শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)বেরুলো
রাজনৈতিক বর্বরতার এক করুণ বাহিনী
মেহুল কামদার
অনুবাদ : কাওসার চৌধুরী
মুম্বাই শহরে লিপি মিজানুর শেখের মৃত্যু সংবাদ একটি বৈকালিক সংবাদপত্র “মিড ডে” এর ভেতরের পাতায় বেরিয়েছিল। মিড ডে পত্রিকার রিপোর্টার এবং সম্পাদককে ধন্যবাদ যে ওর মৃত্যু সংবাদটা ছাপা হয়েছিল। ওর মৃত্যুর কারণ হিসাবে করোনারের রিপোর্টে পেরিটোনাইটিস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অবস্থার জন্য আগস্ট মাসে ওর অপারেশন হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাগণ নাম প্রকাশ না করার শর্ত সাপেক্ষে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে যে লিপি আসলে আত্মহত্যা করেছিল। ওর বয়স ছিল ২৮ বছর এবং তিনি দুই সন্তানের মা। লিজমোর বয়স দশ বছর এবং পারভেজের ছয় বছর। আর স্বামী মিজানুর শেখ সম্পর্কে কোন খবরই জানা যায়নি। লিপি পানশালায় নর্তকী হিসাবে কর্মরত ছিল - যা প্রকৃত অর্থে নগ্ন নর্তকীদের ভারতীয় সংস্করণ। তিনি তার পরিবারসহ বাংলাদেশী নাগরিক হিসাবে ভারতে অবৈধভাবে বসবাস করছিলেন। এই অভিযোগে পরিবারের সকল সদস্যই কারারুদ্ধ ছিলো। পুলিশের পুরুষ এবং মহিলা কর্মকর্তাগণ যারা “মিড ডে” এর সাথে কথাবার্তা বলেছিল তারা খবরের কাগজে বিবৃতি দিয়েছে যে লিপি তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বলেই আত্মহত্যা করেছে। সন্তানরা ‘কাজরাত’ এবং ‘ভিওয়ান্দি’র সংশোধনী স্কুলগুলোতে থাকতো, কিন্তু তার স্বামীর খোঁজ খবর কেউ জানাতে পারেনি।
আমার চেয়ে আরো প্রতিভাবান কোন লেখক জীবন মৃত্যুর এই করুণ কাহিনী নিয়ে এমন একটা গল্প লিখতে পারতেন এবং লিপির এই মর্মান্তিক কাহিনী পড়ে অনেক পাঠকের চোখেই অশ্রু আসত। এক দরিদ্র মহিলা তার পরিবারসহ জীবিকার জন্য দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে সুদুর এক অজানা দেশে, যেখানে লোকজন এবং তাদের ভাষা সবই তার কাছে অপরিচিত সেখানে অবস্থান নেয়। তার স্বামী, যদি ধরে নেয়া হয় যে সে কিছুটা শিক্ষিত ছিল, তাহলে সে হয়তো একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারতো যা দিয়ে সন্তানদের অন্তত: ক্ষুধার অন্ন সংস্থান হতো। কিন্তু এই সুন্দরী মহিলাকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিল। ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরে অর্থাৎ যেখানে আবাসন খরচ পৃথিবীর অন্য সব বড় বড় শহরে যেমন টোকিও কিংবা নিউইয়র্কের সমমানের, সেখানে তাকে প্রতিদিন আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে পানশালায় নগ্ন নৃত্য প্রদর্শন করতে হতো।
কল্পনা করতে পারি যে ওর স্বামী প্রতিদিন ওর সন্তানদের ঘুম পাড়ানোর সময় ওদের মায়ের অবস্থান সম্বন্ধে কাল্পনিক গল্প বলতো। যে কেউ লিপির মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করতে পারবেন: প্রতিদিন সে পানশালার সংগীত ও বাদ্যের সাথে নিজেকে দর্শকদের সামনে উন্মুক্ত করছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তার দেহ স্পর্শ করেছে, আবার কেউবা তার অর্ন্তবাসের ভেতরে টাকা গুছে দিচ্ছে আর তার সাথে রয়েছে দর্শকদের অশ্লীল মন্তব্য। প্রতিদিনকার এই নির্যাতনের মধ্যে সে কি তার সন্তানদের কথা ভাবতে পারতো? প্রতিদিন এই পরবাসে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য, সন্তান-স্বামীর দু’মুঠো আহারের সংস্থানের জন্য দিনের পর দিন নিদারুণ আত্মঅবমাননা কি সে সহ্য করতে পারতেন?
