‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ প্রবন্ধের সমালোচনার উত্তরে
আমার ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ শীর্ষক প্রবন্ধটি মুক্তমনায় প্রকাশিত হবার পর বাম ঘরণার কিংবা সমাজতান্ত্রিক ভাবাপন্ন লোকজনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে বামরাজনীতির চর্চাকারী লোকজনের এমনিতেই ঘাটতি নেই। বুঝে হোক, না বুঝে হোক পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদকে দুটো গালি দিতে পারলেই ভাবেন তারা মহান! আসলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিপ্লবের ধ্বনি দিয়ে উত্তেজনার আগুন পোহানোর মত ‘কমরেড’দের অভাব ছিলো না বোধ হয় কখনোই, কিন্তু সে তুলনায় নিজেদের ‘বিশ্বাস’কে যুক্তির কষ্ঠিপাথরে যাচাই করার মত সৎ সাহস রাখেন খুব কম লোকই। আমার আলোচ্য লেখার প্রশংসা যেমন পেয়েছি (মুক্তমনায় শিক্ষানবিস এবং ড. বিপ্লব পাল-এর মন্তব্য, এবং অন্য কিছু ব্লগে কিছু মন্তব্য দ্রঃ), তেমনি কেউ কেউ আবার মহা ব্যাজার হয়েছেন। তা ব্যাজার হওয়াই উচিৎ। তারা কমিউনিস্ট পয়গম্বরদের লেখা যে লাল বইগুলোকে একসময় ধর্মগ্রন্থের মত মাথায় তুলে রেখে, বুকে পেটে বিপ্লবীর তকমা এঁটে আর বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়ে দিন কাটাতেন অহর্নিশি, কেউ কেউ ‘শ্রেনীশত্রুও’ মারতেন লুকিয়ে ছাপিয়ে – হঠাৎ করে তাদের এতদিনকার লালিত স্বপ্নকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ হিসেবে দেখতে পেলে একটু দিশেহারা লাগে বৈকি।
সেরকম ‘দিশেহারা দলের’ বেশ কিছু বক্তব্য আবার বিভিন্ন ব্লগ সাইটেও প্রকাশিত হয়েছে। তবে তাদের অধিকাংশ মন্তব্যই আবর্তিত হয়েছে একটি নির্দিষ্ট ছকে। তাদের প্রতিক্রিয়ার ছকটা অনেকটা এরকম -
প্রথমতঃ আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে ‘পুঁজিবাদের দালাল’ অভিধায় (কখনো সরাসরি, কখনো ঘুরিয়ে পেচিয়ে), কখনো বলা হয়েছে ‘শোধনবাদী’, কখনো বা ‘একচোখা’।
দ্বিতীয়তঃ কখনো আমার যুক্তি খন্ডন না করে বলে দেওয়া হয়েছে – আমি মার্ক্সবাদ জানি না।
তৃতীয়তঃ কখনো বা বলা হয়েছে আমি মার্ক্সবাদের ভুল ইন্টারপ্রিটেশন করেছি।
চতুর্থতঃ বলে দেওয়া হয়েছে আমি এ বিষয়ে কোন ‘বিশেষজ্ঞ’ নই।
মজার ব্যাপার হল, একই ধরণের প্রতিক্রিয়া আমি পাই ধর্মবাদীদের সাথে তর্ক করতে গেলেও। তাদের প্রতিক্রিয়া গুলো হয় অনেকটা এরকম –
প্রথমতঃ ধর্মবাদীরা আমাকে আক্রমণ করেন ‘নাস্তিক’ বা ‘ইসলাম ব্যাশার‘ অভিধায় (কখনো সরাসরি, কখনো ঘুরিয়ে পেচিয়ে) কিংবা বলেন আমি ‘একচোখা’ – ধর্মের কিছু ভালো কিছু দেখি না।
দ্বিতীয়তঃ কখনো আমার যুক্তি খন্ডন না করে বলা হয় – আমি ইসলাম সম্বন্ধে জানি না।
