শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)বেরুলো

বিজ্ঞান, শিল্প ও নন্দনতত্ত্ব

অপার্থিব

 

বিজ্ঞান ও শিল্প বা কলার মধ্যে যে এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বিদ্যমান সেটা পাঠকের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যেই এই প্রবন্ধটি লেখার প্রয়াসআমি পেশায় বিজ্ঞানী নইতাই মৌলিক কোন বৈজ্ঞানিক ধারণা এই লেখায় থাকবেনা বিজ্ঞান লেখক হিসাবে আমার চেষ্টা হবে এই বিষয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান বা সুচিহ্নিত ধারণাগুলো, যা এই অন্তরঙ্গ সম্পর্ককে প্রমাণ করে, সেগুলোকে সংকলিত করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করাএই লেখায় আমি বিজ্ঞান, কলা ও নান্দনিক অনুভূতি বা নন্দনতত্ত্বের (Aesthetics) মধ্যকার সম্পর্কের তিনটি দিকের ওপর আলোকপাত করব; এক - বিজ্ঞান ও কলা বা নান্দনিক অনুভূতির অনুবদ্ধ বা পারম্পর্য্য অর্থা বিভিন্ন ব্যক্তিনির্ভর কলা বা নান্দনিক ধারণার অনুভূতির পেছনে কি কি বস্তুনির্ভর বৈজ্ঞানিক গুণক বা কারণ কাজ করে, দুই - শৈল্পিক চেতনায় মস্তিষ্কের ভূমিকা, এবং তিন - কলা ও নান্দনিক অনুভূতির বৈবর্তনিক উ, এই তিনটি নিয়েতবে এর আগে ঐতিহাসিক কিছু প্রসঙ্গের দীর্ঘ ভূমিকা

 

একটা বাঁধা বুলি প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, শিল্প বা সৌন্দর্য শুধু অনুভব করার ব্যাপার, যার চোখে বা মনে যেমন দেখায় তেমন করেএখানে বোঝার বা ব্যাখ্যার কোন ব্যাপার নেইকিন্তু আসলেই কি তাই? এই উক্তিকে এখন অসার বাক্যই বলা উচিত বিজ্ঞানের শিল্প বা কলার সাবর্জনীন কোন সংজ্ঞা হয়ত নেই ঠিকই, কিন্তু শিল্পকে বা শৈল্পিক অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করা বা বোঝা যায় না এটা আর মানা যায় না বিজ্ঞানের, বিশেষ করে বিবর্তন বিজ্ঞানের আলোকেযার অস্তিত্ব সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত বা অনুভূত, তার কোন সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই, তাই তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলাটা একটা অসার বাক্যই শুধুশিল্প ও সৌন্দর্য এমনই এক সার্বজনীন ধারণা সংজ্ঞায়ন নয়, বরং এই সার্বজনীন ধারণার অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই মুখ্য ব্যাপার বিবর্তন, বিশেষ করে বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হল মানুষের মনের এই সার্বজনীন শৈল্পিক ও নান্দনিক চেতনার উদ্ভবের কারণ খোঁজা, বিবর্তনের আলোকে

 

ঐতিহাসিকভাবে কবি এবং সাহিত্যিকদের মাঝে একটা বাঁধা ধারণা ছিল যে বিজ্ঞান ও কলা বা সাহিত্য পরস্পর বিরোধীএখানে বিজ্ঞানকে ব্যাপক অর্থে বুঝিয়ে গণিত ও যুক্তি শাস্ত্রকেও অন্তর্ভুক্ত করছিইংরেজ কবি কীট্স্ নিউটনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছিলেন যে আলোকের সূত্রের দ্বারা রংধনুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি রংধনুর সৌন্দর্যকেই ক্ষুণœ করেছেনঅথচ কীট্স্ই আবার অন্য এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে সত্যই সৌন্দর্য্য অন্যান্য কিছু পাশ্চাত্য কবিও বিজ্ঞানের প্রতি তীর্যক মন্তব্য করেছিলেন যেমন ইউজিন কামিংস, এমিলি ডিকিনসন (যাঁর লেখা এক লাইন হল নিভৃত কোন এক প্রান্তরের ওপর রঙ্গীন আলোর ছটা, যা বিজ্ঞান কখনই ছুঁতে পারবেনা, শুধু মানুষের প্রকৃতিই তা অনুভব করে ...”), ওয়ার্ড্সওয়ার্থ প্রমুখআর এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যিনি বিজ্ঞানবিমুখ এই বাঁধা ধারণায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন তিনি হলেন ফরাসী দার্শনিক রুশো বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর রীতিমত অশ্রদ্ধাই ছিল বিজ্ঞান ও শিল্প বা সাহিত্যের এই ঐতিহাসিক বিরোধের ওপর The Two Cultures and the Scientific Revolution” (দুই সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব) নামে এক বিখ্যাত বই লিখেছিলেন C. P. Snowদুই সংস্কৃতি বলতে তিনি বিজ্ঞান ও শিল্প বা সাহিত্যকেই বুঝিয়েছেনএই বইতে তিনি কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে বিজ্ঞান এর প্রতি সাধারণ এক অবজ্ঞাসূচক মনোভাব ও বৈজ্ঞানিকদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকার না করার প্রবণতার প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন

এ বিষয়ে প্রয়াত নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফাইনম্যানকে জড়িয়ে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা ঘটনাটির উল্লেখ পাওয়া যাবে ক্রিস্টফার সাইক্স্ (Christofer Sykes) এর লেখা No Ordinary Geniusনামক বইতে

