শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)
মহাপ্লাবনের বাস্তবতা : পৌরাণিক অতিকথন বনাম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান
“পৃথিবীতে মনুষ্যজাতি সৃষ্টির পর মানুষ একসময় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব, ‘ঈশ্বর বন্দনা’ ছেড়ে দিয়ে ঘোর পাপ কর্মে নিমজ্জিত হয়েছিল। লোভ-হিংসা-বিদ্বেষ আর অপরাধপ্রবণতার কারণে ভুলে গিয়েছিলো সৃষ্টিকর্তাকে। মনুষ্যজাতির এই অধঃপতন দেখে বিচলিত বোধ করলেন ঈশ্বর, ক্রুদ্ধ হলেন তাঁর সৃষ্টির ওপর। মনে মনে সংকল্প আটলেন -এই পাপ এবং পাপী থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার জন্য ধ্বংস করে ফেলতে হবে, নূতন করে ধরণীকে গড়ে তুলতে হবে। ধ্বংসের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন প্লাবন, এক মহা-মহা-প্লাবন; যে প্লাবনের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল দুনিয়ার সমস্ত পাপী, ধ্বংস হয়েছিল সকল পাপের বিষ, এমন কী আমাদের জীবজগতও। তবে সৃষ্টিকর্তা শুধু বাঁচালেন হযরত নুহ্ (হিব্রু উচ্চারন নোয়া, এবং আরবী উচারণ নুহ্) ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীসাথীদের। পরবর্তীতে তাঁদের মাধ্যমেই ঈশ্বর প্রাণের বিস্তার ঘটালেন পৃথিবীতে। আমরা, পৃথিবীর মানুষেরা আজ- সেই হযরত নূহ্রে বংশধর”। - সারসংক্ষিপ্ত করলে প্রায় এই ধরনের পৌরাণিক কাহিনীর অস্তিত্ব পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে, বিভিন্ন আঞ্চলিক লোকগাঁথা, বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যানে রয়েছে। লোকগাঁথা বা পৌরাণিক উপাখ্যানের বর্ণনাগুলোকে আমাদের মত সাধারণ মানুষেরা অবাস্তব কেচ্ছাকাহিনী বা শুধু গল্প হিসেবে মেনে নিলেও, ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত বর্ণনাকে সত্য হিসেবেই বিশ্বাস করেন বেশিরভাগ মানুষ। এটা সত্য যে, এই মহাপ্লাবনের কাহিনী দীর্ঘদিন আপামর সাধারণ মানুষের মনে (বিশেষ করে ইউরোপিয়ানদের মনে) সৃষ্টির প্রতি ঈশ্বরের লীলা বা প্রতিশোধ হিসেবে বিরাজমান ছিল। যার ফলে নানা সময়ে এই প্রখ্যাত লোকগাঁথাটি বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রমাণের (যেমন, বিবর্তনবাদ) প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খোদ চার্লস ডারউইন থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী লায়েল, চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চিসহ আরো অনেকেই এই মহাপ্লাবনের বিপক্ষে নানা প্রমাণ হাজির করে মানুষের ভ্রান্তি দুর করতে চেষ্টা করেছিলেন। তারপরও পশ্চিমাদের এই অর্ধসত্য থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ণসত্যের সন্ধান লাভ সহজ হয়নি; দীর্ঘসময় পাড়ি দিতে হয়েছে। যা হোক, আমরা এই প্রবন্ধে পশ্চিমাদের জ্ঞান অন্বষণের ইতিহাসে না ঢুকে, মহাপ্লাবনের সম্ভাব্যতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকব এবং মহাপ্লাবনের প্রেক্ষাপট বোঝানোর জন্য কিছু লোকগাঁথার কাহিনী উল্লেখপূর্বক কয়েকটি ধর্মগ্রন্থের বক্তব্য তুলে ধরব। তবে আগেই উল্লেখ করা ভালো, আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ‘মহাপ্লাবনের’ সত্যতা নির্ণয়ে অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান চালানো সম্ভব না। আমাদের এই অক্ষমতা বা রুঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে মহাপ্লাবনের পৌরাণিক কাহিনীকে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের জন্য অংকের আশ্রয় নিতে হবে। কী উত্তর বের হয়ে আসে, একটু পরেই দেখা যাবে।
হযরত নুহ্ (আঃ) ও মহাপ্লাবন সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থসমূহে বর্ণিত তথ্য:-
ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল-এর ওল্ড টেস্টামেন্টের (পুরাতন নিয়ম) অন্তর্গত তৌরাত শরিফে হযরত নুহ্ (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে-
লামাকের একশো বিরাশি বছর বয়সে তাঁর একটি ছেলের জন্ম হল। তিনি বললেন, “আমাদের সব পরিশ্রমের মধ্যে, বিশেষ করে মাবুদ মাটিকে বদদোয়া দেবার পর তার উপর আমাদের যে পরিশ্রম করতে হয় তার মধ্যে এই ছেলেটিই আমাদের সান্ত¡না দেবে।” এই বলে তিনি তাঁর ছেলের নাম দিলেন নুহ॥ নুহ্রে জন্মের পর লামাক আরো পাঁচশো পচানব্বই বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর আরো ছেলেমেয়ে হয়েছিল। মোট সাতশো সাতাত্তোর বছর বেঁচে থাকবার পর লামাক ইন্তেকাল করলেন। (পয়দায়েশ / Genesis), ৫:২৮-৩১)
মাবুদ দেখলেন দুনিয়াতে মানুষের নাফরমানি খুবই বেড়ে গেছে, আর তার দিলের সব চিন্তা-ভাবনা সব সময়ই কেবল খারাপীর দিকে ঝুঁকে আছে। এতে মাবুদ অন্তরে ব্যথা পেলেন। তিনি দুনিয়াতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলে দুঃখিত হয়ে বললেন, “আমার সৃষ্ট মানুষকে আমি দুনিয়ার উপর থেকে মুছে ফেলব; আর তার সঙ্গে সমস্ত জীবজন্তু, বুকে-হাঁটা প্রাণী ও আকাশের পাখীও মুছে ফেলব। এই সব সৃষ্টি করেছি বলে আমার মনে কষ্ট হচ্ছে।”
কিন্তু নুহ্-এর উপরে মাবুদ সন্তুষ্ট রইলেন (পয়দায়েশ, ৬:৫-৮)।
এই হল নুহ্-এর জীবনের কথা। নুহ্ একজন সৎলোক ছিলেন। তাঁর সময়কার লোকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন খাঁটি। আল্লাহ্’র সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ -সম্বন্ধ ছিল। সাম, হাম আর ইয়াফস নামে নুহ্-এর তিনটি ছেলে ছিল। সেই সময় আল্লাহ্’র কাছে সারা দুনিয়াটাই গুনাহের দুর্গন্ধে এবং জোর জুলুমে ভরে উঠেছিল। আল্লাহ্ দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, তা দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে, কারণ দুনিয়ার মানুষের স্বভাবের পচন ধরছে (পয়দায়েশ, ৬:৯-১২)।
