শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)বেরুলো

আমাদের সংগ্রাম চলবেই ...
ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প ও গণঅভ্যুত্থান

হায়দার আকবর খান রনো



এশিয়া এনার্জির সঙ্গে চুক্তির বিষয়বস্তু
ফুলবাড়ীর জনগণের সংগ্রামের যে বিজয় তা যেমন একদিকে ছিলো বিস্ময়কর, তেমনি গভীর তা
পর্যপূর্ণ। একটি সুনির্দিষ্ট সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে জনগণ বিজয়ী হলো। তবে লড়াই এখনো শেষ হয়নি। ফুলবাড়ীর বিজয় একটি প্রাথমিক বিজয় মাত্র। এই বিজয়কেও ছিনিয়ে নেবার ষড়যন্ত্র চলছে।


সংক্ষেপে ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রকল্প সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত পাঁচটি কয়লাখনির সন্ধান পাওয়া গেছে - ১. জামালগঞ্জ, ২. বড়োপুকুরিয়া, ৩. ফুলবাড়ী, ৪. খালিসাপাড়া ও ৫. দিঘিপাড়া। প্রথমটি জয়পুরহাট এবং বাকী চারটি দিনাজপুর জেলায়। জামালগঞ্জে রয়েছে সবেচেয়ে বড়ো মজুত এক বিলিয়ন টন। কিন্তু কয়লা স্তরটি রয়েছে তিন হাজার ফিট নিচে। সাধারণ প্রযুক্তিতে তা উত্তোলন সম্ভব নয়। বড়ো পুকুরিয়া এক চীনা কোম্পানিকে কয়লা উত্তোলনের জন্য ঠিকাদারী দেয়া হয়েছে। এই খনির মালিক বাংলাদেশ এবং উত্তোলিত কয়লার উপর বাংলাদেশের পুরো অধিকার থাকবে। এ ব্যাপারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। খালিসাপাড়া ও দিঘিপাড়ায় এখনও কোনো কাজ শুরু হয়নি। এবার আসা যাক ফুলবাড়ী প্রসঙ্গে।


এই খনিটি ৩০ বছরের জন্য লিজ দেয়ার চক্রান্ত চলছিলো। সেজন্য ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে বিএইচপি নামে অস্ট্রেলিয়ার এক কোম্পানির সাথে অনুসন্ধান (ঊীঢ়ষড়ধঃরড়হ) চুক্তি করে সরকার। পরে ১৯৯৭ সালে ঐ কোম্পানি লিজিং লাইসেন্স এক ব্রিটিশ কোম্পানি এশিয়া এনার্জির কাছে বিক্রি করে। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে সরকারের সাথে এশিয়া এনার্জির চুক্তি হয়।


২০০৫ সালের অক্টোবরে এশিয়া এনার্জি অনুসন্ধানের কাজ সম্পন্ন করে সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্ট গৃহীত হলে ওই কোম্পানিকে ৩০ বছরের জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খননের জন্য লিজ দেয়া হতো। উত্তোলিত কয়লার পুরোটার (অর্থা
পুরো কয়লাখনির) মালিক হতো এশিয়া এনার্জি কোম্পানি। তারা ঐ কয়লা রপ্তানি করার এবং বিক্রি করার অধিকার পেতো। বিনিময়ে বাংলাদেশ পেতো উত্তোলিত কয়লার ৬ শতাংশ মাত্র রয়্যালটি হিসেবে।


