বিবর্তনের আর্কাইভ
ভ্রান্ত ধারণা
বিবর্তন অজাচার শিক্ষা দেয়
১) বিবর্তন অজাচার শিক্ষা দেয় না, বিবর্তনের কারণে বরং অজাচারের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং এটি প্রতিরোধ করার প্রবণতাটাই মূখ্য হয়ে উঠে। গবেষণায় দেখা গেছে, খুব কাছের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাভিচারের ফলে যে সন্তান জন্মায় দেখা গেছে তার বংশাণু বৈচিত্র্য হ্রাস পায়, ফলে সে ধরণের সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। শুধু তাই নয় জীববিজ্ঞানীরা গবেষণা থেকে দেখেছেন যে, বাবা কিংবা মায়ের পরিবারে যদি কোন জিন-বাহিত রোগ থাকে, তবে শতকরা ২৫ ভাগের মতো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্ভাবনা থেকে যায় ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সন্তান জন্মানোর। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘কনজেনিটাল বার্থ ডিফেক্ট’ (congenital birth defects) বা জন্মগত সমস্যা। নিঃসন্দেহে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যাপারটি অনুধাবন করেছিলেন যে কাছাকাছি পারিবারিক সম্পর্কযুক্ত মানুষজনের মধ্যে যৌনসম্পর্ক হলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে এবং সে সমস্ত শিশুর মৃত্যু হার বেশি। সামাজিকভাবেই এটিকে প্রতিহত করার প্রবণতা দেখা দেয়। সেজন্যই বিবর্তনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় আমাদের প্রবৃত্তিগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের পরিবারের সদস্যদের দেখে যৌন আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয় না[1]। অজাচার থেকে দূরে থাকার প্রবৃত্তিই বরং বিবর্তনের কারণেই সৃষ্ট।
২) মানুষের জন্য যে ব্যাপারটি সত্য, সেটার প্রতিফলন প্রকৃতিতে অন্য প্রানীদের মধ্যেও দৃশ্যমান। ইনসেস্ট বা অজাচারকে বৈজ্ঞানিকভাবে জীববিজ্ঞানে অভিহিত করা হয়ে থাকে ‘ইন-ব্রিডিং’ হিসেবে। প্রকৃতিতে আমরা খুব বেশি ইন-ব্রিডিং দেখতে পাই না, কারণ ইন-ব্রিডিং হলে প্রজাতির টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়, তারা খুব দ্রুত প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। কিন্তু যদি ভিন্ন পরিবার থেকে এসে দুইজন সন্তান উৎপাদন করে তাহলে সন্তানের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ জেনেটিক ভ্যারিয়েশন হবে। আর যথেষ্ট পরিমাণ জেনেটিক ভ্যারিয়েশন প্রজাতির টিকে থাকার জন্য অবশ্য দরকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পৃথিবীর চিতাবাঘের সংখ্যা নেমে এসেছিল প্রায় ত্রিশ হাজারে। সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা করলে ত্রিশ হাজার একটি বড় সংখ্যা হলেও জনপুঞ্জের জনসংখ্যা হিসাব করলে তা খুব একটা বড় নয়। আর এই কারণেই চিতাবাঘকে ইনব্রিডিং-এর আশ্রয় নিতে হয়েছিল। যার পরিণামে আজকে আমরা দেখতে পাই, প্রকৃতিতে চিতাবাঘ বিলুপ্ত প্রায়।