তৃতীয়তঃ আমি কোরান-হাদিসের ভুল ইন্টারপ্রিটেশন করছি।
চতুর্থতঃ বলা হয় আমি এ বিষয়ে কোন ‘বিশেষজ্ঞ’ নই।
উপরের দুই গ্রুপের মধ্যে বক্তব্যের মিল লক্ষ্যনীয়। ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। আমি লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবন প্রমুখ দার্শনিক, বিজ্ঞানী, এবং ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণ হাজির করে আমার প্রবন্ধে দেখিয়েছি মার্ক্সের তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের সাযুজ্যই বেশী। কিন্তু সমস্যা হল ধর্মবাদীদের সাথে কমিউনিস্টদের তুলনা করলে তারা যার পর নাই চটিতং হয়ে উঠেন। তাদের অনেক গোস্যা। একজন দিশেহারা দলের সদস্য ধর্মের সাথে কমিউনিজমের তুলনা করায় আমাকে আবার এজন্য থ্রেটও করেছিলেন। কিন্তু থ্রেট করলে কি হবে তাদের আচার আচরণে কিন্তু ধর্মবাদীদের সাথে পার্থক্য পাওয়া যায় খুবই কম। কমিউনিজমও যে আসলে একটি ধর্ম – এনিয়ে অনেক বিশ্লেষণমূলক লেখা ইন্টারনেটেও আছে। সঙ্গত কারণেই প্রতিক্রিয়াতেও পাওয়া যায় ধর্মবাদীদলের সাথে দিশেহারা দলের এত মিল!
এখন উপরের ছক বাধা আক্রমণকে লজিকের ভাষায় বলে ‘Argumentum ad hominem’। এ ধরনের আক্রমনের উত্তর দেয়ার কোন মানে হয় না। কে ‘বিশেষজ্ঞ’ আর কে ‘নির্বোধ’ তা বিচারের ভার আমি পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিতে চাই।
সম্প্রতি আজাহারুল ইসলামের একটি সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে মুক্তমনায়। সমালোচনাটির মধ্যে কিছু নতুনত্ব খুঁজে পাওয়া গেল বলে এর একটি উত্তর দেবো মনস্থ করেছি। যদিও তার সমালোচনায়ও উপরের ছকের কিছুটা প্রভাব আছে (যেমন তিনি সরাসরি আমাকে ‘একচোখা হরিণ’ বলেছেন)। এর বাইরেও তিনি যোগ করেছেন কিছু বাড়তি উপাদান। আমি ব্যক্তি-আক্রমণ এবং ব্যক্তি-আলোচনা যথাসাধ্য এড়িয়ে নৈর্বক্তিকভাবে এগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করব। সেই সাথে অন্য কয়েকটি জায়গায় প্রকাশিত কিছু সমালোচনারও উত্তর দিব।
আজাহার সাহেব আমার প্রতি বিভিন্ন প্রশংসাসূচক শব্দ ব্যবহার করে প্রবন্ধ শুরু করলেও প্রবন্ধের সপ্তসুরে পৌঁছুতে তার সময় লাগেনি। বলেছেন, ‘মুক্তমনার এ নিবন্ধটির প্রায় সবটা জুড়েই রয়েছে মার্ক্সবাদ, মার্ক্সবাদী বিপ্লব ও বিপ্লবী নেতাদের নানা রকমভাবে নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ করে কদর্য চিত্র এঁকে প্রমাণ করা যে, সর্বদিক থেকে সর্ববিচারে এগুলো খারাপ’। আরো বলেছেন, ‘তার লেখার শেষ দিকের সামান্য কিছু অংশ বাদে প্রথম থেকে প্রায় চার-পঞ্চমাংশ জুড়ে কোথায়ও একটি বাক্যও নাই যে মার্ক্সবাদ বা কোন মার্ক্সবাদী নেতার কর্মকাণ্ড সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশ্ব ইতিহাসে কোন ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে’। এগুলো বলে টলে আজাহার সাহেব শেষ পর্যন্ত যে আমাকে ‘একচোখা হরিণ’ বানিয়ে গল্পের ইতি টেনেছেন পুরোনো ছকে।