মাইনিং অ্যাক্ট
কেন মাত্র ৬ শতাংশ? এটা মাইনিং অ্যাক্ট অনুসারে রাষ্ট্রের প্রাপ্য। এই মাইনিং অ্যাক্ট সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। ঔপনিবেশিক আমলে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থেই এই অ্যাক্ট প্রণীত হয়েছিলো, যেখানে কয়লা খানি কোনো দেশী বিদেশী কোম্পানি চিরস্থায়ী লিজ দেবার কথা ছিলো এবং রয়্যালটিও নির্ধারিত ছিলো - উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হলে উত্তোলিত কয়লার ৬ শতাংশ এবং সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে হলে ৫ শতাংশ। এর মানে কার্যত বিনামূল্যে কোনো কোম্পানিকে খনির পুরো মালিকানা দেবার বিধান ছিলো। ১৯৮৯ সালে এই অ্যাক্টে সংশোধনী আনা হয়। রয়্যালটির পরিমাণ বর্ধিত করা হয়। ১৯৯৯ সালে এশিয়া এনার্জির স্বার্থেই পুনরায় রয়্যালটির পরিমাণ কমানো হয়, পুরাতন জায়গায় অর্থা
৫ বা ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হয়।


উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি খনন
ফুলবাড়ী কয়লা খনিতে মজুত আছে ৫৭২ মিলিয়ন টন। যেভাবে চুক্তি হয়েছে তাতে ৩০ বছরে ওই মজুত শেষ হয়ে যাবে। চুক্তি অনুসারে উত্তোলন করা হবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে। এতে উত্তোলনের পরিমাণ বেশী হলেও তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া হতো মারাত্মক। প্রথমত, প্রায় ৫০-৬০ হাজার মানুষকে স্থানান্তরিত করা হতো। পুরো কয়লা অঞ্চলের সকল ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে হতো। ওই অঞ্চলের মাটি খুবই উর্বর। কিন্তু সেখানে কোনো শস্যক্ষেত থাকতো না। গাছপালা, গরু ছাগল পশুপাখি পুকুর জলাশয় কিছুই থাকতো না। সবচেয়ে মারাত্মক যেটা তা হলো পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতো। মাটি ও কয়লার মধ্যবর্তী অবস্থায় রয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। সেই পানির স্তর পাম্প করে অন্যত্র সরাতে হবে। সেজন্য প্রযুক্তিগত সমস্যা তো রয়েছেই। তাছাড়া তিরিশ বছর ধরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে শূণ্য করা হলে মাটির উর্বরতা আর থাকতো না এবং শুধু খনি অঞ্চলই না, গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে মরু প্রক্রিয়া দেখা দিতো। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি খনন বাংলাদেশের জন্য কোথাও প্রযোজ্য হতে পারে না।


এশিয়া এনার্জি ও বাংলাদেশী দালাল
ব্রিটিশ কোম্পানি এশিয়া এনার্জি একাই আমাদের কয়লা সম্পদ লুট করার মধ্যে ছিলো না। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছিলো দু’টি আন্তর্জাতিক ব্যাংক-মরগান ও বার্কলে। তাহলে বিষয়টি ছিলো সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের বিষয়। এইভাবেই বহুজাতিক ব্যাংক ও বহুজাতিক কোম্পানি যৌথভাবে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লুণ্ঠন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের যে সংগ্রাম তা ছিলো সুনির্দিষ্টভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম। এখানে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এশিয়া এনার্জি কিন্তু এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে খনি খননের অনুমতি পায়নি। তবে পেতে যাচ্ছিলো। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিলো। কিন্তু এশিয়া এনার্জি তার আগেই বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে দাবি করেছিলো যে, তারা ফুলবাড়ী কয়লাখনির শতকরা একশত ভাগের মালিক হয়েছে। এবং তার ভিত্তিতে লন্ডনস্থ স্টক বাজারে স্টকের মূল্য বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলো। এটা ছিলো স্রেফ জোচ্চুরী।


এশিয়া এনার্জি একরকম নিশ্চিতই ছিলো যে, ফুলবাড়ী কয়লাখানির মালিকানা পেতে যাচ্ছে নিশ্চিতভাবেই সরকারের কোনো মহল তাদেরকে এব্যাপারে নিশ্চয়তা দান করেছিলো। কিন্তু এশিয়া এনার্জি ও তার দালালদের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো জনগণের সাহসী প্রতিরোধের মুখে।


গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন যে, এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ছিল জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং এই চুক্তি যারা করেছিল তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। এরপরপরই আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরও বললেন একই কথা। তিনিও বললেন যে, এই চুক্তি ছিলো জাতীয় স্বার্থবিরোধী। তবে এই চুক্তির জন্য মাহমুদুর রহমান আওয়ামী লীগকে এবং ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিএনপিকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। আসলে এই চুক্তি হয়েছিলো দুই পর্যায়ে দুই আমলে ১৯৯৪ সালে বিএইচপি-এর সঙ্গে চুক্তি করে তদানিন্তর বিএনপি সরকার এবং তারই ধারাবাহিকতায় একই চুক্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালে। তবে একটা ব্যাপার - ঐ দুই ঐ প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেতা আবার ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তা হলো, তাদের মতে, চুক্তি তা যতোই খারাপ হোক না কেন, বাতিল করা যাবে না। কারণ তাতে নাকি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নিরু
সাহিত হবে। আসলে দুটি বড় দলই এশিয়া এনার্জি তথা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করেছে।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন হচ্ছেন এশিয়া এনার্জির মতো লুটেরা কোম্পানির আইন উপদেষ্টা । এখনও পর্যন্ত তিনি এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে বা জনগণের সংগ্রামের পক্ষে একটি কথাও বলেননি। এই সকল ভ- নেতাদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার।


এখানে আরও উল্লেখ্য যে, যে কমিটি এশিয়া এনার্জির রিপোর্টটি পরীক্ষা করে দেখবে এবং এশিয়া এনার্জিকে খননের অনুমতি দেয়া যায় কি যায় না তা স্থির করবে, সেই কমিটির অনেকেই আবার এশিয়া এনার্জির কনসালটেনসি করছে।


এশিয়া এনার্জি সরকারি মহলে ও সরকারের বাইরে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, আমলা, তথাকথিত সিভিল সমাজ, বুদ্ধিজীবী-বিশেষজ্ঞ ও মিডিয়ার লোকজনদের দালাল বানানোর চেষ্টা করেছিলো। তারা স্থানীয় কিছু লোককে দালাল বানানোর চেষ্টা করেছিলো। স্থানীয় পর্যায়ে ও উপরতলায় কিছু দালাল তৈরিও হয়েছিলো। কিন্তু তারা যা পারেনি তা হলো জনগণকে কিনতে বা বোকা বানাতে। বস্তুত, কোনো বুর্জোয়া দলই এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। বরং তারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে এশিয়া এনার্জির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। একমাত্র বামপন্থী রাজনৈতিক দল গ্রুপ ও ব্যক্তিরাই এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এবং সংগ্রাম করেছেন।


এশিয়া এনার্জি বা এই ধরনের বহুজাতিক কোম্পানি তাদের মুনাফার জন্য এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করতে পারে না। সম্প্রতি (৩ সেপ্টেম্বর) লন্ডনস্থ গার্ডিয়ান পত্রিকার রবিবারের সংখ্যায় (সানডে অবজারভার) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘অ্যাকশন এইড’ নামক এ আন্তর্জাতিক এনজিও’র কান্ট্রি ডিরেক্টর নাসরিন হলের মৃত্যুর জন্য এশিয়া এনার্জিকে সন্দেহ করা যেতে পারে। তিনি এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। ‘সানডে অবজারভার’ বলছে, ওটি দুর্ঘটনা ছিলনা। তা ছিল পরিকল্পিত হত্যাকা-। নাসরিন হক এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের জন্য ত
পর ছিলেন। এজন্য ব্রিটিশ ঋণতাদা সংস্থা উঋওউ-এর কর্মকর্তা নাসরিন হককে ধমক দেবার চেষ্টা করেন, তবে নাসরিন হক তাতে ভীত হয়ে পিছিয়ে আসনেনি। এটাই ছিলো তার মৃত্যুর কারণ।


২৬ আগস্ট (২০০৬) বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর বিডিআর-এর গুলি এবং ২৬ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ফুলবাড়ীতে যে গণবিস্ফোরণ ঘটেছিলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয় এবং ঘোষণা করে যে, এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হবে। আমাদের প্রশ্ন, গুলি ও গণঅভ্যুত্থানের আগে কেন সরকার নিজ উদ্যোগে তখন খারাপ চুক্তিটি বাতিল করেনি।


