শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)

শিক্ষা সংস্কার: কয়েকটি বিবেচ্য বিষয়

মাওলানা হোসেন আলী

 

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দেশে চিন্তা-ভাবনা যে একেবারে কম হয়নি, এর একটি প্রমাণ স্বাধীনতার আগে ও পরে অন্তত ১৫টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক গঠিত হয়েছিল কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন। এ কমিশন কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টের সুপারিশমালা এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও কল্যাণমুখী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে এখনো অনেকখানি প্রাসঙ্গিক। অথচ মজার ব্যাপার হলো এ রিপোর্টটিকে পাশ কাটানোর কৌশল আবিষ্কার করার জন্যই পরবর্তী সময়ে গঠিত হয়েছে প্রায় ডজনখানেক শিক্ষা কমিশন। এ প্রবন্ধে আমি সে সব বিষয়ে যাব না। আমি এখানে শিক্ষার সংস্কার বিষয়ে খুব স্পষ্টভাবে ৩-দফা একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরতে চাই। বলাবাহুল্য, এ ৩ দফা একটি শিক্ষা ব্যবস্থার ভৌত রূপরেখার খসড়া নয়; বরং মৌলিক ধারণাগত রূপরেখার আংশিক পটভূমি মাত্র। এখানে আরো বলে রাখতে চাই, আমি এ প্রস্তাবনা তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি প্রধানত এ কারণে যে, আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে সক্রিয় চিন্তা-ভাবনার কিছু উদ্যোগ আছে। ‘শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। ব্যক্তিগত পর্যায়েও অনেকে এ ব্যাপারে গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা করছেন। ৩-দফা প্রস্তাবনার ভিত্তিতে আমি তাদের সামনে আরো একটি দায়িত্বই তুলে ধরতে চাই।


ক. প্রথম দফা হিসেবে যে বিষয়টিকে সামনে আনতে হয় তা হলো, বিশ্বজনীন মূল্যবোধ। আমাদের শিক্ষা সংস্কারের ভাবনায় এ বিষয়টি এখন নতুন মাত্রায়, নতুন গুরুত্বে বিবেচনায় আনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বিশ্বজনীন মূল্যবোধ মানবসভ্যতার অতিপ্রাচীন ও শীর্ষস্থানীয় মহান শিক্ষারই স্পষ্ট কথা। অনেকেই হয়তো বলবেন এটা নতুন কোনো কথা নয়, অনেক পুরনো কথা। কিন্তু না; এ বিরাট তা
পর্যপূর্ণ বিষয়ের আরো বড় নতুন প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। আমরা যদি এটিকে বুঝতে চেষ্টা না করি তবে পুরনো জানা বিষয় বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারব, সমস্যার আসল জায়গাটা খুঁজে বের করা কঠিনই থেকে যাবে।
সহজবোধ্য বিষয় হিসেবে অনেকেই হয়তো বলছেন, সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের জীবনধারা বদলাচ্ছে। মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি আধুনিকায়িত হচ- এটি তেমন নতুন কি? আমাদের শিক্ষার মধ্যে এর প্রভাব পড়ছে এবং আরো পড়বে- এটি চলমান বিষয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, এর মধ্যে একটি মৌলিক গুণগত পরিবর্তনের বাস্তবতা চলে এসেছে। মানব সভ্যতায় এর আগে বিশ্বজননীতা ছিল তত্ত্বগত ও মহ
চিন্তার বিষয়বস্তু হিসেবে; কিন্তু এখন এটি বাস্তবতা। প্রাচীন গোষ্ঠীতন্ত্র আঞ্চলিক সভ্যতা, বৃহ সাম্রাজ্য, আধুনিক জাতীয়তাবাদ এবং বিশ্বায়ন- এসব কিছুই সভ্যতার স্বাভাবিক গতিতে ঘটে যাচ্ছে। মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মানুষ বদলায় এবং অনেক কিছু ফেলেও দিতে হয়। তবে অতীতকে ঝেরে-মুছে ফেলে দিয়ে কেউ অগ্রসর হয় না বরং বলিষ্ঠ উত্তরাধিকারের সূত্র থেকে গড়ে ওঠে মূল্যবোধের সমৃদ্ধি। মানব সভ্যতায় বিশ্বজনীন মূল্যবোধ কোনো অপরিচিত বিষয় নয়। উন্নততর মূল্যবোধগুলো সবসময়ই বিশ্বজনীন। এসব কথা আমরা জানি এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এগুলো কম-বেশি প্রতিফলিত। মূল্যবোধের অনেক স্ববিরোধ, বিভিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতা সহই এক প্রকার স্বস্থিতে অগ্রসর হয়ে আসছিল ইতিপূর্বেকার সভ্যতা। কিন্তু খুব বস্তুগতভাবে বর্তমান সভ্যতা প্রায় একক ও অভিন্ন হয়ে উঠেছে। ভিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতার অবকাশ কমে গেছে। বলা চলে একটি আন্তর্জাতিক মানব সভ্যতা যেন ধীরে বিকশিত হচ্ছে।


হাজার বছর আগেও মানব সভ্যতার উন্নততর শিক্ষা ও চিন্তাগুলোর মধ্যে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত ছিল। কিন্তু এরপরও গোষ্ঠিবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার প্রাধান্য ছিল প্রায় সর্বত্রই। আমরা স্বীকার করি আর না-ই করি, এগুলো এখনো আমাদের শিক্ষা ও মূল্যবোধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এখন খুব দ্র“ত মানব সভ্যতায় একটি মৌলিক পরিবর্তন চলে এসেছে। বিশ্বজনীনতা একটি নতুন মাত্রা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এ অবস্থায় আমরা পরিবর্তনের বহিরাঙ্গিক দিকটিকেই বেশি দেখতে পাচ্ছি। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার, প্রযুক্তি বিপ্লব, তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, যোগাযোগের সহজলভ্যতা, জীবনধারার পরিবর্তন ইত্যাদি আমাদের কাছে দৃশ্যমান। কিন্তু এই উন্নয়ন ও পরিবর্তনের পাশাপাশি আমাদের যার যার সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধগুলোর মধ্যে যে গোষ্ঠিবদ্ধতা, সংকীর্ণতা ও বিশ্বজনীনতার বৈরী উপাদান রয়ে গেছে সেগুলো এত দ্র“ত পরিবর্তিত হচ্ছে না। এমন কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। আমরা যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাব, বিশ্বজনীন মূল্যবোধের ঘাটতি ব্যাপকভাবে এর ভেতরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অথচ আগামী দিনের শান্তি ও সংহতির জন্য এগুলো বিরাট অন্তরায়।


আমরা জানি আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একাধিক স্বীকৃত ও অস্বীকৃত ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে সর্বাধিক মানসম্পন্ন ধারা হিসেবে যদি মূলধারার জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামটিকে ধরি তবে এর ভেতরে অনুসন্ধান করলে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের অনেক ঘাটতি দেখতে পাব। শুধু তাই নয়, বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরী অবস্থান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ছড়াছড়িও এর ভেতরেই আমরা দেখতে পাই। এ ব্যাপারে খুব মোটাদাগের কিছু উদাহরণ তুলে ধরে আলোচনা করতে গেলেও আলোচনা দীর্ঘ হবে। সুতরাং সেদিকে এখন না গিয়ে শুধু এটুকু বলে রাখতে চাই, আমাদের জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের ভেতরটাকে এই আঙ্গিক থেকে নতুন করে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সেকালে মূল্যবোধের বৈরি উপাদানগুলোকে সঠিকভাবে চিহিক্রত করতে হবে এবং উন্নত বিশ্বজনীন মূল্যবোধের পরিপোষক আরো কী যুক্ত করার প্রয়োজন আছে, তা বিবেচনা করে দেখতে হবে।


এরপর যদি আমরা দেখতে চাই আমাদের মূলধারা বহির্ভূত ধারাগুলোতে বিশ্বজনীন মূল্যবোধ পরিপোষণের অবস্থা কি, তবে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। আমার অভিমত হলো ধর্ম, ঐতিহ্য, জীবিকা, বিশ্বায়ন, বহির্গমন ইত্যাদি কোনো অজুহাতেই কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে জাতীয় কারিকুলাম মনিটরিং ব্যবস্থার বাইরে রাখা উচিত নয়। এ বিবেচনায় আমাদের আলিয়া মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, হাফেজিয়া মদ্রাসা, নূরানী মাদ্রাসা, মক্তব, প্রি-ক্যাডেট স্কুল, প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসাসহ ইংরেজি মাধ্যম দেশি বা বিদেশি কারিকুলামে পরিচালিত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম বিচার করে দেখতে হবে। আমাদের মাদ্রাসাগুলো যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখতে পাব, এখানে নানা মাত্রায় বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরিতা রয়েছে। ইসলামের মর্মবাণী যদি আমরা অনুসন্ধান করি তবে দেখতে পাব এর ভেতরে দেড় হাজার বছর আগের সমাজ পটভূমিতে বিশ্বজনীতার সুর আছে বেশ তা
পর্যপূর্ণ ও বলিষ্ঠভাবে। কিন্তু বাস্তবে এখন মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরে চরম সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধবিশ্বাস, বদ্ধচিন্তা ও বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরী শিক্ষা। সুতরাং এ শিক্ষা যতটা না ধর্মের, তার চেয়ে বেশি রক্ষণশীলতা, অজ্ঞতা ও মতলববাজির। সুতরাং ধর্মের নাম শুনে এখানে থমকে দাঁড়ানোর বা মিইয়ে যাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। মাদ্রাসা শিক্ষাকে অবশ্যই বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরী অবস্থান থেকে অনুকূল অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। আমি মনে করি, এটি সম্ভব এবং এর কোনো বিকল্প নেই। রক্ষণশীল তো বটেই অনেক প্রগতিশীলও মাদ্রাসা শিক্ষার কোনো রকম সংস্কার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। মাদ্রাসাকে একটি গালি দিতে পারার মধ্যে প্রগতিপনার দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন। তারা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। আজকের বিশ্বজনীন মূল্যবোধের এটাও একটা দিক যে, নিজেদের সমাজের ভেতরের তো বটেই, বিশ্ব পরিসরের যে কোনো স্থানে অস্তিত্ববান কোনো অপ্রিয় বাস্তবতাকেও না দেখার ভান করে সুস্থ সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের সমাজের পশ্চাপদ জায়গাগুলোকে টেনে তোলা যে আমাদের দায়িত্ব, এটা বিশ্বজনীন মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান শিক্ষা।


অতএব মাদ্রাসা শিক্ষার ভেতরে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরিতার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে রোধ করার পদক্ষেপ নেওয়া এবং এর অনুকূল পরিবেশের বিকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টির ভেতরে গেলে আমরা দেখতে পাব মাদ্রাসা শিক্ষার বিভিন্ন ধারার মধ্যে বৈরিতার দিকগুলো বিভিন্ন মাত্রায়। আর অনুকূল শিক্ষার ঘাটতিগুলোও বিভিন্ন মাত্রায়। আলিয়া মাদ্রাসার ভেতরে এটি যথেষ্ট আধুনিকতার মোড়ক দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ পর্যাপ্ত জ্ঞানসমৃদ্ধ পাশ্চাত্য বিরোধিতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্লোগানের মোড়ক এবং যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন ফ্যাসিবাদী ধ্যান-ধারণার বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে সেখানে। আর কওমি মাদ্রাসার ভেতরে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার নামে অত্যন্ত পশ্চা
পদ ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি শেখানো হয়। এছাড়া মক্তব, হাফেজিয়া, ফোরকানিয়া ও নূরানী মাদ্রাসাগুলোতে কিছু মুখস্থ বিদ্যা শেখানো হয়, যার মধ্যে সমাজমনস্কতা বা জীবন ঘনিষ্ঠতার কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, এর ভেতরে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের প্রচুর বৈরিতা ও ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু খুব সরলিকৃত ব্যবস্থায় এর সমাধান নেই। সমাধান করতে হলে এর ভেতরটিকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং ধাপে ধাপে এর শিক্ষাসূচি ও ব্যবস্থার ভেতরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে মানবসভ্যতা সংক্রান্ত গভীর জ্ঞান ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগাতে হবে।


অতএব আবার ফিরে আসি আমাদের মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশ্নে। এর ওপরে আধুনিকতার একটি লেবাস থাকলেও ভেতরে সংকীর্ণতা, অন্ধবিশ্বাস, কুযুক্তি ও মিথ্যা সাম্প্রদায়িক অহমিকার বিস্তর প্রভাব রয়েছে। বিভক্ত সভ্যতার যুগ থেকে বিশ্ব সভ্যতার যুগে আসার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা এর ভেতরে রয়ে গেছে। সুতরাং মূল শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের পরিমার্জিত প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখেছি প্রচলিত বিভিন্ন ব্যবস্থায় এর অভাবের মাত্রাগত তারতম্য আছে। এক্ষেত্রে প্রস্তাব হলো- এক. প্রচলিত সব শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিমার্জনের মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় আনতে হবে। অর্থা
রাষ্ট্রীয় নীতিমালাবহির্ভূত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চলতে দেওয়া যাবে না। দুই. শিক্ষা সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় এমন একটি বোর্ড গঠন করা দরকার, যে বোর্ড আমাদের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্ক্যান করে এর ভেতরে বিশ্বজনীন মূল্যবোধের বৈরিতা, অন্তরায় ও ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করবে। এ ধরনের একটি রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের একটি দিক, অর্থা মূল্যবোধের দিকটি পুনর্বিন্যস্ত করা সম্ভব হতে পারে। পরিশেষে আরেকটি কথা বোধ হয় এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, তা হলো, বিশ্বজনীন মূল্যবোধ কোনো অবস্থাতেই শেকড় ছেঁড়া মূল্যবোধ নয়। বিশ্বজনীনতার নামে মূল্যবোধকে যদি শেকড়ছেঁড়া অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় তবে তা হবে ভয়ানক বিপজ্জনক।


