শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)বেরুলো
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
মামুনুর রশীদ
আমি ১৯৮২ সালে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর ভাইয়ের এক কন্যার তখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে। প্রথম স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়লো আমার এবং তার স্ত্রীর ওপর। বাবা খুবই ব্যস্ত। মেয়ে কিছুতেই স্কুলে যাবে না। মহা বিপদ। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে স্কুলে নিয়ে গেলাম। অপেক্ষা করলাম যে কোনো সময়ে ও হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে। কিস্তু স্কুল যখন ছুটি হল তখন সেই বালিকা বলছে আবার স্কুল কখন শুরু হবে? পরদিন সে ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুত হয়েই জিজ্ঞাসা করতো একটাই কথা কখন সে স্কুলে যাবে। বহু বছর পরে তার বিয়েতে যখন নিউইর্য়কে যাই তখন সে উচ্চ বেতনে একটা কম্পিউটার কোম্পানিতে চাকরি করছে। আর একবার আমি ১৯৮৫ সালে জাপানে যাই। জাপানের একটি স্কুল দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। স্কুলের মাঠে দেখতে পাই কিছু বালক কাঁদার মধ্যে সাইকেল চালাচ্ছে। একটা কাঁদার পাহাড়ের ওপর সাইকেল চালিয়ে উঠছে আর ধরাস্ করে নিচে পড়ে যাচ্ছে। একটু ভীত হয়েই শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করলাম এতো রীতিমতো আত্মঘাতী খেলা। শিক্ষক হেসে বললেন, ও কিছু না, বিন্দুমাত্র হাত-পা ভাঙ্গার কোন ঘটনা নেই। বরং হাড্ডি শক্ত হয়। স্কুলে ঢুকে দেখি এতো স্কুল নয়, খেলাধূলার জায়গা। মনের আনন্দে গান গাওয়া, বাজনা বাজানো, ছবি আঁকা, খেলাধূলা, তার মধ্যেই একটু খানি মনের আনন্দেই লেখাপড়া। প্রায় পনের বছর পর আবার যখন জাপানে যাই, দেখতে পাই ওরাই বড় বড় কলকারখানা আর অফিস আদালত চালাচ্ছে।
এই সব অভিজ্ঞতার একটু দীর্ঘ বয়সই হয়ে গেলো। কিন্তু এবার দেখা যাক বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ শিশু যে সব সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে তার চিত্রটা কি? এই চিত্র বয়ানের কোনই প্রয়োজন নেই। আবারো নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলি। দক্ষিণ কোরিয়াতে শিশুদের এক কর্মশালার শিক্ষক ছিলাম। যে স্কুলটিতে কর্মশালাটি হচ্ছিলো সেটি ছিল ছোট একটি পাহাড়ের ওপর।
নিচে বরফগলা নদী। শিশুদের কিছু তথ্য দিতে হবে। সেই তথ্যগুলো ওরা গান-নাচ-ছবি আাঁকার মাধ্যমে প্রকাশ করবে। শিশুরা তথ্য নিতেই চায় না। ভীষণ অমনোযোগী। তাদের চকলেট দিতে হয়, গান গাইতে হয়। নাচতে হয়। খেলতে হয়। কিন্তু কোন ধরণের বল প্রয়োগ করা যাবে না। এমনকি শরীরে স্পর্শও করা যাবে না। কোন ধরনের কর্তৃত্ত্ব ফলানো যাবে না। ঘন্টা দুয়েক প্রাণান্তকর চেষ্টার পর একটু মনোযোগ যখন এলো, তখন একটি শিশু হঠাৎ করে বরফগলা নদীর দিকে রওনা দিল। দেখা গেলো সবাই তাকে অনুসরণ করছে। আমরা তিনজন ওরা প্রায় একুশজন। ঐ নদীতে গোসল করা নিষিদ্ধ। মানুষ মারা যায়। সেখান থেকে ঠেকান। উহ! সে যে কি ভয়ংকর কাজ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওরা ফিলেছিলো এবং চমৎকার পরিসমাপ্তিও হয়েছিলো। জীবনে এত পরিশ্রান্ত ও পরিতৃপ্ত হবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।
শিক্ষকদের প্রায় প্রতিদিনই ওসব দেশে এরকম ঘটনা ঘটছে। আর আমাদের দেশে এরকম কষ্ট করে শিক্ষকতা করতে কতজন রাজী হবেন?
