যুক্তি (২য় সংখ্যা)

 

“... মানুষ যেটুকু অনুভব করে, তার চেয়েও তারা বেশি স্বাধীন।”
—মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৩)


প্রথম সংখ্যা বেরুনোর অনেকদিন পরে অবশেষে যুক্তি দ্বিতীয় সংখ্যা বের হল; অনেক অপেক্ষা-প্রতীক্ষার পর। স্বীকার করতে হবে—এ ব্যাপারে সব কৃতিত্ব পাঠকের। পাঠকের নিরন্তর অনুপ্রেরণা-উ
সাহ-তাগাদা আমাদের সাহস যুগিয়েছে শত অসুবিধা-সীমাবদ্ধতার মধ্যে যুক্তি দ্বিতীয়বার বের করার জন্য উদ্যোগী হতে। পাশাপাশি ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি—সময়মত যুক্তি নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হতে পারিনি বলে।

লাথি মার ভাঙরে তালা! যতসব বন্দীশালায়—আগুন জ্বালা... : চারিদিকে এখন ভয়ঙ্কর দৈন্য, মহামারি, অভাব; নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দু-দফা বন্যা আর ভয়াবহ ‘সিডর’ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে আমাদের দেশের প্রাণ কৃষি আর কৃষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

স্বাধীনতার পর এই প্রথম (১/১১-এর পর) রাজনৈতিক দলগুলো ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ছে, ‘দেশ-জনগণ’ যাদের কাছে এতদিন ‘বাপেরবাড়ি’ আর ‘শ্বশুরবাড়ি’র তালুকদারি হিসেবে গণ্য হতো—চৌদ্দ শিকের ঘরে মোটা চালের ভাত খেয়ে তাদের এতদিনকার ঈশ্বরীয় জীবনের ইন্দ্রপতন ঘটেছে (স্বীকার করতে হচ্ছে, এরকম পতনের আবশ্যিক প্রয়োজন ছিল); ঠেলায় পড়ে ‘ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া’ বাকি রাজনীতিবিদগণ শুরু করেছেন ‘সংস্কার’ নিয়ে চিরাচরিত কানামাছি খেলা। কিন্তু গত ২২ জানুয়ারির ইলেকশন নিয়ে আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, সেই মান্যবর ইয়াজ উদ্দিন ও আজিজ গং এখনো বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছেন! কেন বাপু?

গত বছরের ২০-২২ আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া সশস্ত্র বাহিনীর অবিমৃষ্যকারী ভূমিকা এবং এজন্য পরবর্তীতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ছাত্রবিক্ষোভের ঘটনায় ইন্ধন দেবার দোহাই দিয়ে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয়-সম্মানিত শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, শাস্তিপ্রদান, ছাত্র-শিক্ষকদের নিঃশর্ত মুক্তির বিষয়টি ‘অযথা’ ঝুলিয়ে রাখার মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধপরায়ণতার স্বরূপ তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে—রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পরও ‘পাকি শাসক আইয়ুবীয় ভূত’ ক্ষমতাসীনদের কারো কারো মননে-মগজে-চেতনায় এখনো রয়ে গেছে! আর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সম্মানিত শিক্ষকদের সাথে শাসকগোষ্ঠীর এহেন অন্যায়-অন্যায্য-নিন্দনীয় আচরণের পরও—‘সুশীল’ বুদ্ধিজীবীদের নিষ্ক্রিয়-নি®প্রভ ভূমিকায়, আমরা চরমভাবে ব্যথিত-লজ্জিত। পূর্বতন সময়ে গণতন্ত্র-মানবাধিকার নিয়ে যাঁদের সোচ্চার পদচারণা লক্ষ্য করা যেত, আজ তাঁদের ‘জার্সি বদল কালচার’ (কারো-কারো অসহায় আত্মসমর্পণ)—আবারো চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকারের মারাত্মক দীনতা ও অভাব। এহেন দুঃসময়ে আমরা স্পষ্ট করেই বলছি, সর্বদা নিঃশঙ্ক চিত্তে থাকা আর যুক্তির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই।

