বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
চোখের মত জটিল অঙ্গ বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে না
১) এটি একটি অজ্ঞতাপ্রসুতযুক্তি[1] । কোন কিছু জটিল ‘মনে হওয়ার’ মানে এই নয় যে বিবর্তনের ক্রমধারারায় এটি তৈরি হতে পারবে না ।
২) ক্রমবর্ধমান নির্বাচন বা ‘কিউমুলেটিভ সিলেকশন’ এর মাধ্যমে ধাপে ধাপে জটিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যে উদ্ভুত হতে পারে, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত[2]।
৩) আজকে আমরা চোখের যে পূর্নাংগ গঠন দেখে বিস্মিত হই, তা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি, বরং বহুকাল ধরে ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকা ছোট ছোট পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে[3]। আলোর প্রতি সংবেদনশীল একধরনের স্নায়বিক কোষ থেকে প্রথম চোখের বিকাশ শুরু হয়। তারপর হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হতে হতে আজকে তারা এই রূপ গ্রহন করেছে। কতগুলো সংবেদনশীল কোষকে কাপের মত অবতলে যদি ঠিকমতভাবে সাজানো যায় তাহলে যে নতুন একটি আদি-চোখের উদ্ভব হয় তার পক্ষে আলোর দিক নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে উঠে। এখন যদি কাপটির ধারগুলো কোনভাবে বন্ধ করা যায়, তা হলে আধুনিক পিন হোল ক্যামেরার মতো চোখের উৎপত্তি ঘটবে। তারপরে এক সময় গতি নির্ধারণ করতে পারে এমন একটি অক্ষিপট বা রঙ বুঝতে পারে এমন কোনের মতো অংশ বিকাশ লাভ করে, তা হলে উন্নত একটি চোখের সৃষ্টি হবে। এরপর যদি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইরিস ডায়াফ্রামের উৎপত্তি ঘটে তা হলে চোখের ভেতরে কতখানি আলো ঢুকবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এরপর আস্তে আস্তে যদি লেন্সের উদ্ভব ঘটে তা তাকে আলোর সমন্বয় এবং ফোকাস করতে সহায়তা করবে, আর এর ফলে চোখের উপযোগিতা আরো বাড়বে। এভাবেই দর্শন উপযোগী চোখের উদ্ভব ঘটেছে[4]।
৪) সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে উপযোগিতা নির্ধারণ করে চোখের ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা এখনও আমাদের চারপাশে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বিভিন্ন ধাপের চোখের অস্তিত্ব দেখতে পাই, অনেক আদিম প্রাণীর মধ্যে এখনও বিভিন্ন রকমের এবং স্তরের আদি-চোখের অস্তিত্ব দেখা যায়[5]।
ছবি: প্রকৃতিতে পাওয়া বিভিন্ন ধরণের চোখ- খুব সরল ধরণের চোখ থেকে শুরু করে জটিল চোখের অস্তিত্ব এই প্রকৃতিতেই আছে, আর তা সবই তৈরি হয়েছে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়
৫) কিছু এককোষী জীবে একটা আলোক-সংবেদনশীল জায়গা আছে যা দিয়ে সে আলোর দিক সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা করতে পারে, আবার কিছু কৃমির মধ্যে এই আলোক-সংবেদনশীল কোষগুলি একটি ছোট অবতল কাপের মধ্যে বসানো থাকে যা দিয়ে সে আরেকটু ভালোভাবে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। সমতলের উপর বসানো নামমাত্র আলোক সংবেদনশীলতা থেকে শুরু করে পিনহোল ক্যামেরা সদৃশ চোখ কিংবা মেরুদন্ডী প্রাণীদের অত্যন্ত উন্নত চোখ পর্যন্ত সব ধাপের চোখই দেখা যায় আমাদের চারপাশে (অন্ধ গুহা মাছ মেক্সিকান টেট্রা থেকে শুরু করে সালামানদরে, নটিলাস, প্লানারিয়াম, অ্যান্টার্কটিক ক্রিল, মৌমাছি, মানুষের চোখ ইত্যাদি), এবং তা দিয়েই বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বিবর্তন প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে না ঘটলে আমরা প্রকৃতিতে এত বিভিন্ন ধরণের চোখের অস্তিত্ব পেতাম না।
৬) শরীরবৃত্তিয় এবং বংশগতীয় গবেষণা থেকে চোখের বিবর্তনের চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। PAX6 gene নামের জেনেটিক টুলকিটের সাহায্যে ফ্রুটফ্লাই থেকে শুরু করে মানুষের চোখের নিয়ন্ত্রক জিন খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে[6],[7]। এ ছাড়া মেরুদন্ডি প্রাণির জন্য βγ-crystallin জিন যা লেন্স তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন সংশ্লেষণ করে, তার সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা যা Ciona βγ-crystallin জিনের সমরূপ। Ciona দের বলা হয় সাগর সুইর্ট বা urochordate, যারা মেরুদণ্ডী প্রানীদেরই নিকটাত্মীয়। Ciona র একক জিন আলোর প্রতি সংবেদনশীল অসেলাসের (otolith) মধ্যে প্রকাশিত হয়ে পিগমেন্টের প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি করে। কাজেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, পুর্ববর্তী লেন্সবিহীন প্রজাতির চোখ থেকে পরবর্তীকালের লেন্স তৈরি হয়েছে বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে[8]।
৬) সুইডিশ অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন এবং পেলগার তাদের গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, আদি সমতল পিগমেন্টেড আলোক সংবেদনশীল সেল থেকে শুরু করে প্রায় ২০০০ ধাপের মধ্যে পরবর্তীতে মানুষের চোখের মতো জটিল যন্ত্রে পরিবর্তিত হতে পারে[9]।
ছবি: অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন এবং পেলগারের সিমুলেশনের ফলাফল, তারা দেখিয়েছেন আদি সমতল আলোক সংবেদনশীল সেল থেকে শুরু করে ৪০০ ধাপ পরে তা রেটিনাল পিটের আকার ধারণ করে, ১০০০ ধাপ পরে তা আকার নেয় পিন-হোল ক্যামেরার মত আকৃতির, আর প্রায় ২০০০ ধাপ পরে অক্টোপাসের মত জটিল চোখের উদ্ভব ঘটে। জীববিজ্ঞানী মার্ক রিডলীর সাইটে ব্যাপারটি এনিমেশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, এখানে।
ভিডিও :
কিভাবে বিভিন্ন ধাপের মাধ্যমে চোখের মত জটিল অঙ্গ ক্রমান্বয়ে উদ্ভুত হতে পারে এ নিয়ে শিশু কিশোর এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্সের ভিডিও -
[1] Mark Isaak, The Counter-Creationism Handbook, University of California Press, 2007, p 68
[2] Richard Dawkins, Blind Watchmaker, Penguin, 1990
[3] বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)
[4] অভিজিৎ রায় এবং রায়হান আবীর, অবিশ্বাসের দর্শন, শুদ্ধস্বর, ২০১১
[5] বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ২০০৭ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ২০০৮)
[6] G Halder, P Callaerts, WJ Gehring, "New perspectives on eye evolution". Current opinion in genetics & development 5 (5): 602–9, 1995
[7] S. I. Tomarev, P. Callaerts, L. Kos, R. Zinovieva, , G.Halder, W.Gehring, J. Piatigorsky, "Squid Pax-6 and eye development". Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America 94 (6): 2421–2426, 1997.
[8] Mark Isaak, The Counter-Creationism Handbook, University of California Press, 2007, p 68
[9] Nilsson, D.-E., and S. Pelger. 1994. A pessimistic estimate of the time required for an eye to evolve. Proc. Roy. Soc. Lond. B 256:53-58.