এটা বিস্ময়কর যে এই লাঞ্ছিত জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে তিনি কি স্বপ্ন দেখতেন? এই দুঃখজনক অবস্থায় প্রতি রাত্রিতে তার স্বামীর কী অসহায় অনুভূতি তা সহজেই অনুমেয়। বস্তীর নোংরা পরিবেশে সন্তানদের পাশে শুয়ে থেকে সারাক্ষণ তার স্ত্রী কি দুঃসহ সময় কাটাচ্ছে সে চিন্তা থেকে মনকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতো এবং এক দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে অপেক্ষা করতো আর ভাবতো যে কখন তার প্রিয়তমার কাজ শেষ হবে এবং সে ঘরে ফিরে আসবে। সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে এমন এক জীবিকায় বাধ্য করার জন্য তার স্বামীর অসহায়তা এবং তাদের জীবন যাত্রার জন্য ন্যূনতম সংস্থান করাই দায়ী।
আমরা সবাই জানি বাচ্চাদের স্কুলে তাদের সহপাঠি শিশুরা কি নির্মম মন্তব্য করে থাকে। বিশেষ করে যদি তারা তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে থেকে কিছু শুনে থাকে তবে সেটা বার বার উচ্চারণ করতে থাকে। যেমন- “তোমাদের মা অপরিচিত মানুষের সামনে ল্যাংটা হয়ে নাচে”, “তোমার মা একজন পতিতা”, “তোমরা বেজন্মা এবং তোমাদের মা হচ্ছে গণিকা”। কিন্তু এ সত্ত্বেও লিপির মিজানুর ও সন্তানদের নিয়ে একটা পরিবার ছিল। হয়তো স্বপ্নও দেখত একদিন এই অভিশাপ জীবন থেকে মুক্ত হবে। লিপি তার সন্তানদের এতটাই ভালোবাসত যে যখন তার সন্তানদের সাথে দেখা হওয়ার কোন আশাই রইল না তখন সে আত্মহননের পথ বেছে নিল। সে একজন মা বলেই এমনি একটা অসম্মানজনক পেশার যন্ত্রনাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি তার বাচ্চাদের আহারের সংস্থানের জন্য সব কিছুই করতে পারতেন। তিনি এই আশা করতেন যে তার এই আত্মত্যাগ লিজমা এবং পারভেজের উন্নত ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারে। সে স্বপ্ন দেখতো যে তার বাচ্চারা একদিন ভালোভাবে বড় হয়েছে এবং তার অল্প বয়সের এই অত্যাচারিত জীবন শুধু এক দুঃখময় স্মৃতি হয়েই থাকবে। কিন্তু এর কোনটাই আর হয়ে উঠলো না।
লিপি তার পরিবারসহ আরো ৫০জন বাংলাদেশী উদ্বাস্তুকে ভারতে অবৈধভাবে বসবাসের জন্য মুম্বাই পুলিশ গ্রেফতার করে। ভারতীয় সাংসদগণ কিছু কিছু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সহায়তা নিয়ে গত কয়েক বৎসর যাবৎ ভারত প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করা এবং ভারতীয়দের হত্যা করার উদ্দেশ্য তথাকথিত সন্ত্রাসীদের বসবাস করা নিয়ে সোচ্চার এবং এদেরকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তৎপর ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনকার দাবি ছিল এবং একজন রাজনীতিবিদ যিনি বর্তমানে প্রয়াত হয়েছেন তার বক্তব্য ছিলো “আমাদের নিজের ঘরেই শক্র”; তিনি তাদের গ্রেফতার করে বহিস্কার করার দাবি জানাতেন। কিছুদিনের জন্য ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসিন দল কংগ্রেস যে কিনা মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারা নৈতিক পরিচ্ছন্ন অভিযানের নামে এ সকল নগ্ননৃত্য প্রদর্শনীর পানশালা অবৈধ ঘোষণা করেছে। সরকারের এই পদক্ষেপ প্রচুর বিরোধিতার সম্মুখীন হয় - কারণ এর ফলে অনেক দরিদ্র মহিলার কর্মচ্যুত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করে; আন্দোলনকারীরা এই সিদ্ধান্ত রহিত করার জন্য জনতার সাথে প্রবল দাবী তোলে।
প্রায় একশত ভাগ ভারতীয় নগ্ন নর্তকীগণ হলো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। হাজার হাজার নারী লিপির মতো স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে এভাবে কষ্ট সহ্য করে যাতে এই যন্ত্রণার বিনিময়ে তাদের পরিবার ক্ষুধায় যেন মৃত্যুবরণ না করে। ঠিক এমনই অবস্থায় এই গণগ্রেফতার হলো। এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র নাৎসী বর্বরতার নিদর্শন বিভিন্ন শ্রমিক ক্যাম্পগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে পরিবারগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে শ্রমিকদের বিভিন্ন বন্দী শিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