শক্তের ভক্ত নরমের যম : দৈনিক প্রথম আলোর সাপ্তাহিক রম্যম্যাগাজিন ‘আলপিন’-এ গতবছর (১৭ সেপ্টেম্বর) ছাপানো সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কার্টুনিস্ট আরিফের ‘ছেলেমানুষী’ একটি কার্টুন নিয়ে ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাতে’র অজুহাতে ‘জরুরি অবস্থা’ ডিঙিয়ে কয়েকটি মুখচেনা ইসলামি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-গোষ্ঠী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সারা দেশে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিল (অথচ যৌক্তিক-নৈতিক-মানবিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জরুরি অবস্থার মধ্যে মৌনমিছিল ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে; শোনা যাচ্ছে ‘সুষ্ঠু আইনি’ প্রক্রিয়ায় বিচার চলছে!—কিন্তু ঐ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-পাণ্ডাদের ব্যাপারে সরকার আশ্চর্যজনকভাবে নীরব!)। প্রথম আলোর সম্পাদক, কার্টুনিস্টকে মুরতাদ-কাফের ইহুদি-নাসারাদের সোল এজেন্ট ঘোষণা করে ফাঁসি দাবি করা হল প্রকাশ্য রাজপথ থেকে। যদিও একই ধরনের কার্টুন আমরা আগেও দেখেছি—জামাতে ইসলামির মাসিক ম্যাগাজিন ‘কিশোরকণ্ঠ’-এর (১৯৯৮ সালের নভেম্বর সংখ্যা) হাসির বাক্স বিভাগে। তখন কোনো ইসলাম দরদী দল বা ব্যক্তিত্ব দেখলাম না, জামাতে ইসলামি দ্বারা ‘ইসলাম’ বা ‘নবিজি’কে অবমাননা করার অপরাধে প্রতিবাদ-মিটিং-মিছিল, নিদেনপক্ষে কোনো বিবৃতি...!

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ‘ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি’-করা নিয়ে একই দ্বিচারিতা (সোজা বাংলায় ভণ্ডামি); আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক-নারীবাদী তসলিমা নাসরিন কবেকার কোন লেখায় ‘ইসলাম’ নিয়ে (সমালোচনামূলক) মন্তব্য করেছেন; এরপর টেমস থেকে সুরমা, নীলনদ থেকে গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে—অথচ এখন এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে জল ঘোলা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসরকার তসলিমার ঐ লেখাটি কথিত সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি রক্ষার নামে অনেক আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল! যতদূর জানা যায়, এরপর তসলিমা আর এ ধরনের লেখা লেখেননি। তাহলে এখন কেন তসলিমাকে ভারত থেকে উ
খাতের জন্য জঙ্গি-আন্দোলন? তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ আনা হচ্ছে? কারা মদদ দিচ্ছে এসবে?—বাতাসে অনেক কথাই শোনা যায়, বিশেষ করে ‘নন্দীগ্রাম’ ইস্যু...। যাহোক, এ আমাদের আলোচ্য নয়। বলতে চাচ্ছি—পাকিস্তানের মোশারফ সরকার তো কয়েক দিন আগে ঐ অঞ্চলের বিখ্যাত লাল মসজিদটি ‘জঙ্গি’ মুক্তকরণের নামে কামান দাগিয়ে গুড়ো করে দিলেন, সেনা পাঠিয়ে রক্তগঙ্গা বানালেন; অথচ তখন বা এখনও এ উপমহাদেশের কোন ইসলাম-মুসলমান দরদী আলেম-ওলামাকে পেলাম না—প্রেসিডেন্ট মোশারফকে ‘আল্লাহর ঘর’ মসজিদে কামান দাগানো, তছনছ করা, গণহত্যা চালানোর অপরাধে—কোনো ফতোয়া দিতে, মুরতাদ ঘোষণা দিতে—ন্যূনতম প্রতিবাদ করে বিবৃতিটুকুও মিডিয়ার মাধ্যমে পেলাম না! মসজিদের ভেতর নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে মুসলমানকে গ্রেনেড-বোমা মেরে হত্যা করলে, কামান দাগিয়ে মসজিদ চুরমার করে দিলে—ইসলামের অবমাননা হয় না! কিন্তু ইসলাম নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা করলে কিংবা ইসলামের কোনো ‘ব্যাকডেটেড চিন্তা-প্রথা’র সমালোচনা করলেই ইসলামের অবমাননা হয়। হায়!... এরকম উদাহরণ সেই মুতাজিলা কিংবা ওমর খৈয়াম-ইবনে সিনাদের সময়কার ঘটনার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়!