এখানে বেত্রাঘাত শিক্ষকের প্রধান অস্ত্র। জাপান কোরিয়া থেকে ঘুরে এসে শিক্ষাকে কেমন করে আনন্দময় করা যায় তার জন্যে দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিতে শুরু করলাম। সরকারি, বেসরকারি কর্তৃপক্ষ ও শেষ পর্যন্ত ইউনিসেফ-এ গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সর্বত্র। সাড়া পাই একটুখানি তারপর হারিয়ে যায়। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রথমবার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে (১৯৮৬-৮৭) নাটককে একটি বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে নানা জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করলাম। অবশেষে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফ দেশব্যাপী একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এযাবত প্রতিটি জেলায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। জানা যায় এই প্রকল্পের একটা প্রভাব পড়েছে যদিও প্রশিক্ষিত লোকগুলোর কাজের পরিধি সীমিত।
আমাদের এই দেশে প্রাচীনকালে একটা তপোবন শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ গুরুশিষ্য পরম্পরায় প্রাকৃতিক পরিবেশে আনন্দের মাধ্যমে একটি শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবেন। তিনি তা শুরুও করেন। আজো তা অব্যাহত আছে। কিন্তু শিশুদের জন্যে যে শিক্ষা ব্যবস্থা তার ওপর চড়াও হয়ে আছে বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতী আর দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে একটি বিদ্যাপীঠ। তাই শিশুদের বিকাশের মনে অন্তরায় হয়ে আছে ঐ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ব্যবস্থাটি এরকম ছিলনা। তখনকার এক চারুকলার ছাত্রের কাছে শুনছিলাম। ‘নন্দলাল বাবু আমাদের শিক্ষক ছিলেন। তিনি বক্তৃতা দিতেন না। আমরা ছবি আঁকতাম। তিনি এলে দেখতেন আর বাড়িঘরের খবর নিতেন। যেমন বাড়ি থেকে টাকা এলো কিনা, বাবার ম্যালেরিয়া সারলো কিনা এসব। কখনো ছবি আঁকতে গিয়ে আটকে গেলে মাস্টার মশাইয়ের কাছে যেতাম। উনি বলতেন ঐ চীনা ভবনে যা, ওখানে কয়েকটা ছবি আছে দেখে আয়। মাথা খুলে যাবে। কি আশ্চার্য মাথা খুলেও যেতো।’
বক্তৃতা নির্ভর শিক্ষার বিকল্প কিছু ভাবা যায় কিনা, শিক্ষার একমুখীনতাকে কি করে দ্বিমুখী করা যায় এ নিয়ে পঞ্চাশের দশক থেকে বিস্তর ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পাবলো ফ্রেরারী, নোয়াম চমস্কি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মতভাবে এসব প্রশ্নের মীমাংস করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের দেশের শিক্ষা সংস্কৃতিতে এর কোন ঢেউ এসে পড়েছে কিনা সন্দেহ।
শিক্ষার ক্ষেত্রে আরো বড় সংকট পাঠ্যপুস্তক। বেতনভুক শিক্ষাআমলা, ব্যর্থ অধ্যাপক, আর সৃজনবিমুখ কিছু লোকদের দ্বারা পরিচালিত পাঠ্যপুস্তক কমিটি যত সব অপাঠ্যপুস্তক উপহার দিয়ে আসছে। ভেজালের অংক শিখিয়েছে। পঞ্চাশ/ষাট দশকেও যে সব মানবিক পাঠ ছিলো তাও উবে গেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কোন রাষ্ট্র/সরকার প্রধানের শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন উৎসাহ দেখা যায়নি। যে বছর দেশ স্বাধীন হয় সে বছরই নকলের এবং মাস্তানির মাধ্যমে চেয়ার-টেবিলও পাশ করে যায়। রাজনীতিকরা যতটা ছাত্র রাজনীতিতে আগ্রহী হলেন ততটা শিক্ষার ক্ষেত্রে হলেন না। পাঠ্যক্রমেও ঢুকে গেলো রাজনীতি। শিক্ষা কমিশন হল। কিন্তু সেগুলোর সৎ প্রয়োগ না হয়ে উল্টো পথ ধরলো। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনকে পরিত্যক্ত করে সেখানে ঢুকে গেলো মজিদখানের শিক্ষানীতি। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হবার পর শোনা যায় সেই নীতিই নাকি চলছে এখনও।
সনাতন নম্বর প্রথা বাতিল করে গ্রেড প্রথা চালু হয়েছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ভালো গ্রেডে পাশ করছে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা, মানবিক শিক্ষার দশাটা কি?