 

ফাইনম্যানকে তাঁর এক শিল্পী বন্ধু হাতে একটা ফুল ধরে তাঁর দিকে তাক করে বলেন, “একজন শিল্পী হিসেবে আমি এই ফুলের সৌন্দর্য হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম, আর তুমি এটাকে ভেঙ্গে চুরে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর সৌন্দর্যকেই বিলীন করে দাওএর উত্তরে ফাইনম্যান বলেছিলেন যে একজন শিল্পী ফুলে যে সৌন্দর্য দেখতে পান, তিনিও সেই একই সৌন্দর্য দেখতে পান, কিন্তু উপরন্তু তিনি ফুলের ভেতরকার সৌন্দর্যকেও দেখতে পান, যেমন কি ভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা ফুলের পাপড়ি গঠিত হয়, কিভাবে বৈবর্তনিক উপযোজনের কারণে কীটপতঙ্গকে আকর্ষণ করার জন্য ফুলের সুন্দর রঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে, এই সব, যা থেকে তাঁর শিল্পী বন্ধু বঞ্চিতআর একজন কবি, ওয়াল্ট হুইট্ম্যান তাঁর কবিতা যখন বিজ্ঞ জ্যোতির্বিদকে বলতে শুনলাম” (“When I heard the Learn’d Astronomer”) কবিতায় লিখেছেন কিভাবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর এক বক্তৃতা শুনতে শুনতে একঘেমেয়ি বোধ করে কবি বক্তৃতাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান বাইরে রহস্যময় রাতের আঁধারে, যাতে একান্ত নিভৃতে আকাশের তারার পানে চেয়ে থাকতে পারেন:

 

WHEN I heard the learn’d astronomer;  

When the proofs, the figures, were ranged in columns before me;  

When I was shown the charts and the diagrams, to add, divide, and measure them;  

When I, sitting, heard the astronomer, where he lectured with much applause in the lecture-room,  

How soon, unaccountable, I became tired and sick;        

Till rising and gliding out, I wander’d off by myself,  

In the mystical moist night-air, and from time to time,  

Look’d up in perfect silence at the stars.

 

হুইটম্যানের এই লাইনগুলোর যথার্থ প্রত্যুত্তর দিয়েছেন বৈজ্ঞানিক ভিক্টর ওয়াইজ্কফতিনি হিউবার্ট রিভ্স এর লেখা Atoms of Silenceবইটির মুখবন্ধে বলেন হিউবার্ট রিভ্স বিজ্ঞ জ্যোতির্বিদের বক্তৃতার বিষয়বস্তু জানেন ও বোঝেনকিন্তু ওয়াল্ট হুইট্ম্যান এর মত রাতে তিনিও আকাশের তারার পানে চেয়ে থাকতে পছন্দ করেন হুইটম্যানের কবিতার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ফাইনম্যান তাঁর বিখ্যাত ফাইনম্যান বক্তৃতা সিরিজে লিখেছেন, তিনিও হুইটম্যান এর মত নির্জন রাতে আকাশের তারার দিকে চেয়ে পুলক ও রোমাঞ্চ অনুভব করেন, কিন্তু তাঁর এই রোমান্টিক অনুভূতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যখন তিনি উপলব্ধি করেন যে ঐ তারার আলো তাঁর চোখে পৌঁছুতে লক্ষ লক্ষ বছর নিয়েছে, এবং যখন এটা উপলব্ধি করেন যে তাঁর দেহ যে উপাদান দ্বারা গঠিত তাও সুদূর অতীতে কোন অতিনবতারার বিস্ফোরণের দরুণ বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ বৈ কিছু নয়এইযে বাড়তি কিছু জানা, তা এই রহস্যটার কোন ক্ষতি করেনা, কারণ সত্য এক অদ্ভুত সুন্দর জিনিষ, যা অতীতের কোন শিল্পী কখনো কল্পনাও করতে পারেননি প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আইজাক আজিমভ তাঁর বই The Roving Mindবিজ্ঞান ও সৌন্দর্যনামক প্রবন্ধে লিখেছেন অবশ্যই রাতের আকাশ সুন্দর, কিন্তু জ্যোতির্বিদেরা কি রাতের আকাশের আরও বাড়তি এক গভীর সৌন্দর্যকে তুলে ধরেন না? এরপর তিনি কাব্যিক ভাষায় নক্ষত্র, ছায়াপথ ও মহাবিশ্বের রহস্য নিয়ে একের পর এক অধ্যায় লিখে যান

 

এটা সত্যি খুবই দুঃখজনক যে অতীতের নামী দামী সাহিত্যিকেরা বিজ্ঞানের প্রতি কটাক্ষ করে বিজ্ঞানকে সাহিত্যের বিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদেরকে রহস্য ও সৌন্দর্য বিনাশকারী বলে অভিযুক্ত  করেছিলেনকারণ বিজ্ঞান আমাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও রহস্যবোধকে আরও জোরদার করে।  প্রত্যেকটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই রহস্যকে আর এক ধাপ নিচে ঠেলে দেয় রহস্যের পরিসমাপ্তি ঘটায় না চূড়ান্ত রহস্যের হাতছানি বৈজ্ঞানিকদের এগিয়ে নিতে অনুপ্রাণিত করে, অজানাকে জানবার ইচ্ছা ও সিসৃক্ষার (যা শৈল্পিক চেতনার এক অপরিহার্য্য উপাদান)[*] সনাতন প্রবৃত্তিকে জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে

 

বিখ্যাত বৃটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার জেম্স জীন্স তাঁর The Nature of the Physical Worldবইয়ের বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মবাদ প্রবন্ধে তাঁর লেখা উদ্গতিবিজ্ঞানের (fluid dynamics) পাঠ্য বইয়ের বায়ু ও তরঙ্গ বিষয়ক পাতাগুলো থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে এর তুলনা করেন বাস্তবে সমুদ্রের তীরে বসে সূর্যের আলোস্নাত ঢেউএর নৃত্যলীলা দেখার নান্দনিক অনুভূতির সাথে আইনস্টাইন প্রকৃতির মধ্যে যে অপূর্ব প্রতিসাম্য পরিলক্ষিত হয় তাকে সৌন্দর্যের এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে কেবল দেখেনই নি, এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আপেক্ষিকতার সুগভীর তত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেননিউ ইয়র্ক টাইম্সের ১৯৩৫ সালের ১ মের সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন, বিশুদ্ধ গণিত যেন একরকম কবিতা, যৌক্তিক ধারণার কবিতা

 

আরেক নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ডিরাকও পদার্থবিজ্ঞানে সৌন্দর্যের যথার্থ উপলব্ধি ও তার প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেনতিনি তাঁর বিখ্যাত ডিরাক সমীকরণের (যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন) পেছনে এই সৌন্দর্যের উপলব্ধি ও কদরকেই কৃতিত্ব দিয়েছিলেনতিনি দাবি করেন যে এক তীক্ষè সৌন্দর্য সচেতনতাই তাঁকে ১৯২৮ সালে ইলেক্ট্রনের তরঙ্গ অপেক্ষক বা Wave Function আবিষ্কারে সাহায্য করে১৯৬৩ সালের মে মাসের Scientific American পত্রিকায় এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন :

 

আমার মনে হয় এই গল্পের একটা শিক্ষণীয় বাণী আছে, আর সেটা হল যে কোন সমীকরণে সৌন্দর্য থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সমীকরণটি পর্যবেক্ষণের সাথে মিলল কি না আগেই তার বিচারে যাওয়াটা নয়কেউ সমীকরণে সৌন্দর্যের দৃষ্টিভঙ্গী ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে এগোলে প্রগতির পথ সুনিশ্চিত হবেকারও তত্ত্বের সাথে পর্যবেক্ষণের একশ ভাগ সঙ্গতি না হলেও হতাশ হবার কিছু নেইকারণ এই সামান্য গরমিল হয়তো বা কোন ছোটখাট ব্যাপার যথাযথভাবে খেয়াল না করার কারণেই ঘটেছে যা পরবর্তীতে তত্ত্বকে আরও পরিশীলিত করতে দূরীভূত হতে পারে

নোবেল পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর যেমন কৃষ্ণগহ্বরের গাণিতিক তত্ত্বের ওপর ৬৫০ পৃষ্ঠার এক বিশাল ও জটিল বই লিখেছিলেন তেমনই সত্য ও সৌন্দর্যনামে একটি বই লিখেছিলেন যেখানে তিনিও ডিরাকের মত বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার পেছনে সৌন্দর্যবোধ থাকাটার ওপর জোর দিয়েছিলেনতিনি শেক্স্পিয়ার, বেটফেন, শেলী প্রমুখের শিল্পসৃষ্টির সাথে সৌন্দর্যচেতনায় উদ্বুদ্ধ বিজ্ঞানীদের সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টার তুলনা করেনকাজেই দেখা যাচ্ছে যে অনেক আবিষ্কারের প্রেরণার পেছনে আছে সৌন্দর্য ও মহাবিশ্বের রহস্যের প্রতি এক আধ্যাত্মিক আকর্ষণস্যার জগদীশচন্দ্র বোস তাঁর কবিতা ও বিজ্ঞান প্রবন্ধে বিজ্ঞান ও কবিতার বা সৌন্দর্যের মধ্যে বিরোধহীনতার বা অন্তর্দ্বন্দ্বের অভাবের কথা বলেছেনআরও পরে গণিতজ্ঞ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর কবি ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে সেই একই কথাই বলেছেন

 

বিজ্ঞান ও কলার এই অবিরোধের বাণী প্রচারের জন্য একজন ইংরেজ সাহিত্যিক ও একজন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের যৌথ উদ্যোগে লেখা বইয়ের চাইতে বেশি উপযোগী আর কি হতে পারে? এমন একটি বই হল Thomas Vargish DeloE. Mook এর লেখা Inside Modernism: Relativity Theory, Cubism, Narrativeনামক বইটিএই বইটিতে তাঁরা লিখেছেন :

 

আমরা আপেক্ষিকতার বিশেষ ও সাধারণ তত্ত্বকে আর আধুনিকবাদী শিল্পসৃষ্টিকে একই দৃষ্টিতে দেখি, কারণ উভয়ের মধ্যেই আছে আধুনিকবাদী মূল্যের এক জোরাল প্রকাশ

 

এই বই সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে নিম্নের ওয়েব সাইটে কিক্ল করুন :

http://yalepress.yale.edu/yupbooks/book.asp?isbn=9780300076134

 