৩) বিবর্তন-বিরোধী ধার্মিকেরা যারা এ দাবী করেন, তাদের ধর্মের নানা কাহিনীতেই বরং অজাচারের অজস্র ইঙ্গিত মেলে। গুগল ডিকশনারি ইনসেস্ট বা অজাচার-এর অর্থ বলছে এটি ভাই-বোন, পিতা-কন্যা, মাতা-ছেলের মধ্যে যৌন সঙ্গমের দরুন একটি অপরাধ। ধর্ম নিজেকে নৈতিকতার প্রশাসন হিসেবে পরিচয় দেয়, অথচ তারা আদম-হাওয়া নামের দুজন মানব মানবী থেকে আমাদের আসার যে গল্প শোনায় তা মারাত্মক রকমের অনৈতিক। আদম হাওয়ার গল্প সত্যি হয়ে থাকলে পৃথিবীতে আমরা এসেছি অজাচারের মধ্য দিয়ে[2]।
চিত্র: বহুদিনের পুরনো ধারণাগুলোর সত্যতাও বিচার-বিশ্লেষণ করা উচিত।
ধর্মগ্রন্থে আমরা আদম হাওয়ার কথা পড়েছি, পড়েছি তাদের দুই সন্তান হাবিল, কাবিলের কথা। তবে আমাদের পড়াশোনা ঠিক এখানেই শেষ, আমরা ধরে নিয়েছি দুটো মানুষ, তাদের সন্তানরা মিলে সারা পৃথিবী মানুষে মানুষে ছেয়ে ফেলেছে। তবে এখানেই থেমে না গিয়ে আরেকটু সামনে আগালে, আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই একটা গভীর প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়। সন্তান উৎপাদনটা ঠিক কীভাবে হলো? ভাইবোনে সঙ্গম ছাড়া নিঃসন্দেহে পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি হয়নি, তাই না?
৪) অন্যান্য ধর্মেও অজাচারের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। মৎস্যপুরাণে লেখা আছে ব্রহ্মা একদিন তার নিজের মেয়ে শতরূপাকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেন নি। হিন্দুদের আদি মানব মনুর জন্ম হয় ব্রহ্মা আর শতরূপার মিলন থেকেই। হয়ত কেউ বলতে পারেন পুরাণের চরিত্রগুলো তো কোন বাস্তব চরিত্র নয়, মানুষের কল্পনা। হ্যাঁ, কিন্তু কল্পনা তো আকাশ থেকে হয় না, উপকরণ লাগে। ওই বিকৃত কল্পনাগুলো করেছিল বৈদিক যুগের পুরুষেরা। তারা নিজেরা ছিল কামাসক্ত, বহুপত্নীক এবং অজাচারী; তাই তাদের কল্পনায় তৈরি দেব-দেবীগুলোও ছিল তাদের মতই চরিত্রের। এজন্যই সমস্ত হিন্দু ধর্মের বই পুস্তক গুলোতে শুধু অযাচিত কাম আর মৈথুনের ছড়াছড়ি। শুধু ব্রহ্মাই নয়, নিজ মেয়ের সাথে মিলনের কাণ্ড ঘটিয়েছে দেবতা প্রজাপতিও। ঊষা ছিলেন প্রজাপতি কন্যা। প্রজাপতি ঊষার রূপে কামাসক্ত হন, এবং মিলিত হতে চান। তখন ঊষা মৃগী-রূপে ধারণ করেন। প্রজাপতি মৃগ-রূপ ধারণ করে তার সাথে মিলিত হন (মৈত্রায়ন সংহিতা ৪/২/২২)। অজাচারের এবং অনৈতিকতার উপকরণ ধর্মীয় নবী পয়গম্বরদের চরিত্রের সাথে জড়িত অঙ্গাঙ্গীভাবে। পালিত পুত্রের স্ত্রী জয়নবের মোহে হজরত মুহম্মদ কিভাবে লালায়িত হয়েছিলেন সেটা ইতিহাসেই বর্ণিত আছে। কাজেই বিবর্তনকে দোষারোপ করার আগে ধার্মিকদের উচিৎ নিজের ধর্মগ্রন্থের দিকে চোখ মেলে তাকানো।
[1] অভিজিৎ রায়, ভালবাসা কারে কয়, শুদ্ধস্বর, ২০১২
[2] অভিজিৎ রায় এবং রায়হান আবীর, অবিশ্বাসের দর্শন, শুদ্ধস্বর, ২০১১ (দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১২)