একটি কথা মনে পড়ছে, যদিও এখানে প্রকাশ করা বাহুল্য, তবে অপ্রাসঙ্গিক নয়—আজ যারা (বিশেষ করে মৌলবাদীরা) ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ কিংবা মুতাজিলাদের মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ ‘মুসলিম’ মনীষী-বিজ্ঞানী, ‘ইসলামি চিন্তাবিদ’ হিসেবে অভিহিত করেন (ইউরোপীয়দের সাথে টেক্কা দিবার স্বার্থে), বুক ফুলিয়ে প্রচার চালান (‘ইবনে সিনা ট্রাস্ট’ ধর্তব্য),—তাদের একটু কষ্ট করে ইতিহাসের পুনঃপাঠের অনুরোধ জানাচ্ছি। ত
কালীন মধ্যএশিয়ার শাসকগোষ্ঠী-মৌলবি-সমাজপতিরা কথিত মুসলিম মনীষী-বিজ্ঞানীদের মুক্তচিন্তা-যুক্তিবাদিতা চর্চা করার কারণে কী পরিমাণ নির্যাতন-নিষ্পেষণ চালিয়ে, ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করে সমাজচ্যুত করেছিল, ঘরবাড়ি-বইপত্র পুড়িয়ে দিয়েছিল, প্রাণে বাঁচার তাগিদে তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল—এ ইতিহাস ‘আত্ম-পরিচিতি’র সংকটে ভোগা বর্তমানের এ গোষ্ঠীটি বিস্মৃত হতে পারে, কিন্তু মুক্তমনা-যুক্তিমনস্ক মানুষ বিস্মৃত হয়নি, হতে পারে না। শুধু মধ্যএশিয়ার মনীষী কেন,—আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল, বাংলার নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়া, শিখা’র আবুল হুসেন’কেও তো ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করেছিল, লেখনী বন্ধ করার জন্য প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল তকালীন মুসলিম সমাজপতিরা। তাই আজো যারা পুনরায় আরজ আলী মাতুব্বর, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন-এর বিরোধিতা করেন, উখাতের প্রচেষ্টা চালান তাঁদের মত-মননকে, তখন এদের জন্য করুণাই হয়! ভাবনা হয়,—এদেরই পরবর্তী প্রজন্ম আবার হয়তো কিছুদিন পর হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ, আরজ আলীকে ‘হাইজ্যাক’ করে শ্রেষ্ঠ ‘মুসলিম’ মনীষী, ‘ইসলামি’ চিন্তাবিদ বানাতে কসুর করবে না; তসলিমা নাসরিনকে বানিয়ে দেবে মুসলিম মহীয়সী নারী!

 

সূচি

পুনঃপাঠ
আদেশের নিগ্রহ আবুল হুসেন

প্রবন্ধ
শিক্ষা নিয়ে অনিয়ত ভাবনা অজয় রায়
নাস্তিকতা - মুর্দাবাদ, বিজ্ঞানচেতনা - জিন্দাবাদ যতীন সরকার
সমাজবাদীর জন্য জরুরি ‘ভাষা’: একটি আত্মোপলব্ধি বেনজীন খান


সাক্ষাৎকার
প্রবীর ঘোষ

প্রবন্ধ
স্বেচ্ছামৃত্যু সুমিত্রা পদ্মনাভন
অধার্মিকের ধর্মকথন অভিজি
রায়
বিজ্ঞান, ধর্ম ও বিশ্বাস অপার্থিব
ধর্ম ও নারীর গল্প নন্দিনী হোসেন
আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন সৈকত চৌধুরী।
 