বিংশ শতকের গোড়ার দিকের বিখ্যাত গাণিতিক G.n. Watson বলেছিলেন যে মাইকেল এঞ্জেলোর সৃষ্ট ফ্লোরেন্সের স্যান লোরেনজোর মেডিচি চ্যাপেলের  দিবস/রজনী/সায়াহ্ন/প্রভাত ভাস্কর্যকর্ম তাঁকে যেভাবে রোমাঞ্চিত করে রামানুজানের কোন কোন গাণিতিক সূত্র তাঁকে ঠিক একইভাবে রোমাঞ্চিত করে (এর উল্লেখ পাওয়া যাবে Roger Penrose এর লেখা বই The Emperor’s New Mindএর ৫৪৫ পৃষ্ঠায়)

 

সম্প্রতি প্রয়াত কোয়ান্টাম পদার্থবিদ ও দার্শনিক ডেভিড বম তাঁর বিজ্ঞান ও শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্কনামক নিবন্ধে বিজ্ঞান ও শিল্পের বিকাশের মধ্যে মিলের কথা আলোচনা করেছেনতিনি শিল্পক্ষেত্রে মনেট (Monet) ও সেজানের শিল্পশৈলী থেকে ত্রিমাত্রিকবাদীদের ও মন্ড্রিয়ান এর বিমূর্ত শিল্পশৈলীর ক্রমবিকাশের সাথে বিজ্ঞান ও গণিতে প্রতীক বা প্রতিরূপের স্থলে বিশুদ্ধ কাঠামো বা অবয়বের দিকে ক্রমবিকাশের তুলনা করেন

 

পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিল্পকে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না বা করার অর্থ হয় না শিল্পের ধারণা মানুষের মনের ওপর তার প্রভাব থেকেই প্রতীয়মান শিল্পকে যদি মানুষের মনে তার সৃজনশীল সৃষ্টির আনন্দের দ্বারা সংজ্ঞায়িতা করা হয় তাহলে বিজ্ঞান সহজেই একটি শিল্পরূপ এবং বিজ্ঞানীরা এই শিল্পরূপের শিল্পী বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীরা শিল্পের রস আস্বাদন করতে পারেন না এটা বলা ভিত্তিহীন যেমনটি বলা ভিত্তিহীন যে একজন সংগীতশিল্পী কবিতা উপভোগ করতে পারবেন নাসূত্র বা তন্তুতত্ত্ব (String Theory) সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের চেয়ে কোন অংশে কম উন্নত নয়একজন সূত্রতত্ত্ববিদ সুগভীর শিল্প ও সৌন্দর্যবোধের দ্বারাই তাঁর গবেষণা পরিচালিত করেনএটা কম বেশি সব বৈজ্ঞানিক শাখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য১৭ জুলাই ২০০৩ সালের Nature ম্যাগাজিনে যদি বিজ্ঞানের কোন বিশেষ একটি ব্যাপারে জনগণকে অধিকতর সচেতন করতে চান তাহলে আপনি কি বলবেন?” এই প্রশ্নের উত্তরে আণবিক জীববিজ্ঞানের অধ্যাপিকা Bonnie Bassler বলেন বলব যে আমরা বিজ্ঞানীরা মোটেই কাটখোট্টা নই, আমরাও শিল্পী, আমরা যা করি সেটাও শিল্পকর্মের মতই উত্তেজনাকর, আনন্দময় ও সৃজনশীল

 

এবারে আসি আলোচ্য বিষয়ের প্রথম দিকটায় বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মধ্যেকার সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন এবং সাম্প্রতিক বিজ্ঞানীরাও এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেনকোন কোন বিজ্ঞানী সুন্দর বলে বিবেচিত বস্তুর সুন্দর বিন্যাস, কারুকার্য্য বা নক্সার পেছনে কোন কোন গাণিতিক বিন্যাস বা pattern আবিষ্কার করেছেনএই সব আবিষ্কারের পরিণতিতে গণনামূলক নন্দনতত্ত্ব’ (Computational Aesthetics) নামে জ্ঞানের এক শাখার সৃষ্টি হয়এই শাখার পথিকৃ হলেন বিশিষ্ট মার্কিন গণিতজ্ঞ ও আমেরিকান গাণিতিক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি (১৯২৪-১৯২৬) ডেভিড বার্কফ যাঁর বিখ্যাত আর্গোডিক প্রকল্পের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বা শিক্ষকরা সুপরিচিতকুড়ির ও তিরিশের দশকের সময় তিনি সৌন্দর্যের ওপর বস্তুনির্ভর ধারণা আরোপের চেষ্টা করেন যেমন বিন্যাস, জটিলতা ও সৌন্দর্য গুণকে ইত্যাদিএই সময় এ নিয়ে তিনি একটা প্রবন্ধও লেখেন যার শিরোনাম ছিল কান্তিবিদ্যার গাণিতিক তত্ত্ব এবং কবিতা ও সংগীতে এর প্রয়োগযা প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের রাইস ইনস্টিটিউট পুস্তিকার ১৮৯-৩৪২ পৃষ্ঠায়এর পরপরই তিনি তাঁর গবেষণা ব্যাখ্যা করার জন্য বক্তৃতা সফরে বের হনতাঁর বস্তুনির্ভর ধারণার ভিত্তিতে কিছু গণনার দ্বারা তিনি দেখাতে সমর্থ হন যে কেন তুষার কণা, ফুল ইত্যাদি অন্য অনেক বস্তুর চেয়ে সুন্দরসুর ও কবিতার শ্রবণেন্দ্রিয় সংক্রান্ত মাত্রার কিছু সূত্রও তিনি উদ্ভাবন করলেনএরপরে পঞ্চাশের দশকে জার্মানীতে সাহিত্যতাত্ত্বিক এক গোষ্ঠী, যাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন Max Bense, তাঁরা বার্কফের মত কান্তি বিচারের এক মডেল, তথ্যমূলক কান্তিবিদ্যার আবিষ্কার করেন, যা Claude Shannon এর তথ্যতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেষাট দশকের শেষভাবে এর আরও বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হন Nijmegen এর মনোবিজ্ঞানী Emmmanuel Leeuwenbergআমি কেবল এই বিজ্ঞানীদের কাজের কথারই উপরি উপরি উল্লেখ করলামএদের কাজের ভেতরের খুঁটিনাটি দেয়া সম্ভব নয়