প্রথম কথা হল - আজাহার শুরুই করেছেন ভুলভাবে। আমার লেখার ‘প্রথম থেকে প্রায় চার-পঞ্চমাংশ জুড়ে কোথায়ও’ মার্ক্সবাদ সম্বন্ধে ভাল কিছু পাননি বলে যে অভিযোগ করেছেন তা সত্য নয়। আমি আমার প্রবন্ধ শুরুই করেছিলাম মার্ক্সকে ‘শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বলেছিলাম – ‘কার্ল মার্ক্স উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ। শ্রেণীহীন শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিল একসময় বিশ্বের বহু মুক্তিকামী মানুষকে’। প্রথম তিনটি প্যারাগ্রাফ জুরে বিশ্লেষণ করেছিলাম কেন এবং কিভাবে মার্ক্সের ধারণা সারা বিশ্ব জুড়ে অগনিত চিন্তাশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো। আমার প্রবন্ধটি ভাল করে পড়লেই বোঝা যাবে আমি বেশ কিছু ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের মানবিক অবদান অস্বীকার করিনি। বরং পরিস্কার করেই বলেছি যে, ‘যে সমস্ত সমাজব্যবস্থায় শ্রেনী বৈষম্য এবং শ্রেনী নিপিড়ন বিদ্যমান সে সমস্ত ব্যবস্থায় মার্ক্সের শিক্ষা এবং তত্ত্ব যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। ’ ফুলবাড়ি আর কানসাটের জায়গায় মার্ক্সিজম যে আজও প্রাসঙ্গিক তাও স্পষ্ট করেই বলেছি। আমি বলেছি, দেরিদার মত আমিও ‘মরাল সিস্টেমে’ মার্ক্সবাদের প্রয়োগ দেখতে চাই। এটা কি ‘একচোখা’ নীতি হল? আমার লেখাকে ‘একচোখা’ ভাবলে, আজাহার সাহেবের নিজের লেখা সম্বন্ধে তাঁর কি ধারনা? আমি তো আজাহার সাহেবের লেখার কোন জায়গায় সমাজতন্ত্রের কোন ‘খারাপ কিছু’ কিংবা পুঁজিবাদের কোন ‘ভাল কিছু’ উদ্ধৃত করতে দেখলাম না। দেখলাম শুধু গৎবাধা ছকে সমাজতন্ত্রের জয়গান গেয়ে চলেছেন। পুঁজিবাদ মানেই তার কাছে ‘এশিয়া এনার্জির’ মত সাম্রাজ্যবাদী দৈত্য (পুরো লেখায় এশিয়া এনার্জির কথা টেনে এনেছেন ৯ বার, যদিও এশিয়া এনার্জির উদাহরণটি আমিই মূল লেখায় এনেছিলাম)। আজাহার সাহেব হয়ত উত্তরে বলবেন যে, তিনি পুঁজিবাদের সমর্থক যেহেতু নন, কেন অযথা পুঁজিবাদের বন্দনা করবেন। ঠিকি তো! কিন্তু যে ধরণের কাজ তিনি নিজে করেন না লেখার সময়, একই ধরনের নীতির জন্য প্রতিপক্ষকে কি ‘একচোখা’ নামে ডাকা উচিৎ (যেখানে নিদেন পক্ষে আমি মার্ক্সিজমের যেখানে যেখানে প্রশংসা পাওয়া উচিৎ তা দিয়েছি)? আমাকে ‘এক চোখা’ নামে ডাকলে আজাহার সাহেবের নিজেই নিজেকে যে ‘অন্ধ’ ডাকতে হবে!
আসলে আজাহার সাহেব আমার প্রবন্ধের নির্যাসটুকুই ধরতে পারেননি। মার্ক্সিজমের মানবিক প্রেক্ষাপট আমি মোটেই অস্বীকার করিনি। আমি কেবল আপত্তি তুলেছি মার্ক্সিজমকে ঢালাওভাবে ‘বিজ্ঞান’-এর মোড়কে পুরতে, কিংবা বৈজ্ঞানিক মনে করাতে। বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়গুলোতে বামপন্থি দলগুলোকে অহরহই 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' শ্লোগান দিতে দেখেছি। কাজেই তাদের তত্ত্ব সত্যই বৈজ্ঞানিক কিনা সেটা অবশ্যই বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা যেতে পারে। আমি আমার প্রবন্ধে দেখিয়েছি, মার্ক্স যেভাবে কল্পণা করেছিলেন ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র, এবং সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদ – এরকম ‘প্রিডিফায়েন্ড’ পথে সমাজের বিবর্তন ঘটেনি। বরং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোই একসময় ফিরে গেছে পুঁজিবাদের পথে। মার্ক্স তার তত্ত্বের আলোকে আরো ভেবেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক বিল্পব পশ্চিমা অগ্রসর পুঁজিবাদি রাষ্ট্রগুলোতে আগে হবে – কারণ সে সমস্ত দেশেই ‘প্রলেতরিয়েতরা’ হবে ‘সবচেয়ে শোষিত’। কিন্তু অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশে যে আগে বিপ্লব হয়নি, কিংবা এখনো হচ্ছে না – তা বোধ হয় কাউকে আর বলে দিতে হবে না। মার্ক্স পুঁজিবাদী সমাজে মালিক আর শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যবর্তী মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বিকাশ দেখতে পাননি, নস্ট্রাডামুসের মত দিব্য দৃষ্টিতে দেখেছিলেন কেবল পুঁজিবাদের ‘অবশ্যাম্ভাবী পতন’। এগুলোর কোন কিছুতেই মার্ক্স সঠিক প্রমাণিত হননি। আমি আমার প্রবন্ধের আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যায় অন্ততঃ দশটি পয়েন্ট উল্লেখ করেছিলাম – কেন মার্ক্সিজমকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ মনে করি তা উল্লেখ করে। দুর্ভাগ্যক্রমে একটিরও সদুত্তর পাইনি।
মুশকিলটা হল, আজাহার সাহেবরা ধণতন্ত্রের কেবল ‘শোষণ’টাই দেখতে পান। যখন বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প গড়ে ওঠে, আর তার ফলশ্রুতিতে হাজারো জমিলা আমিনারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অর্থনীতির চাকা মজবুদ করেন, শুধু নিজের পরিবারের নয়,সেই সাথে দেশেরও; দেশে ধীরে ধীরে সংগঠিত হয় কর্মক্ষম নারীদের এক নিরব বিপ্লব – এর সুফলটুকু আজাহার সাহেবদের চোখে পড়ে না। তারা দেখেন কেবল পুঁজিবাদের লুন্ঠণ এবং শোষণ (দেখুন সত্যিকার একচোখা আসলে কে!)। একটি ‘সিলিকন ভ্যালি’ তৈরির পেছনে কি পরিমাণ মেধা, চিন্তা, সৃজনশীলতা আর সাহস কাজ করে তা তাদের মাথায়ই আসে না। তারা বোঝেন না একটি সিলকন ভ্যালি বিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিই কেবল বদলে দেয়নি, সেই সাথে বদলে দিয়েছে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের চিরায়ত ধারনাগুলোও। তারা সেসব কিছুর ধার দিয়ে যান না, তারা শুধু দেখতে পান এর পেছনে মালিক পক্ষের অব্যাহত শোষণ।
এর কারণ হল, কার্ল মার্ক্স পুঁজিবাদী সমাজের অস্তিত্বকে বিশ্লেষণ করেছিলেন শুধুমাত্র মুনাফাখোরদের দ্বারা শ্রমিক ঠকানোর মাজেজায়। শ্রমিকেরা কারখানায় যে পরিমাণ কাজ করে, সে তুলনায় নায্যমূল্য পায় না। এই ঠকানোর অংশটুকুই (সারপ্লাস) মূলতঃ মুনাফা হিসেবে মালিকদের পকেটে যায়। এটাই হল মার্ক্সের ‘থিওরী অব সারপ্লাস ভ্যালু’র মোদ্দা কথা। মালিকপক্ষের কাছে ‘মুনাফা অর্জন’ই যেহেতু মূখ্য, সেহেতু মালিকপক্ষ চাইবে কম মজুরীতে অনেক শ্রমিক নিয়োগ করে বেশি সময় ধরে তাদের খাটাতে। ফলে শোষণ বাড়তে থাকবে অব্যাহত গতিতে। এর ফলশ্রুতিতে মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে তৈরি হবে অনিরূপনেয় ‘ক্লাস টেনশন’-এর –যা পরিশেষে শ্রমিকদের বিপ্লবের পথে ঠেলে দিয়ে পুঁজিবাদের পতন ঘটাবে। যেহেতু অগ্রসর পুঁজিবাদী সমাজে মুনাফা বজায় রাখতে কারখানায় নতুন নতুন প্রযুক্তি আর যন্ত্রপাতির অন্তর্ভুক্তি ঘটবে; সে কারণে বহু শ্রমিক চাকরী হারাবে। আর অন্যদিকে ছোট খাট ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে প্রলেতারিয়েতদের খাতায় নাম লেখাবে। শেষ পর্যন্ত তারা চলে যাবে বিপ্লবে। সুতরাং অবশ্যাম্ভাবীভাবে সে সমস্ত অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশেই বিপ্লব হবে আগে, আর তরান্বিত করবে পুঁজিবাদের ধ্বংস।
দুর্ভাগ্যবশতঃ মার্ক্সের দেখানো পথে পুঁজিবাদের ধবংস হয়নি। এর কারণ অনেক। অর্থনীতির বাজার কেবলমাত্র মার্ক্স বর্ণিত ‘মুনাফা’র ভিত্তিতে চালিত হয় না, এর পেছনে আছে ‘সাপ্লাই এন্ড ডিমান্ডের’ মায়াবী লীলাখেলা! যখন কোন নতুন পন্যের একচেটিয়া বাজার শুরু হয় – ওই যে মনোপলি মার্কেটে – সেখানে কখনো সখনো মালিকের ইচ্ছেয় বাজার নিয়ন্ত্রিত হতে পারে বটে, তবে কিছু দিনের মধ্যেই অন্য প্রতিযোগীরা বাজারে প্রবেশ করায় সেই একচেটিয়া মুনাফা আর কারো পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয় না। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ীই বহু উৎপাদক নিজেদের নিয়োজিত করে একই ধরণের দ্রব্য উৎপাদনে। আর পারষ্পরিক প্রতিযোগিতার কারণে দ্রব্যের মূল্যও একটা সময় পর কমে আসবে। একটা সাধারণ উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিস্কার হবে। পারসোনাল কম্পিউটার (পিসি) যখন বাজারে নতুন এসেছিলো, তখন তার দাম ছিলো আকাশ ছোঁয়া। আর আজ পিসি এতটাই ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এসে গেছে যে, একেকজনের বাসায় দু’ তিনটি পিসিও বিরল নয়। আসলে মার্ক্স কথিত ‘সারপ্লাস ভ্যালু’ খুব একটা না বদলালেও বরং ‘সাপ্লাই-ডিমান্ডের’ মেকানিজমের কারণেই এটা ঘটেছে। উল্টোটাও সত্য হতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। একটা গাড়ি তৈরিতে ‘শ্রমের মূ্ল্য’ অনেক বেশি থাকে, তাই গাড়ির দাম একমন চালের চেয়ে বেশি হবে এটা ধরে নেয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভিক্ষের সময় সেই একমন চাল গাড়ির দামকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই দেখা যাচ্ছে চাহিদা-সরবরাহের গতিপ্রকৃতি শ্রমমূল্যকে অনেক সময়ই অতিক্রম করে যায়। কাজেই ‘সাপ্লাই-ডিমান্ড’ অস্বীকার করে শুধু ‘সারপ্লাস ভালু’ আর ‘শোষণ’ দিয়ে অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করলে তা কখনই সুবিবেচনাপ্রসুত হবে না। আমি সেজন্যই আমার প্রবন্ধে দেখিয়েছি যে, মার্ক্সের ইকোনমিক থিওরী অনেক সরল - সেই রিকার্ডোর 'লেবার থিওরী ভ্যালুর' উপর নির্মিত। আজকের সমাজ অনেক জটিল। আধুনিক অর্থনীতিতে মার্ক্সের তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘মার্জিনাল ইউটিলিটি’ তত্ত্ব দিয়ে। আসলে সাপ্লাই-ডিমান্ডের গানিতিক মডেল, গেম থিওরী, ট্রেন্ড এনালাইসিস, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত না করলে আজকের ‘গ্লোবালাইড ওয়ররল্ডের’ বাস্তবতা ঠিকভাবে উঠে আসবে না। এ প্রসঙ্গে আমি আলেকজান্দার সলঝনেৎসিনের মার্ক্সবাদ এবং সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে কয়েকটি লাইন ঊল্লেখ করেছিলাম –
‘Marxism, a primitive superficial economic theory, is not only inaccurate, not only unscientific, has not only failed to predict a single event in terms of figures, quantities, time-scales or locations (something that modern economic theory with complex mathematical model using computers today do with laughable ease in the course of social forecasting although never with the help of Marxism) -is absolutely astounds one by economic and mechanistic crudity of its attempts to explain the most subtle of creatures, the human beings, and that even more complex synthesis of millions of people of the society. Only the cupidity of some, the blindness of others, and a craving of faith on the part of still others can serve to explain this grim humor of the twentieth century.’
যারা বিভিন্ন জায়গায় আমার প্রবন্ধটির ‘সমালোচনা’ করেছেন, তারা কেউই আমার যুক্তি খন্ডন করতে পারেননি। এক ‘বামপন্থি ব্লগার’ এক ব্লগে যুক্তি খন্ডন করতে গিয়ে বললেন – ‘কুলাখপন্থী সোলঝনেৎসিনরে লইয়া আতিশয্য আমারে একটু আহত করে’। বললেন, ‘এইরম বিভ্রান্ত মানুষের বচনে যুক্তিবচন তৈরীকরণের প্রক্রিয়া। এই আচরণ একটা যুক্তিরে অবৈধ করে’। এটা কি রকম যুক্তি খন্ডন হল? সলঝনিৎসন কুলাখপন্থি কি স্টালিনপন্থি সেটা তো এখানে বিষয় নয়, বিষয় ছিলো মার্ক্সের অর্থনীতি বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারছে কিনা। মুল বিষয় হল ম্যাসেজের খন্ডন । সেরকম খন্ডন কি হয়েছে? বক্তার বক্তব্য খন্ডন না করে বক্তার পেছনে লেবেল এঁটে দিয়ে মুক্তি পারার চেষ্টা খুব পুরানো পদ্ধতি। এগুলো ধাপ্পাবাজি অনেক নতুন ব্লগারকে মুগ্ধ করলেও আমাকে করে না। কারণ আমি জানি এটা একটা ফ্যালাসি। এই ফ্যালাসির নাম - Circumstantial Ad Hominem । এই ফ্যালাসির গঠন নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
১। ‘কামাল’ নামক বক্তা কোন এক দাবী –‘দ’ উত্থাপন করল ।
২। ‘জামাল’ নামক বক্তা এসে ‘ক’ এর পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আক্রমণ শুরু করল
৩। অতএব দাবী ‘দ’ মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেল।
Circumstantial Ad Hominem একটি ফ্যালাসি এ কারণে যে, উপরের ‘জামাল’ নামক বক্তা ‘কামাল’ -এর যুক্তি খন্ডন না করে তার পারিপার্শ্বিকতাকে আক্রমন করেছে। এটা বুঝতে হবে, যে পারিপার্শ্বিকতার উপরে কিন্তু বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা নির্ভর করে না। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিস্কার হবে-
"Bill claims that 1+1=2. But he is a Republican, so his claim is false."
যে কোন ছোট বাচ্চাও উপরের ‘যুক্তি’ দেখে হাসবে। বিল রিপাবলিকান হলেই তার ১+১ =২ এর দাবী মিথ্যা হয়ে যায় না। বিলকে ভুল প্রামাণ করতে হলে তার যুক্তি খন্ডন করতে হবে। এখন উপরের উদাহরণে ‘Bill’-এর জায়গায় ‘সলঝনিৎসন’ আর Republican এর জায়গায় ‘কুলাখপন্থি’ বসালেই জামাল সাহেব বুঝতে পারতেন তার যুক্তির দুর্বলতা কোথায়।
দ্বিতীয়তঃ পুঁজিবাদী অর্থনীতির টিকে থাকার পেছনে মূল চালিকা কেবল ‘শোষণ’ ভেবে বসে থাকলে ভুল হবে। ‘সিলিকন ভ্যালি’র উদাহরণ আগেই দিয়েছি। সিলিকন ভ্যালির স্থায়িত্বের পেছনে যতটা না শোষন আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে সৃজনশীলতা, ইনোভেশন, মেধা, রিস্ক এবং প্রতিযোগিতা করে সফল হবার আগ্রহ। এ বৈশিষ্ট্য গুলোই আসলে ধনতন্ত্রের মুল যোগান – যা সিস্টেমকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রেখেছে, তা সমাজতন্ত্রীরা বসে বসে যতই গাল পাড়ুক না কেন। বস্তুতঃ এই ইনোভেশন এবং প্রতিযোগিতাকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রত্রু বানিয়ে ফেলায় সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব হয়ে পড়েছিলো স্থবির। আর তারপর তা একদিন বালির বাধের মত ধ্বসে পড়ল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য যে, পতনের আগ পর্যন্ত তারা তাদের সিস্টেমকে ‘বৈজ্ঞানিক’ বলে ভাবতেন (তাদের ক্ষয়িষ্ণু অনুসারীরা এখনো তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন)। রামসের একটি উক্তি মনে পড়ছে –
The chief danger to our philosophy, apart from laziness and woolliness, ... is treating us what is vague as if it were precise....
তৃতীয়তঃ সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিগুলো শ্রমিক-মালিকের সম্পর্কের চিরায়ত ধারনাই পালটে দিয়েছে – তা আমার প্রবন্ধে খুব ভালভাবেই আমি দেখিয়েছি। বলেছি, পশ্চিমা বিশ্বে ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করার ফলে শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ কায়িক শ্রম দানের পরিবর্তে বুদ্ধিজনিত শ্রমদান (মেন্টাল লেবার) করছে এবং তারাই মধ্যবিত্তসূলভ জীবন জাপন করছে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বুদ্ধিমত্তা ও মানসিকতা আপামোর জনগণের কাছে সাধারণ মানদন্ড হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং সমাজে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হবার মধ্য দিয়ে তাদের স্বার্থ অনুযায়ী সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশের বামপন্থি ব্লগাররা এই বাস্তবতাকে এখনো অস্বীকার করে বালিতে মুখ গুঁজে রয়েছেন, আর নিজেদের বিশ্বাসকে ‘মার্ক্সীয়’ ছাঁচে ফেলতে পশ্চিমের মধ্যবিত্ত শ্রেনীকেই পুরোপুরি গায়েব করে দিয়েছেন। এটাই সমস্যা। তারা ভাবছেন তাদের ওই লাল বইগুলোতে যে ভাবে লেখা আছে তার বাইরে গাছের পাতাটাও নড়বে না। লাল বইয়ে লেখা আছে- দ্য ল অব ইনক্রিজিং মিজারী অনুযায়ী আমেরিকার মত পুঁজিবাদী সমাজে ক্লাস পোলারাইজেশন বাড়বে, মধ্যবিত্ত শ্রেনী সংকীর্ণ হয়ে প্রলেতারিয়েতে এসে বিলীন হয়ে যাবে, আর শেষ-মেষ যাবে বিপ্লবের পথে। শ্রমিক শ্রেনীর এই বিপ্লব নাকি অবশ্যাম্ভাবী। বাস্তবে সেরকমটি না ঘটলেও বাস্তবতাকে লাল বইয়ে বর্ণিত তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে তারা আপেলকেও কমলা বানিয়ে ফেলতে চান, গায়েব করে দিতে চান পুঁজিবাদী বিশ্বের লক্ষ কোটি মধ্যবিত্তের বাস্তব অস্তিত্ব। কিন্তু লাল