শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার নিবেদন মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)বেরুলো
বিষন্ন এক সংগ্রামী নারীর মুখোমুখি
পোষাকী নাম ড. তসলিমা নাসরিন। পেশায় একদা ছিলেন চিকিৎসক - সেই সুবাদে ডক্টর, কিন্তু নিজে বা অন্য কেউ খুব একটা এ শব্দটি নামের আগে ব্যবহার করেন না। তসলিমা নাসরিন নামেই পরিচিতা সমধিক। নিকট জনের কাছে শুধু তসলিমা। এখন চিকিৎসা বিদ্যা ছেড়ে দীর্ঘদিন ধরেই লেখার জগতে সাচ্ছন্দ্য বিচরণ। প্রচুর লিখেছেন - কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নানা পাঁচমেশালী লেখা। নন্দিত হয়েছেন দেশে ও বিদেশে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে। সম পরিমাণে নিন্দিত হয়েছেন ধর্মবাদীদের কাছে, ইসলামী মৌলবাদীর কাছে, এমন কি সমগোত্রীয় নারী সমাজ থেকেও, বলা বাহুল্য এঁদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন প্রগতিপন্থী ও নারীবাদী। সমালোচিত হয়েছেন লেখক ও কবি মহল থেকেও - কেউ বলেছেন ওর কবিতা ‘কবিতা হয় না’, উপন্যাসের নামে লেখিকার এক ধরনের বালখিল্যতা, নাকি বালিকা-বিলাস ? আবার অন্যদিকে তাঁর অদম্য সাহসিকতার জন্য সাধারণ নাম না জানা নিপীড়িত নারী সমাজের কাছে পেয়েছেন ভালবাসা, পেয়েছেন সৎ সাহসী মুক্তমনা মানুষের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা - পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি। একদিকে যেমন পেয়েছেন বন্ধু প্রিয়তা, আবার তাঁর খোলাখুলি মন্তব্যের জন্য অনেক বন্ধু হারিয়েছেনও। এমনিই এক মিশ্র চরিত্রের এই মানুষটি যার মধ্যে রয়েছে আকর্ষণ করার অনেক গুণ ও উপাদান।
তিনি সমালোচিত হয়েছেন একদিকে অশ্লীলতা দোষে, আবার নিন্দাবাদ পেয়েছেন কট্টর মৌলবাদীদের কাছে- তাঁর লেখা নাকি ধর্মবিরুদ্ধ, ঈশ্বরনিন্দিত আল্লা ও কোরানবিরুদ্ধ। কিন্তু সেজন্য লেখা ছাড়েন নি, আপোষ করেন নি নিজের নীতিবোধের সাথে।
দু তিন মাস আগে এক দুপুরে তাঁর সাথে আলাপ হয়েছিল দীর্ঘক্ষণ ধরে, নানা বিষয়ে। তবে বার বার ফিরে আসছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। প্রবাস বাসের বেদনা ক্লিষ্ট এক বিষণœ বদনা নারীর মুখোমুখী আমি। এক পর্যায়ে উঠল মৌলবাদীদের অক্রমণে তাঁকে দেশে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে- সেই পুরানো কথা। আমি বলেছিলাম, ‘মৌলবাদিরা তো তাদের স্বভাব সুলভ কাজ করবেই, করেছেও এবং এখনও করছে। কিন্তু দেশের সেক্যুলার শক্তি, যে শক্তির উত্থানের কারণেই বাংলাদেশের জন্ম সেই সেক্যুলার ও প্রগতির পক্ষের শক্তি, লিবারেল ডেমোক্রেসির পক্ষের শক্তি এবং বামপন্থি শক্তি তো পাল্টা আন্দোলনে নামে নি অপানাকে বাঁচাতে। কই তখন তো আপনার পাশে এসে শক্ত পায়ে দাঁড়ায় নি। হ্যাঁ অনেক ব্যক্তি ভাল মানুষ আপনাকে আশ্রয় দিয়েছে, দেশ ছেড়ে যেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা তো এজন্য ঢাকা যাবে না। আমি নিজে খুব ছোট মানুষ, আমাকে চেনেই বা ক’জন - তবু আমার অবস্থান থেকে চেষ্টা করেছি বিপরীত স্্েরাতে কথা বলতে, আর্ন্তজাতিক মহলে আপনার কথা তুলে ধরতে।’
একটি কথা ড. নাসরিন বার বার বলছিলেন ‘আমি কি কোন দিনই দেশে ফিরতে পারব না। অন্ততঃ কিছু দিনের জন্য তো বেরিয়ে আসতে পারি। আপনি বা আপনারা কি কিছু করতে পারেন না আমার জন্যে।’
কবিতার মধ্য দিয়ে তাঁর এই আকুতি প্রকাশ পেয়েছে, তার মর্মবেদনা ঝরে পড়ছিল প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি শব্দেঃ
দেশ তুমি কেমন আছো?