খ. দ্বিতীয় দফা হিসেবে যে বিষয়টি সামনে আনা দরকার তা হলো, আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে ধর্মীয় শিক্ষার অবস্থানটা কি হবে? বর্তমানে আমাদের মূলধারার জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মশিক্ষা হিসেবে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। যেখানে মুসলমানদের জন্য ইসলাম ধর্ম শিক্ষা, হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য হিন্দু ধর্ম শিক্ষা এবং অনুরূপভাবে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য যার যার ধর্ম শিক্ষার বই। তবে এর মধ্য পড়ানো হয় শুধু ইসলাম ধর্মই। এখানে উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের ভূমিকা কিন্তু কম নয়। এখনো পর্যন্ত এ দেশের উচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন স্কুল-কলেজগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্র্যান্ড নাম হিসেবে খ্রিস্টান ধর্মীয় শিক্ষার প্রচলন নেই। খ্রিস্টান মূল্যবোধের প্রভাব তো অবশ্যই আছে, তবে সেসব মূল্যবোধ বিশ্বজনীন মূল্যবোধের সঙ্গে খুব বৈরী বা অসঙ্গতিপূর্ণ, এমন বলা যায় না। তবে বিশেষ ধর্মের ব্র্যান্ড নামে পরিচালিত ধর্মীয় শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।


বিগত শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই উপমহাদেশে একটা সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হতে থাকে। আলীগড় মুসলিম কলেজ, কলকাতার হিন্দু কলেজ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সূচিত হওয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এক সময় গণমানুষের শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে। প্রাইমারি স্কুল, মাইনর স্কুল, সেকেন্ডারি স্কুল ইত্যাদির মধ্য দিয়ে শিক্ষার বুনিয়াদি স্তরগুলো মফস্বল শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত গণমানুষের নাগালের মধ্যে সম্প্রসারিত হতে থাকে। এই যে গণমানুষের জন্য সম্প্রসারিত শিক্ষা ব্যবস্থা এটা বাস্তব কারণেই হয়ে উঠতে থাকে ধর্মনিরপেক্ষ। অর্থা
হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ছেলেমেয়ের জন্য একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিন্তু প্রত্যেক ধর্মের শিশুদের বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় হিসেবে ধর্ম বেশ যতœসহকারেই পড়ানোর ব্যবস্থা চালু হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত করে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও সৌভাগ্যক্রমে প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার কাঠামোটা থেকে যায় বটে, তবে মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয় শরিয়তবদ্ধ ইসলামের নামে কড়া রক্ষণশীল সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে এবং তা বাধ্যতামূলক করা হয় তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। আর ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা কাঠামোর ভেতরেও প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামকে প্রাধান্য দিয়ে তথাকথিত ইসলামী মূল্যবোধের নামে কড়া সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। অন্যদিকে মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে আধুনিক ও প্রাচীনপন্থি মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার যে শুধু সরকার বা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটেছে এমনও নয়। জনগণ ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় ইহকাল-পরকালের সওয়াবের আশায় মহ কর্ম হিসেবে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত উদ্যোগই প্রাথমিক ভিত্তি। আমাদের স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে যে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে তা পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করেই। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন এখানে বড় ধরনের পরিবর্তনের যে সুপারিশমালা উপস্থাপন করেছিল তা অকার্যকর করার জন্য এরপর অনেক কমিশন ও কারসাজি করা হয়েছে। মূলত সবকিছুই করা হয়েছে পাকিস্তান আমলে প্রবর্তিত ধারা অব্যাহত রেখে কিছুটা ঘষামাজা করে মানিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষার প্রেক্ষিতটিকে সেই পটভূমিতেই দেখতে হবে।


