একজন গভীরভাবে ধর্মনিষ্ঠ অবিশ্বাসী
“আমি ব্যক্তি ঈশ্বরের কল্পনা করতে চাইনা; আমরা আমাদের অসম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় যে মহাবিশ্বের গড়ন এখন পর্যন্ত সম্যক বুঝতে পেরেছি এতেই শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়ে আমরা আপ্লুত।”
- আলবার্ট আইনস্টাইন। (১)
হৃদয় নিঃসৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি
একটি কিশোর সবুজ ঘাসের ওপর অধোমুখে শায়িত, ওর চিবুক দু'হাতের তালুর ওপর বিশ্রাম করছে। হঠাৎ করেই সে অভিভূত হয়ে পড়ল জটপাকানো কিশলয় আর শিকড়ের উচ্চকিত সচেতনতায়, কিম্বা ক্ষুদ্র জগতে বনের আবির্ভাবে, অথবা পিঁপড়া ও ঝিঁঝিঁ পোকার রূপান্তরিত এক জগতের আকস্মিক উপস্থিতিতে; এমন কি অভিভূত হয়ে ঊঠতে পারে, যদিও সে সময় অত বিশদ জানত না, কোটি কোটি ব্যাক্টেরিয়ার সমাহার ক্ষুদ্র জগতের স্বল্প পরিসরে নিশ্চূপ ও অদৃশ্যভাবে পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠায়। অকস্মাৎ মনে হল, সবুজ ঘাসের চাদরের ক্ষুদ্র বনানীটি যেন ফুলে ফেঁপে উঠল এবং মহাবিশ্বের সাথে এক হয়ে মিশে গেল; আর বালকটি নিবিষ্ট মন নিয়ে এর গভীরে হল আত্মমগ্ন। এই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সে ব্যাখ্যা দাঁড় করাল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে - একটি অলৌকিক ঘটনা রূপে। পরবর্তীকালে কিশোরটি পরিণত হল একজন পুরোপুরি পুরোহিতে। তিনি এঙ্গলিয়ান পুরোহিত হিসেবে দীক্ষিত হলেন, এবং হয়েছিলেন আমার বিদ্যালয়ের ধর্মগুরু ও আমার একজন প্রিয় শিক্ষক। তাঁকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর মত চমৎকার উদারপন্থী একজন পাদ্রী পেয়েছিলাম - এ আমার ভাগ্য; কাজেই আমাকে কেউ বলতে পারবে না যে সে সময় ধর্মের অমৃত আমাকে গলাধঃকরণ করানো হয়েছিল।
অন্য কোন মুহূর্তে এবং অন্য কোথাও, ঐ কিশোরটি হতে পারতাম আমি - নক্ষত্রখচিত কালো আকাশের নীচে - অভিভুত হচ্ছি কালপুরুষ, কাশ্যপেয় এবং সপ্তর্ষী প্রভৃতি তারাপুঞ্জের মোহনীয় দৃশ্যে, মোহিত হচ্ছি অশ্রসজল চোখে ছায়াপথের অশ্র“ত সঙ্গীতের মুর্চ্ছনায়, অথবা লাল জেসমিনের রাতের সুবাসে এবং আফ্রিকার উদ্যান থেকে ভেসে আসা উগ্র ঘ্রানযুক্ত ফুলের সৌরভে আমি বিমোহিত। প্রশ্ন হচ্ছে একই ধরনের অনুভূতি বা হৃদয়াবেগ আমার ধর্মগুরুকে ঠেলে নিয়ে গেল একদিকে, আর আমাকে ঠিক বিপরীতে, অন্যদিকে - কিন্তু কেন? উত্তরটি কিন্তু সহজ নয়। প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের প্রতি আধা-মরমী সাড়াদান বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীদের মধ্যে একটি সাধারণ ঘটনা। এর সাথে আধিভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নেই। আমার ধর্মগুরু, অন্তত শৈশবকালে, আমার মনে হয় ডারউনের 'দ্য অরিজিন অব স্পিসিজের' সমাপনী পঙক্তিগুলোর কথা জানতেন না (এবং আমিও না), সেই বিখ্যাত 'এনট্যাঙ্গল্ড ব্যাংক' অনুচ্ছেদটি, যার অভ্যন্তরে রয়েছে সেই অনুপম কথাগুচ্ছ :
“যেখানে ঝোপঝাড়ের ওপর পাখীরা গাইছে, যেখানে বিচিত্র ধরনের পোকা-মাকড় ইতস্তত ঘুরছে-ফিরছে, আর যেখানে আর্দ্র মাটির নীচে কীট-কৃমিরা গুটিগুটি করে প্রবেশ করছে .. .. । ”
তিনি যদি এই কথাগুলো তখন জানতেন তাহলে তৎক্ষণাৎ এই কথাগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে যেতেন, আর পরিণামে পাদ্রী না হয়ে, হয়ে উঠতে পারতেন একজন ডারউইনবাদী এবং বিশ্বাস করতেন, সবকিছুই 'উৎপন্ন হয়েছিল আমাদের চতুর্দিকে ক্রিয়াশীল নিয়মের ভেতর দিয়ে': (২)
পাঠগ্রহণ কালে আমাদের খেলা ছিল - তাঁকে ধর্মীয় পুস্তকের পৃষ্ঠা থেকে সরিয়ে এনে 'ফাইটার কমান্ডের' বা এ ধরনের কতিপয় রোমাঞ্চকর গল্পের দিকে টেনে আনা। তিনি রয়্যাল বিমান বাহিনীতে যুদ্ধকালীন কর্মে নিযুক্ত ছিলেন; এই হৃদ্যতা নিয়ে, এবং সঙ্গে ইংল্যান্ডের চার্চের প্রতি এখনও পোষণকরা কিছু ভালবাসা নিয়ে (অন্তত প্রতিযোগিতার সাথে তুলনা করে), আমি পরবর্তীকালে জন বেৎজেম্যানের কবিতা পড়েছিঃ আমাদের পাদ্রী একজন পুরানো বৈমানিক, তারা এখন নিষ্ঠুরভাবে তাঁর ডানাগুলো কর্তন করেছে, কিন্তু এখনও রেক্ট্রি উদ্যানের পতাকাবাহী দন্ডটি অনেক উচ্চতর বিষয়াভিমুখে দিক নির্দেশ করে .. .. .. ।