কেমন আছো দেশ তুমি?
তুমি দেশ আছো কেমন?
আছো তুমি কেমন, দেশ?
আমার তো পরান পোড়ে তোমার জন্য,
তোমার পোড়ে না?.. ..
আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় দেশ।
আমি আবারও বলেছি ‘আমি সামান্য মানুষ, তবুও চেষ্টা করে দেখব আপনার অবস্থানটি এখন সরকারের কাছে কেমন জানবার জন্য এবং আপনার এক কালের শুভানুধ্যায়ীদের সাথে আলাপ করব।’
নাসরিন আমার কথায় আশ্বস্ত না হলেও (বোধ্য কারণেই) খুশী হয়েছিলেন বেশ। বিদায় কালে সম্প্রতি লেখা অনেক কটি বই উপহার দিলেন। তাঁর সারা মন জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের কথা, বাংলাদেশে একবার আসবার কথা। আমি বেদনার্ত বোধ করছিলাম, সাশ্র“নয়নে বিদায় নিলাম ও হাত ধরে বিদায় জানালো, ‘আবার দেখা হবে।’ তখন বিকেল সাড়ে চারটা- কখন দুতিন ঘন্টা কেটে গেছে টের পাই নি।
এদেশরই এক নরম মনের মিষ্টি মেয়ে মাত্র কয়েক’শ কিলোমিটার দূরে থেকে দেশে আসতে চাইছে অন্তত একটি বারের জন্য। কিন্তু পারছে না। এ লজ্জা আমরা কোথায় রাখব। তার এই অন্তরে স্বদেশের কথা উচ্চারিত হয়েছে সাম্প্রতিক একটি কবিতায়:
আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোনা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভিড়ে হট্টগোল, খরায় বন্যায়
অপেক্ষা করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুকুরে-
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুননেসা, অপেক্ষা করো ঈদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালবাসতে, হাসতে, জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে-
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারি বইমেলা আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, তাকে কফোটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রহ্মপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকু- পাহাড়-আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।
ড. অজয় রায়, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও নিবেদিতপ্রাণ গবেষক। মানবতাবাদী ও মানবাধিকার রক্ষায় সদা উচ্চকণ্ঠ। চেতনা চিন্তায় প্রকৃতিবাদী ও সংশয়বাদী এবং মনেপ্রাণে সেক্যুলারিস্ট। ছাত্রাবস্থা থেকে ভাষা আনোদালনসহ সকল বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ এরই স্বাভাবিক পরিণতি। সমাজতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি শৃঙ্খলায় তাঁর অবাধ বিচরণ। বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন সহস্রাধিক প্রবন্ধ। সে তুলনায় পুস্তক লিখেছেন অনেক কম। তাঁর লেখা ‘আদি বাঙালী’ ও ‘জড়ের সন্ধানে’ শিরোনামে গ্রন্থ দুটি পাঠকপ্রিয়তায় ধন্য। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ৫খন্ডে লেখা ‘বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান কোষের’ অন্যতম সম্পাদক ও লেখক। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবাধিকার সংগঠনের সাথে যুক্ত। ইতিহাস পরিষদের অন্যতম সহ সভাপতি, শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি ও দক্ষিণ এশীয় মৌলবাদ ও সামপ্রদায়িকতা বিরোধী সংগঠনের সভাপতি ম-লীর সদস্য .. .. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক রায় শিক্ষক হিসেবে কার্জন হল চত্বরে কাটিয়েছেন চল্লিশটি বছরেরও বেশী সময়।
মুক্তান্বেষা (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা): যোগাযোগ – সাইফুর রহমান তপন, ৬/৭, সেগুনবাগিচা; বি/৬, ডোমিনো এল্ডোরাডো, ঢাকা – ১০০০, টেলিফোনঃ ৬৬৬৮৬৪০৪৭১, ইমেইলঃ [email protected], অথবা [email protected]
অথবা,
ঋত্বিক, ৩৪ আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০