এই অবস্থা দেখে আল্লাহ্ নুহ্ কে বললেন, “গোটা মানুষজাতটাকেই আমি ধ্বংস করে ফেলব বলে ঠিক করেছি। মানুষের জন্যই দুনিয়া জোরজুলুমে ভরে উঠেছে। মানুষের সঙ্গে দুনিয়ার সবকিছুই আমি ধ্বংস করতে যাচ্ছি। তুমি গোফর কাঠ দিয়ে তোমার নিজরে জন্য একটা জাহাজ তৈরি কর। তার মধ্যে কতগুলো কামরা থাকবে; আর সেই জাহাজের বাইরে এবং ভিতরে আল্কাত্রা দিয়ে লেপে দিবে। জাহাজটা তুমি এইভাবে তৈরি করবে; সেটা লম্বায় হবে তিনশো হাত, চওড়ায় পশ্চাশ হাত, আর উচ্চতা হতে ত্রিশ হাত। জাহাজটার ছাদ থেকে নীচে এক হাত পর্যন্ত চারদিকে একটা খোলা জায়গা রাখবে আর দরজাটা হবে জাহাজের একপাশে। জাহাজটাতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থাকবে। আর দেখ, আমি দুনিয়াতে এমন একটা বন্যার সৃষ্টি করব যাতে আসমানের নীচে যে সব প্রাণী শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে তারা সব ধ্বংস হয়ে যায়। দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীই তাতে মারা যাবে (পয়দায়েশ, ৬:১৩-১৭)।
“কিন্তু আমি তোমার জন্য আমার ব্যবস্থা স্থাপন করব। তুমি গিয়ে জাহাজে উঠবে আর তোমার সঙ্গে থাকবে তোমার ছেলেরা, তোমার স্ত্রী ও তোমার ছেলেদের স্ত্রীরা। তোমার সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য তুমি প্রত্যেক জাতের প্রাণী থেকে স্ত্রী-পুুরুষ মিলিয়ে এক এক জোড়া করে জাহাজে তুলে নেবে। প্রত্যেক জাতের পাখী, জীবজন্তু ও বুকে-হাঁটা প্রাণী এক এক জোড়া করে তোমার কাছে আসবে যাতে তুমি তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পার; আর তুমি সব রকমের খাবার জিনিস জোগাড় মজুদ করে রাখবে। সেগুলোই হবে তোমার ও তাদের খাবার।” নুহ্ তা-ই করলেন। আল্লাহ্র হুকুম মত তিনি সবকিছুই করলেন (পয়দায়েশ, ৬:১৮-২২)।
এরপরে মাবুদ নুহ্কে আবার বললেন, “তুমি ও তোমার পরিবারের সবাই জাহাজে উঠবে। আমি দেখতে পাচ্ছি, এখনকার লোকদের মধ্যে কেবল তুমিই সৎ আছ। তুমি পাকপশুর প্রত্যেক জাতের মধ্য থেকে স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে তোমার সঙ্গে নেবে, আর নাপাকপশুর মধ্য থেকেও স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে এক জোড়া করে নেবে। আকাশে উড়ে বেড়ায় এমন পাকপাখীদের মধ্য থেকেও স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে তোমার সঙ্গে নেবে। দুনিয়ার উপর তাদের বংশ বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তুমি তা করবে। আমি আর সাতদিন পরে দুনিয়ার উপরে বৃষ্টি পড়বার ব্যবস্থা করবো। তাতে চল্লিশদিন আর চল্লিশরাত ধরে বৃষ্টি পড়তে থাকবে। আমি ভূমিতে যেসব প্রাণী সৃষ্টি করেছি তাদের প্রত্যেকটিকে দুনিয়ার উপর থেকে মুছে ফেলব”। মাবুদের হুকুম মতই নুহ্ সব কাজ করলেন (পয়দায়েশ, ৭:১-৫)।
মহাপ্লাবন সম্পর্কে তৌরাত শরিফে বর্ণিত আছে :-
দুনিয়াতে বন্যা শুরু হওয়ার সময় নুহ্রে বয়স ছিল ছ’শো বছর। বন্যা থেকে রক্ষা পাবার জন্য নুহ্ তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছেলেরা এবং ছেলেদের স্ত্রীরা সেই জাহাজে গিয়ে উঠলেন। আল্লাহ নুহ্কে হুকুম দেবার সময় যা বলেছিলেন সেইভাবে পাক ও নাপাক পশু, পাখী ও বুকে-হাঁটা প্রাণীরা স্ত্রী-পুরুষ মিলে জোড়ায় জোড়ায় সেই জাহাজে নুহ্রে কাছে গিয়ে উঠল। সেই সাত দিন পার হয়ে গেলে পর দুনিয়াতে বন্যা হল। নুহ্রে বয়স যখন ছ’শো বছর চলছিল, সেই বছরের দ্বিতীয় মাসের সতেরো দিনের দিন মাটির নীচের সমস্ত পানি হঠাৎ বের হয়ে আসতে লাগলো আর আকাশেও যেন ফাটল ধরলো। চল্লিশদিন আর চল্লিশরাত ধরে দুনিয়ার উপরে বৃষ্টি পড়তে থাকল (পয়দায়েশ, ৭:৬-১২)।
তারপর থেকে চল্লিশদিন ধরে দুনিয়াতে বন্যার পানি বেড়েই চলল। পানি বেড়ে যাওয়াতে জাহাজটা মাটি ছেড়ে উপরে ভেসে উঠল। পরে দুনিয়ার উপরে পানি আরো বেড়ে গেল এবং জাহাজটা পানির উপরে ভাসতে লাগল। দুনিয়ার উপরে পানি কেবল বেড়েই চলল; ফলে যেখানে যত বড় পাহাড় ছিল সব ডুবে গেল। সমস্ত পাহাড়-পর্বত ডুবিয়ে পানি আরো পনেরো হাত উপরে উঠে গেল। এর ফলে মাটির উপর ঘুরে বেড়ানো প্রাণী, পাখী, গৃহপালিত আর বন্য পশু, ঝাঁক বেঁধে চরে বেড়ানো ছোট ছোট প্রাণী এবং সমস্ত মানুষ মারা গেল। শুকনা মাটির উপর যে সব প্রাণী বাস করত, অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে যারা বেঁচে ছিল তারা সবাই মরে গেল। আল্লাহ এইভাবে ভূমির সমস্ত প্রাণী দুনিয়ার উপর থেকে মুছে ফেললেন। তাতে মানুষ, পশু, বুকে-হাঁটা প্রাণী এবং আকাশের পাখী দুনিয়ার উপর থেকে মুছে গেল। কেবল নুহ্ এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা জাহাজে ছিলেন তাঁরাই বেঁচে রইলেন। দুনিয়া একশো পঞ্চাশ দিন পানিতে ডুবে রইল (পয়দায়েশ, ৭:১৭-২৪)।
জাহাজে নুহ্ এবং তাঁর সঙ্গে যেসব গৃহপালিত ও বন্য পশু ছিল আল্লাহ তাদের কথা ভুলে যান নি। তিনি দুনিয়ার উপরে বাতাস বহালেন, তাতে পানি কমতে লাগল। এর আগেই মাটির নীচের সমস্ত পানি বের হওয়া এবং আকাশের সব ফাটলগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়াও থেমে গিয়েছিল। তাতে মাটির উপরকার পানি সরে যেতে থাকল, আর বন্যা শুরু হওয়ার একশো পঞ্চাশ দিন পরে দেখা গেল পানি অনেক কমে গেছে। সপ্তম মাসের সতের দিনের দিন জাহাজটা আরারাতের পাহাড়শ্রেণীর উপরে গিয়ে আট্কে রইল। এরপরেও পনি কমে যেতে লাগল, আর দশম মাসের প্রথম দিনে পাহাড়শ্রেণীর চূড়া দেখা দিল (পয়দায়েশ, ৮:১-৫)।
নুহ্রে বয়স তখন ছ’শো একবছর চলছিল। সেই বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনেই মাটির উপর থেকে পানি সরে গিয়েছিল। তখন নুহ্ জাহাজের ছাদ খুলে ফেলে তাকিয়ে দেখলেন যে, মাটির উপরটা শুকাতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় মাসের সাতাশ দিনের মধ্যে মাটি একেবারে শুকিয়ে গেল। তখন আল্লাহ্ নুহ্কে বললেন, “তুমি তোমার স্ত্রীকে আর তোমার ছেলেদের ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে জাহাজ থেকে বের হয়ে এস, আর সেই সঙ্গে সমস্ত পশু-পাখি এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী, অর্থাৎ যত জীব-জন্তু আছে তাদের সকলকেই বের করে নিয়ে এসো। আমি চাই যেন দুনিয়াতে তাদের বংশ অনেক বেড়ে যায় এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা দ্বারা তারা সংখ্যায় বেড়ে উঠে।” তখন নুহ্ তাঁর স্ত্রীকে আর তাঁর ছেলেদের ও তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে জাহাজ থেকে বের হয়ে আসলেন। তাঁদের সঙ্গে সব পশু-পাখী এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী, অর্থাৎ মাটির উপরে ঘুরে বেড়ানো সমস্ত প্রাণী নিজের নিজের জাত অনুসারে বের হয়ে গেল (পয়দায়েশ, ৮:১৩-১৯)।
কোরান শরিফে হযরত নুহ্ এবং মহাপ্লাবন সম্পর্কে বর্ণিত তথ্য :-
পবিত্র কোরান শরিফে হযরত নুহ্-এর নামে আটশটি আয়াতসমৃদ্ধ একটি সুরা-ই (৭১ নম্বর) আছে, এই সুরাসহ আরো বিভিন্ন সুরার বিভিন্ন আয়াতে হযরত নুহ্ এবং মহাপ্লাবনের কথা বলা হয়েছে, হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে এই কাহিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। তবে তৌরাত শরিফের মত এত বিস্তারিতভাবে নুহ্রে জাহাজের বর্ণনা বা মহাপ্লাবনের ব্যাপারে (যেমন, জাহাজের উচ্চতা-আয়তন-ধারণসংখ্যা-প্লাবন কতদিন ছিল ইত্যাদি) বক্তব্য রাখা হয়নি। নিম্নে হযরত নুহ্ ও মহাপ্লাবন সম্পর্কিত কিছু আয়াত পাঠকের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হল :-
আমি নুহকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছি, তারপর সে তাদের বলল, হে আমার জাতির লোকেরা, তোমরা আল্লাহতায়ালার দাসত্ব কবুল করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই; আমি তোমাদের ওপর এক কঠিন দিনের আযাবের আশংকা করছি (সুরা আল আ’রাফ, ৭:৫৯)।
তার জাতির নেতারা বললো, (হে নুহ্) আমরা দেখতে পাচ্ছি তুমি এক সুস্পষ্ট গোমরাহিতে (নিমজ্জিত) রয়েছো (সুরা আল আ’রাফ, ৭:৬০)।
সে বললো, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা, আমার মধ্যে কোনোই গোমরাহি নেই, আমি তো হচ্ছি সৃষ্টিকুলের মালিক আল্লাহর পক্ষ থেকে (আসা) একজন রসুল (সুরা আল আ’রাফ, ৭:৬১)।
(আমার কাজ হচ্ছে) আমি আমার মালিকের বাণীসমূহ তোমাদের কাছে পৌঁছে দেব এবং (সে মতে) তোমাদের শুভ কামনা করবো, (আখেরাত সম্পর্কে) আমি আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে এমন কিছু কথা জানি, যা তোমরা জান না (সুরা আল আ’রাফ, ৭:৬২)।
তারপর তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, আমি তাকে এবং তার সাথে যারা নৌকায় (আরোহণ করে) ছিল, তাদের সবাইকে (আজাব থেকে) উদ্ধার করেছি, আর যারা আমার আজাবসমূহকে মিথ্যা বলেছে, তাদের আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি: এরা ছিলো (গোঁড়া) অন্ধ (সুরা আল আ’রাফ, ৭:৬৪)।
অতপর আমি তার কাছে ওহি পাঠালাম যে, তুমি আমার তত্ত্বাবধানে আমারই ওহি অনুযায়ী একটি নৌকা প্রস্তুত করো। তারপর যখন আমার (আজাবের) আদেশ আসবে এবং (জামিনের) চুল্লি প্লাবিত হয়ে যাবে, তখন (সব কিছু থেকে) এক এক জোড়া করে নৌকায় উঠিয়ে নাও, তোমার পরিবার পরিজনদেরও (উঠিয়ে নেবে, তবে) তাদের মধ্যে যার ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার সিদ্ধান্ত এসে গেছে সে ছাড়া (দেখো), যারা জুলুম করেছে তাদের ব্যাপারে আমার কাছে কোনো আরজি পেশ করো না, কেননা (মহাপ্লাবনে আজ) তারা নিমজ্জিত হবেই (সুরা আল মোমেনুন, ২৩:২৭)।
তুমি আমারই তত্ত্বাবধানে আমারই ওহির আদেশে একটি নৌকা বানাও এবং যারা জুলুম করেছে, তাদের ব্যাপারে তুমি আমার কাছে (কোনো আবেদন নিয়ে) হাজির হয়ো না, নিশ্চয়ই তারা নিমজ্জিত হবে (সুরা হুদ, ১১:৩৭)।
(পরিকল্পনা মোতাবেক) সে নৌকা বানাতে শুরু করলো। যখনই তার জাতির নেতৃস্থানীয় লোকেরা তার পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করতো, তখন (নুহ্কে নৌকা বানাতে দেখে) তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিতো; সে বললো (আজ) তোমরা যদি আমাদের উপহাস করো (তাহলে মনে রেখো), যেভাবে (আজ) তোমরা আমাদের ওপর হাসছো (একদিন) আমরাও তোমাদের ওপর হাসবো (সুরা হুদ, ১১:৩৮)।
অবশেষে (তাদের কাছে আজাব সম্পর্কিত) আমার আদেশ এসে পৌঁছল এবং চুলো (থেকে একদিন পানি) উথলে উঠলো, আমি (নুহ্কে) বললাম, (সম্ভাব্য) প্রত্যেক জীবের (পুরুষ-স্ত্রীর) এক একজোড়া এতে উঠিয়ে নাও, (সাথে) তোমার পরিবার-পরিজনদেরও (ওঠাও) তাদের বাদ দিয়ে, যাদের ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত (ঘোষিত) হয়েছে এবং (তাদেরও নৌকায় উঠিয়ে নাও) যারা ঈমান এনেছে; (মূলত) তার সাথে (আল্লাহর ওপর) খুব কম সংখ্যক মানুষই ঈমান এনেছিলো (সুরা হুদ, ১১:৪০)।
(So it was) till then there came Our Command and the oven gushed forth (water like fountains from the earth). We said: ÒEmbark therein, of each kind two (male and Female), and your family, except him against whom the Word has already gone forth, and those who believe. And none believed with him, except a few (Surah Hud, 11:40).
সে (তার সাথীদের) বললো, তোমরা এতে উঠে পড়ো, আল্লাহর নামে এর গতি ও স্থিতি (নির্ধারিত হবে): নিশ্চয়ই আমার মালিক ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু (সুরা হুদ, ১১:৪১)।
তারপর সে (নৌকা) পাহাড়সম বড়ো বড়ো ঢেউয়ের মধ্যে তাদের বয়ে নিয়ে চলতে থাকল্।ো নুহ্ তার ছেলেকে (নৌকায় আরোহণ করার জন্যে) ডাকলো, সে (আগ থেকেই) দূরবর্তী এক জায়গায় (দাঁড়িয়ে) ছিলো - হে আমার ছেলে, আমাদের সাথে (নৌকায়) ওঠো, (আজ এমনি এক দিনে) তুমি কাফেরদের সাথী হয়ো না (সুরা হুদ, ১১:৪২)।
... এরপর সুরা হুদের ৪৮ নং আয়াত পর্যন্ত হযরত নুহ্ এবং মহাপ্লাবন সম্পর্কিত ঘটনার উল্লেখ আছে, কিন্তু আমরা আলোচনার পরিসর সীমিত রাখার স্বার্থে আর অগ্রসর হলাম না।
পাঠক, উল্লিখিত কোরান শরিফের সুরা হুদের ৪০ নং আয়াত দুইবার উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, বাংলা আয়াতে লক্ষ করা যাচ্ছে- আল্লাহতায়ালা হযরত নুহকে সম্ভাব্য সকল প্রজাতির এক জোড়া করে সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর ইংরেজি আয়াতে ‘সম্ভাব্য’ শব্দটি অনুবাদক হাফেজ মুনির উদ্দিনের নিজস্ব প্রয়োগ, মূল আয়াতে এটি নেই। কারণ, বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের কোরানসূত্র (পৃষ্ঠা-৩৫৬) -এ উল্লেখ আছে - ‘প্রত্যেক জীবের এক-এক জোড়া উঠিয়ে নাও’। সেখানেও ‘সম্ভাব্য’ শব্দটি নেই। তাছাড়া সুরা আল মোমেনুন-এর ২৭ নং আয়াতে সুস্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, “সবকিছু থেকে এক জোড়া সংগ্রহ করে” নৌকায় তুলে নিতে, -এ সম্পর্কে কোনো ভ্রান্তি সৃষ্টি না হওয়ার জন্যই তা করা হয়েছে।
সনাতন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মহাপ্লাবন :-
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মৎস্যপুরাণ এবং শতপথ ব্রাহ্মণে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর দশটি অবতারের মধ্যে একটি অবতার “মৎস্য বা মাছ অবতার”-এর কথা বলা হয়েছে (লক্ষ্য করার বিষয়, মৎস্যপুরাণ বা শতপথ ব্রাহ্মণেও মনুর নৌকা বা মহাপ্লাবন সম্পর্কে তৌরাত শরিফের মতো বিস্তারিত বর্ণনা নেই; আছে কিছুটা ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের মতো)। মৎস্যঅবতার আবির্ভাবের যে প্রেক্ষাপট বর্ণিত আছে, তা সংক্ষিপ্ত করে বললে- প্রথম মানব মনু হাত-পা ধৌত করতে গিয়ে এক জলাশয়ে একটি ক্ষুদ্র মাছ দেখতে পেলেন, ক্ষুদ্র মাছটি অন্যান্য রাক্ষুসে মাছ থেকে রক্ষা করার জন্য মনুর কাছে অনুরোধ করলো। তিনি সেই মাছকে নিরাপদ স্থান হিসেবে জলভর্তি পাত্রে রেখে দিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল, মাছটি অতিবৃহৎ হয়ে গেল, যে আর ঐ স্থানে রাখা সম্ভব হচ্ছে না; তিনি একে একটি জলাশয়ে নিয়ে গেলেন। সেখানেও রাখার কিছুদিনের মধ্যে মাছটি আরো বৃহৎ হয়ে গেলো যে, জলাশয়ে মাছের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে নিয়ে গেলেন একটি পুকুরে, সেখান থেকে নদীতে। এরপরও মাছটি এত বৃহৎ হয়ে গেলো যে, এর স্থান সংকুলানের জন্য সমুদ্রে নিয়ে যেতে হলো। একদিন মাছটি মনুকে সমগ্র পৃথিবীতে মহাপ্লাবনের বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দিল এবং দ্রুত একটি বৃহৎ নৌকা বানাতে নির্দেশ দিল, কারণ এই মহাপ্লাবনে পৃথিবীর সমস্ত জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। মনু তখন মাছের কথামতো কাজ শুরু করে দিলেন। যখন পৃথিবীতে মহাপ্লাবন শুরু হল, সারা পৃথিবী জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যেতে শুরু করল, সেই মাছটি মনু ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যসমেত নৌকাটির গুণ টেনে একটি বিরাট পাহাড়ের উপরে নিয়ে গেল। মহাপ্লাবনে সমস্ত পৃথিবী ল-ভ- হয়ে ভগবান বিষ্ণুর ইচ্ছা পূর্ণ হল, তখন আস্তে আস্তে মহাপ্লাবনের পানি কমে এল। বন্যার পানি কমে গেলে পৃথিবী পুনর্নিমাণের জন্য মনু ও তার পরিবার পাহাড় থেকে ভূমিতে নেমে এল, এবং পুনরায় পৃথিবীতে বংশবিস্তারের মাধ্যমে মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখল।
আরো কিছু বিখ্যাত পৌরাণিক কাহিনী এবং লোকগাঁথা : - আগেই বলা হয়েছে - স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে চরিত্রের নামের ভিন্নতা আর কাহিনীর ছোট-খাট পরিবর্তন নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলেই এই প্লাবন/মহাপ্লাবনের কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এরকমই কয়েকটি লোকগাঁথার কাহিনী পাঠকের আগ্রহ বিবেচনা করে তুলে ধরা হলো: - (১) প্রাচীন রোমান পৌরাণিক কাহিনীতে রয়েছে- দেবতাশিরোমনি জুপিটার একসময় প্রচ- ক্রোধান্বিত হলেন, মানুষের শয়তানি এবং নাফরমানি দেখে। সিদ্ধান্ত নিলেন, ধ্বংস করে দিবেন এই জীবজগতকে। প্রথমে ঠিক করলেন, আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হবে; কিন্তু পরে আবার সিদ্ধান্ত বদল করে নিলেন; প্লাবনের পানিতে ভাসিয়ে-ডুবিয়ে ধ্বংস করবেন এ জীবজগতকে। এজন্য দেবতা নেপচুনের সাহায্য নিলেন ভয়ানক ভূমিকম্প-বজ্রপাতের মাধ্যমে মহাপ্লাবনের জোয়ার সৃষ্টি করতে। এই মহাপ্লাবনের স্রোতে ভেসে যেতে লাগল সকল প্রাণ, ডুবে যেতে লাগল সমস্ত পৃথিবী। কিন্তু শেষমেশ ডুবলো না শুধু পারনাস্সুস পাহাড়ের চূড়া। ভয়ঙ্কর ঐ প্লাবনের সময় নৌকা বানিয়ে স্রোতে ভেসে ভেসে পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিয়েছিল প্রমিথিউয়াস পুত্র ডিউকেলিয়ন এবং তার স্ত্রী পাইহা। আগে থেকেই তাদের সততা, নিষ্ঠায় মুগ্ধ ঈশ্বর, তাদেরকে আশীর্বাদ করলেন এবং দুনিয়া থেকে বন্যার পানি কমিয়ে দিলেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ডিউকেলিয়ন ও পাইহা একদিন পাহাড়ের চূড়া থেকে মাটিতে নেমে এলেন এবং দৈববাণী অনুসারে পৃথিবীতে পুনরায় বংশবিস্তার শুরু করলেন। (রোমান এই পৌরাণিক কাহিনীর সাথে গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনীর লক্ষ্যণীয় মিল রয়েছে, যেমন- প্রমিথিউয়াস পুত্র ডিউকেলিয়ন এবং পাইহা নামের চরিত্র গ্রিককাহিনীতেও রয়েছে, রোমান ঈশ্বর জুপিটারের বদলে ওখানে রয়েছে জিউস ... ইত্যাদি।) (২) সুমেরিয়ান গল্পগাঁথা থেকে জানা যায়, ঈশ্বর একসময় তাঁদের সৃষ্টির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে মনুষ্যপ্রজাতিকে ধ্বংস করে দিতে মনস্থির করলেন, কিন্তু সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজা জিউসুদ্রের প্রতি প্রীত হয়ে দেবতা এনলিল আগত ভয়ানক বন্যার ব্যাপারে আগেই সাবধান করে দিলেন এবং পরামর্শ দিলেন একটি বৃহৎ জাহাজ বানানোর জন্য। রাজা জিউসুদ্র দেবতা এনলিলের পরামর্শ মতো কাজ শুরু করে দিলেন। একসময় এলো সেই ভয়ানক কালরাত্রি; চারিদিক থেকে শাঁ শাঁ করে প্রচ- বেগে ছুটে আসা বাতাস আর সাত দিন - সাত রাত ধরে অবিরাম বৃষ্টিতে এ ধরণী ডুবে গেল। বন্যার সময় জিউসুদ্র সদ্য তৈরি করা জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন। জাহাজে করে ভেসে বেড়াতে লাগলেন একস্থান থেকে অন্যস্থানে। জাহাজে বসে রাজা জিউসুদ্র সূর্যদেবতা উতুর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন সূর্য উদয়ের জন্য, যাতে করে বৃষ্টি কমে গিয়ে বন্যার পানি কমে যায়। আস্তে আস্তে যখন দেবতাদের ক্রোধ কমে এল তখন বন্যার পানিও কমতে লাগল, এবং আকাশে একসময় সূর্যের দেখা মিললো। বন্যার পানি একদম কমে গেলে রাজা জাহাজ থেকে ভূমিতে নেমে এলেন; এবং দেবতাদ্বয় অনু এবং এনলিলের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য একটি ভেড়া ও ষাঁড় কোরবানি দিলেন (মহাপ্লাবনের পরে কোরবানি দেয়ার ঘটনাটি তৌরাত শরিফেও উল্লেখ আছে, দেখুন : পয়দায়েশ, ৮:২০-২১)। (৩) আসামের লুসাই আদিবাসিদের লোকগাঁথায় আছে-একবার জলের রাজা যিনি আবার শয়তানদেবতা, নগাই-তি নামক এক অপূর্ব সুন্দরীর প্রেমে পড়ে গেলেন। শয়তানদেবতা তাঁর চিত্তহরণকারী নারীর কাছে যখন প্রেম নিবেদন করতে গেলেন, কিন্তু নগাই-তি দেবতার সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকার করলো এবং পালিয়ে গেল। সাধারণ এক নারীর দুঃসাহস দেখে অপমানিত বোধ করলেন, ক্ষুদ্ধ হলেন, রাগান্বিত হলেন! মানবীর সাথে প্রেম করতে ব্যর্থ হয়ে দেবতা কা-জ্ঞান শূন্য হয়ে গেলেন। প্রচ- ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তিনি মানবজাতিকে ‘ফুন-লু-বুক’ পাহাড়ে পানি দিয়ে ঘেরাও করে ফেললেন। হুমকি দিলেন-নাগাই-তিকে না পেলে সকলকে তিনি পানিতে ডুবিয়ে মারবেন। শয়তানদেবতার হুমকিতে ভীত হয়ে সাধারণ জনগণ আশু বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য নগাই-তিকে জোর করে বন্যার পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এরপরই দেবতার ক্রোধ কমে গেল এবং তিনি পাহাড়ের চারপাশ থেকে বন্যার পানি কমিয়ে দিলেন। (৪) চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ললোবাসীদের লোকগাঁথা থেকে জানা যায়, স্বর্গের পিতা সিজুসিহ্ একজন মৃতমানুষের রক্ত ও সামান্য মাংস নিয়ে আসার জন্য পৃথিবীতে একবার দূত প্রেরণ করলেন। দূতটি সব জাযগায় নানা মানুষের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হল, কিন্তু একজন ব্যক্তি ‘দুমু’ শুধুমাত্র স্বর্গের পিতার কথা রক্ষা করল। পিতা পৃথিবীর লোকদের এই বেঈমানি দেখে রাগান্বিত হলেন এবং আকাশ হতে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলেন। প্রচন্ড বৃষ্টিতে চারদিকে প্লাবনের সৃষ্টি হল। সকলেই বন্যার পানিতে ভেসে যেতে লাগল, ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু দুমু, তার চার ছেলে, কয়েকটি বুনো হাঁস, কয়েকটি ভোঁদরসহ একটি লম্বা বড়সড় গাছে আশ্রয় নিল এবং পিতার করুণায় বেঁচে গেল। আজকে যারা সুসভ্য বা লেখা-পড়া জানে, তারা দুমুর ঐ চার সন্তানের বংশধর এবং যারা অশিক্ষিত বা সভ্যতার আলো পায়নি তারা কাঠ দ্বারা নির্মিত মূর্তির বংশধর, যেগুলিকে দুমু ভয়াবহ সেই মহাপ্লাবনের পর মেরামত করেছিল। (৫) পূর্বআফ্রিকার মাসাইদের আঞ্চলিক গাঁথায় আছে- অনেককাল আগে মাসাইদের ওখানে টামবাইনোত নামে সৎ-নিষ্ঠাবান একজন ব্যক্তি বাস করতেন। তার স্ত্রীর নাম নাইপান্দে এবং তিন সন্তানের নাম ওশমো, বার্তিমারো, বারমাও। হঠাৎ একদিন টামবাইনোতের ভাই লেঙ্গারনি মারা গেলে স্থানীয় প্রথানুসারে তিনি মৃতভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করলেন। মৃতভাইয়ের ঘরেও তিন সন্তান ছিল, ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করার ফলে ঐ সন্তানও টামবাইনোতের সন্তান হয়ে যায়। অর্থাৎ আগের তিন সন্তানসহ মোট ছয় সন্তান হয়। সে সময়ে পৃথিবীতে প্রচুর জনসংখ্যা ছিল। জনসংখ্যার ভারে পৃথিবী কম্পমান। কিন্তু পৃথিবীতে অধিক জনসংখ্যা থাকলেও মানুষের মধ্যে ন্যায়-নিষ্ঠা-নীতি-নৈতিকতা বলতে কিছু ছিল না। হত্যা-ধ্বংস-দুর্নীতি-লুণ্ঠন ইত্যাদি অপরাধপ্রবণতায় চারিদিক ছেয়ে গিয়েছিল। ঈশ্বর মানুষের ঐ অধোগতি দেখে ব্যথিত হলেন, ক্ষুব্ধ হলেন; পরে মনস্থির করলেন ধ্বংস করে ফেলতে হবে এই মনুষ্যপ্রজাতিকে, নূতন করে গড়তে হবে আবার। কিন্তু ঈশ্বর টামবাইনোতের সততায় সন্তুষ্ট ছিলেন, তাই তাকে নির্দেশ দিলেন কাঠ দিয়ে একটি জাহাজ তৈরি করতে, যেখানে আশ্রয় নিবে টামবাইনোত, তার দুই স্ত্রী, ছয় সন্তান, ছয় সন্তানের স্ত্রী এবং কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণী। যখন টামবাইনোত ঈশ্বরের পরামর্শ মতো জাহাজ বানানো শেষ করে ফেললেন, তখন ঈশ্বর ভয়ঙ্কর বৃষ্টির আদেশ দিলেন। একটানা প্রচ- বৃষ্টিতে চারিদিকে ভয়ানক বন্যা হয়ে গেল। সেই বন্যায় ডুবে যেতে লাগলো বাকি সব মানুষ, পশু-পাখীসহ নানা প্রাণী। টামবাইনোতের জাহাজটি আস্তে আস্তে বন্যার পানিতে ভেসে বেড়াতে লাগলো একস্থান থেকে অন্য স্থানে। একসময় বৃষ্টি থেমে গেলে, টামবাইনোত একটি পায়রা আকাশে উড়িয়ে দিলেন। বেশকিছুক্ষণ পর পায়রাটি ক্লান্ত হয়ে এল। টামবাইনোত বুঝতে পারলেন, পায়রা চারিদিকে কোথাও বসার জন্য শুকনো স্থান না পেয়ে আবার ফিরে এসেছে। ধীরে ধীরে আরো কিছু দিন চলে গেল, এবার তিনি একদিন একটি শকুন আকাশে উড়িয়ে কৌশলে পালকের সাথে তীর আটকে দিলেন; শকুনটি যদি কোথাও গিয়ে বসে, তবে তীরটি যেন ঐ স্থানে আটকে যায়। ঐ দিন সন্ধ্যার দিকে শকুনটি ফিরে এল তবে পালকের মধ্যে আর তীর আটকে ছিল না। এবার টামবাইনোত বুঝতে পারলেন, শকুনটি কোন নরম স্থানের ওপর বসে ছিল, যেখানে ঐ তীরটি আটকে গেছে। আরো কিছুদিন পর বন্যার পানি একদম কমে গিয়ে মাটির সমান হয়ে গেল এবং ওদের জাহাজটিও একজায়গায় এসে আটকে গেল। তখন টামবাইনোত তার পরিবারসহ ভূমিতে নেমে এসে আকাশে অপূর্ব রঙধনু দেখতে পেলেন; একে তারা ঈশ্বরের ক্রোধ স্থিমিত হওয়ার লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করলেন।
বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান :-
ওল্ড টেস্টামেন্টের অন্তর্গত তৌরাত শরিফে (জেনেসিস অধ্যায়ে) হযরত আদম থেকে হযরত ইব্রাহিমের বয়সের তালিকা সরাসরি দেয়া আছে। কিন্তু হযরত ইব্রাহিম থেকে খ্রিষ্টের জন্ম অবধি এই সময়কালের সেরূপ কোনো তথ্য (জন্মলতিকা) সরাসরি বাইবেলে নেই। এ অবস্থায় প্রাচীন নানা ধর্মগ্রন্থ বিশ্লেষণ করে ১৬৫৪ সালে আয়ারল্যান্ডের ধর্মযাজক জেমস আসার (১৫৮১-১৬৫৬), তাঁর ‘অ্যানাল্স অফ ওল্ড এন্ড নিউ টেস্টামেন্ট’- গ্রন্থে বাইবেলে উল্লেখিত আদম এবং তাঁর বংশধরদের জন্মতালিকা যোগ করে জানিয়েছিলেন- ঈশ্বর এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০৪ সালে, রবিবার সকাল নয় ঘটিকায়, অক্টোবরের ২৩ তারিখে। এর কিছুকাল পরেই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জন লাইটফুট (১৬০২-১৬৭৫) নতুন গণনা করে জানালেন, আদমের জন্ম সকাল নয় ঘটিকায়, সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে, খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার চার সালেই; এবং বাইবেলে উল্লিখিত ‘মহাপ্লাবন’ খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৪৮-এ হয়েছিল। এই দুই প-িতব্যক্তির সূক্ষ্ম দিনক্ষণের হিসাবকে বিশ্বের বহু ইহুদি এবং খ্রিষ্টান সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে থাকেন। বাংলা একাডেমি; ঐতিহাসিক অভিধান (মোহাম্মদ মতিউর রহমান সংকলিত, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৩২৭) মতে-আদম পৃথিবীতে আসেন ৫৮০৯ খ্রিষ্টপূর্ব এবং মৃত্যুবরণ করেন ৪৮৭৯ খ্রিষ্টপূর্ব। হযরত আদম থেকে হযরত নুহ্রে বয়সের ব্যবধান ১০৫৬ বছর। হযরত নুহ্রে বয়স যখন ছয়শত বছর, তখন মহাপ্লাবন হয়েছিল। অর্থাৎ হযরত আদম জন্মের ১৬৫৬ বছর পর (খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৪৮ সালে) মহাপ্লাবন হয়েছিল। এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে, ২৩৪৮+২০০৭ = ৪৩৫৫ বছর। আর একটি বারের জন্যেও মহাপ্লাবন হয়নি, কী অদ্ভুত!
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থসমূহে যে মহাপ্লাবনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তা থেকে দুটি প্রশ্ন উঠে আসে :-
(১) মহাপ্লাবনের মাধ্যমে পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতগুলিকে ডুবিয়ে দেওয়ার মতো আদৌ এতো বৃষ্টি হওয়া কি সম্ভব?
(২) হযরত নুহ্রে জাহাজে কি সত্যই পৃথিবীর সকল প্রাণীর এক জোড়া করে জায়গা হওয়া সম্ভব ছিল?
এ দুটি প্রশ্নের উত্তর বের করার আগে পাঠকদের দুটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, (১) আমাদের এই প্রবন্ধে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য খ্রিষ্টন ও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তৌরাত শরিফকে বেছে নিয়েছি কারণ, তৌরাত শরিফের জেনেসিস অধ্যায়ে হযরত নুহ্, নুহ্রে জাহাজ, মহাপ্লাবন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যেরকম বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, অন্যকোনো ধর্মগ্রন্থ বা পৌরাণিক লোকগাঁথাতে এরকম বর্ণনা নেই। স্পষ্ট করে বললে, ওগুলোতে যা আছে, তা ভাসা-ভাসা বা হালকা চালে লেখা। ফলে বাইবেল ব্যতিরেকে বাকি সকল ধর্মগ্রন্থের বাণী বা লোকগাঁথা থেকে তথ্য নিয়ে মহাপ্লাবনের কাহিনীকে সত্য প্রমাণ করা সম্ভব না কিংবা এ তথ্য সম্পর্কে সংশয়ী হয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালানোও সম্ভবনা। (২) আমরা কোনোভাবেই স্থানীয় বন্যা বা প্লাবনকে অস্বীকার করছি না। বরং আমরা মনে করি সেটি হবার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, প্রাচীনকালের সকল সভ্যতাই নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে; যেমন নীলনদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, সিন্ধু নদীর তীরে সিন্ধুসভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর তীরে ব্যবিলনীয় সভ্যতা এবং হাল আমলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে আমাদের ঢাকাই সভ্যতা। নদী কেন্দ্রিক সভ্যতা তৈরি হলে, সহজেই ধারণা করা যায়, স্থানীয়ভাবে বন্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। ধারণা করতে পারি, স্থানীয় বন্যায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা প্রাচীনকালের মানুষকে বেশ আকর্ষণ করেছে। এ আকর্ষণের প্রভাব গিয়ে পড়েছে ঐ অঞ্চলের মানুষদের চিন্তা-চেতনায়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মগ্রন্থে-পৌরাণিক গল্পে-আঞ্চলিক লোকগাঁথায়। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই, আজকের এই প্রবন্ধে শুধুমাত্র ‘কথন’ এবং ‘অতিকথন’ (স্থানীয় প্লাবনকে কল্পনার ফানুস দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মহাপ্লাবন বানানো, সমগ্র পৃথিবীকে ডুবিয়ে দেয়া, একজোড়া করে পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতি সংগ্রহ করে নৌকায় রাখা ইত্যাদি)-এর মধ্যবর্তী দূরত্বের মধ্যেই আলো ফেলতে চাচ্ছি। পাঠক নিশ্চয়ই বিষয়টি বুঝতে পারছেন। এখন আর দেরি না করে উপরের দুটি প্রশ্নের সমাধান অংকের মাধ্যমে দেখা যায় –
(১) মহাপ্লাবন ঘটা কি সম্ভব : - আমাদের এই পৃথিবীর পরিধি হচ্ছে ৭,৯২৬ মাইল বা ১২,৭৫৬ কিলোমিটার। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ হচ্ছে প্রায় ৬,৩৭০ কিলোমিটার। তাহলে পৃথিবীর আয়তন হচ্ছে প্রায় ১,০৮০ বিলিয়ন কিউবিক কিলোমিটার বা প্রায় ১,০৮২,৬৯৬,৯৩২,০০০ কিউবিক কিলোমিটার। এই বিশাল আয়তনের পৃথিবীকে ডুবিয়ে দেয়ার মতো মহাপ্লাবনের এত জল এল কোথা থেকে? আকাশ থেকে নিশ্চয়ই। তারপর সেই জল গেল কোথায়? সারা পৃথিবীর জল মাটিতে শুষে নেয়া সম্ভব নয় (কারণ, পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল), আবার অন্য কোনো উপায়ে উবে যাওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র যে জায়গায় এই জল যেতে পারে, সেটা বায়ুম-ল; অর্থাৎ এই জল বাষ্প হয়ে যেতে পারে। তাহলে বায়ুম-লেই এখন জলটা আছে। এখন যদি আকাশের সমস্ত বাষ্প জমে জলবিন্দুেেত পরিণত হয় ও পৃথিবীতে ঝরে পড়ে তা হলে কী আবার আর একটি মহাপ্লাবন হয়ে সর্বোচ্চ পর্বতগুলিকেও ডুবিয়ে দেবে? মনে হয় না আর কোন মহাপ্লাবন হবে। কারণ ঈশ্বর যে নিষেধ করেছেন, আর কখনও বন্যা হযে সমস্ত প্রাণী জাতিকে ধ্বংস করবে না (পয়দায়েশ, ৯:১৫)।
আবহবিদ্যার বই থেকে আমরা জানতে পারি, প্রতি বর্গমিটারের উপরে যে বায়ুম-ল রয়েছে, তাতে গড়পড়তা ১৮ কিলোগ্রাম জলীয়বাষ্প থাকে এবং ২৫ কিলোগ্রামের বেশী থাকতে পারে না। বায়ুম-লের এই আদ্রতা ঘনীভূত হয়ে এক সঙ্গে যদি ঝরে পড়ে, তাহলে পৃথিবীতে জলের গভীরতা কতটুকু বাড়ে?
১ বর্গমিটার জায়গায় সবচেয়ে বেশি জল থাকতে পারে ২৫ কিলোগ্রাম বা ২৫,০০০ গ্রাম; এবং এই ২৫,০০০ গ্রাম জলের আয়তন হবে ২৫,০০০ ঘনসেন্টিমিটারের সমান। এই আয়তন হবে প্রতি ১ বর্গ মিটার বা ১০০ ঢ ১০০ = ১০,০০০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গায় উপরের স্তরে। এখন জলের আয়তনকে ভূমির ক্ষেত্রফল দিয়ে ভাগ করলে জলস্তরের গভীরতা পাওয়া যাবে, ২৫,০০০ ভাগ ১০,০০০ = ২.৫ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ মহাপ্লাবনে সবচেয়ে বেশি জল জমা হলে, তা হতে পারে ২.৫ সেন্টিমিটার গভীর। অর্থাৎ মহাপ্লাবনে পৃথিবীর সবজায়গায় গড়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হলে ২.৫ সেন্টিমিটার জল জমতে পারে। আবার এইটুকু উচ্চতায় জল জমা সম্ভব হতে পারে একমাত্র যদি মাটি এই বৃষ্টির জল শুষে না নেয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মহাপ্লাবনে সত্যই ২.৫ সেন্টিমিটারের থেকে বেশী জল জমা সম্ভব নয়।
কিন্তু বহু জায়গায় বৃষ্টিপাত অনেক সময় ২.৫ সেন্টিমিটারকে ছাড়িয়ে যায়। কারণ, সেসব ক্ষেত্রে জলবায়ুম-ল থেকে সোজাসুজি শুধু সে জায়গায় পড়ে না, পাশাপাশি অন্যান্য অঞ্চল থেকেও বাতাস জল বয়ে আনে। কিন্তু ধর্মগ্রন্থের মতে (পয়দায়েশ, ৭:২০) মহাপ্লাবন একই সঙ্গে সারা পৃথিবীকে ডুবিয়ে দিয়েছিল জলের নীচে, সুতরাং তখন এক অঞ্চলে অন্য অঞ্চল থেকে বাতাসের মাধ্যমে জল আসা সম্ভব ছিল না।
হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, প্লাবন যদি হয়েও থাকে তা হলেও জল ২.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উপরে উঠতে পারে নি। কিন্তু আমাদের এভারেস্ট পর্বতের উচ্চতম শৃঙ্গ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৮.৮ কিলোমিটার বা ৮৮০০ মিটার উঁচু। তৌরাত শরিফসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ, আঞ্চলিক লোকগাঁথা এবং পৌরানিক উপাখ্যানে বলা হয়েছে- মহাপ্লাবনের ফলে পৃৃথিবীর সমস্ত পাহাড়-পর্বত ডুবে গিয়েছিল। এখন একটু হিসেব করলেই বুঝা যাবে মহাপ্লাবনের এই জলের গভীরতাকে কতগুণ বাড়িয়ে বলা হয়েছে?
৮.৮ কিলোমিটার = ৮৮০,০০০ সেন্টিমিটার। এখন একে ২.৫ সেন্টিমিটার দিয়ে ভাগ দিলে পাওয়া যায় - নাহ, খুব বেশি অতিরঞ্জন করা হয়নি! মাত্র ৩৫২,০০০ (তিন লক্ষ বাহান্ন হাজার) গুণ বাড়িয়ে বলা হয়েছিল! খুবই কম, তাই না?