 

সজাগ পাঠকেরা এটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে উপরোক্ত তত্ত্বসমূহ কেবল ব্যক্তিনির্ভর (subjective) সৌন্দর্যের ধারণার সঙ্গে বস্তুনির্ভর (objective) বৈজ্ঞানিক মাপ এর এক অনুবন্ধী সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস মাত্রকিন্তু কি কারণে সুন্দর বস্তুর ঐ বস্তুনির্ভর ধর্মগুলো মানুষের মনে ব্যক্তিনির্ভর সৌন্দর্যের অনুভূতির সৃষ্টি করে ঐ তত্ত্বসমূহ সেটা ব্যাখ্যা করেনাএর জন্য আমাদের বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হবেযেহেতু বিবর্তনের অবিসংবাদিত এক সত্য হল এই যে মানুষ তথা মানুষের মস্তিষ্ক বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট সেহেতু এটা বলাই বাহুল্য যে সৌন্দর্যবোধ, শিল্পসিসৃক্ষা, নৈতিকতা তথা মানুষের সকল বৈশিষ্ট্য যা মানুষের মস্তিষ্কে সৃষ্ট তাও বিবর্তনের ফলএগুলো কোন দৈব শক্তির দ্বারা মানুষের মগজে রোপিত হয় না যদিও কেউ কেউ এটাই বিশ্বাস করেনআমাদের মধ্যে কাউকে এটা বলতে শোনা যায় যে প্রেম, ফুল বা শিশুর সৌন্দর্য এ সবই এক দৈব বা স্বর্গীয় সৃষ্টিআসলে এই উক্তি ঐ সৌন্দর্যের প্রতি তাদের মনের বিস্ময়াপ্লুত আবেগেরই প্রকাশ মাত্র, যার কারণ হল প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দ্বারা এই সৌন্দর্যকে বোঝার অপারগতা, বা আদৌ যে এর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা সম্ভব এই চিন্তাটাও মাথায় না আসাতাই অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যাই (যদিও প্রকৃত অর্থে তা ব্যাখ্যা নয়) তাঁরা বেছে নেন সৌন্দর্য (বস্তুর বিশেষ ধর্ম অর্থে) ও সৌন্দর্যবোধ (মানুষের মনের এক অনুভূতি অর্থে) এ দুটো হল পরস্পর সম্পূরক দুটি বিবর্তনীয় সৃষ্টিজড় বস্তুর সৌন্দর্য (যেমন তুষার ফলকের বা রংধনু ইত্যাদি) সরাসরি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে সৃষ্ট, আর জীবের (প্রাণী ও উদ্ভিদ) সৌন্দর্য বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট, যদিও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বিবর্তনও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের এক পরিণতি

 

সৌন্দর্যের প্রতি আসক্তি মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তিএই সৌন্দর্য কোন বস্তুর (জড় বা জীব) মধ্যে বিধৃত হতে পারে, আবার কখনও বা অমূর্ত ধারণায় বিধৃত হতে পারে যেমন গানে বা কবিতায়কিন্তু যেটাই হোক, এই দুইয়ের একটা সাধারণ ব্যাপার হল যে উভয় ক্ষেত্রেই সৌন্দর্যের উস হল এক অন্তর্নিহিত তথ্য বা বিন্যাস যা মানুষের মস্তিষ্কের আনন্দকেন্দ্রে সৌন্দর্যবোধের সৃষ্টি করেকাজেই গভীর প্রশ্ন হল কিভাবে সৌন্দর্যের উস এই তথ্য বা বিন্যাস এর সঙ্গে মস্তিষ্কের আনন্দকেন্দ্রের এই কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলআগেই উল্লেখ করেছি মানুষের অনুভূতি সংক্রান্ত সব বৈশিষ্ট্যই বিবর্তনের ফল বৈশিষ্ট্যগুলো বৈবর্তনিক নির্বাচনজনিত চাপের (Evolutionary Selection Pressure) মুখে উদ্বর্তনের জন্য উপযোজনীয় কৌশল হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্ট হতে পারে অথবা উদ্বর্তনের উপযোজনীয় কৌশলের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা উপজাত হিসেবে পরোক্ষভাবে সৃষ্টি হতে পারেএই উপজাতকে বিবর্তনের স্প্যান্ড্রেল (Spandrel) বলা হয় স্প্যান্ড্রেলের স্বকীয় কোন উদ্বর্তন মূল্য (survival) নেই স্প্যান্ড্রেল হল কোন ইরামত নির্মাণের সময় খুঁটি বা স্তম্ভগুলোর বাড়তি অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো যা ইমারত নির্মাণের আবশ্যকীয় উপজাত হিসেবে তৈরি হয় সৌন্দর্যের অনুধাবন বা আসক্তি অনেকাংশে (সবগুলো নয়) এই বিবর্তনের স্প্যান্ড্রেলএই প্রসঙ্গে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেই যে বিবর্তনের ভাষায় উদ্বর্তন বলতে পরবর্তী প্রজন্মে বংশাণুকে হস্তান্তর করাকেই বোঝায় শারীরিক অর্থে বেঁচে থাকাটাই নয়কেউ যদি সন্ততিতে বংশাণু সংক্রমিক করে তারপর মৃত্যুবরণ করে তাহলে বিবর্তনের ভাষায় সে উদ্বর্তিত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে মানুষের দেহ হল বংশাণু মজুত রাখার এক  সাময়িক ভান্ডার মাত্রবংশাণু রক্ষাই হল বিবর্তনের একমাত্র লক্ষ্যএকটি বংশাণু লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়ে চলেছে বিবর্তনের মাধ্যমেএর মাঝে বিভিন্ন মানুষ ঐ বংশাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে মাত্র