সুতরাং, প্রকৃতির যুদ্ধ থেকে, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু থেকে আমাদের কল্পনায় অধিকাংশ সর্বোৎকৃষ্ট মূল্যবান বস্তুনিচয়, যেমন উচ্চতর জীব-জন্তুর উৎপত্তি, সরাসরি উপজাত হয়। জীবনের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিতে মহত্ত আছে, যার সাথে জড়িয়ে আছে নানা প্রকৃতির ক্ষমতা, যা আদিতে কতিপয় রূপে বা এককে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করত; এবং যখন চিরন্তন অভিকর্ষের নিয়ম অনুযায়ী এই গ্রহটি চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকল, অতি সরল আরম্ভ থেকে অন্তহীন রূপে প্রাণের বিবর্তন ছিল চমৎকার ও বিস্ময়াপন্ন, এবং তা ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে।
'পেল ব্লু ডট' এ কার্ল সাগান লিখেছিলেন ঃ
এটি কি রকম ব্যাপার হল যে, কোন ধর্মই বিজ্ঞানের প্রতি সামান্যতম দৃষ্টিপাত করে বলেনি, “এটি আমরা যা ভেবেছিলাম তার চাইতে ভাল। আমাদের পয়গম্বররা যা বলেছিলেন তার চাইতে মহাবিশ্ব কি অনেক বৃহৎ, মহত্তর, সূক্ষ্মতর, অধিকতর সুচারু?” পরিবর্তে তাঁরা বলেন, “না, না, না। আমার দেবতা এক ক্ষুদ্র দেবতা, এবং আমি চাইব তাকে সে ভাবেই রাখতে।”(৩) মহাবিশ্বের বিশালতার ওপর, যা ইতোমধ্যেই আধুনিক বিজ্ঞান প্রকটিত করেছে, যে ধর্ম, তা পুরাতনই হোক আর নতুনই হোক, অধিকতর গুরুত্ব দেবে সেই ধর্ম অবশিষ্ট শ্রদ্ধাকে আকর্র্ষণ করতে পারবে; এবং মনে হয় না যে প্রথাগত বিশ্বাস থেকে উৎক্ষরিত ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধাকে ধর্ম আর ধরে রাখতে পারবে।
কার্ল সাগানের বইগুলো তুরীয় বিস্ময়ের স্নায়ু-প্রান্তকে স্পর্শ করে - যে অপার বিস্ময়কে গত শতাব্দীগুলোতে ধর্ম এতদিন নিজের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আমার লেখা বইগুলোও সে একই আকাক্সক্ষাতেই লেখা। ফলে আমি অভিযোগ শুনতে পাই যে, আমি না কি গভীরভাবে ধর্মনিষ্ঠ। জনৈক আমেরিকান ছাত্র আমাকে লিখেছিল যে সে তার অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমার সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণা আছে কি না। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন 'অবশ্যই'। 'তাঁর ইতিবাচক বিজ্ঞান ধর্মের সাথে সঙ্গতিহীন, কিন্তু তিনি প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের চারপাশে মোমের পালিশ লাগিয়ে হর্ষোৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। আমার কাছে এটাই তো ধর্ম।'
কিন্তু ধর্ম কি সঠিক শব্দ ? নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদ (এবং নাস্তিক) স্টিভেন ভাইনবার্গ তাঁর 'ড্রিম অব ফাইনাল থিওরি' গ্রন্থে অনেকের মতই এ বক্তব্য রেখেছিলেন ঃ
অনেকে ঈশ্বর সম্পর্কে বেশ উদার, প্রশস্ত এবং নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন - ফলে এটি অসম্ভব নয় যে তারা যেখানে ঈশ্বরকে খুঁজবে সেখানেই তাঁর দেখা মিলবে। আমরা এমন কথাও বলতে শুনি - 'ঈশ্বরই হলেন চরম বা শেষ পরিণতি', কিম্বা 'ঈশ্বর হলেন প্রকৃতির সুন্দরতম প্রকাশ', অথবা 'ঈশ্বরই হলেন মহাবিশ্ব'। অবশ্যই, যে কোন শব্দের মত ঈশ্বর শব্দের ওপরও আমরা পছন্দ মত অর্থ আরোপ করতে পারি। আপনি যদি বলতে চান -'ঈশ্বরই শক্তি' অবশ্যই তা বলতে পারেন, এবং তাহলে আপনি একখন্ড কয়লাতেও তাঁর সন্ধান পাবেন।
ভাইনবার্গ অবশ্য সঠিক বলেছেন যে ঈশ্বর শব্দটি, যদি না এর অর্থ মানুষের কাছে অকেজো হয়ে পড়ে, জনগণ সাধারণত যে ভাবে বোঝে সেই অর্থেই ব্যবহৃত হওয়া উচিত ঃ অর্থাৎ একজন আলৌকিক সৃষ্টিকর্তাকে চিহ্নিত করতে এবং যিনি আবার “আমাদের যথাযথ উপাস্য”।