দেখ যাচ্ছে, “প্লাবন” যদি হয়েও থাকে তাহলে ঠিক যাকে বৃষ্টি বলে তা হয় নি, একটা ঝিরঝিরে বর্ষণ হয়েছে মাত্র। কেননা, চল্লিশদিন-চল্লিশরাত ধরে বিরামহীন বৃষ্টির ফলে (পয়দায়েশ, ৭:১২) যদি মাত্র ২৫ মিলিমিটার (২.৫ সেন্টিমিটার) জল জমে, তাহলে দৈনিক বৃষ্টি হবে ০.৬২৫ মিলিমিটার। আর শরৎকালে যে ঝিরজিরে বৃষ্টি হয় তাতেও ১০ মিলিমিটারের মত জল থাকে (প্রায় ২০ গুণ বেশী)।
(২) হযরত নুহ্-এর জাহাজ :- দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ঐ জাহাজে পৃথিবীর সকল প্রাণীর এক জোড়া করে কি জায়গা হওয়া সম্ভব? ধর্মগ্রন্থে (পয়দায়েশ, ৬.১৫) আছে, জাহাজ ছিল তিন তলা, লম্বায় তিনশ হাত, চওড়া ৫০ হাত, উচ্চতা ত্রিশ হাত।
প্রাচীন পশ্চিম এশিয়ার লোকদের একহাত বলতে যে মাপ বোঝানো হত, তাকে দশমিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন করলে দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার বা ০.৪৫ মিটার। তাহলে, জাহাজটি লম্বায় ছিল ৩০০ ী ০.৪৫ = ১৩৫ মিটার লম্বা। আর ৫০ ী ০.৪৫ = ২২.৫ মিটার চওড়া। তাহলে, প্রতিটি মেঝের মাপ ছিল ১৩৫ ী ২২.৫ = ৩০৩৭.৫ বর্গমিটার এবং তিনতলা মিলিয়ে জাহাজে মোট জায়গা ছিল ৩ ী ৩০৩৭.৫ = ৯১১২.৫ বর্গমিটার।
পৃথিবীতে শুধু প্রাণীই আছে দশ রকমের চঐণখটগ-এর (উদ্ভিদের কথা না হয় বাদ দেয়া হল) :- (1) Protozoa (2) Porifera (3) Coelenterata (4) Platyhelminthes (5) Nemathelminthes (6) Annelida (7) Arthropoda (8) Mollusca (9) Echinodermata (10) Chordata।
এর মধ্য থেকে আমরা শুধু মাত্র একটা ফাইলামকে বেছে নিচ্ছি, ঈযড়ৎফধঃধ অর্থাৎ মেরুদ-ী প্রাণী। এই মেরুদ-ী প্রাণীদের আবার পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন - (১) পাখী, (২) মাছ, (৩) সরীসৃপ (৪) উভচর (৫) স্তন্যপায়ী। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ১,৭৫০,০০০ প্রজাতির প্রাণী আছে; এবং ধারণা করা হয় অনাবিষ্কৃত রয়েছে ১৪,০০০,০০০ প্রজাতির প্রাণী। নিম্নে কিছু প্রাণীর প্রজাতি সংখ্যা উল্লেখ করা হলো-
স্তন্যপায়ী
৩৫০০
পাখী
১৩০০০
উভচর
১৪০০
সরীসৃপ
৩৫০০
পতঙ্গ
৩৬০,০০০
অঙুরিমাল (Annelid)
১৬০০০
এখন দেখি, ঐ জাহাজে কেবল স্তন্যপায়ীদের জন্যই জায়গা যথেষ্ট ছিলো কি না?
ধর্মগ্রন্থের (পয়দায়েশ, ৭:২৪) বর্ণনা মতে, দুনিয়া ১৫০ দিন জলের নীচে ডুবে ছিল। তাহলে ঐ সময় স্তন্যপায়ীদের জন্যই কেবল জায়গার ব্যবস্থা করতে হয়নি, তাদের খাবারের জন্যও জায়গা করতে হয়েছিল। সাথে সাথে হযরত নুহ্, নুহ্রে স্ত্রী, তাঁদের তিন ছেলে, ছেলের স্ত্রীদের জন্য জায়গাসহ তাঁদের খাবার-দাবার রাখতে হয়েছিল। জাহাজে প্রতি জোড়া স্তন্য পায়ীদের জন্য জায়গা ছিল, ৯১১২.৫ ভাগ ৩৫০০ = ২.৬ বর্গমিটার।
নিঃসন্দেহে এই জায়গা পর্যাপ্ত নয়। নুহ্-এর পরিবারের জন্য জায়গার দরকার হয়েছিল, তাদের নিজেদের খাদ্যের দরকার ছিল, প্রাণীদের খাঁচাগুলোকে ফাঁক ফাঁক করে রাখতে হয়েছিল (স্তন্যপায়ীদের মধ্যে তিমি, ডলফিন, হাতি, রাইনো, হিপ্পো, বাঘ, সিংহ, গরু, ছাগল, হাতি, জিরাফসহ ইত্যাদি বিশাল আকারের জন্তুরাও আছে), এসকল প্রাণীদেরও খাদ্যের দরকার ছিল। তৃণভোজী প্রাণীদের জন্য ঘাস-গাছ-গাছালী, মাংসাশী প্রাণীদের জন্য মাংসসহ খাদ্যের স্টক কোথায় রাখা হবে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোয়ালা নামক লেজবিহীন ছোট ভালুকের মতো প্রাণীটি রোজ এক কেজি করে ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতা খায়, যা তার পুষ্টি ও পানির চাহিদা মিটিয়ে দেয়। ঐ জাহাজে তো মুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণীদেরই পর্যাপ্ত জায়গা হচ্ছে না, আবার অন্যান্য প্রাণীসহ ১৫০ দিন চলার মতো তাদের খাদ্যের স্টক কোথায় রাখা হবে?
মোদ্দা কথা, ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত মহাপ্লাবনের বর্ণনাকে মিথ্যে করে দিচ্ছে অংকের হিসাব। আসলে ওরকম কিছু ঘটাই অসম্ভব। যদি কিছু হয়ে থাকে তো, মনে হয় কোন স্থানীয় বন্যা হতে পারে। বাকি বক্তব্যগুলি কল্পনা, অতিমাত্রায় অতিকথন ছাড়া আর কিছুই নয়।
তথ্য নির্দেশিকা :-
(১) কিতাবুল মোকাদ্দস, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা।
(২) হাফেজ মুনির উদ্দিন আহমেদ, কোরআন শরীফ : সহজ সরল বাংলা অনুবাদ, আলকোরআন একাডেমী লন্ডন। মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, কোরানসূত্র, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩৫৬। Interpretation of the meaning of The Noble Quran, Translated into the English Language By Dr. Muhammad Taqiud-Din Al-Hilali, ph.D. & Dr. Muhammad Muhsin Khan. (www.road-to-heaven.com)
(৩) নারায়ণ সেন, ডারউইন থেকে ডিএনএ এবং চারশো কোটি বছর, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃষ্ঠা - ৩০। এবং http://gpc.edu/`pgore/geology/geo102/age.htm
(৪) বেনজীন খান, দ্বন্দ্বে ও দ্বৈরথে, চারুলিপি প্রকাশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৫৮।
(৫) প্রবীর ঘোষ, আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা-৩০।
(৬) http://www.abarnett.demon.co.uk/atheism/noahs_ark.html
(৭) http://www.indianchild.com/animal_kingdom.htm
(৮) বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যানে মহাপ্লাবনের আরো কাহিনী জানতে আগ্রহীরা ভিজিট করতে পারেন- http://www.talkorigins.org/faqs/flood-myths.html
অনন্ত বিজয় দাশ : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। ২০০৬ সালে মুক্তমনা .ব্যাশনালিস্ট এওয়ার্ড পেয়েছেন; যুক্তি পত্রিকার সম্পাদক।
মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা): যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected], অথবা [email protected]
অথবা,
ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০