এরমধ্যে সবচেয়ে কৌশলী হচ্ছে জামাত-শিবির চক্র। সুযোগ হলে তারা খাপটি মেয়ে বসে আছে শিক্ষার বিষয়টিতে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এদের অদৃশ্য হাত। অকার্যকর মাদ্রাসা শিক্ষাকে রক্ষা করে তাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটিকেও নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি তার নিজস্ব একটা অর্থনীতিও নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলা ভাষায় শিক্ষা, ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা এবং আরবি ভাষায় শিক্ষা এই তিন ধারার শিক্ষায় জাতি বিভক্ত এবং দিশেহারা। এই অবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা করা দুরূহ কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু তবুও কাজটা করে যেতে হবে। অন্ততঃ বিতর্কগুলো গুরুতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি।
নাট্যকলাকে মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে একটি সফল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নাট্যকলা বিভাগ আছে। কিন্তু স্কুল, কলেজ পর্যায়ে নেই। হঠাত করে অনার্স ক্লাসে গিয়ে সে যখন নাট্যকলার দুরূহ বিষয়গুলোর প্রাথমিক পাঠ নেয় তা বড় বেশি ধাক্কা হয়ে যায় না? যে ছেলেটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা, ইংরেজি, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞানের ক্লাস করে অনার্সে ভর্তি হচ্ছে তার কাছে লেখাপড়াটা যতটা সাবলীল হবে নাট্যকলার ক্ষেত্রে তা হওয়া কি সম্ভব? শুধু সে শিক্ষা জীবনের চার বছর এই বিদ্যালাভের সুযোগ পাচ্ছে। আবার তার মেধা বিচার হচ্ছে অন্যান্য বিষয়ের নিরীখে। দেখা গেলো যে ছেলেটি মেধা তালিকায় সর্বনিম্ন, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রয়োজনেই সে এই বিষয়টি পড়ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে এই ব্যবস্থাটি যদি থাকতো তাহলে তার ঝোঁক থেকেই বিষয় নির্বাচনটি সহজ হয়ে যেতো। বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষকরা একটা অবলম্বন খুঁজে পেতেন। চারুকলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক তৃতীয় বিভাগে পাশ করা ছেলে পরবর্তীকালে মহৎ শিল্পী হয়েছে। শিল্পের শিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাও ভিন্নমুখী।
স্কুল কলেজে নাট্যকলা চালু হলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছেলে-মেয়েরাও চাকরির সুযোগ পেতো। তাদের ব্যাংকে, পত্রিকায় বা নানাধরণের অদ্ভুত চাকুরী করতে হতো না। আবারো জাপানের কথা বলতে হয়। সে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ছাত্র/ছাত্রীদের চাকরির বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়।
এদেশে অবশ্য সে ধরণের কোন ব্যবস্থা নেই। বেকারের ভবিষ্যতের জন্যে রাষ্ট্র কোন মাথা ঘামায় না। বরং কোন জায়গায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-আমলারা স্বজনপ্রীতি বা নিয়োগ বাণিজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চাকুরীর ব্যাপারে সুবিচারের আশায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সেখানে বিগত পিএসসি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সীমাহীন দুর্নীতিতে লজ্জিত হতে হয়।
সম্প্রতি বিষয়গুলো অন্তত জনসমক্ষে এসেছে কিন্তু কতটা সমাধান হবে তা অজানা। তবুও মানুষ জানছে তাই বা কম কি? প্রকৃত শিক্ষা পেলে মানুষ বাঁচবে। প্রকৃত শিক্ষা না থাকলে দেশের কি হাল হয় তা আমরা দেখছি। শিক্ষিত লোকরাই যে ভয়াবহ দানব হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে। আমাদের কত শিখতে হবে?
মামুনুর রশীদ : নাট্য ও শিল্পজগতের একটি অতি সুপরিচিত নাম। নাট্যকার, অভিনেতা ও গ্র“প থিয়েটার আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি। শিক্ষা সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর সাবলীল পদচারণা এই মানবতাবাদী শিল্পীকে এক অনন্যতা প্রদান করেছে। মানবাধিকার যেখানেই লঙ্ঘিত হয় এই শিল্পী সেই মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা): যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected], অথবা, [email protected]
অথবা,
ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০