 

এবার এই নতুন গবেষণার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের কাজের কিছু উল্লেখ করি কান্তিবিদ্যার মূল যে জীববৈজ্ঞানিক সেই অভিমত আগেই একজন অবিজ্ঞানী সাহিত্যিক ফ্রেডারিক টার্নারই দিয়েছিলেন তাঁর Natural Classicismবইটিতেএই বইতে তিনি এই মত ব্যক্ত করেন যে মানুষের কান্তিবোধ প্রাক যুগের জীববৈজ্ঞানিক তাড়নার কারণেই সৃষ্টকিন্তু এ বিষয়ে বিবর্তন বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম ও সযতœ বিশ্লেষণের দ্বারা প্রথম যে বই লেখা হয় যা পরবর্তীতে অন্যান্য বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করে সেটি হল বিভিন্ন গবেষকদের লেখা নিয়ে সংকলিত ১৯৯২তে প্রকাশিত বই The Adapted Mind: Evolutionary Psychology and the Generation of Cultureযার সম্পাদনায় ছিলেন বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানী Jerome H. Barkow, Leda Cosmides, I John Toobyআর একটি বহুল প্রশংসিত বই হল ন্যান্সি আইকেন এর লেখা The Biological Origin of Artsএই বইয়ের মূল বক্তব্য তাঁর লেখা প্রবন্ধ An Evolutionary perspective on the Nature of Art’’ এ পাওয়া যাবেএই প্রবন্ধ পড়তে চাইলে পাঠক http://www.apa.org/divisions/div10/articles/aiken.html সাইট এ ক্লিক করতে পারেন আইকেনের বই অবশ্য এর আগে Dissanayake এর লেখা Homo aestheticus: Where art comes from and whyবইয়ের ধারণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা

 

ব্রেট কুক ও ফ্রেডারিক টার্নার এর সম্পাদিত একটি বই Biopoetics: Evalutionary Explorations in the Artsএ সম্পাদকেরা বলেন যে শিল্পের সৃজন বা উপভোগ করার জন্য আমাদের মধ্যে নিহিত সনাতন প্রবৃত্তিকে বুঝতে চাইলে যে আমাদেরকে আমাদের বৈবর্তনিক ইতিহাস বা ঐতিহ্যের দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে তার সাক্ষ্য প্রমাণ বেড়েই চলেছেআমরা যদি স্রেফ শিল্পের খাতিরে শিল্প এই কথাও বলি তবুও এটা আবশ্যক যে ডারুইনীয় অর্থে শিল্পের খাতিরে শিল্প বলতে কি বোঝায় সেটা বুঝতে চেষ্টা করি

 

শিল্পের বৈবর্তনিক উস নিয়ে একটি সুলিখিত সন্দর্ভ হল শিল্প কি একটা উপযোজন? সৌন্দর্যের প্রতি বৈবর্তনিক দৃষ্টিভঙ্গীর সম্ভাবনা” (“Is Art an Adaptation? Prospects for an Evolutionary Perspective on Beauty”) যার লেখক টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক রোনাল্ড ডি সুসা সন্দর্ভটি প্রকাশিত হয় জুন ২০০৪ সালের কান্তিবিদ্যা ও শিল্পসমালোচনার সাময়িকীতে (The Journal of Aesthetics and Art Criticism, Volume 62, Issue 2, Page 109, June 2004) পাঠকেরা এটা পড়তে চাইলে ক্লিক করতে পারেন সুসার নিজের সাইটে: http://www.chass.utoronto.ca/%7Esousa/artfunction/art.htm

 

বিবর্তন ও সাহিত্যতত্ত্ব”(“Evolution and Literary Theory”) বইটিতে লেখক জোসেফ ক্যারল শিল্পের (বিশেষ করে সাহিত্য) ডারুইনীয় ব্যাখ্যার সপক্ষে শুধু যুক্তি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, শীর্ষ আধুনিকোত্তরবাদী (Postmodernist) বা অবয়বোত্তরবাদীদের (Poststructuralist) বিশেষ করে দেরিদা, ফুকো ও তাঁদের শিষ্যদের নির্বিচারবাদী পাঠবাদের (Textualism) এই যুক্তিও খন্ডন করেন যে শিল্পসাাহিত্যে বস্তুনির্ভর কোন অন্তর্দৃষ্টি অর্জন সম্ভব নয়আগ্রহী পাঠকেরা ক্যারলের লেখা পড়তে চাইলে এই সাইটে ক্লিক করতে পারেন : http://www.umsl.edu/~carrolljc/

 

বৃটিশ বিজ্ঞানী ও লেখক জন ব্যারো তাঁর Between iner space and outer spaceবই এর কান্তিবিদ্যানামক অধ্যায়ে কিভাবে প্রাচীন মানবের মধ্যে উপযোজনের তাগিদে সৌন্দর্যচেতনার সৃষ্টি হয়েছিল তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেনবিশেষ করে প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য সম্বলিত চিত্রের বা Landscape Art এর প্রতি আদিম মানব এর আকৃষ্ট হবার কারণ হিসেবে এর উদ্বর্তনী মূল্যের কথা উল্লেখ করেছেন আদিমকালের আফ্রিকান মহাদেশে বিপদশংকুল চারণভূমিতে, যেখানে হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণের ভয় সদা বিরাজমান, সেখানে উন্মুক্ত ও সুষম খোলা প্রান্তর বেঁচে থাকার পক্ষে সহায়ক, কারণ সেখানেই সহজেই হিংস্র প্রাণীকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখা যায়কাজেই যারা এই ধরনের প্রতিসাম্যপূর্ণ বিস্তীর্ণ প্রান্তরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত তারাই উদ্বর্তনের দৌড়ে এগিয়ে ছিল প্রতিসাম্যের প্রতি আকর্ষণ উদ্বর্তনের ব্যাপারে সাধারণভাবে অধিকতর সহায়ক ছিল বলে বিবর্তনবিজ্ঞানীদের অভিমতআর এই প্রতিসাম্যের প্রতি আসক্তিই পরবর্তীতে সুন্দর জিনিসের প্রতি আসক্তির উস হয়ে যায়ব্যারো আরও বলেন কোন কোন বিশেষ আকার বা রঙ্গের প্রতি আসক্তি আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য উদ্বর্তনের সহায়ক উপযোজন হিসেবে কাজ করেছিল, যা পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে ফুল, চিত্রকলা, নক্সা ইত্যাদির প্রতি আসক্তির রূপ নেয়কাজেই দেখা যাচ্ছে শৈল্পিক বা নান্দনিক আসক্তির একটা উপযোগীয় কারণ ছিলসময়ের সাথে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সেই উপযোগজনিত কারণ কমে গেছে বা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছেকিন্তু প্রয়োজন ফুরালেও তখনকার সৃষ্ট সেই সৌন্দর্যচেতনা ফুরিয়ে যায়নি কশেরুকার নিচের coccyx নামক অঙ্গের মতই অতীতের স্বাক্ষর হয়ে এখনও বিরাজমানঅবশ্য সেই সৌন্দর্য চেতনারও অনেক রূপান্তর ঘটেছে, সেটাও বিবর্তনের কারণে বেটফেনের পঞ্চম সিম্ফনি বা রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী তারই উদাহরণব্যারো আরও একটা উদাহরণ দিয়ে যুক্তি দেন যে সংগীতের প্রতি আসক্তিও বিবর্তনভিত্তিকএর সপক্ষে উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের দুই জন পদার্থবিজ্ঞানীর এক আবিষ্কারের উল্লেখ করেনতাঁরা দেখলেন যে সব সভ্যতা বা কৃষ্টিরই সবচেয়ে জনপ্রিয় ধ্রুপদী বা আধুনিক সংগীতের সুরের মধ্যে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়এই বৈশিষ্ট্যকে শব্দবিজ্ঞানে বলা হয় 1/f type spectral noiseতাঁরা এই বৈশিষ্ট্য কম্পাঙ্কের এক বিরাট প্রসার বা range এর মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেনসকল কৃষ্টির মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যের সার্বজনীনতাই মানুষ প্রজাতির সংগীতের প্রতি আসক্তির এক সার্বজনীন বিবর্তনীয় ভিত্তির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেকারণ এটা খুবই কাকতালীয় ব্যাপার হত যদি সব সংস্কৃতিতেই একইরকম সংগীতের প্রতি আকর্ষণের উদ্ভব হত বিবর্তন ব্যতীতএছাড়া মস্তিষ্ক যে এক বিশেষ সুরধ্বনির সঙ্গে সমন্বিত, যা আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায় জানা গেছে (যার উল্লেখ পাওয়া যাবে ৪ নভেম্বর ২০০৪ সংখ্যার সায়ন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকায় Norman Weinberger এর লেখা মস্তিষ্ক ও সংগীত বিষয়ক প্রবন্ধে), সেটাও প্রমাণ করে যে সংগীতের উপত্তিও বিবর্তনজনিত, কারণ মস্তিষ্ক নিজেই বিবর্তনের কারণে সৃষ্টআবার এটা জানা গেছে যে মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ও ভ্রƒণ বিভিন্ন সুরের প্রতি বিভিন্নপ্রকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সংগীত বিচারে সক্ষম, যার উল্লেখ পাওয়া যাবে Robin Maconie এর সংগীত বিজ্ঞান” (The science of Music) বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠায়এর দ্বারাও এটা বোঝা যায় যে সংগীত জ্ঞান বংশাণুগত, সেহেতু বৈবর্তনিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মস্তিষ্ক ও সংগীতের মধ্যে যোগসূত্রের বিষয়ে আর একজনের গবেষণার কথা উল্লেখ করতে হয়আর তিনি হলেন আমেরিকার সান ডিয়েগোতে ক্যালিফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মস্তিষ্ক ও অবধারণ কেন্দ্রের মস্তিষ্কবিজ্ঞানী রামাচন্দ্রন, যাঁর লেখা বই Phantoms in the Brain সুপরিচিততিনি ও তাঁর সহকর্মী Hirstein চেতনা বিষয়ক সাময়িকী The Journal of Conciousness Studies, ৬/৭, ১৫-৪১তে শিল্পের বিজ্ঞান বা The science of Artনামক প্রবন্ধে স্নায়বিক গবেষণার ভিত্তিতে লব্ধ শিল্পরসবোধের বিভিন্ন দিকের ওপর তাঁদের মতবাদ জানান, যেমন (ক) শিল্পের যুক্তি, অর্থা কোন সার্বজনীন সূত্র আছে কিনা, (খ) বৈবর্তনিক কারণ, অর্থা এই সূত্রগুলোর বিকাশ হল কিভাবে এবং সূত্রগুলোর রূপটি যেমন তেমনটিই বা হল কেন এবং (গ) মস্তিষ্কের কোন বর্তনী এতে জড়িত ইত্যাদিএই সবের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা তাঁদের নান্দনিক অনুভূতির আটটি বিধি প্রস্তাব করেন, অনেকটা বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টমার্গের মত