অতিপ্রাকৃত ধর্ম থেকে আইনস্টানীয় ধর্মকে পৃথক করতে না পারার ব্যর্থতার কারণে অনেক দুর্ভাগ্যজনক সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সময়, নানা প্রসঙ্গে আইনস্টাইন ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করেছেন (এবং বলাবাহুল্য, তিনিই একমাত্র নাস্তিক বিজ্ঞানী নন, যিনি এ কাজ করেছেন), যার ফলে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আর এটি করতে প্রয়াস পেয়েছেন অতিপ্রকৃতিবিদরা; এঁরা অতি উৎসাহে মহান চিন্তাবিদকে তাদের নিজেদের বলে দাবী করে এই ভ্রান্তি বিলাসে ইন্ধন জুগিয়েছেন। স্টিফেন হকিংয়ের 'কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস'(৪) বইটির - “তাহলে ঈশ্বরের মনে কী আছে তা আমাদের জানা উচিত” - এই নাটকীয় (না কি দুষ্টবুদ্ধি প্রণোদিত?) সমাপ্তি বাক্যটির গঠনশৈলী কুখ্যাতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এর ফলে ভুলক্রমে হলেও মানুষ বিশ্বাস করে যে, হকিং হলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। 'দ্য সেক্রেড ডেপথ্ অব নেচার' এ কোষ জীববিজ্ঞানী উরসুলা গুডএনাফ যে সব উক্তি করেছেন তাতে তাঁকে মনে হতে পারে হকিং বা আইনস্টাইনের তুলনায় অধিকতর ধর্মনিষ্ঠ। তার লেখা থেকে গির্জা, মন্দির, মসজিদ ভালবাসেন এবং তাঁর পুস্তকের অসংখ্য অনুচ্ছেদ অপ্রাসঙ্গিকভাবে তুলে এনে অতিপ্রাকৃত ধর্মের পক্ষে গোলা বারুদ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এমন কি তিনি নিজে 'ধর্মপ্রাণ প্রকৃতিবাদী' (Religious Naturalist) হিসেবে আখ্যায়িত হতে ভালবাসেন। কিন্তু তবুও যত্নের সাথে তাঁর বইটি পড়লে সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হবে যে, আমি যতটা কঠোর নাস্তিক, তিনিও, প্রকৃতপক্ষে ততটাই।
প্রকৃতিবাদী একটি অনিশ্চিতার্থক বা দ্ব্যর্থক শব্দ। আমার কাছে এটি আমার শৈশবের নায়ক হিঊ লোফটিংয়ের ডক্টর দোলিটলকে ঐকান্তিকভাবে আবাহন করার মত (যিনি প্রসঙ্গক্রমে হলেন এমন ব্যক্তি যার রয়েছে তার চারপাশে এইচ এম এস বিগলেব 'দার্শনিক' প্রকৃতিবাদীর স্পর্শ । অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রকৃতিবাদী বলতে যা বোঝান হত আজও শব্দটি সে অর্থেই আমাদের কাছে বোধগম্য ঃ 'প্রাকৃতিক জগতের একজন শিক্ষার্থী'। গিলবার্ট হোয়াইট থেকে শুরু করে প্রকৃতিবাদীরা এই অর্থে অধিকাংশই ছিলেন পাদ্রী। আর ডারউইন নিজ়েও চেয়েছিলেন চার্চে যোগ দিতে - এই আশায় যে চার্চে তাঁর নিরুপদ্রব গ্রামীণ জীবনে ঝিঁঝিঁ পোকার প্রতি তাঁর প্রবল আসক্তি নিয়ে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু দার্শনিকেরা 'প্রকৃতিবাদী'কে অনেক বেশী ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে থাকেন - ঠিক 'অতিপ্রকৃতিবাদী'র বিপরীত অর্থে। জুলিয়ান বাজ্জিনি নাস্তিকতার(৫) প্রসঙ্গটির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে ঃ
'অধিকাংশ নাস্তিকরা বিশ্বাস করেন যে যদিও মহাবিশ্ব একই প্রকার পদার্থে পরিপূর্ণ এবং তা হল ভৌত, তাহলেও এই ভৌত বস্তু থেকেই আসে মন, সৌন্দর্য, আবেগ, নৈতিক মূল্যবোধ .. .. এক কথায় জীবন প্রপঞ্চের সকল স্বরগ্রাম - যা মনুষ্য জীবনকে সমৃদ্ধ করে।'
মস্তিস্কের অভ্যন্তরে সংঘটিত ভৌত সত্তাদির অতি জটিল মিথস্ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয় মানুষের চিন্তা ও আবেগ। একজন নাস্তিক ব্যক্তি এই অর্থে দার্শনিক প্রকৃতিবাদী যিনি মনে করেন প্রকৃতি ও পার্থিব জগতের বাইরে কিছু নেই, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের অন্তরালে ওৎ পেতে থাকা অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিশীল কোন বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্ব নেই, দেহাতীত আত্মা নেই এবং নেই কোন অলৌকিকতা - ব্যত্যয় কেবল যে এমন কিছু প্রাকৃতিক প্রতিভাস রয়েছে যা আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি। যদি এমন কোন অবোধ্য ঘটনা থাকে যা আমাদের কাছে এখনও ব্যখ্যাতীত, আমরা মনে করি অদূর ভবিষ্যতে এর রহস্য উন্মোচিত হবে, এবং তা প্রাকৃতিক ব্যখ্যার পরিম-ল থেকেই। আমরা যখন রংধনুর রহস্য ভেদ করি, এর অপার সৌন্দর্য - চমৎকারিত্ব কিন্তু বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হলেও, আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা কিন্তু মোটেও ধর্মবাদী নন যদি