আমাদের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন ধর্মশিক্ষা তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১০০ নম্বরের একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। ধর্মশিক্ষার এ বিষয়টিতে মূলনীতি হলো যার যার ধর্মশিক্ষা। এই নীতির ওপর ভিত্তি করে মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে এখানে প্রায় একক ধর্ম ধরে নিয়ে ইসলাম শিক্ষার একটা পাঠ্যসূচি প্রণীত হয়েছে। এ পাঠ্যসূচিতে দোয়া-কালাম, নামাজ-রোজাসহ ধর্মীয় আচার-আচরণ শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইসলামের মর্মবস্তুর কিছুই এখানে নেই এমনটা বলা যাবে না। তবে শরিয়ত নির্ভর ধর্মাচার বিধিই এ শিক্ষার মূল কথা। আর চিরায়ত ধর্মের সূত্র থেকে পাওয়া সত্যনিষ্ঠতার নীতি-নৈতিকতাগুলোকে ইসলামের নামে এখানে এই বিশ্বাসই দেওয়া হয় যে, ইসলামই একমাত্র সত্যধর্ম এবং তা চিন্তন। ইসলামের নামে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করের মতো কিছু না বোঝার শ্রেষ্ঠত্ব ও চিরন্তন নৈতিকতার বিশ্বাসসহ না বোঝা ধর্মীয় আচার-আচরণকেই এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে পরিবেশন করা হয়। অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষার্থীদের জন্যও অন্তত নীতিগতভাবে যার যার ধর্ম বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেসব সম্প্রদায়ের ধর্মের জোরালো পাঠ্যসূচি, শিক্ষক ও শিক্ষা পিরিয়ডের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অজুহাত হিসেবে বলা হয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা কম এবং তাদের পক্ষ থেকে ধর্মশিক্ষার চাহিদা ও আগ্রহ কম। বাংলাদেশে সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষার প্রশ্নে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যও ভিন্ন ধরনের। ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক শরিয়তভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষার দীর্ঘ পাঠ্যসূচি ও স্বতন্ত্র ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচলন দীর্ঘকাল থেকে আর হিন্দু ধর্মের শিক্ষা চলে এসেছে অনেকটাই অনানুষ্ঠানিক ও লোকায়ত ব্যবস্থায়। সুতরাং অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষাটা হয়ে উঠেছে শুধু ইসলাম ধর্মশিক্ষা এবং সেই ইসলাম আবার শরিয়তপন্থি বাহ্যিক আচার-আচরণও দোয়া-কালামসর্বস্ব ইসলাম। এ অবস্থায় এখন শিক্ষা ব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে দুটি। এক. আমাদের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা রাখা প্রয়োজন আছে কি-না বা এটা কী ভাবে রাখা উচিত। দুই. শুধু ধর্মীয় বা মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কী ভূমিকা হওয়া উচিত? এক্ষেত্রে প্রথমোক্ত প্রশ্নের উত্তরে আমি খুব স্পষ্ট করেই বলতে চাই- জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় অবশ্যই ধর্ম শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে রাখা উচিত এবং অবশ্যই সব ধর্মের শিক্ষা একই পাঠ্যপুস্তকে। যার যার ধর্মের দোয়া-কালাম বা তন্ত্রমন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতর আনার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতরে থাকবে ধর্মের মর্মবস্তুর শিক্ষা, মূল্যবোধ এবং বোধগম্য যৌক্তিক শিক্ষা। আর সব ধর্ম সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা অভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে বাধ্যতামূলকভাবে সব ধর্মের মর্মকথা শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে পড়বে। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলাম, সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিস্তান- এ চারটি ধর্মসহ প্রয়োজনে অন্য ধর্মের মর্মবস্তু তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম অথবা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের বয়স ও চেতনার স্তর অনুসারে পাঠ্যভুক্ত করতে হবে। অপেক্ষাকৃত ওপরের স্তরগুলোতে প্রত্যেক ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত উপ-সম্প্রদায়, বিভিন্ন ফেরকার চিন্তা ধারাসহ মূল ধারার ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও এর বাস্তব জীবন ঘনিষ্ঠতার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে থাকবে ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস এবং মূল্যবোধের বিবর্তনশীলতা। এ কাজটি করার জন্য যা আপাতত কঠিন এবং অনেক বড় কাজ তা হলো ৭ বা ৯টি শ্রেণীর জন্য এ ধরনের পাঠ্যপুস্তক রচনা করা। এটি খুব গতানুগতিক সহজ কাজ হবে না। তবে আমার বিশ্বাস, এ ধরনের পাঠ্যপুস্তক রচনা করার মতো যোগ্য-জ্ঞানীজন আমাদের সমাজে রয়েছেন। আমাদের দেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নামে একটি বিষয় খোলা হয়েছে। ধর্ম শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরগুলোর একটি দিক হবে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রাক-প্রস্তুতিস্বরূপ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাঠ্যপুস্তকে সব ধর্মের জন্য সমান সমান পৃষ্ঠা রাখতে হবে বা বিষয়বস্তুতে অহেতুক তুলনা, আরোপিত সমতা বা গোঁজামিলের আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী স্টাডিজ নামে একটি বিষয় আছে। এ বিষয়টিকেও মানসম্পন্ন ও আধুনিক করার দরকার আছে। তবে ধর্ম শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিষয়বস্তু প্রত্যেক ধর্ম সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীর নিজ নিজ ধর্মের উচ্চতর শিক্ষার বুনিয়াদও তৈরি করবে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম শিক্ষার ৭ বা ৯ বছরের শিক্ষাসূচি কেমন হবে তা অবশ্যই দীর্ঘ চিন্তার ব্যাপকতর বিষয়। বিষয়টি একটি প্রবন্ধের ভেতরে পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। এখানে শুধু প্রস্তাবনাটা উপস্থাপন করা হলো। এরপর দ্বিতীয় প্রশ্ন অর্থা
মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কী ভূমিকা হওয়া উচিত এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই, মাদ্রাসা তুলে দেওয়া বা রাতারাতি একীভূত করে ফেলার চিন্তা অবাস্তব। আর এর চেয়েও বড় বিপজ্জনক হলো মাদ্রাসার দিকে না তাকানো। মাদ্রাসার দিকে না তাকিয়ে আমরা এ সমস্যার পাশ কাটিয়ে যেতে পারব না। আমূল সংস্কারের উদ্যোগও বাইরে থেকে নেওয়া যাবে না। কিন্তু রাষ্ট্রকে একটা জায়গায় বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে হবে। তা হলো রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চলতে পারবে না এবং শিক্ষার বিষয়বস্তু বা পাঠ্যসূচিতে মানসম্পন্ন ও অভিন্ন মূল্যবোধ নিশ্চিত করার জন্য তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা রাষ্ট্রের থাকতে হবে।