সরকার কর্তৃক চুক্তি বাতিলের ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ ফুলবাড়ীতে জনসভা করে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলসহ আন্দোলনকারীদের ছয়দফা দাবির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। আমাদের প্রশ্ন, আগে কেন তারা এই দাবির প্রতি সমর্থন জানায়নি? এমনকি ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীতে হত্যাকা-ের পর হত্যা ও গুলির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল হরতাল ডাকলেও, তখনও আওয়ামী লীগ এশিয়া এনার্জির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের দাবি তোলেনি। তার মানে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ কোনো বুর্জোয়া দলই সাম্রাজ্যবাদের বিরাগভাজন হতে চায়নি, প্রকারান্তরে এশিয়া এনার্জির পক্ষেই দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু বড় বড় রাজনৈতিক দল, তথাকথিত সিভিল সমাজ, নামী দামী ব্যক্তিদের তোয়াক্কা না করেই জনগণ বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বিজয় ছিনিযে আনতে সক্ষম হয়েছে। এটি একটি বিরাট রাজনৈতিক শিক্ষা হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। এবার সেই গণআন্দোলন যা গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিলো, তার কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।


ফুলবাড়ির গণঅভ্যুত্থান
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়িতে কয়লা খনি খনন হতে যাচ্ছে এটা যখন জানাজানি হয়, তখন ফুলবাড়িতে একটি ‘ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটি’ গঠিত হয়েছিলো ২০০৫ সালেই। এর মধ্যে বাম ডান, সরকারি বিরোধী সকল দলের স্থানীয় নেতা এবং ফুলবাড়ীর সকল স্তরের প্রতিনিধি ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া দলগুলোর নেতারা সরে পড়েন। বস্তুত তারা এশিয়া এনার্জির দালাল রূপে চিহ্নিত হন। পরবর্তী পর্যায়ে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যু
-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বিরোধী অর্থা এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বিরোধী আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই সম্পর্কিত বহু লেখালেখিও করেছেন অনেক দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী ও বাম রাজনৈতিক নেতা। এই আন্দোলনটি ছিলো প্রচারধর্মী।


২৬ আগস্ট (২০০৬) ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ফুলবাড়ী পৌরসভার কেন্দ্রস্থলে জমায়েত হয় প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ। নারী পুরুষ তরুণ মাঝবয়সী এবং বাঙালী ও সাঁওতাল। তাদের অনেকের হাতে ছিল লাঠি। ফেস্টুন ব্যানারও ছিল। তারা এসেছিলেন পৌরসভার বিভিন্ন পাড়া থেকে, আবার দূরের গ্রাম থেকেও। তাদের চোখেমুখে ছিলো প্রতিরোধের আগুন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত তারা এশিয়া এনার্জির অফিস আক্রমণ করেন নি। অফিসটি পাহারা দিয়ে রেখেছিল বিডিআর। সামান্য সংঘর্ষ হয়েছিল পুলিশের সঙ্গে। কিন্তু গুলি করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবু এক পর্যায়ে বিডিআর পাখি শিকারের মতো করেই গুলি চালাল। ছয়জনের প্রাণহানি ঘটে। আহতদের সংখ্যা অসংখ্য।


এমন দৃশ্য বাংলাদেশে নতুন নয়। অনেকবারই জনতার সঙ্গে পুলিশ মিলিটারী বিডিআর-এর সংঘর্ষ ও সাধারণ মানুষের সাহসী লড়াইয়ের ঘটনা ইতোপূর্বে বেশ অনেকবার দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে। এবারও যে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করলাম সেরকম ঘটনা বাংলাদেশে একেবারে নতুন না হলেও খুব বেশী নয়। ১৯৬২, ১৯৬৯ অথবা এরশাদ বিরোধী সংগ্রামের কিছু কিছু সময় যে ধরনের গণবিস্ফোরণ দেখেছি, তার সঙ্গে তুলনীয় ছিলো ফুলবাড়ীর ঘটনা। ২৭ আগস্ট (২০০৬) থেকে ফুলবাড়ীতে প্রশাসন যেন ভেঙে পড়েছিলো। জনতার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। সারাক্ষণ চলছে মিছিল ও সভা। ক্রুদ্ধ জনতা এবার আক্রমণ করল এশিয়া এনার্জির অফিস। তাদের জিনিসপত্র ভাঙচুর করল। এশিয়া এনার্জির বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে গুড়িয়ে দিলো। চিহ্নিত দালালদের বাড়ি আক্রমণ করলো। এদিকে লাগাতার হরতাল চলছে। এশিয়া এনার্জি এবং গুলি চালিয়েছে যে বিডিআর তার সঙ্গে অসহযোগ চলছে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সংগ্রামী জনগণ এশিয়া এনার্জিকে (তার কর্মকর্তারা আগেই পুলিশ প্রহরাধীনে ফুলবাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিল) ফুলবাড়ী থেকে বিতাড়িত করেছে, এখন তারা প্রস্তুত হচ্ছে কোনো বৃহত্তর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। একেই বলে গণঅভ্যুত্থান।


২৬ থেকে ৩০ আগস্ট (২০০৬) ফুলবাড়ীর জনগণ যে ইতিহাস সৃষ্টি কলেছিলো, তা সত্যিই বিস্ময়কর। চোখে না দেখলে পুরোটা বোঝানো সম্ভব নয়। আমি এই অভ্যুত্থানের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে উল্লেখ করতে চাইঃ


১. প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, পুলিশ বাধ্য হয়ে সরে পড়েছে, এশিয়া এনার্জির স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, দালালদের বাড়ি আক্রমণ হচ্ছে কিন্তু জনগণের নিরাপত্তা বিঘিœত হয়নি। কোনো চুরি ডাকাতি বা লুটতরাজ ইত্যাদি হয়নি। এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা স্বাভাবিক সময়ের বেশি নিশ্চিত ছিলো। আমাদের দেখা অতীতের যে কোনা গণঅভ্যুত্থানের সময়ও এই বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করা গেছে।


২. এই অভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছিলো তারা সবাই গরীব খেটে খাওয়া মানুষ। দ্ইু একজন খুদে ব্যবসায়ী ছাড়া সকলেই শ্রমজীবী। হরতালের কারণে গরীব মানুষের আর্থিক কষ্ট হয়েছে খুব বেশি। তবু তারা হাসিমুখে এই কষ্ট স্বীকার করেছিলেন। ফুলবাড়ীর ঘটনা আরেকবার প্রমাণ করলো গরীব শ্রমজীবীরা ধনীদের চেয়ে অকেন বেশি দেশপ্রেমিক, ত্যাগ করতে জানেন এবং সংগ্রামী।


৩. অনেকের ধারণা যে, জায়গা জমি হারানোর আশংকায় জনগণ এতোটা মারমুখী হয়ে উঠেছিলো। কথাটা আংশিক সত্য। অবশ্যই ফুলবাড়ীর মানুষ তাদের জায়গা জমি হারাতে চায় না। কিন্তু এই আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের একটা বড় অংশের তো কিছুই নাই। একেবারে নিঃস্ব। তবু তারাই সবচেয়ে সংগ্রামী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার মানে এই নিঃস্ব গরীব মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমটাই প্রধানত কাজ করেছে।


৪. এটাও দেখা গেছে যে, গরীব মানুষ, রিকশা ভ্যানচালক, ক্ষেতমজুর, দোকান কর্মচারী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবী এবং তাদের পরিবারের নারী সদস্যরা ফুলবাড়ী প্রকল্পের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করছেন। পাঁচ-ছয় শতাংশ রয়্যালটির বিষয়টিও আলোচনা করছেন, যা আমি নিজ কানে শুনেছি। আমার মনে হয়েছে, তারা শহরে তথাকথিত ভদ্রলোক, এমনকি প-িত বলে পরিচিত নামীদামী অনেক লোকের চেয়েও বেশি সচেতন। অথচ তাদের প্রায় সকলেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে কিছুই নেই। তথাকথিত সিভিল সোসাইটির লোকেরা যে বিষয়টি জানেন না, বা জেনেও মুখ খোলেন না হয় সাহসের অভাবের অথবা সুবিধাবাদী বলে, তাদের চেয়ে ফুলবাড়ীর ওই সংগ্রামী মানুষকে অনেক বেশি উন্নত, সচেতন ও দেশপ্রেমিক বলে আমার মনে হয়েছে।


৫. এই সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ ছিলো উল্লেখযোগ্য। শ্রমজীবী পরিবারের নারীরা, মায়ের বয়েসী ও কমবয়েসী নারীরা যেভাবে সভা মিছিলে অংশ নিয়েছেন, বক্তৃতা করেছেন, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ করেছেন (২৬ আগস্ট, ২০০৬) তা নিঃসন্দেহে উল্লেখ করার মতো বিষয়। এই গরীব শ্রমজীবী নারীরা বক্তৃতাও করেছেন। কি তেজোদ্দীপ্ত ভাষা, কি চম
কার যুক্তি, কি সাহস আমি অবাক হয়েছি তাদের বক্তৃতা বা আলোচনা শুনে। আন্দোলনে বিজয়ী হবার পর ৩১ আগস্ট মাঝবয়েসী ও কমবয়েসী সাধারণ গরীব নারীরা যেভাবে সুশৃঙ্খলভাবে দলবদ্ধভাবে আনন্দ নৃত্য করেছেন, তা অনেকেই টেলিভিশনে দেখেছেন। আমি মনে মনে ভেবেছি, কোথায় গেলো মৌলবাদীর দল? যে কোনো প্রকৃত গণআন্দোলন প্রতিক্রিয়ার দুর্গকে আঘাত করে এবং জনগণের সচেতনতা ও তাদের সাংস্কৃতিক মান বৃদ্ধি করে - এই সত্যটা ফুলবাড়ী আবার দেখিয়ে দিলো।


৬. আদিবাসীদের (সাঁওতাল) অংশগ্রহণ ছিলো উল্লেযোগ্য। আদিবাসী এবং নারীরা হচ্ছে গরীবের মধ্যে গরীব, শোষিতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোষিত ও বঞ্চিত। তাই যে কোনো প্রকৃত গণসংগ্রামে তাদের সক্রিয অংশগ্রহণ থাকে সবচেয়ে বেশি। তাদের সংগ্রামী মেজাজ দেখে মনে হয়েছে তারা যথার্থই সিধু কানুর ঐতিহ্য বহন করছেন।


৭. এই আন্দোলনে রাজনৈতিক দল হিসাবে বামপন্থীরা সক্রিয় ছিল। বুর্জোয়া দলের উপস্থিতি একেবারেই ছিল না। কোনো কোনো বুর্জোয়া দলের কোনো কোনো নেতা সরাসারি দালালি করেছে অথবা নিরাপদ দূরত্বে থেকেছে।


অভিজ্ঞতার ভা-ার বিপুল। সবটা উল্লেখ করা গেলো না। কয়েকটা মূল পয়েন্ট উল্লেখ করা হলো মাত্র।


বিপদ এখনো কাটেনি
ফুলবাড়ীর অভ্যুত্থানের রূপ দেখে সরকার ভীত ও বিচলিত হয়ে পড়েছিল। তাই ৩০ আগস্ট (২০০৬) তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। বস্তুত, জনগণের পক্ষ থেকে যে ছয় দফা প্রণয়ন করা হয়েছিলো, সরকারের পক্ষ থেকে তা হুবহু মেনে নেয়া হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা সরকারের প্রতিনিধি প্রেস ও জনগণের সামনে ঘোষণা দেয় যে, এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হবে, বাংলাদেশে এশিয়া এনার্জির কাজ নিষিদ্ধ করা হবে, কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি খনন করা হবে না এবং ভবিষ্যতে অন্য কোনো পদ্ধতিতে খনন করতে হলেও তা জনগণের মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে। বর্তমান সরকার ও পরবর্তী যে কোনো সরকার যদি এই ঘোষণার প্রতি আন্তরিক থাকে, তবে বলতে হবে অবশ্যই এটা একটা বিরাট বিজয়। জনগণ রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করে অন্তত একটা জায়গায় সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেছে।


কিন্তু মুনাফার লালসায় যারা দেশ দখল করতে পারে, মানুষ খুন করতে পারে, তারা অতো সহজে পিছু হটে যাবে, এমন আত্মতুষ্টিতে থাকার কোনো কারণ নাই। সম্ভবত উন্মুক্ত পদ্ধতিতে আর কোথাও কয়লা খনি খননের উদ্যোগ নিতে ঝুঁকি নেবে না ভবিষ্যতের কোনো সরকার। কিন্তু অন্য নামে হয়তো এশিয়া এনার্জি আসবে, অথবা আসবে আর কোনো বহুজাতিক কোম্পানি। আশংকা আছে, হয়তো কোনো বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিকে সুড়ঙ্গ করে কয়লা খননের সুযোগ দেয়া হবে, পাঁচ কি ছয় কি বড়োজোর বিশ শতাংশ রয়্যালিটির বিনিময়েÑ কয়লাখনির পুরো মালিকানা বিদেশীদের হাতে দেয়া হবে।


ইতোমধ্যেই সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মুখ থেকে নানা ধরনের কথা উঠেছে। কিছু কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বলতে শুরু করেছেন, বিদেশী বিনিয়োগ দরকার। তারা বিনিয়োগ আর ডাকাতির মধ্যে পার্থক্য দেখেন না। কেউ কেউ বলছেন যেহেতু আমাদের প্রযুক্তি জ্ঞান নাই, সেহেতু কিছু রয়্যালিটির বিনিময়ে বিদেশীদের ডেকে আনা ছাড়া উপায় কি? কয়লা মাটির তলায় থেকে লাভ কি হবে, ইত্যাদি। এর উত্তরে আমাদের বলতে হবে, কয়লা বিদেশীদের হাতে কার্যত বিনা মূল্যে দিয়ে দেবার চেয়ে মাটির তলায় থাকা তো বরং ভালো, ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সুনির্দিষ্ট দু’টি বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরতে হবে।


(১) আমাদের পাঁচ কি দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের প্রতিভাবান ব্যক্তিদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে খনি মালিকানা ও উ
পাদিত কয়লার পুরো মালিকানা বাংলাদেশের কাছেই থাকবে; অথবা


(২) কয়লা খনি ও উ
পাদিত কয়লার উপর পুরো মালিকানা রক্ষা করে বিদেশী অভিজ্ঞ ঠিকাদার নিয়োগ করতে পারি (যেমন করা হয়েছে বড়োপুকুরিয়ার ক্ষেত্রে)।


কিন্তু কোনোক্রমেই কয়লাখনি লিজ দেয়া চলবে না। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটির লোকেরা বা কোনো কোনো রাজনীতিবিদ নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর যুক্তি দেয়া শুরু করবে। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। বাম ও দেশপ্রেমিক শক্তির কাজ হলো এই ধরনের ভ্রান্ত (দালালির) যুক্তিকে খ-ন করা, জনগণকে আরও সচেতন করে তোলা এবং আরও বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করা। ফুলবাড়ীর জনগণ এশিয়া এনার্জিকে তাড়িয়েছে। কিন্তু আবার যেন অন্য কোনো বহুজাতিক কোম্পানি পেছনের দরজা দিয়ে না আসতে পারে সেজন্য সজাগ, সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।

 


হায়দার আকবর খান রনো, রাজনীতিবিদ ও প্রবন্ধকার। ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রত্যক্ষভাবে বাম রাজনীতির সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। চিন্তাশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য।

 


 

মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা):  যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected], অথবা [email protected]  

অথবা,

ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০