সুম্পূর্ণ সংখ্যাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 



এ ‘হাইজ্যাক’ করার প্রবণতা শুধু মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে নয়, হিন্দুদের মধ্যেও এ অপপ্রবণতা মারাত্মকভাবে লক্ষণীয়। হিন্দুরা (ব্রাহ্মণ্যবাদীরা) তো সেই কবে নিরীশ্বরবাদী দার্শনিক গৌতম বুদ্ধকে ‘হাইজ্যাক’ করে হিন্দু ধর্মের দশাবতারে ঢুকিয়ে দিয়েছে! অথচ বুদ্ধ কখনোই ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্তৃক প্রণীত বেদের অপৌরুষেয়তা মানেননি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি, নিজে কোনো ধর্ম প্রচার করেননি। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা শুধু বুদ্ধকে কেন, চৈতন্য থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত অনেককেই হাইজ্যাক করেছে; আগামীতে হয়তো আরও করবে...। মনে প্রশ্ন আসে, ধর্মবাদীরা কেন এত অত্যাচার-নির্যাতন-সমাজচ্যুত করার পরও মুক্তচিন্তার-যুক্তিমনস্ক মানুষকে পুনরায় ‘হাইজ্যাক’ করে নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলে? হয়তো অনেকের কাছে এর সুনির্দিষ্ট সমাজবৈজ্ঞানিক উত্তর রয়েছে, তবে খুব সংক্ষেপে আমাদের মনে হয়: (এক) ধর্মবাদীরা ‘আত্ম-পরিচিতির সংকট’ -এ ভোগার ফলেই এ রকমটি করে, (দুই) আমাদের সমাজে সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে (আইনি) ‘মুক্তমনা-যুক্তিবাদী’ মানুষের কোনো স্বতন্ত্র স্বীকৃতি ও অধিকার নেই; যেমনটি অন্যান্য ধর্মবাদীদের আছে—ফলে সুযোগটি তারা কাজে লাগাতে পারে।

এ জীবন পূর্ণ কর... : সমাজনীতি-রাজনীতির জটিল-কুটিল আলোচনা ছেড়ে এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। ক্ষণজন্মা এ মানবজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য কী হওয়া উচি
? সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক এককথায় বলবেন ‘মানবজাতির কল্যাণ’। আমরাও তাই মনে করি; তাই তো দেখি, একেবারে শ্রমজীবী মানুষ থেকে উচ্চশ্রেণির মানুষ পর্যন্ত অনেকেই বিভিন্ন সময়-সুযোগে মানবতার পক্ষে কাজ করেন, বৃহত্তর মানবজাতির কল্যাণে স্বেচ্ছায় শ্রম দেন। তাদের এ নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়-অক্লান্ত পরিশ্রমে মানুষে-মানুষে গড়ে ওঠে প্রীতির বন্ধন, এগিয়ে যায় মানবসভ্যতা। তাঁরা আমাদের নমস্য। তবে জীবিত অনেকে মানুষের কল্যাণে নির্দ্বিধায় নিবেদিত থাকলেও—মৃত্যুর পরও অসুস্থ মানুষের সেবা করা যায় মরণোত্তর দেহ ও চক্ষুদানের মাধ্যমে—এ বিষয়টি বেশিরভাগই জানেন না কিংবা জানলেও এ প্রক্রিয়ায় যেতে উদ্বুদ্ধ হন না নানা কারণে (ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, ভয় ইত্যাদি)। একজন মৃতব্যক্তির বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (চোখ, হার্ট, কিডনি, যকৃত ইত্যাদি) দিয়ে প্রায় ছয়-সাতজন অসুস্থ ব্যক্তিকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব। বেঁচে থাকতে আমরা সবাই কমবেশি জনকল্যাণে কাজ করি, কিন্তু মৃত্যুর পরও এ অপ্রয়োজনীয় দেহ দিয়ে যখন আরো ছয়-সাত ব্যক্তি প্রাণ ফিরে পায়, সুস্থ হয়ে উঠতে পারে, এর থেকে বড় মানবসেবা আর কী-বা হতে পারে? যেহেতু প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আমরা মৃতদেহকে মাটিতে কবর দিয়ে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে এমনিতেই নষ্ট করে ফেলি। আপনি জানলে অবাক হবেন, বাংলাদেশে অন্ধ-ব্যক্তির মোট সংখ্যা ১৪ লক্ষের ওপরে; এরমধ্যে কর্নিয়াজনিত অন্ধের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ছাব্বিশ হাজার এবং সাড়ে তিন লক্ষ জনের এক চোখ অন্ধ (এ হিসাবটি ১৯৯৯ সালের, এখন নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে)। অথচ দেশে বার্ষিক কর্নিয়া সংগ্রহের হার অত্যন্ত অল্প—মাত্র ১০০-১৫০। ২০২০ সালের মধ্যে সবার দৃষ্টি পুনরুদ্ধার করতে হলে আমাদের প্রতি বছর ৩১ হাজার করে কর্নিয়া সংগ্রহ করতে হবে। এটা কী সম্ভব? মোটেই অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে বর্তমান গড় মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৭.৮ করে প্রতি বছর প্রায় ১১ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করেন; এ উসের শতকরা মাত্র তিন ভাগ সংগ্রহ করতে পারলেই বছরে প্রায় ৩৩ হাজার কর্নিয়া সংগ্রহ সম্ভব। তবেই আমরা দেশ থেকে স্বল্পতম সময়ে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করতে পারবো। তাই বিশাল এ কর্মযজ্ঞে সফল হতে হলে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। এ দায়িত্ব আপনাকে-আমাকে মানবকল্যাণকামী সবাইকে নিতে হবে। আপনি কি রাজি আছেন? আপনার-আমার সর্বশেষ দান দিয়ে একজন ব্যক্তি পুনরায় দৃষ্টি ফিরে পাবে, এ সুন্দর পৃথিবী অবলোকন করতে পারবে—এর থেকে আনন্দের আর কী হতে পারে!

মরণোত্তর চক্ষুদান নিয়ে অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ভয়-কুসংস্কার কাজ করে। আমাদের জানা মতে কোনো ধর্মেই মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, বরং এটি স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত। কেউ কেউ মনে করেন—চক্ষুদান করা মানে, মৃত্যুর পর চোখ খুলে নিয়ে যাবে, দেহের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে; মোটেই তা নয়, চোখ চোখের জায়গাতেই থাকবে, দেহের সৌন্দর্য একটুও নষ্ট হবে না। শুধুমাত্র (মৃত্যুর ৬ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই) ডাক্তার এসে চোখের ভিতরের সাদা অংশটুকু (কর্নিয়া) বের করে নিবেন, সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন এবং এরপর আলতো করে চোখের পাতা বন্ধ করে দেয়া হবে; বাহির থেকে দেখে বিন্দুমাত্র বোঝার কোনো উপায় নেই যে চোখের কোনো পরিবর্তন ঘটেছে।

বাংলাদেশে একমাত্র সন্ধানী-ই (১৯৭৫ সালের অন্ধত্বমোচন আইন এবং ১৯৯৯ সালের মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের মাধ্যমে) মরণোত্তর চক্ষুদান সংগ্রহ করে থাকে (যোগাযোগ: সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষুব্যাংক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ। ফোন ও ফ্যাক্স : ০২-৮৬৪০৪০। ঢাকার বাইরে যারা, তারা স্থানীয় মেডিকেল কলেজের সন্ধানী জোনে যোগাযোগ করতে পারেন)। আর মরণোত্তর দেহদানের জন্য নিকটস্থ সরকারি মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগে যোগাযোগ করুন। এজন্য প্রয়োজন হবে পরিবারের দুজন সদস্যের সম্মতিসূচক নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে একটি এফিডেভিট। বাংলাদেশে অনেকেই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না আর মৃতদেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি ভাবতে পারে না, তাই মরণোত্তর দেহদানের হার অনেক অনেক কম। অথচ বাংলাদেশে শতশত রোগী হৃ
পিণ্ড, কিডনি, যকৃ নষ্ট হয়ে গেলে টাকার অভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিনে প্রতিস্থাপন করতে পারে না বলে, মারা যায়। কিন্তু ‘ব্রেন ডেথ’ রোগীর মৃত্যুকে মেনে নিয়ে ঐ মৃতদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করলে (রোগী আগেই দান করে গেলে কিংবা আত্মীয়-স্বজন রাজি থাকলে) অন্য অসুস্থ রোগীর শরীরে প্রতিস্থপন করা যায়; অসুস্থ রোগীটি পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠবে, পাশাপাশি দান করা রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বেঁচে থাকবে (তবে খেয়াল রাখবেন, সংক্রামকরোগে মৃত্যু হলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করবেন না)। চাইলে দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেওয়ার পর ঐ দেহকে নিজ-নিজ রীতি অনুযায়ী সকার করা সম্ভব কিংবা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য দিয়ে দিতে পারেন।

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য প্রয়োজনে সবরকম সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে হবে; মানবিক দিক বিবেচনা করতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই যদি পরের তরে না হয়ই, তবে কে হবে আর? সবশেষে এ অংশটুকু শেষ করতে চাই দ্রোহী-যুক্তিবাদী মনীষী ড. আহমদ শরীফের (১৯৯৫ সালে লিপিবদ্ধ করা) ‘মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান’-এর অসিয়তনামা থেকে একটি উক্তি দিয়ে—“চোখ শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ-প্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।”

যুক্তি নিয়ে আরো কিছু কথা... : বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজনীতি’র সমন্বয়ে বেশকিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ দিয়ে সাজানো হয়েছে যুক্তি’র এ সংখ্যা। চিরাচরিত ধ্যান-ধারণার বাইরে থেকে রচিত কয়েকটি লেখায়—আমাদের সমাজে প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত কিছু ‘মিথ’কে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, দেখিয়ে দেয়া হয়েছে এদের অন্তঃসারশূন্যতাকে;—আশা করি আগের মতই যুক্তি তার পাঠকপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারবে। আমরা মনে করি, জনগণের সমাজ সচেতনতাই পারে কাক্সিক্ষত সমাজ পরিবর্তন; আর জনগণকে সচেতন করে তুলতে যুক্তির কোনো বিকল্প নেই।

এ সংখ্যায় প্রকাশিত সকল লেখকের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, বিশেষ করে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ এবং ভারতীয় মানবাধিকার সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুমিত্রা পদ্মনাভনের কাছে; প্রত্যেক লেখকই নিজেদের প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মাঝে সময় বের করে যুক্তি’র জন্য দু-কলম লিখেছেন। সাথে-সাথে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যাদের লেখা এ সংখ্যায় স্থান সংকুলান করা গেল না। অনেক চেষ্টার পরও এ সংখ্যায় কিছু ভুল থেকে যেতে পারে, পাঠকের কাছে অনুরোধ—এ ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার পাশাপাশি ধরিয়ে দিতে, যাতে ভবিষ্যতে আমরা সংশোধন করতে পারি। সবশেষে স্পষ্ট করে বলতে চাই, যুক্তি’র এ সংখ্যায় প্রকাশিত সব লেখকের সব বক্তব্যের সঙ্গে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল পুরোপুরি একমত নয় এবং সম্পৃক্তও নয়; আমরা (বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল) মনে করি, প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকগণের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অভিমত কিংবা তথ্যসংকলন। তবে আমরা চাই, এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো গঠনমূলক আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক; পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্য যত স্পষ্ট হবে, ততই আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারবো। তাই, প্রকাশিত যে কোনো লেখার যে কোনো বিষয়বস্তুর সঙ্গে যে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন এবং প্রকাশের জন্য আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন; প্রকাশযোগ্য হলে পাঠকের ভিন্নমত আগামী সংখ্যায় অবশ্যই প্রকাশ করা হবে।

অনন্ত বিজয় দাশ
সম্পাদক, যুক্তি
বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল, সিলেট

 

সম্পূর্ণ যুক্তি (২য় সংখ্যা)টি পিডিএফ ফরম্যাটে পড়ুন  :   যুক্তি -২য় সংখ্যা 

 

যুক্তির ২য় সংখ্যাটি সংগ্রহ করতে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্রাঙ্গনে কিংবা শিক্ষাবার্তা, অঙ্কুর এবং অবসর (প্রতীক) স্টলে খোঁজ করুন। এছাড়া বইপত্র, উত্তর জিন্দাবাজার, সিলেট;  তক্ষশিলা, আজিজ সুপার মার্কেট, ঢাকা ম্যাগাজিন কর্নার, রাণীবাজার, রাজশাহীতেও ম্যাগাজিনটি পাওয়া যাচ্ছে।

 


যুক্তি (Yukti) : The collection of essays on freethought, skepticism and rationalism. Editor: Ananta Bijoy Dash