প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম শিক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাবনার প্রসঙ্গটা আপাতত এখানেই শেষ করা যায়। তবে এরপরও একটি বিষয় উল্লেখ করে রাখতে চাই। আমাদের সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী মহলে কারো কারো এমন মত আছে যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। এই মতটি খুবই অগভীর এবং কার্যত বিভ্রান্তিকর। ধর্ম আমাদের সমাজ ও জীবনধারার অবিচ্ছিন্ন বাস্তবতা এবং এটা কোনো ভুঁইফোড় বাস্তবতা নয়। ধর্ম বলতে আমরা কী বুঝি সে নিয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য বা ভুল বোঝাবুঝি আছে; ধর্মের বহিরাঙ্গিক রূপ নিয়ে বোদ্ধা মহলে নাক সিঁটকানোর কারণ খুব সঙ্গতভাবেই আছে। কিন্তু ধর্ম শুধু এই দোয়া-কালাম, তন্ত্রমন্ত্র বা বহিরাঙ্গিক রূপটির নামই নয়। ধর্ম এর চেয়েও অনেক গভীর এবং জীবনবোধের গতি-প্রকৃতি নির্ণায়ক শক্তি। মর্মার্থের বিবেচনায় বোদ্ধা এবং না বোঝা সব মানুষের জীবনেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মের প্রভাব ক্রিয়াশীল। মানব সভ্যতায় পেশাদারিত্বের উ
কর্ষের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্ভব ঘটেছে কয়েক শ’ বছরের মধ্যে আর মানুষের ধর্ম শিক্ষার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। ৩শ’ বছর আগেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়বস্তু প্রায় সবটাই ছিল ধর্মের অথবা ধর্মাশ্রয়ী। জীবিকার জন্য শিক্ষা খুব গভীরতর অর্থে উঁচু মূল্যবোধ নয় এবং প্রাচীনকালে তা একেবারেই ছিল না। প্রাচীনকালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল মূলত মানবিক ও চিত্তবৃত্তিক উকর্ষের লক্ষ্যে। সঙ্গত কারণেই তা কখনো কখনো আধ্যাÍিক শিক্ষা হিসেবে অভিহিত হয়েছে এবং সাধারণভাবে ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে। শিক্ষার বিষয় হিসেবে ভাষায়, ব্যাকরণ, সাহিত্য, তর্কশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস, দর্শন এমনকি জ্যোতির্বিদ্যা, দেহতত্ত্ব ও চিকিসাশাস্ত্র ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে শিক্ষাদান করা হয়েছে। আমরা আমাদের সভ্যতার শেকড়টা খুব মোটা দাগে খুঁজতে গেলেও দেখি যে, প্রাচীন সব মহাকাব্য ও মহাগ্রন্থ ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত নায়ক এবং প্রাচীন সব মহাপুরুষই কোনো না কোনোভাবে ধর্মপুরুষ। সুতরাং ধর্মকে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিতে বা উন্নাসিকতার দৃষ্টিতে দেখতে গেলে তা হবে অজ্ঞতা। আরো একটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো, অজ্ঞতা দিয়ে কিছু জয় করা যায় না। আজকের যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানব সভ্যতা অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ধর্ম যে আমাদের সামনে এক বিপত্তি হিসেবে থেকে যাচ্ছে এর একটা বড় কারণ আমাদের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং স্পর্শকাতরতা। ধর্ম মোটেও স্পর্শকাতর বিষয় নয়, অথচ আমাদের শিক্ষিত সমাজ এখন ধর্মকে স্পর্শকাতর করে তুলছে। স্পর্শকাতর সব জিনিসই অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিপজ্জনক। আমরা উন্নাসিকতাবশত একদিকে ধর্মীয় বিষয়ের অজ্ঞতাতে বাহাদুরি দেখানোর চেষ্টা করি, অন্যদিকে ধর্মের নামে জমে ওঠা সব বিকৃতি, অন্ধবিশ্বাস ও পশ্চাপদতাকে এক ধরনের সমীহ দেখাই। এটা বর্তমান পেশাদারি শিক্ষিত সমাজের বিরাট দৈন্য এবং আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে এ দৈন্য ও সীমাবদ্ধতা কাটানোর চেষ্টা করতে হবে।