আপনি তাদের বিশ্বাসগুলোকে অভিনিবেশ সহকারে বিশ্লেষণ করে দেখেন। একথা নিঃসন্দেহে আইনস্টাইন ও হকিংয়ের ক্ষেত্রে সত্যি। বর্তমান 'এস্ট্রনমার রয়্যাল' ও 'রয়্যাল সোসাইটির' সভাপতি মার্টিন রিস বলেছিলেন যে তিনি চার্চে যান একজন 'অবিশ্বাসী এঙ্গলিকান' হিসেবে .. .. ট্রাইবটির প্রতি অনুগত্যতা বশত। তাঁর কোন ধর্মীয় বিশ্বাস নেই, তবে কবিত্বময় নৈসর্গবাদে অংশ নেন যা মহাবিশ্ব অন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যেও জাগিয়ে তোলে, যাদের কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি। সম্প্রতি টেলিভিশনে প্রচারিত কথপোকথনে প্রসঙ্গক্রমে ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ও ব্রিটিশ ইহুদিবাদের একজন নমস্য স্তম্ভ, আমার বন্ধু রবার্ট উইনস্টোনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলাম এটি স্বীকার করাতে যে তাঁর ইহুদিবাদিতা হল এই প্রকৃতির এবং তিনি সত্যিই এমন কিছুতে বিশ্বাস করেন না যা অতিপ্রাকৃত। তিনি এটি প্রায় স্বীকার করে নিলেও, শেষ পর্যন্ত বেড়ার আড়ালে আশ্রয নিলেন (সত্যের খাতিরে বলতে হয় যে তিনিই আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, এর উল্টোটা নয়)। আমি চেপে ধরলে তিনি বলেছিলেন যে ইহুদি ধর্ম তাঁকে শৃঙ্খলার মাধ্যমে জীবন গঠনে সাহায্য করেছিল এবং সুন্দর জীবন যাপন করাতে শিখেয়েছিল। হয়তো তা ঠিক; কিন্তু তা, অবশ্যই, অতিপ্রাকৃত কোন দাবীর মূল্যের ওপর সামান্যতম প্রভাবও রাখে না। অনেক নাস্তিক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যাঁরা গর্বের সাথে নিজেদের ইহুদি বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন এবং ইহুদি রীতি নীতি পালন করেন - সম্ভবত প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবশত অথবা নিহত আত্মীয় স্বজনদের প্রতি আনুগত্যের কারণে; এ ছাড়াও কারণ হল হতবুদ্ধি ও সংশয়ী ইচ্ছায় নিজেকে সর্বেশ্বরবাদী ভক্তিমতের সাথে চিহ্নিত করা, যা আমরা অনেকেই এর মহান প্রবর্তকের সাথে অংশ নিতে চাই, তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন। তারা হয়তো বিশ্বাস করে না, তবে ড্যানিয়েল ডেনেটের শব্দগুচ্ছ ধার করে বলা যায়, তারা 'বিশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রাখে' (believe in belief)।
আইনস্টাইনের একটি বহুল উদ্ধৃত মন্তব্য হল 'ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খঞ্জ, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ।'(৬) কিন্তু আইনস্টাইন এও তো বলেছিলেন,
আমার ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে আপনারা যা পড়েন তা অবশ্যই মিথ্যা, এটি এমন এক মিথ্যা যা ক্রমান্বয়ে পদ্ধতিগতভাবে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। আমি কোন ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না এবং কখনও অস্বীকার করি নি বরং পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করেছি। আমার মধ্যে যদি এমন কোন কিছুকে ধর্মীয় বলে সনাক্ত করা যায় তা হল বিশ্বের গড়নের জন্য আমার অনাবিল প্রশংসা, যে বিশ্ব-গড়নকে আমাদের বিজ্ঞান এ পর্যন্ত উন্মোচিত করেছে। (২)
উক্ত বক্তব্য থেকে কি মনে হতে পারে যে, আইনস্টাইন স্ববিরোধিতা করেছিলেন ? তাঁর কথাগুলো কি উভয় পক্ষের সমর্থনে তুলে এনে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যায়? না। 'ধর্ম বা রিলিজিয়ন' শব্দটিকে আইনস্টাইন একেবারেই ভিন্ন বিছু কিছু অর্থে ব্যবহার করেছেন যা প্রচলিত অর্থে ব্যবহৃত 'ধর্ম' শব্দ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অতিপ্রাকৃত বা আলৌকিক ধর্ম ও আইনস্টাইনীয় ধর্মের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে আমি যখন অগ্রসর হচ্ছি, মনে রাখবেন যে আমি কেবল অতিপ্রাকৃত দেবতার বিভ্রান্তি বা প্রবঞ্চনা নিয়ে কথা বলছি।
আইনস্টাইন থেকে আরও কতিপয় উদ্ধৃতি চয়ন করা যাক, যা থেকে তাঁর ধর্ম-প্রকৃতির কিছুটা সৌরভ পাওয়া যাবে:
আমি গভীরভাবেই ধর্মীয় অবিশ্বাসী (religious non believer)। এটিকে বলা যেতে পারে এক শ্রেণীর নতুন ধর্ম। আমি কখনও প্রকৃতির ওপর কোন উদ্দেশ্য আরোপ বা এর সাথে কোন লক্ষ্য যুক্ত করিনি। অথবা এমন কিছু আরোপ করতে চাই না যার ব্যাখ্যা হতে পারে 'নৃ-রূপকাশ্রিত' (anthropomorphic)। প্রকৃতির মধ্যে আমি যা দেখি তা হল এর চমকপ্রদ গড়ন - যার রহস্য আমরা খুব সামান্যই উন্মোচন করতে পেরেছি, এবং প্রকৃতির এই বিশাল বিস্ময় যে কোন চিন্তাক্ষম মানুষকে বিনয় ও নম্রতায় ভরিয়ে দেয়। এ হল এক সত্যিকার ধর্মীয় অনুভূতি যার সাথে অবশ্য মরমীবাদের (mysticism) কোন সস্পর্ক নেই।
ব্যক্তি ঈশ্বরের ধারণা আমার কাছে একেবারেই ভিনদেশী
(alien) এবং এমন কি মনে হয় বেশ সরলও।
আইনস্টাইনের মৃত্যুর পরে অধিক সংখ্যক ধর্মবাদীরা
বোধ্য কারণেই তাঁকে নিজেদের বলে দাবী করতে থাকে।
সমকালীন ধার্মিক সহকর্মীদের অনেকে অবশ্য তাঁকে
দেখেছিলেন নিজেদের থেকে অনেক আলাদা করে, ভিন্ন
দৃষ্টিতে। ১৯৪০ সালে আইনস্টাইন তাঁর সেই যে
বিখ্যাত উক্তি - 'আমি
ব্যক্তি ঈশ্বরে
বিশ্বাস করি না',(৭) এর সমর্থনে একটি
বিখ্যাত প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এই প্রবন্ধ এবং এ
ধরনের অনেক বক্তব্যে ধর্মীয় গোড়াদের কাছ থেকে আসা
চিঠির ঝড় উঠেছিল সে সময়। এর মধ্যে অনেকগুলো তাঁর
ইহুদি-উৎসকে
পরোক্ষ কটাক্ষ করেও লেখা হয়েছিল। আইনস্টাইনের
বক্তব্যের যে নির্যাস পরবর্তী অংশে তুলে ধরা হয়েছে
তা ম্যাক্স জাম্মেরের লেখা 'আইনস্টাইন এন্ড
রিলিজিয়ন' পুস্তকটি থেকে। (আমার ব্যবহৃত
আইনস্টাইনের ধর্ম বিষয়ক উদ্ধৃতিগুলোর মূল উৎসও
এই গ্রন্থটি)।
কানসাস শহরের রোম্যান ক্যাথোলিক বিশপ বলেছিলেন,
'এটা খুবই দুঃখজনক যে, যে ব্যাক্তি পুরাতন বাইবেল (Old Testament) বর্ণিত জাতি থেকে উদ্ভূত এবং ঐ ধর্মগ্রন্থ থেকে শিক্ষালাভ করেছেন, তিনি কিনা আজ সেই জাতির মহান ঐতিহ্যকে অস্বীকার করছেন।'
অন্য ক্যাথোলিক পাদ্রীরাও একই সুরে সুর মিলিয়ে বলছেন ঃ
“ব্যক্তি ঈশ্বর ব্যতিরেকে অন্য কোন ধরনের ঈশ্বর নেই। .. .. আইনস্টাইন জানেন না তিনি কী বলছেন। তিনি যা বলছেন সব ভ্রান্ত । কিছু ব্যক্তি, যেহেতু তাঁরা কোন বিশেষ ক্ষেত্রে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেছেন, সে কারণে মনে করেন যে সব ব্যাপারেই মতামত ব্যক্ত করতে তাঁরা পারদর্শী।”
ধর্ম এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে যে কারও পক্ষে বিশেষজ্ঞ সাজার দাবী বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়া যায় না। যেমন, কোন এক পরী-বিশেষজ্ঞ এসে হুট করে পরীদের ডানার যথার্থ আকৃতি ও রং নিয়ে জ্ঞানদান করতে থাকলে ঐ পাদ্রী মহোদয়, নিশ্চয় বিনা বাক্যব্যয়ে তার কথা মেনে নেবেন না। তিনি ও বিশপ উভয়ই মনে করেন যে, যেহেতু আইনস্টাইনের ধর্মতত্ত্বের ওপর কোন প্রশিক্ষণ নেই, তাই তিনি ঈশ্বরের স্বরূপ অনুধাবন করতে পারেন নি। কিন্তু এ কথা সত্য নয়, আইনস্টাইন ভালমতই জানতেন তিনি কী অস্বীকার করেছেন।
জনৈক যুক্তরাষ্ট্রীয় রোমান ক্যাথোলিক আইনজীবী, যিনি সমগ্র খ্রিশ্চিয়ান চার্চ সম্মেলনের পক্ষে কাজ করতেন, এক সময় আইনস্টাইনকে লিখেছিলেন ঃ
'আপনি এমন বন্তব্য রেখেছেন যাতে আমরা গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি, ... কারণ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ঈশ্বরের ধারণাকে আপনি পরিহাস করেছেন। গত দশ বছরে কোন কিছু এমনভাবে হিসেব করে দেখা হয় নি যাতে জনগণ মনে করতে পারে যে জার্মানী থেকে ইহুদি বিতাড়নের পেছনে হিটলারের সামান্যতম যুক্তি থাকতে পারে, যা আপনার বক্তব্য করেছে। আপনার বাক স্বাধীনতা অবশ্যই আছে স্বীকার করে নিয়েও, আমি বলব আপনার (ঈশ্বর সম্বন্ধে) বক্তব্য য়ুক্তরাষ্ট্রে অশান্তির বৃহত্তম উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছে।'
জনৈক নিয়র্কবাসী ইহুদি যাজক উক্তি করেছেন,
“আইনস্টাইন অবশ্য প্রশ্নাতীতভাবে বড় মাপের বিজ্ঞানী,
কিন্তু
ধর্ম সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ইহুদি-ধর্ম থেকে
একশত আশি ডিগ্রি’ বিপরীতে অবস্থিত।”
'কিন্তু'? 'কিন্তু'? 'এবং' বলা হল না কেন?
নিউ জার্সিতে একটি ইতিহাস সোসাইটির সভাপতি চিঠি লিখেছিলেন যেখানে এত জঘন্যভাবে ধর্মীয় মনোভঙ্গির দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে যে এটি দু'বার পঠনযোগ্য ঃ
“আমরা আপনার বিদ্যামত্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ড. আইনস্টাইন। কিন্তু একটি জিনিষ রয়েছে যা আপনি শেখেন নি- ঈশ্বর হল একটি চৈতন্যময় সত্তা বা একটি চেতনা যাঁকে দূরবীক্ষণ বা অণুুবীক্ষণ দিয়ে ধরা যায় না, ঠিক যেমন মগজকে বিশ্লেষণ করে মানুষের ধ্যান-ধারণাকে বা আবেগকে দেখা যায় না।(৮)
“যেমনটি সবাই জানে ধর্মের ভিত্তি হল বিশ্বাস, জ্ঞান নয়। প্রতিটি চিন্তাক্ষম ব্যক্তি মাত্রই, সম্ভবত কোন না কোন সময় ধর্ম নিয়ে সন্দেহ-ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে। আমার নিজের বিশ্বাসও অনেকবার চির খেয়েছে। কিন্তু আমার অধ্যাত্মিক অপেরনের কথা কারও কাছে কখনও প্রকাশ করি নি দুটি কারণে ঃ (১) আমার ভয় হত যে এটি প্রকাশ করলে এমন কি সামান্য ইঙ্গিতও, আমার কোন কোন সহযোগীর জীবন ও আশার বিচলন ঘটাতে ও ক্ষতি সাধন করতে পারে; (২) কারণ আমি একজন লেখকের সাথে একমত, যিনি বলতেন, “যে কোন ব্যক্তির মধ্যে সঙ্কীর্ণ লক্ষণ থাকতে পারে যা কোন ব্যক্তির বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিতে পারে। " .. .. আমি আশা করি, ড. আইনস্টাইন, আপনার বক্তব্যকে ভুলভাবে উত্থাপন করা হয়েছে, এবং আপনি অচিরেই অধিকতর মধুর কথা আমেরিকান জনগণের বিশাল অংশকে শোনাবেন যারা আনন্দের সাথে আপনার মত প্রতিভাকে সম্মান জানাতে চায়।”
কি মারাত্মক ক্ষতিকর হৃদয় উন্মোচিত পত্র ! প্রতিটি বাক্যের সাথে যেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক ভিরুতা ঝরে ঝরে পড়ছে।
কম হেয় প্রতিপন্নকারী, কিন্তু অধিকতর মর্মন্তুদ হল ওকলাহোমায় অবস্থিত 'ক্যাভালরি তাবের্নাকল এসোসিয়েশনের' প্রতিষ্ঠাতার লেখা চিঠিটিঃ
“প্রফেসর আইনস্টাইন, আমার বিশ্বাস আমেরিকার প্রতিটি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী আপনাকে জবাব দেবে, -আমরা আমাদের ঈশ্বর এবং তাঁর পুত্র যিশু খ্রিস্টের ওপর থেকে আমাদের বিশ্বাস সরিয়ে নেব না, কিন্তু আপনি যদি এই জাতির জনগণের ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করেন তাহলে আমরা আপনাকে আহ্বান জানাচ্ছি আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে যেতে। আমি ইস্রাইলের কল্যাণে আমার ক্ষমতায় যথাসাধ্য করেছি, এবং তখন আপনি এদেশে চলে এলেন, এবং সাথে আপনার ঈশ্বর নিন্দুক জিহ্বা নিসৃত একটি বাক্য; ইস্রাইলকে ভালবাসে এমন সব খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের দেশ থেকে ইহুদি বিদ্বেষ দমন করতে যা পারে সে তুলনায় ঐ ধর্মবিদ্বেঘী বাক্যটি আপনার জনগণের স্বার্থের অনেক বেশী ক্ষতি করেছে। প্রফেসর আইনস্টাইন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী আপনাকে এখনই প্রত্যুত্তর দেবে, ‘আপনার পাগলাটে ও ভ্রান্ত বিবর্তনবাদকে সাথে নিয়ে জার্মানীতে ফিরে যান, যেখান থেকে এসেছেন; অন্য বিকল্পটি হল যে জনগণ এদেশে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে গ্রহণ করেছে ঠিক সেই সময় যখন আপনার নিজদেশ আপনাকে পালাতে বাধ্য করেছে সেই জনগণের বিশ্বাসকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন।”
তাঁর আস্তিক সমালোচকরা একটি বিষয়ে সঠিক যে আইনস্টাইন তাদের একজন নন। তাঁকে যে বলা হত 'তিনি একজন আস্তিক' তা তিনি বাববার দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করে এসেছেন। তবে কি তিনি ভলতেয়ার বা দাইদেরতের মত প্রত্যাদেশবিরোধী ঈশ্বরবাদী? অথবা স্পিনোজার মত সর্বেশ্বরবাদী - যাঁর দার্শনিক মতবাদের তিনি প্রশংসা করেছেন ঃ
উদ্ধৃতি
আমি স্পিনোজার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, বিরাজমান শৃঙ্খলাময় ঐকতানে যিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন, এমন কোন ঈশ্বরে নয় যিনি নিজেকে মানুষের ভাগ্য কর্ম ও ভালমন্দের সাথে সম্পৃক্ত রাখেন।(৯)
ব্যবহৃত কয়েকটি পরিভাষার অর্থ নিয়ে দু'একটি কথা বলা যাক। একজন আস্তিক বা ঈশ্বরবাদী অতিপ্রাকৃত বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, যিনি প্রথমেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির আসল কাজটি সম্পন্ন করা ছাড়াও, এখনও আশে পাশেই আছেন তাঁর সৃষ্টির তদারকির জন্য এবং তাঁর আদি সৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য। অনেক অস্তিক্যবাদী বিশ্বাস-পদ্ধতিতে দেবদেবীরা মনুষ্য বিষয়ে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকেন।(১০) তিনি (ঈশ্বর) ভক্তের প্রার্থনায় সাড়া দেন, পাপ ক্ষমা করেন বা এর জন্য শাস্তি দেন, আলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে জগতে হস্তক্ষেপ করতে ভালবাসেন, মন্দকাজ ও ভালকাজ নিয়ে মাথা ঘামান এবং তিনি জানেন কখন তা আমরা করব (এমন কি করার চিন্তা করলেও)। একজন প্রত্যাদেশ বিরোধী আস্তিক’ও (deist) অতিপ্রাকৃত বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বাসী, কিন্তু তিনি এমন একটি সত্তা যিনি কেবল যে নিয়মাদি প্রথমদিকে সৃষ্ট মহাবিশ্ব পরিচালনা করে সেই সব তৈরীতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন, অন্য কোন বিষয়ে নয়। প্রত্যাদেশ বিরোধী আস্তিকের ঈশ্বর এর পর থেকে আর কখনও হস্তক্ষেপ করেন নি, এবং মনুষ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে অবশ্যই তাঁর কোন আকর্ষণ নেই। সর্বেশ্ববাদীরা (pantheist) অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তবে তারা ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করে প্রকৃতির নাতিপ্রাকৃত সমার্থক শব্দ রূপে; অথবা মহাবিশ্বকে বোঝাতে, কিংবা পরিপূর্ণ নিয়মাদি বোঝাতে, যে নিয়মাদির মাধ্যমে প্রকৃতির ক্রিয়াদি সম্পাদিত হয়। প্রত্যাদেশ বিরোধীরা কট্টর ঈশ্বরবাদীদের থেকে স্বতন্ত্র এই অর্থে যে তাদের ঈশ্বর প্রার্থনায় কর্ণপাত করেন না, পাপ বা স্বীকারোক্তিতে কোন ঔৎসুক্য নেই, আমাদের মনের কথা পড়তে পারেন না, চমকপ্রদ আলৌকিকত্ব দেখিয়ে জাগতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন না। প্রত্যাদেশ বিরোধী ঈশ্বরবাদীরা সর্বেশ্বরবাদীদের থেকে এই হিসেবে স্বতন্ত্র যে তাদের ঈশ্বর এক একক, মহাবৈশ্বিক বুদ্ধিমত্তা - অন্যদিকে সর্বেশ্বরবাদীদের ঈশ্বর হলেন আলঙ্কারিক বা রূপক (metaphoric) - যেন মহাবিশ্বের নিয়মাবলীর জন্য চয়নকৃত কবিত্বময় প্রতিশব্দ। সর্বেশ্বরবাদ হল প্রমত্ত নাস্তিকতার এক কাব্যময় প্রকাশ, আর প্রত্যাদেশ বিরোধী ঈশ্বরবাদ হল জল দিয়ে লঘুকৃত আস্তিকতা।
এ কথা মনে করার যথেষ্ট যুক্তি আছে যে আইনস্টাইনবাদ বা আইনস্টাইনের নামে কথিত ধর্ম সম্পর্কে তাঁর মতবাদ কোন ক্রমেই প্রত্যাদেশ বর্জিত আস্তিকতা নয়, এবং অবশ্যই বিশুদ্ধ আস্তিকতার প্রকাশও নয়। যে বাক্যাবলী বা উদ্ধৃতিসমূহ তাঁর ধর্ম-দৃষ্টিভঙ্গির নির্দেশক বলে ধরা হয় সেগুলো বিবেচনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ধরনের প্রায়শ উদ্ধৃত বাক্যাবলীর মধ্যে রয়েছে, যেমন ঃ 'ঈশ্বর সূক্ষ্মানুভূতিময় কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণ নন', 'তিনি পাশা খেলেন না', 'মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কি কোন বিকল্প পছন্দ ছিল', . । (৩)
'ঈশ্বর পাশা খেলেন না' - এ বাক্যটির অনুবাদ হওয়া উচিত 'সকল বস্তুর অন্তরে ইতস্তততা (randomness) বিরাজ করে না'। 'মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কি কোন পছন্দ ছিল' - এ কথার অর্থ 'মহাবিশ্ব কি অন্য কোন প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে শুরু হতে পারত?' আইনস্টাইন 'ঈশ্বর' শব্দটিকে বিশুদ্ধ রূপক ও কাব্যিক অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। স্টিফেন হকিংও, এবং অধিকাংশ পদার্থবিদই আইনস্টানীয় অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, বিশেষ করে যে সব পদার্থবিদ ধর্মীয় অলঙ্কারিক ভাষার আশ্রয় নিতে ভালবাসেন। পল ডেভিসের রচিত 'ঈশ্বরের মন' (The Mind of God), আমার মনে হয়, আইনস্টানীয় সর্বেশ্বরবাদ ও এক ধরনের অস্পষ্ট প্রত্যাদেশ বর্জিত ঈশ্বরবাদের মধ্যবর্তী স্থানে ইতস্তত বিচরণ করে। এ কাজের জন্য অবশ্য পল ডেভিসকে টেম্পল্টন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।(১১)
স্বয়ং আইনস্টাইন থেকে আর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আইনস্টানীয় ধর্ম নিয়ে আলোচনার উপসংহার টানতে চাই ঃ
“কোন কিছুর পশ্চাতে, যা অভিজ্ঞতা-উপলব্ধনীয়, তা অনুধাবন করতে হলে ‘এমন কিছুর’ অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয় যা আমাদের অন্তর সম্যকভাবে বুঝে উঠতে পারে না এবং এর সৌন্দর্য ও গরিমা আমাদের কাছে উপনীত হয় অপ্রত্যক্ষভাবে এবং অতি দুর্বল প্রতিফলনের আকারে। এটি ধর্মপরায়ণতা। এই অর্থে আমি ধর্মপরায়ণ।”
এই অর্থে আমিও ধর্মপরায়ণ- শুধু সেই ব্যাক্যাংশটি সম্পর্কে যেখানে বলা হয়েছে , “ আমাদের অন্তর সম্যকভাবে বুঝে উঠতে পারে না” সেটি সম্পর্কে আমি ভিন্ন মত পোষণ করি। এই বাক্যটির অর্থ কখনও হতে পারে না যে এই মুহূর্তে অবোধ্য কোন সত্তা “চিরকালের জন্যই অবোধ্য” হয়ে থাকবে। কিন্তু আমি কখনও 'ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ' এই অভিধায় চিহ্নিত হতে পছন্দ করি না, কারণ এটি লোকের কাছে ভুল অর্থবহন করবে। এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর ও ভ্রান্ত অর্থবাহী কারণ জনগণের বৃহ্ত্তর অংশের কাছেই 'ধমের্র' অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে 'অতিপ্রাকৃত' (supenatural)। কার্ল সাগান সুন্দরভাবে এটি উত্থাপন করেছেন,
“.. .. যদি 'ঈশ্বর' শব্দ দিয়ে মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণকারী একগুচ্ছ পার্থিব নিয়ম’কে কেউ বুঝতে চান, তাহলে নিশ্চয় সে ধরনের ঈশ্বর রয়েছে। এ ধরনের ঈশ্বর ভাবাবেগের দিক থেকে কিন্তু একেবারেই অসন্তোষজনক .. .. অভিকর্ষ নিয়মের কাছে মাথা ঠেকিয়ে নামাজ, পুজো বা প্রার্থনা করার কোন অর্থ হয় না।”
কৌতুক উদ্রেক করলেও, সাগানের শেষ বক্তব্যটি কিন্তু আমেরিকার ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক রেভারেন্ড ডক্টর ফুলটন জে শীনের বক্তব্যে অনেকটাই কালিমালিপ্ত হয়ে গেছে। এই বক্তব্য ছিল আইসস্টানের ১৯৪০ খ্যাত 'ব্যক্তি ঈশ্বর বিরোধী' ধারণার ওপর ভয়ানক আক্রমণ চালনার অংশ বিশেষ। শীন বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে প্রস্তাব রেখেছেন এমন কেউ কি আছেন যিনি 'ছায়াপথের' জন্য প্রাণ বিসর্জনে প্রস্তুত? তিনি মনে ভেবেছিলেন যে তিনি আইনস্টাইনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে জোরালো নম্বর অর্জন করেছেন, নিজের মতের পক্ষে যতটা নয়। কারণ তিনি এর সাথে আরও সংযোজন করেছেন ঃ
“তাঁর (আইনস্টাইনের) মহাজাগতিক ধর্মের (cosmical religion) একটি মাত্র ত্র“টি রয়েছেঃ তিনি শব্দটিতে একটি অতিরিক্ত (ইংরেজী) অক্ষর বসিয়েছিলেন - অক্ষরটি হল ‘এস’ (s)।”
না, আইনস্টাইনের ধর্মে comical বা কৌতুকপ্রদ কিছু নেই। কিন্তু সে যাই হোক, পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে আমার অনুরোধ যে তাঁরা যেন তাদের 'প্রতীক বা রূপক' অর্থে ঈশ্বর শব্দটির ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন। রূপকার্থে বা সর্বেশ্বরবাদী অর্থে ব্যবহৃত পদার্থবিদদের 'ঈশ্বর' বাইবেলের, পুরোহিত-পাদ্রি-মোল্লা-ইহুদি যাজকদের সর্ববিষয়ে হস্তক্ষেপ-ইচ্ছুক, অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়সী, অন্তর-পঠনক্ষম, পাপের শাস্তি বিধায়ক, প্রার্থনায় সাড়াদানকারী, এবং সাধারণের ভাষায় ব্যবহৃত ঈশ্বর থেকে আলোক-বর্ষ যোজন দূরে অবস্থিত। এই দুটি স্বতন্ত্র ধারণাকে এক করে ইচ্ছাকৃত সংশয় সৃষ্টির অপচেষ্টা আমার মতে, একটি উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসঘাতকতা।(১২)
অনুবাদকের টীকা
১। রিচার্ড ডকিন্স পরিচিতি ঃ রিচার্ড ডকিন্স একজন
খ্যাতনামা বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী, তাত্ত্বিক
অভিব্যক্তিবাদী।
২। আইনস্টাইনের প্রাসঙ্গিক ইংরেজি উদ্ধৃতিটি হল ঃ
I do not
believe in a personal God and I have never
denied this but have expressed it clearly. If
something is in me which can be called religious
then it is the unbounded admiration for the
structure of the world so far as our science can
reveal it.
৩। এখানে আইনস্টাইনের বাংলায় উদ্ধৃতিগুলোর
যথাক্রমিক ইংরেজী বাক্যগুলো হলঃ
God is
subtle but he is not malicious
He does not play dice
Did God have a choice in creating the Universe ?
পাদটীকা
১) আইনস্টাইন কথিত বাক্যটির ইংরেজি হচ্ছে ঃ
I don’t try to
imagine a personal God: It suffices to stand in
awe at the structure of the world, insofar as it
allows our inadequate senses to appreciate it. '
২) মূল ইংরেজী বাক্যটি ছিল all was `produced by laws acting around us’.
৩) মূল ইংরেজী বাক্যটি ছিল No, no, no! My god is a little god, and I want him to stay that way.
৪) A brief History of Time, Stephen Hawking, Bantam Press, London, 1988
৫) বইটির পুরো শিরোনাম ঃ Atheism: A Very Short Introduction to the meaning of an atheist’s commitment to nautralism
৬) ‘Science without religion is lame, religion without science is blind.’
৭) ‘I do not believe in personal God.’
৮) ভারতীয় ব্রহ্মবাদীরাও বলেন যে পরম ‘ব্রহ্ম’ হলেন চৈতন্যময়, একমাত্র রিয়ালিটি। এই ব্রহ্মেরই প্রকাশ হল জড় জগৎ মহাবিশ্ব।
৯) প্রাসঙ্গিক ইংরেজি বাক্যটি ছিলঃ I believe in Spinoza’s God who reveals himself in the ordinary harmony of what exists, not in a God who concerns himself with fates and actions of human beings।
১০) উদাহরণ: হিন্দু পৌরাণিক ধর্মে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ছাড়াও অনেক ছোটখাটো দেবদেবী (লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা, কালী, কার্তিক, গণেশ, বিশ্বকর্মা .. ) মানুষের জীবনের সাথে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ইসলামপূর্ব আরবে কাবার অসংখ্য দেবদেবী কোরাইশ ও অন্য আরব গোত্রের মানুষদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করত।
১১) টেম্পল্টন ফন্ডেশন (Templeton Foundation) থেকে প্রতিবছর পুরস্কার হিসেবে বিপুল অর্থ একজন বিজ্ঞানীকে প্রদান করা হয়। বিজ্ঞানীকে অবশ্য ধর্ম সম্পর্কে কিছ কিছু সুুন্দর কথা বলতে হয়।