সৌন্দর্যানুভূতির একটি বিশেষ দিক হল বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সৌন্দর্যানুভূতিএটাও বৈবর্তনিক ভিত্তিতে ভালভাবেই বোঝা গেছে বৈবর্তনিক মনোবিজ্ঞানের অনুসন্ধানে জানা যায় যে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে যে সকল বৈশিষ্ট্যকে সুন্দর বলে প্রতীয়মান হয় সেগুলো আসলে বংশানুক্রম যোগ্যতারই (Genetic Fitness) নির্দেশকবেশ কয়েকজন মনোবিজ্ঞানী নর ও নারীদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সন্ধান করেছেনতাঁদের মধ্যে প্রধান হলেন দেবেন্দ্র সিংহ ও ডেভিড বুস প্রমুখআর দুজনের নাম উল্লেখ করে শেষ করছি জীববিজ্ঞানী ও লেখক ম্যাট রিডলী তাঁর বই The Red Queenএ মস্তিষ্কে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সৌন্দর্য বোধের কারণ হিসেবে বিবর্তনের এক বিশেষ দিক বা যৌন নির্বাচনকে (Sexual Selection) চিহ্নিত করে এ নিয়ে সুবিস্তারে আলোচনা করেছেন পরিশেষে Geoffrey Miller এর লেখা এক গবেষণাপত্রের উল্লেখ করি যেখানে তিনি শৈল্পিক গুণাবলী এবং শৈল্পিক রসবোধ ও বিচারজ্ঞানকে যৌন নির্বাচন দ্বারা ব্যাখ্যার প্রয়াস করেছেনএই গবেষণা পত্রের বিস্তারিত পড়তে চাইলে পাঠকেরা এই সাইটে ক্লিক করতে পারেন

http://www.unm.edu/%7Epsych/faculty/aesthetic_fitness.htm

 

তথ্যসূত্রঃ

 

*      The Artistic Animal: an Inquiry into the Biological Roots of Art by Alexander Alland Jr., Anchor Books, 1977

*      Evolutionary Aesthetics, edited by Eckart Voland and Karl Grammer Heidelberg: Springer Verlag, 2003.

*      The Bard on the Brain: Understanding the Mind through the Art of Shakespeare and the Science of Brain Imaging by Paul Matthews and Jeffrey McQuain, Univ. Chicago Press, 2003

*      The Biological Foundations of Music edited by Robert Zatorre and Isabelle Peretz, New York Academy of Sciences, 2001

*      Cross-Pollinations: the Marriage of Science and Poetry by Gary Paul Nabhan, Milkweed Press, 2004

*      Evolution and Literature - D.A Evans, South Dakota Review.

*      Connections: the Geometric Bridge between Art and Science by Jay Kappraff, McGraw Hill, 1991

*      Einstein, Picasso: Space, Time and the Beauty that Causes Havoc by Arthur I. Miller, Basic Books, 2001

*      Where mathematics comes from; How the embodied mind brings mathematics into being - Lakoff & Nunez 2000

*      Physics and Music: the Science of Musical Sound by Harvey White and Donald White, Holt Rinehart Winston, 1980

*      Physics and Psychophysics of Music by Juan Roederer, Springer Verlag, 1995

*      Physics of Musical Instruments by Norman Fletcher and Thomas Rossing, Springer Verlag, 1998

 

অপার্থিব : মুক্তমনার ফোরামের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অপার্থিব এর সাথে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা হিসেবে ও লেখক হিসেবে পুরো নাম অপার্থিব জামান, তবে অপার্থিব নামেই লিখে থাকেন তাঁর লেখা তীক্ষè কুশলী ও বিশ্লেষণমুখীবিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য, যুক্তিবাদ অধিবিদ্যা তাঁর প্রিয় বিষয় সাহিত্য-মননসমৃদ্ধ এই লেখক বিজ্ঞানকে দেখেন শিল্পের এক অনিন্দ্য প্রকাশ হিসেবেপদার্থবিদ্যার এই স্নাতক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরতঅপার্থিবের কিছু লেখার সাথে পাঠক পরিচিত হতে পারবেন মুক্তমনার ওয়েবসাইট থেকে :
https://gold.mukto-mona.com/Articles/aparthib/
তার ইমেইল
[email protected]


 

[*] চলন্তিকার মতে সিসৃক্ষাহল সৃষ্টি করিবার ইচ্ছা

মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা):  যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected]