মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান? কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যা
আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি শিক্ষানবিস এবং ড. বিপ্লব পালকে আমার ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ শীর্ষক লেখাটিতে তাদের সুলিখত মতামত প্রদানের জন্য। এ ছাড়া ইন্টারনেটের একটি বাংলা ব্লগেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। আমি আনুষঙ্গিক কিছু ব্যাখ্যা হাজির করছি।
খান মুহাম্মদ জানতে চেয়েছেন মার্ক্স তার তত্ত্বকে ‘বিজ্ঞান’ বলেছেন কিনা। কেউ কেউ আবার বলেছেন, বিজ্ঞান মানে আসলে কি বুঝবো ? আমি যেইটা বুঝি সেইটা হলো নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ যখন একটা সিদ্ধান্ত দেয় তখন সেইটাই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত । একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ক্ষেত্রবিশেষে ভুল সিদ্ধান্তও দিতে পারে । তাহলে মার্ক্সিজম বিজ্ঞান হবে না কেন।
মার্ক্স তার তত্ত্বকে ‘বিজ্ঞান’ বলেছেন কিনা - এর উত্তর হচ্ছে তাদের তত্ত্বের 'বিজ্ঞানময়তার কথা মার্ক্স নিজেই বলে গিয়েছিলেন। যেমন মার্ক্স তার ইকোনমিক থিওরী সম্বন্ধে বলেছেন,
"The sicentific nature of my economic theory distinguished it from all other vague utopian ideas about a future 'better world' that existed in my time"
এঙ্গেলসও মার্ক্সের তত্ত্বের বিপ্লবের ধারনাকে সায়েন্টিফিক মনে করে লিখেছেন,
"Marx claimed to identify fundamental underlying laws of a scientific nature that made revolutionary transition inevitable"
আমরা বাংলাদেশে বামপন্থি দলগুলোকে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' শ্লোগান দিতে অহরহই দেখেছি। কাজেই তাদের তত্ত্ব সত্যই বৈজ্ঞানিক কিনা সেটা অবশ্যই বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা যেতে পারে। সেজন্যই মূলতঃ আমার ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ শীর্ষক লেখার অবতারণা। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্র এবং পরিশেষে সাম্যবাদে উত্তোরণের ভবিষ্যদ্বানী 'বৈজ্ঞানিক'ভাবেই করা হয়েছে বলে দাবী করা হয়। মার্ক্স তার ‘ডায়েলেক্টিক ম্যাটিরিয়ালিজম’কে সম্পুর্ণ ‘বৈজ্ঞানিক’ বলে ভাবতেন। আর এই ভাবনার কারনেই মনে করতেন, পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তোরণের জন্য ‘Revolutionary transition’ অপরিহার্য। আমরা সেই ধারনার সাথে বাস্তবতা মিলিয়ে দেখতে চাই।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রসঙ্গে আসি। অনেকে ঢালাওভাবে মনে করেন, নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ যখন একটা সিদ্ধান্ত দেয় তখন সেইটাই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। আসলে সেটা কিন্তু সত্যি নয়। নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিলেই তা বিজ্ঞান হয়ে উঠে না। চিন্তা করুন - জ্যোতিষশাস্ত্র, কিংবা প্যারা-সাইকোলজির বিভিন্ন বিষয় আশয় যারা চর্চা করেন -তারাও কিন্তু বলেন তারা নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নেন, এবং আপনার মতই বলেন, সেই চিন্তাভাবনা (ধরুন কোন জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বানী) ক্ষেত্রে বিশেষে ভুল সিদ্ধান্ত নেয় - তা হলে বিজ্ঞান হবে না কেন?
আসলে এখানেই কার্ল পপার খুব প্রাসঙ্গিক । বিজ্ঞানের সাথে অপবিজ্ঞান, পরাবিজ্ঞান ইত্যাদির পার্থক্য নিরূপন করেন বিজ্ঞানের দার্শনিক স্যার কার্ল পপার (১৯০২-১৯৯৪)। সেটাই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা - 'If something is scientific, it must be logically possible to find evidence that can falsify, refute or show it is wrong'.
মার্ক্সবাদ কেন বিজ্ঞানের সংজ্ঞাভুক্ত হবে না, সেটা পপারের বিজ্ঞানের পদ্ধতির সাথে লিমিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। 'শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার স্বপ্ন' , 'দুনিয়ায় মজদুর এক হও', ‘শ্রেনিশত্রু খতম' ইত্যাদি জিনিস চিরন্তন আবেগী মানসিকতাকে যতটা তুলে ধরে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণযোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় না। এমনকি 'ডায়লেক্টিক' ব্যাপারটাও অনেকের কাছে 'মিস্টিকাল'। বিজ্ঞান 'ডায়লেক্টিক' নিয়ে কাজ করে না, মূলতঃ কাজ করে cause and effect নিয়ে। মার্ক্স 'value'র যে ধারনা হাজির করেছিলেন, এবং ধারনা করেছিলেন, শ্রমিকের সরবরাহ সবসময়ই চাহিদার চেয়ে বেশি থাকবে, এবং তার সাপেক্ষেই 'increasing misery' কে ব্যাখ্যা করা যাবে – এগুলো সঠিকভাবে পরীক্ষণযোগ্যতার মাপকাটিতে ফেলা যায় না। আর সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে শ্রমিক এবং কাঁচামালের সনাতন ধারনাই পালটে দিয়েছে, তা আমি আমার মূল প্রবন্ধেই বলেছি।
আমি যে কারণ গুলোর জন্য মার্ক্সিজমকে বৈজ্ঞানিক মনে করি না, তার সারাংশ করলে দাঁড়াবে অনেকটা এরকম –
১) 'ফলসিফায়াবিলিটির' অভাব এবং 'ফলসিফিকেশন'কে অগ্রাহ্য করা -
বিষয়টা একটু পরিস্কার করা যাক।
এখানে দূটো ব্যাপারকে আলোচনায় আনা হচ্ছে -১) ফলসিফায়াবিলিটি ২) ফলসিফিকেশন। বিষয়ের গভীরে যাবার আগে দুটোর পার্থক্য পরিস্কার করা দরকার। কার্ল পপার তার ‘ফলসিফিকেশন ভার্সেস কনভেনশনালিজম’ প্রবন্ধে পরিস্কার করেই বলেছেন –
‘We must clearly distinguish between falsifiability and falsification. We have introduced falsifiability solely as a criterion for the empirical character of a system of statements. As to falsification special rules must be introduced which will determine under what conditions a system is to be regarded falsified. ’
আমি দুটো বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে লিখছি।
ফলসিফায়াবিলিটি
‘ফলসিফিফায়াবিলিটি’ বা ‘বাতিলযোগ্যতা’ একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অন্যতম গুন। এটা যে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণের অপরিহার্য শর্ত। মুলতঃ এই গুনটিই বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানকে পার্থক্য করে দেয় পরিস্কারভাবে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। যেমন, ‘যুধিষ্ঠির স্বশরীরে স্বর্গে গেছেন’ – এটি এমন একটি বক্তব্য যেটা পরীক্ষা করে আমরা সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারি না। কাজেই এটি একটি টটোলজিকাল স্টেটমেন্ট – ফলসিফায়াবেল নয়। কারণ আমরা কোনভাবে পরীক্ষা করে এর যথার্থতা নির্ণয় করতে পারি না। কিন্তু ‘ইলেক্ট্রন প্রটোনের চেয়ে ভারী’ –এটি একটি ফলসিফায়েবল স্টেটমেন্ট। কারণ পরীক্ষা করে আমরা এর সত্যমিতথ্যা যাচাই করতে পারি। কার্ল পপার তার ‘দ্য লজিক অব সায়েন্টিফিক ডিস্কভারি’তে পরিস্কার করে বলেছেন – ‘A theory is scientific to a degree to which it is testable.’
মার্ক্সের তত্ত্বের বেশ কিছু জায়গায় ফলসিফায়াবেলিটির অভাব রয়েছে বলে মনে করা হয় । যেমন মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্বে যেভাবে শ্রমিকদের ‘increasing misery’ পরিমাপের কথা বলা হয়ছে তা ফলসিফায়াবেল নয়। এ প্রসঙ্গে রুপার্ট য়ুডফিন বলেন, ‘…Increasing misery can be explained without reference to value. We don’t know if it is significant and have no way to finding out.’। একই ধরনের কথা মার্ক্সের এলিনেশন থিওরীর জন্যও খাটে, যেখানে মার্ক্স বলেছেন – ‘We have only the illusion of happiness, because it is an essential part of our nature to be in a proper relationship to these things.’। এখানেও সমস্যা – ‘আমরা সুখে আছি নাকি এটা ইল্যুশন অব হ্যাপিনেস’ – এগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে নির্ণয়ের কোন উপায় নেই। ‘ডায়েলেক্টিক্স’ ব্যাপারটাও ফলসিফায়েবল কিনা তা বিবেচনার দাবী রাখে। পপারের মতে এটি ‘mystical, unverifiable nonsense’।
ফলসিফায়াবিলিটি ছাড়াও মার্ক্সিজমের আরেকটা সমস্যা হল ফলসিফিকেশন বা ‘ভুল প্রমাণিত’ হয়ে যাওয়া ভবিষ্যদ্বানীগুলো। এখানে আসে ফলিফিকেশন প্রসঙ্গ।
ফলসিফিকেশন
ধরুন আমি বললাম ‘ইলেক্ট্রন প্রটোনের চেয়ে ভারি’। আগেই বলেছি এটি একটি ফলসিফায়েবল স্টেটমেন্ট। কারণ এর মধ্যে ‘বাতিলযোগ্যতা’ একটি গুন হিসেবেই ছিলো। এটি টেস্টেবল। এখন পরীক্ষা করে দেখা গেল না - ইলেক্ট্রন প্রটোনের চেয়ে অজনে হাল্কা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আমার স্টেটমেন্ট ফলসিয়ায়েড বা বাতিল হয়ে যাবে। ঠিক একই কারণে টলেমীর ভূকেন্দ্রিক তত্ত্ব বাতিল হয়ে গেল কারণ পর্যবেক্ষনের সাথে বাস্তবতা মিললো না।
কার্ল পপার, David Prytchitko, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা সহ অনেকেই তাদের বইয়ে দেখিয়েছেন যে, মার্ক্সের অনেক ভবিষ্যদ্বানীই ভুল প্রামণিত হয়েছে। যেমন, মার্ক্স যেভাবে ভেবেছিলেন ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র, এবং সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদ – এভাবে ঘটেনি। অনেকে বলবেন, ‘প্রয়োগে ভুল হয়েছিলো’। প্রয়োগে ভুল আর তত্ত্বে ভুল যাই হোক না কেন - বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বলা যায় - মার্ক্সের অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয় নি। মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বানীর আরেকটি বড় বিপর্যয় হল – মার্ক্স ভেবেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিল্পব এডভান্সড পুঁজিবাদি রাষ্ট্রগুলোতে আগে হবে – কারণ সে সমস্ত দেশেই শ্রমিকেরা হবে ‘সবচেয়ে শোষিত’। কিন্তু সে সমস্ত দেশে বিপ্লব আগে হয় নি। এ প্রসঙ্গে পপার লেখেন –
‘It has been predicted revolution would happen first in the technically highest developed countries, and it is predicted that the technical evolution of the ‘means of production’ would lead to social, political, and ideological movements, rather than other way round… But (so-called) socialist revolutions came first in one of the backward countries.’।
এমনকি রাশিয়ায় যখন বিপ্লব হয়েছিলো, তখন রাশিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়ালি ডেভেলপ্ট ছিলো না মোটেই। তাদের ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি হয়েছে বিপ্লব-পরবর্তী যুগে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর ব্যাপারটা আরো বেশি দৃশ্যমান। সমাজতন্ত্রে আঁকড়ে পড়ে থাকা তার্কিকেরা 'সমাজতন্ত্রের পুনরুত্থানের' নিদর্শন হিসবে যে দেশ গুলোর – নেপাল, ভেনিজুয়ালা প্রভৃতি দেশের উদাহরণ হাজির করেন সেগুলো কোনটিই কিন্তু ‘শীর্ষ পুঁজিবাদী’ দেশ নয়। আসলে আমি বার বারই বলেছি আমার প্রবন্ধে – বাস্তবতা হচ্ছে – কট্টর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে বিপ্লব হচ্ছে না – হবেও না বোধ হয়। কারণ বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা ধ্বংস না হয়ে যে টিকে গেছে – সেই টিকে থাকার পেছনে ‘অন্তর্নিহিত বিবর্তন’টি মার্ক্স গোনায় ধরেন নি, কিংবা ধরতে চাননি।
পপারেরকে উদ্ধৃত করি –
‘Marxism is no longer science; for it broke the methodological rule that we must accept falsification, and it immunized itself against most blatant refutations of its predictions’.
অর্থাৎ, মার্ক্সিয়তত্ত্বে থিসিস এন্টি থিসিস থেকে সিন্থেসিস-এ উত্তোরণের কথা বলা হয় বটে কিন্তু মিথ্যে বলে ধরা হয় না। এর ফলে কোন সিদ্ধান্ত মার্ক্সীয় ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে গেলে, সেই মার্ক্সিজমের মধ্যে থেকেই আরো কিছু 'পুর্বনির্ধারিত মার্ক্সীয় প্রকল্প' ঢোকানো হয়। সেই প্রকল্পকে বাতিল করা হয় না। সেজন্যই আমি আমার প্রবন্ধে বলেছি - যখন মার্ক্সের অনুরাগীরা দেখলেন পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি মার্ক্সের দেখানো পথে যাচ্ছে না, তখন তাদের দরকার ছিল এই তত্ত্বকে বাতিল করে নতুন তত্ত্বের খোঁজ করা। তা না করে তারা পুরোন তত্ত্বকেই তারা আঁকড়ে ধরে রইলেন, এবং তত্ত্বকে জোড়া তালি দিয়ে একধরণের যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পপারের মতে এ ধরণের কর্মকান্ড বিজ্ঞানমনস্কতার পরিপন্থি। সত্যি বলতে কি, এ ধরনের মনোভাবই তৈরি করে অন্ধ স্তাবকের এবং একটি তত্ত্বকে ঠেলে দেয় বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানের দিকে।
২) শুধু শ্রেনী সংগ্রাম দিয়ে সব কিছু বিচার করলে চলবে না। 'ক্লাস' বা শ্রেনীকে এখন কোন বেসিক ইউনিট হিসেবে দেখা হয় না। একই ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিভিন্ন মানুযের চাহিদা এবং সংগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন হয় তা দেখা গেছে। আবার সঙ্ঘাতই বলুন, আর কনফ্লিক্ই বলুন এগুলো একই মানুষে অবস্থাভেদে পরিবর্তিত হয়। যেমন, আমেরিকার একজন 'ব্ল্যাক ওয়ররকিং ক্লাস ওম্যান' এর উদাহরণ দেওয়া যায়। এর মধ্যে এন্টাগনিজম তিনটি - ব্ল্যাক, ওয়ররকিং ক্লাস, এবং ওম্যান। কোনটাই কোনটার চেয়ে যে কম তা বলা যায় না। যেমন একই শ্রেনীগত অবস্থায় থাকার পরও চাহিদা, পছন্দ এবং বিভিন্ন অপশন যাচাই বাছাই এর ধরণ ধারন এবং সিদ্ধান্ত অবস্থাভেদে পরিবর্তিত হয়। একই ওয়ররকিং ক্লাসে থাকার পরও কোন ব্ল্যাক ওম্যান হয়ত ওবামার দিকে ঝুকে, কেউবা হিলারীর দিকে - কোন্ এন্টাগোনিজম কখন কার কাছে বড় হয়ে উঠে তার উপর ভিত্তি করে - অনেকাংশেই আবার ওগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। আর তাছাড়া শ্রেনী ছারাও ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত বিভিন্ন সঙ্ঘাত তো আছেই। অমর্ত্য সেনের উদ্ধৃতিটা আবারো দেই – ‘শ্রেণী ছাড়াও আসলে অসাম্যের অনেক উৎস আছে; অসুবিধা আর বৈষম্যের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র শ্রেনী দ্বারাই নির্ধারিত হবে – এই ধারণা ত্যাগ করতে হবে’।
৩। মার্ক্স কথিত 'ইনএভিটেবল' বিপ্লব অনেক ক্ষেত্রেই হয় নি (যেমন তিরিশের দশকের মন্দার সময়), কিংবা অনেক ক্ষেত্রে খুব বাজে ভাবে শেষ হয়েছে। বিপ্লবের 'অলটারনেটিভ' হিসবে 'গনতান্ত্রিক স্থানান্তর' (Democratic transition) অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকরী প্রমানীত হয়েছে এই বিশ্বে।
৪। মার্ক্স তার তত্ত্বে মালিক এবং শ্রমিকশ্রেনীর সংঘাত কেবল দেখেছেন, আধুনিক ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত বিপুল সঙ্খ্যক 'মধ্যবিত্ত' শ্রেনীর উত্থানকে অস্বীকার করেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে এ সমস্ত ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত হাজার হাজার মানুষ চিরায়ত শ্রমিকের ধারনাই পালটে দিয়েছে আজ।
৫) যে কোন ধরনের 'সেন্ট্রাল প্যানিং' - যেমন 'পার্টির একনায়কতন্ত্র' কিংবা 'সর্বহারার একনায়কতন্ত্র' পরিশেষে দুর্নীতি আর স্বৈরশাসনের জন্ম দেয়। এখন মানুষ বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর অনেক আস্থাশীল। অন্ততঃ পৃথিবীর গতি প্রকৃতি দেখলে তাই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার 'The end of History and the last man" সাম্প্রতিক বইটা পড়া যেতে পারে - যেখানে বলা হয়েছে 'সমাজতান্ত্রিক' বা এ ধরণের কোন 'আদর্শবাদ' নয় - বরং লিবারাল ডেমোক্রেসিই মানব সভ্যতার শেষ পরিণতি ।
৬) অনেক মার্ক্সিস্টরা পুঁজিবাদের বিবর্তনের মাধ্যমে শ্রমিকস্বার্থ সংরক্ষণ -এর ব্যাপারগুলো - শেয়ার বাজারের শেয়ার ক্রয়, কর্পোরেটের অংশীদারিত্বের বোধ, বাজারে মতায়ন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যেম পশ্চিমা বিশ্বে শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ, ওয়েল ফেয়ার স্টেটের উত্থান ইত্যাদিকে 'ছদ্ম সমাধান' বলে অভিহিত করেন। ভাবেন এগুলো 'কিন্তু সেটা আখেরে টিকবে না'। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই তথাকথিত 'ছদ্মসমাধানকে'ই মানুষেরা আজ গ্রহন করেছে। বিপ্লবে যাচ্ছে না। 'আখেরে টিকবে না'র পক্ষে কোন শক্ত প্রমাণ আমি কিন্তু পাইনি।
৭) 'ডায়লেক্টিক' যদি একটি গতিশীল বা ডায়নামিক প্রক্রিয়া হয় তবে তা সবসময় বজায় থাকার কথা - এমনকি মার্ক্সের কথিত এর ‘বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী’ সমাজব্যবস্থা কায়েম হবার পরো, যাকে তিনি মনে করেছেন মানব সমাজের সর্বোচ্চ রূপ। কিন্তু মার্ক্স নিজেই বলেছেন সেই ব্যবস্থায় 'dialect will cease to operate' এবং ধারনা করেছেন -
'In good time, the dictatorship of proletariat will wither away and the sunlit uplands of true socialism will be reached'
আজকের সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন মার্ক্সের এ ধারনা অবৈজ্ঞানিক। সমস্ত কনফ্লিক্ট দূর হয়ে গেলে তা হবে 'সায়েন্সদিকশন নাইটমেয়ার'। আসলে সমাজের সব কনফ্লিক্ট কখনোই দূর হয় না, হবে না। এক জায়গার কনফ্লিক্ট-এর প্রশমন হলে আরেক জায়গায় নতুন কনফ্লিক্ট দেখা দেবে। এটাই সভ্যতার বাস্তব রূপ। এটা কিন্তু ভালই, কারণ সব কনফ্লিক্ট দূর হয়ে গেলে সমাজ হয়ে যাবে স্থবির - ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত 'বেহেস্তের' মত।
৮) ইম্পেরিয়ালিজম পুঁজিবাদের একচেটিয়া ছিল না। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বও আগ্রাসন এবং আক্রমনের ভালই খেলা দেখিয়েছে এক সময়।
৯) 'solidarity' ব্যাপারটা গ্রুপে গ্রুপে ভালই, কিন্তু এই 'solidarity'তে উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রেনীশত্রু খতমের লাইনটা বৈজ্ঞানিক নয়, বরং ‘রিয়েকশনারী’। স্ট্যালিনের সময়কার ‘গ্রেট টেরর’ কিংবা মাওয়ের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ সময় লক্ষ মানুষের প্রাণহানী এর প্রমাণ। বাংলাদেশে সর্বহারা পার্টির কর্মকান্ডেরও উল্লেখ করা যায়। তারপরো অনেক মার্ক্সিস্টরাই কিন্তু এই ‘খতমের লাইন’কেই ঠিক মনে করে, এখনো।
১০) মার্ক্সের ইকোনমিক থিওরী অনেক সরল - সেই রিকার্ডোর 'লেবার থিওরী ভ্যালুর' উপর নির্মিত। আজকের সমাজ অনেক জটিল। আধুনিক অর্থনীতিতে মার্ক্সের তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘মার্জিনাল ইউটিলিটি’ তত্ত্ব দিয়ে। আসলে সাপ্লাই-ডিমান্ডের গানিতিক মডেল, গেম থিওরী, ট্রেন্ড এনালাইসিস, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত না করলে আজকের ‘গ্লোবালাইড ওয়ররল্ডের’ বাস্তবতা ঠিকভাবে উঠে আসবে না।
তারপরও এটা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে যে, মার্ক্সিজমের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। আমি আমার প্রবন্ধে পরিস্কার করেই উল্লেখ করেছিলাম যে, যে সমস্ত সমাজব্যবস্থায় শ্রেনী বৈষম্য এবং শ্রেনী নিপিড়ন বিদ্যমান সে সমস্ত ব্যবস্থায় মার্ক্সের শিক্ষা এবং তত্ত্ব যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। আমি ব্রিটিশ শাসনামলে সন্ন্যাস বিদ্রোহ, বারানসী বিদ্রোহ, ওহাবী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, মোপলা বিদ্রোহ, পাবনার কৃষক বিদ্রোহ, দাক্ষিনাত্যের কৃষক বিদ্রোহ, মাদ্রাজের রূম্পা বিদ্রোহ, উরিষ্যার খোন্দ বিদ্রোহ, বীরসা ভগবানের নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ সহ আরো অনেক বিদ্রোহের উদাহরণ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, এই ঔপনিবেশিকতাবিরোধি বিদ্রোহে বরাবরই সাধারণ মুক্তিকামী মানুষেরা আশার আলো খুঁজে পেয়েছে শ্রেনী সংগ্রামের মধ্যে। অতি সাম্প্রতিক কালের কানসাট এবং ফুলবাড়ির উল্লেখও করেছি। আমি বলেছি, আমি মনে করি ‘বৈজ্ঞানিক’ নয় বরং আধুনিক মানবতাবাদী দৃষ্টিকোন থেকেই আজকের দিনে মার্ক্সিজমের গুরুত্ব এবং আরোপযোগ্যতা বিবেচনা করা উচিৎ। কারণ সমাজতন্ত্রের অবস্থান এশিয়া এনার্জর মত রক্তপিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানির হীন উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে এখনো প্রচন্ড ভাবেই মানবিক – অন্ততঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো বটেই। আমি মনে করি, দিদেরা যেমনি বলেছেন - 'Marxism as an ethical program' - অধিকার সচেতন হওয়া, দুঃস্থ, নিপীড়িতদের পাশে এসে দাঁড়ানো –এটা মার্ক্সিজমের চর্চার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়। ব্যাপারটা কিন্তু চিন্তাকরার মতই। আমার মনে হয় মার্ক্সিজমের এই শিফিট – ‘সায়েন্টিফিক সিস্টেম থেকে মরাল সিস্টেমে’ উত্তরোনের ব্যাপারটা আজ সকল মার্ক্সিস্টদের মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। এটাই সময়ের দাবী।
সেপ্টেম্বর ০৬, ২০০৮
প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধঃ
ড. অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি 'বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?' শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত। ইমেইল : [email protected]