গ. তিন নম্বর যে বিষয়টি এ প্রস্তাবনায় আনতে চাই হা হলো- জীবনবোধ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে উন্নততর জীবনবোধ গড়ে তোলার বিষয়টি কোন পর্যায়ে আছে তা আবার নতুন করে খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা জীবনের নানা দাবি গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য করে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এখানে এ শিক্ষায় উন্নততর জীবনবোধ হারিয়ে যাচ্ছে কি-না এমন একটা সন্দেহ উঁকি দেয়। জীবনবোধ বলতে কী বোঝায় তা অনুসন্ধান করার মধ্য দিয়েই এ কাজটি শুরু করা উচিত।


আধুনিক শিক্ষার একটি মৌলিক লক্ষ্য সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহের দক্ষতা অর্জন- এতে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষা অবশ্যই উ
পাদনশীল হতে হবে এ ব্যাপারেও কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। তবে একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু জীবিকার জন্য শিক্ষা মোটেও উন্নত মূল্যবোধ নয়। প্রাচীনকালে জীবিকার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল না এবং জীবকার জন্য শিক্ষা কোনো সম্মানজনক অভিধাও ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক বা কেতাবি শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের চিন্তা-চৈতন্যে, নীতি-নৈতিকতায় ও মূল্যবোধে উকৃষ্ট মানুষ করে তোলা। জীবিকার জন্য মানুষ তার পরিবার বা গোত্র থেকে ব্যবহারিক প্রক্রিয়াই দক্ষতা অর্জন করতো। মানব সভ্যতার শেকড় পর্যায়ের এই যে মূল্যবোধ এটা নিতান্তই কাঁচা বা বিভ্রান্তিকর বলে ফুঁকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো অবশ্যই নয়। কিন্তু আধুনিককালে মানুষের জীবন ও জগ সভ্যতার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। জীবিকাও হয়ে উঠেছে ব্যাপক জ্ঞাননির্ভর। সুতরাং আধুনিক সভ্যতায় মানব সন্তানকে শুধু নীতিবাক্য, মহ চিন্তা ও মহ জ্ঞান শিখিয়ে মহ করে তোলার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং পর্যাপ্ত নীতিকথা ও মহ জ্ঞান মুখস্থ করানোর পরও সম্মানজনক জীবিকা অর্জনে অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে যে কোনো মানুষ কপালবাদী, স্বার্থপর, দুর্নীতিবাজ ও তস্কর হয়ে ওঠার আশঙ্কাই বেশি। অতএব শিক্ষার উদ্দেশ্যের ভেতর জীবিকার প্রশ্নকে গুরুত্বহীন করে দেখার একেবারেই উপায় নেই। কিন্তু শিক্ষার ভেতর দিয়ে মানুষ যে জীবনবোধ লাভ করবে তাতে জীবিকা বা অর্থ উপার্জনকে অতিক্রম করে আরো মহ কিছুর সুস্পষ্ট উপলব্ধি অবশ্যই থাকতে হবে। উন্নত জীবন মানে শুধু অর্থ-বিত্ত বা আরাম-আয়েশের উপকরণ নয়। বরং এর চেয়েও মহ ও অমূল্য কিছু- এমন উপলব্ধি গড়ে উঠতে হবে। আর এ উপলব্ধির স্তর অবশ্যই শিক্ষা স্তরের উন্নয়নের পাশাপাশি উন্নততর হতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাদান এবং শিক্ষাজাত বিবেক-বুদ্ধি সংশ্লিষ্ট উন্নত পেশাদারিত্বের মহলকে অবশ্যই পেটনির্ভর বা ভোগনির্ভর জীবনবোধের ঊর্ধ্বে উন্নততর জীবনবোধের অধিকারী হতেই হবে। এটা শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব নয়। তবে প্রধানত দায়িত্বটা যে শিক্ষা ব্যবস্থার একথা বিবেচনায় রাখতেই হবে।