শুধুমাত্র সন্তানদের মুখে দু’মুঠো আহার তুলে দেবার জন্যে যে মা (লিপি) প্রতিদিন এই অত্যাচার এবং অপমান সহ্য করতো তাকেই চরম যন্ত্রণাটা দেয়া হলো তাকে তার বাচ্চাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। তাদের সাথে সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো এবং আবার কোন দিন ওদের সাথে দেখা হবারও কোন আশা রইল না অসহায় লিপির।
যে কেউ কল্পনা করতে পারেন যে ভারতের এই নিষ্ঠুর আইনের প্রয়োগে কিভাবে লিপির সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। প্রতি রাত্রে যখন সে নগ্ন নৃত্য প্রদর্শন করতো সে যন্ত্রণায় ভাবতো কবে সে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। কবে সে আবার তার স্বামী-সন্তানসহ অন্যান্য মায়েদের মত সুন্দর পরিবারে সময় কাটাতে পারবে।
তাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করতে পারবে। লিজমো-পারভেজকে খাওয়াতে পারবে এবং ঘুম পারাতে পারবে। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সে স্বপ্ন দেখতো একটা দিনের যেদিন সে এই ধরনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে। তার স্বামী এবং সন্তানদের, যাদের জন্য সে প্রতিনিয়ত এই অপমান সহ্য করতো, তাদেরকে তার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে নেওয়া হলো। নগ্ন নর্তকী হিসাবেও সে বাড়ি ফিরে প্রতিদিন সকালের প্রথম ভাগে তার সন্তানদের দেখতে পেত। অন্যান্য মায়েদের মতো সেও তার বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য বিদায় দিতে পারতো। দিনের বেলা কিছু সময় ঘুমাতে পারতো এবং বাচ্চারা ফিরে আসার আগে তাদের জন্য কিছু রান্না করতে পারতো এবং আবার কিছু অপরিচিত মানুষের কামনার দৃষ্টিতে পড়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতো।
তার বাচ্চারাই ছিল তার সান্ত¡না। বাচ্চারা মাকে জড়িয়ে ধরতে পারতো, যখন ওদের সাথে দেখা হতো তখন হয়তো বাচ্চারা ওর কোলে মাথা গুজে শুয়ে থাকতো। তাদের ছোঁয়া হয়তো তার প্রতি রাতের পেশাগত অত্যাচারের জন্য সৃষ্ট তার দেহের অদৃশ্য দংশনগুলো থেকে আরাম দিতে পারতো। ওর কাছ থেকে বাচ্চাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং আর কোনদিনই ওদের সাথে হয়তো দেখা হবেনা এই আশংকাতেই আত্মহননের পথ বেছে নিল।
এই পৃথিবী তার ডাইরীর জন্য ছোট ইহুদি মেয়ে এ্যানি ফ্রানকের করুণ জীবন সম্বন্ধে জানতে পেরেছে। আমি জানিনা লিপি লেখাপড়া জানতো কিনা? তার প্রতিদিনকার অনুভূতিগুলোকে যদি সে সুন্দর করে লিপিবদ্ধ করতে পারতো তাহলে নিতান্ত পাষাণ হৃদয় মানুষ ছাড়া সবাই তার কষ্ট ও যন্ত্রণার জীবন কাহিনী পড়ে আবেগ প্রবণ না হয়ে পারতো না। কঠিন এবং নির্মম এই ভারতীয় নিয়ম এই অল্পবয়সী ফুলের মত পবিত্র তরুণীকে জীবন বিসর্জন দিতে বাধ্য করলো। এটা সত্যি যে আধারওয়াদী জেলখানায় যেখানে লিপিকে রাখা হয়েছিল সেখানে কোন গ্যাস চেম্বার ছিল না, কিন্তু যে পরিস্থিতিতে তাকে জীবন দিতে হলো তাতে করে মনে হয় না গ্যাস চেম্বারের প্রয়োজন আছে। এই পদ্ধতিতে করোনারের রিপোর্টই যথেষ্ট - সে পেটের গোলমালে মৃত্যুবরণ করেছে। তারা কারারুদ্ধ অবস্থায় তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। ভারত তার মৃত্যুর দায় থেকে মুক্ত হতে পারে এবং তার নাম ঐ সকল মৃত কয়েদীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করতে পারে যারা চিকিৎসারত অবস্থায় কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছে। এই সকল পানশালা উন্মুক্ত থাকবে এবং লিপির মত অনেকেই সেখানে যুগযুগ ধরে নৃত্যরত থাকবে।
সেখানে কিছু ভারতীয়, অন্যেরা নেপাল, বাংলাদেশ, বার্মা কিংবা আরো অন্য কোথাও থেকে এসে কাজ নেবে কে জানে? কোথাও কোন দুটি আলাদা সংশোধনী স্কুলে দুটি শিশু প্রতিরাতেই কাঁদে প্রতি সকালেই তারা তাদের মাকে দেখার আশা নিয়ে থাকে। আমি অবাক হয়ে ভাবি আর জীবনে কোনদিনই হয়তো ওরা ওদের মাকে দেখতে পাবে না।
মেহুল কামদার : ভারতের তামিলনাড়ুর অধিবাসী। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো শহরবাসী। মুক্তমনা ফোরামের সহ মডারেটর এবং প্রয়াত এম. ডি. গোপাল কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত ‘মডার্ন র্যাশনালিস্ট’ পত্রিকার সম্পাদক। ভারতে থাকাকালীন অনেক যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ইমেইল [email protected]
মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা): যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected]