বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
সব কিছুর পেছনেই কারণ আছে, মহাবিশ্বের উৎপত্তির একটি আদি কারণ রয়েছে, সেই কারণটিই ঈশ্বর
১) যদি সব কিছুর পেছনেই কারণ থাকে, তবে ঈশ্বরেরও কারণ থাকতে হবে। আবার যদি কারণ ছাড়াই কোন কিছু থাকতে পারে (যেমন ঈশ্বর), তবে এই যুক্তি ঈশ্বরের জগতের জন্যও সমানভাবে প্রযোয্য হতে পারে[1]।
২) মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করার জন্য যদি ঈশ্বর নামক একটি সত্ত্বার আমদানি করতেই হয়, তবে সেই ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করার জন্য একই যুক্তিতে আরেকটি ‘ঈশ্বর’কে কারণ হিসেবে আমদানি করা উচিৎ। তারপর সেই ‘ঈশ্বরের ঈশ্বর’-এর অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য লাগবে আরেকজন ঈশ্বর। এভাবে আমদানির খেলা চলতেই থাকবে একের পর এক, যা আমাদেরকে অসীমত্বের দিকে ঠেলে দেবে। এই ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই সকল বিশ্বাসীদের কাছে আপত্তিকর। তাই ধর্মবাদীরা নিজেরাই ‘সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে’ এই স্বতঃসিদ্ধের ব্যতিক্রম হিসেবে ঈশ্বরকে কল্পনা করে থাকেন আর সোচ্চারে ঘোষণা করেন- ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে কোন কারণের প্রয়োজন নেই।’ সমস্যা হল যে, এই ব্যতিক্রমটি কেন শুধু ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কেন নয়- এর কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেন না[2]।
৩) সব কিছুর পেছনে কারণ আছে - এটি সব জায়গায় সত্য নয়। বিশেষতঃ কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার জগতে কারণবিহীন ঘটনার বহু প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন। কোয়ান্টাম দোদুল্যমনতা (Quantum Fluctuation), আণবিক পরিবৃত্তি (Atomic Transition), আণবিক নিউক্লিয়াসের তেজষ্ক্রিয় অবক্ষয়ের (Radio active decay of nuclei) মতো কোয়ান্টাম ঘটনাসমূহ ‘কারণবিহীন ঘটনা’ হিসেবে ইতিমধ্যেই বৈজ্ঞানিক সমাজে স্বীকৃত[3]। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব (uncertainty principle) অনুযায়ী সামান্য সময়ের জন্য শক্তি (যা E = mc2 সূত্রের মাধ্যমে শক্তি ও ভরের সমতুল্যতা প্রকাশ করে) উৎপন্ন ও বিনাশ ঘটতে পারে- স্বতঃস্ফুর্তভাবে- কোন কারণ ছাড়াই। এগুলো সবগুলোই পরীক্ষিত সত্য। কাজেই উপরের উদাহরণগুলোই এই যুক্তিকে খণ্ডন করার জন্য যথেষ্ট।
৪) মহাবিশ্বের উৎপত্তি অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য পদার্থবিদরা সম্প্রতি বিভিন্ন গাণিতিক মডেল নির্মাণ করেছেন, বৈজ্ঞানিক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, কোনটিতেই ঈশ্বর নামক ধারণা আমদানির প্রয়োজন পড়েনি, বরং তারা সেগুলো নির্মান করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের জানা জ্ঞানের সাহায্যেই[4]। আদ্রে লিন্ডে এবং অ্যালেন গুথের ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্ব কিংবা পল স্টেইনহার্ট এবং নেইল টুরকের প্রস্তাবিত এই চক্রাকার মহাবিশ্ব বা ‘সাইক্লিক মডেল’ নির্মাণ করা হয়েছে কোন ধরণের আদি কারণ ছাড়াই।
৫) যদি মহাবিশ্বের উৎপত্তির পেছনে কোন 'আদি' কারণ থাকেও, সেই কারণটি যে ‘ঈশ্বরের মত ‘সত্ত্বা'ই হতে হবে কেন? কারণটি হতে পারে সম্পূর্ণভাবেই ‘প্রাকৃতিক’[5]।
মুক্তমনায় প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ :
- ঈশ্বরই কি সৃষ্টির আদি কারণ? : অভিজিৎ রায়
- স্রষ্টা এবং ধর্ম প্রসঙ্গ যখন অসঙ্গতির সৈকত চৌধুরী
- মহাবিশ্ব ও ঈশ্বর : একটি দার্শনিক আলোচনা : অভিজিৎ রায়
- বিজ্ঞান কি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছে? : ভিক্টর স্টেঙ্গার (প্রদীপ দেব)
· ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত দার্শনিক যুক্তি খন্ডন (১ | ২ | ৩) অনন্ত বিজয়
[1] বার্ট্রান্ড রাসেল, আমি কেন ধর্মবিশ্বাসী নই (Why I am not a Christian), ভাষান্তর : অরিন ভাদুড়ী, দীপায়ন, ২য় সংস্করণ, জানুয়ারী ২০০৪।
[2] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী (২০০৫, পুনর্মূদ্রণ, ২০০৬)
[3] "Quantum phenomenon, such as atomic transitions and radioactive decay of nuclei, seem to happen without prior cause.", Victor Stenger, Has Science Found God? : The Latest Results in the Search for Purpose in the Universe , pp 173
[4] উদাহরণ হিসেবে এখানে বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত কিছু পেপারের উল্লেখ করা যেতে পারে :
David Atkatz and Heinz Pagels, "Origin of universe as Quantum Tunneling effect" Physical review D25 (1982): 2065-73;
S.W. Hawking and I.G.Moss "Super cooled Phase Transitions in the very early Universe", Physics letters B110(1982):35-38;
Alexander Vilenkin, "Creation of Universe from Nothing" Physics letters 117B (1982) 25-28,
Alexander Vilenkin, "Quantum Origin of the Universe" Nuclear Physics B252 (1985) 141-152,
Andre Linde, "Quantum creation of the inflationary Universe," Letter Al Nuovo Cimento 39(1984): 401-405
Victor Stenger, “The Universe: the ultimate free lunch", European Journal of Physics 11 (1990) 236-243. etc.
[5] অভিজিৎ রায়, ঈশ্বরই কি সৃষ্টির আদি বা প্রথম কারণ?, ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম – সংঘাত নাকি সমন্বয়?’মুক্তমনা।