঠোঁট গাছ-গাছড়া খাওয়ার জন্য খুব ভালভাবেই অভিযোজিত হয়েছে।
যদিও এই বীজ খেকো, গাছ খেকো ফিঙ্গে পাখিগুলো পতঙ্গভূক ফিঙ্গে পাখিগুলো থেকেই বিবর্তিত হয়েছে কিন্তু কোন বিবর্তনের সিঁড়ি অনুসারে পূর্বসূরিরা উত্তরসূরি অপেক্ষা উন্নত বা উচ্চশ্রেণীর নয়। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে ফিঙ্গে পাখিদের বিবর্তন প্রাথমিকভাবে খাদ্যসংস্থানের উপর ভিত্তি করে তাড়িত হয়েছে; যেমন ভূমির ফিঙ্গে পাখিরা বীজ, গাছের ফিঙ্গে পাখিরা গাছের বাকল এবং ওয়ার্বলার ফিঙ্গে পাখিরা পতঙ্গের উপর নির্ভরশীল। যদি গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে কোন কারণে বীজের সংকট দেখা দিত, তবে বীজভূক ফিঙ্গে পাখিরা এই দ্বীপপুঞ্জ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেত আর প্রাচীন পতঙ্গভূক ফিঙ্গে প্রজাতির পাখিরা আরো ভালোভাবে টিকে থাকত। অর্থাৎ গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের ফিঙ্গে পাখির বৈচিত্র বিশ্লেষণ করে সহজেই বোঝা যায় যে, ‘উঁচু’-‘নীচু’ ধারণাটি জৈববিবর্তনের সাথে মোটেই সম্পর্কিত নয়। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বা অভিযোজন-ই বিবর্তনের প্রধানতম চাবিকাঠি।
৪) বিবর্তন কোন ক্রমউন্নতিমূলক প্রক্রিয়া নয় বলে সকল জীবেই বহু ত্রুটিপূর্ণ অংগ-প্রত্যঙ্গ দেখা যায়। প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন সুদক্ষ কারিগর না হওয়ায় বিবর্তন কোন নিখুঁত ডিজাইনের ফল নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচন যেহেতু শুধুমাত্র বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হয়, তাই খুব যুক্তিসঙ্গত কারণেই প্রাণীদেহে অনেক ত্রুটিপূর্ণ অঙ্গপ্রতঙ্গ দেখা যায়, দেখা যায় জীবনযাত্রায়ও নানা ত্রুটি। সামুদ্রিক কচ্ছপের কথা ধরা যাক। এদের পাখনা সাঁতার কাটতে যতটা সুবিধাজনক, বালি খোঁড়ার কাজে ততটা নয়। অথচ, ডিম পাড়ার জন্য তাদেরকে এই কষ্টকর কাজটা বালিতে এসেই করতে হয়। কিন্তু কাজটা খুব একটা ভালোভাবে করা যায় না,উপযুক্ত পাখনার অভাবে। ডিমগুলো ভালোভাবে ঢাকা যায় না, খাবার হয়ে যায় অন্যান্য প্রাণীর সহজেই[4]। আবার, আমাদের তথাকথিত 'উন্নত' মানুষ প্রজাতির চোখের দৃষ্টান্তও বিবেচনা করা যেতে পারে। আমাদের চোখ কিন্তু সবচেয়ে নিখুঁত, সেরা প্রত্যঙ্গ নয়। অনেক 'অনুন্নত' প্রাণীর চোখ আমাদের চোখের চেয়ে বেশি ‘উন্নত’। এদের অনেকেই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে অনেক বেশি দূরের জিনিষ দেখতে পায়। যেমন, রাতের অন্ধকারেও বেড়াল আমাদের চেয়ে ভালো দেখতে পায়। ঘোড়া আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দূর দেখতে পারে। মানুষের চোখে অক্ষিপটের ঠিক সামনে এই স্নায়ুগুলো জালের মত ছড়ানো থাকে বলে একটি অন্ধবিন্দুর (blind spot) সৃষ্টি হয়। অক্টোপাস বা স্কুইড জাতীয় প্রাণীর চোখ বিবর্তিত হয়েছে তাদের চামড়ার অংশ থেকে, মস্তিষ্কের অংশ থেকে নয়। এক্ষেত্রে ত্বকের স্নায়ুগুলো মস্তিষ্কের মত ঠিক বাইরের স্তরে না থেকে ভিতরের স্তরে সাজানো থাকে, আর এ কারণেই স্নায়ুগুলো মলাষ্কের চোখের অক্ষিপটের সামনে নয় বরং পিছনেই রয়ে গেছে। ফলে তাদের ক্ষেত্রে কোন ব্লাইন্ড স্পট বা অন্ধবিন্দু তৈরি হয়নি[5]।
৫) বিবর্তনকে ‘মই বেয়ে উপরে উঠা’ ভাবলে ভুল হবে, বরং বিবর্তন অনেকটা ট্রেডমিলে দৌড়ানোর সাথে তুলনীয়[6]। ‘উন্নতি’ হবে কি হবে না সে নিয়ে আসলে বিবর্তনের কোন মাথা ব্যাথা নেই, বিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি হল বংশাণুর প্রতিলিপিকরণ ও সঞ্চালন, এবং তার ভিত্তিতেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় কে টিকে থাকবে কে বিলুপ্ত হবে আর কে অপরিবর্তিতই থেকে যাবে। তাই অনেক প্রজাতির যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি আবার অনেক প্রজাতি কোটি কোটি বছর ধরে একই রকম রয়ে গেছে, সেটাও বিরল নয়। যেমন, কিছু শৈবাল এবং ছত্রাক, এমন কি কিছু হাঙ্গরজাতীয় প্রাণীর মধ্যে কোটি কোটি বছর পার হয়ে গেলেও তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি। তাদের অগ্রগতির মই বেয়ে ওপরে ওঠার কোন ‘প্রয়োজন’ হয় নি। কারণ ‘উন্নত’ না হয়েই তারা দিব্যি বেঁচে থাকতে এবং বংশবিস্তার করতে পারছে। তেলাপোকার মত প্রানী দীর্ঘদিন কোন ‘উন্নতি’ না করেই প্রকৃতিতে টিকে আছে, আর ডায়নোসারের মত অতিকায় প্রানী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই ‘উন্নতি’ হতেই হবে -সেটা কেউ দিব্যি দিয়ে বলে যায় নি।
[1] বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮), পৃষ্ঠা ৩৯
[2] চার্লস সুল্লিভান ও ক্যামেরন ম্যাকফেরসন স্মিথ, বিবর্তন নিয়ে চারটি ভ্রান্ত ধারণা (অনুবাদ : অভীক দাস), যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০০৩
[3] Petren, K., B.R. Grant, and P.R. Grant. 1999. A Phylogeny of Darwin’s finches based on microsatellite DNA length variation. Proceedings of the Royal Society of London B266: 321-329.
[4] Coyne, J. Why Evolution is True, Viking, 2009, p.12.
[6] Matt Ridley, The Red Queen: Sex and the Evolution of Human Nature, Harper Perennial, 2003