শিক্ষার ভেতর দিয়ে উন্নততর জীবনবোধ গড়ে তোলার বিষয়টি শুধু শিক্ষাসূচির বিষয় নয়, এটা শিক্ষা ব্যবস্থার পরিম-ল এবং শিক্ষা পরিম-লের সংস্কৃতিরও বিষয়। তবে প্রাথমিকভাবে যে জিনিসটি দেখতে হবে তা হলো শিক্ষাসূচির ভেতর দিয়ে বিষয়টি যথাযথভাবে পরিবেশিত হচ্ছে কি-না। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাসূচির ভেতরে এ পরিবেশনার ত্র“টি সীমাবদ্ধতা কিছুটা আছে। তবে সর্বাধিক মারাত্মক সমস্যা যেখানে তৈরি হচ্ছে সেটা হলো শিক্ষার পরিম-ল ও এর সংস্কৃতির ভেতরে অবক্ষয়। উন্নততর জীবনবোধের ঘাটতি এখন আমাদের শিক্ষার পরিম-লের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছে লজ্জাজনকভাবে। আমাদের শিক্ষা সংস্কারের প্রশ্নে ৩ দফা প্রস্তাবনার যেসব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী বিষয় বিবেচনায় আনার কথা বলা হলো এর মধ্যে এই জায়গাটা একেবারে তা
ক্ষণিক হস্তক্ষেপের বিষয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, এমনকি সর্বোচ্চ শিক্ষার কোনো কোনো অঙ্গন পেটসর্বস্ব ও ভোগসর্বস্ব লোকদের করায়ত্ত। শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতি শুরু হয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের মাধ্যমে। এরপর তা সংক্রমিত হয়েছে শিক্ষকদের ভেতর। এখন শিক্ষাঙ্গনের নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ- তাদের কে দুর্নীতিগ্রস্ত আর কি দুর্নীতিমুক্ত তার হিসাব করাই কঠিন। এমন শোচনীয় অধঃপতনের কারণটা কী! কারণ প্রধানত একটাই। জীবনবোধের অধঃপতন। জীবনের মর্মার্থ যাদের কাছে কয়েক টাকা বা কয়েক কোটি টাকার মতো তুচ্ছ প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয় এমন তুচ্ছ মানুষই এখন অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে শিক্ষা পরিম-লের কর্ণধার। এ লজ্জাষ্কর অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে খুব দ্র“ত এবং দৃঢ়তার সঙ্গে। এ জন্য আইন-আদালত, বিচার-শাস্তি ইত্যাদি আমাদের এখনকার আলোচ্য বিষয় নয়। শিক্ষাঙ্গনের ভেতরে এমন জীবনবোধ জাগ্রত হতেই হবে যেখানে নিম্নমানের এসব পেটসর্বস্ব মানুষকে ধিক্কার জানানোর লোকের অভাব না হয়। শিক্ষা পরিম-লের ভেতর থেকে সামাজিকভাবে তাদের বের করে দিতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি এর পরিম-লের ভেতরে ন্যূনতম সম্মানজনক জীবনবোধ জাগ্রত করতে ব্যর্থ হয় তবে এ শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ।*


* প্রবন্ধটিতে ধর্ম ও মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে প্রবন্ধকার যে মতামত ব্যক্ত করেছেন তা তাঁর নিজস্ব - নিঃসন্দেহে তা মুক্তান্বেষার মত নাও হতে পারে। এ ব্যাপারে পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। - সম্পাদকমন্ডলী


মাওলানা হোসেন আলী, ইসলাম ও ইসলামী দর্শন ও চিন্তার সাথে সুপরিচিত পন্ডিত। সাংবাদিক। আচারধর্মী ইসলাম নয়, ইসলামের অন্তর্নিহিত শান্তি ও সাম্যের কথাকেই তিনি মনে করেন ইসলামের প্রকৃত রূপ। তিনি মনে করেন ইসলামের অনুসারীরা যদি এটি বুঝে ইসলাম ধর্ম পালন করেন তাহলে অন্য ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতির সাথে বাস করতে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায ধর্মনিরপেক্ষতা প্রবর্তিত হলে অসুবিধা হতে পারে না। প্রবন্ধকার। বেশ কটি গ্রন্থের লেখক। এককালে দেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বর্তমানে সমকাল দৈনিকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।


 

মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা):  যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected], অথব [email protected]  

অথবা,

ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০