বই গুলো পাশে সরিয়ে তারা যদি অন্ততঃ আমেরিকার নির্বাচনটা ঠিকমত পর্যবেক্ষণ করতেন, তাহলেই তাদের অসারতা বুঝতে পারতেন। এবারকার নির্বাচনে মধ্যবিত্তের চাহিদা পূরণ একটা বিরাট ফ্যাক্টর। সে জন্যই ওবামা ৯৫% ভাগ মধ্যবিত্তের জন্য ট্যাক্স কাটের কথা রোজই ফলাও করে প্রচার করে। ম্যাকেইন নির্বাচনের শেষ বিকেলেও ‘জো-দ্যা প্লাম্বার’-এর ট্যাক্স নিয়ে সোরগোল করে। আর ওদিকে লাল বই পড়া মার্ক্সিস্টরা ‘মধ্যবিত্ত’ বলে কিছু খুঁজেই পান না। বিশ্বাসের কি অপার মহিমা!
চতুর্থতঃ মার্ক্স যেভাবে ভেবেছিলেন – পুঁজিবাদী সমাজে অব্যাহত শোষণ বাড়বে, আর পাল্লা দিতে বাড়তে থাকবে শ্রমিকের দুর্ভোগ। কিন্তু অগ্রসর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে বাস্তবতা অনেকাংশেই বিপরীত। বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী বা শ্রমিকেরা আজ কোম্পানির স্টক কিনতে পারছে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে তারা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে অনেক ভালভাবে - পুঁজিবাদী সমাজেই। পুঁজিবাদী সমাজের বিবর্তন হিসেবে আমরা সুইডেন, নরওয়ে, ক্যানাডার মত ‘ওয়েল ফেয়ার স্টেটও দেখেছি – যা শ্রমিকদের জীবন এবং মান নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি চাকরী চলে গেলে পর্যাপ্ত ভাতা পর্যন্ত দেয় বছরের পর বছর, রাষ্ট্র সেখানে নিজ উদ্যোগে বৃদ্ধ, পঙ্গু, অক্ষম এবং বিকলাঙ্গদের দেখভাল করে। একারণেই ডঃ রুপার্ট উডফিন বলেন –
‘Marx assumed that 19th century laissez-faire capitalism, with individuals and families owning whole enterprises, would continue. He did not anticipate that middle classes, who he thought to be crushed out of existence by the two of the monolithic classes of capital and labor, would in fact grow from strength to strength. Thanks to the introduction of the joint stock company, many people can become co-workers, often through third parties such as pension funds or saving schemes. Increasing numbers of shareholders have an interest in preserving capitalism. Other became managers, paid by shareholders to manage their investment. The later group, far from joining the proletariat as Marx expected, felt superior to the class from whence they had been drawn.
The concentration of capital does lead to the 'collectivization' of workers. But, against Marx’s prediction, it allowed workers to form their own associations – Trade Unions. Trade unionism is not dedicated to overthrowing the system, but to improving wages and conditions. The political philosophy of ‘welfare state’ social democracy grew powerful in 20th century. So much for Marx’s idea of government only ever serving the interest of rich! ’।
এমনকি আমেরিকার মত ‘খচ্চর’ দেশেও ওবামার ‘ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার’ নির্বাচনের একটা বড় ওয়াদা। এ সমস্ত দেশে শ্রমিকেরা আর তাই সেই পুরোনো যুগের বিপ্লবের জন্য বসে নেই। মার্ক্স যেখানে ধারনা করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজে অমানবিকতা ক্রমান্বয়ে বাড়বে, নিপিড়ন আর শোষন বাড়বে - সেখানে পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাওয়া যাবে – এ সমস্ত পুঁজিবাদী সমাজে বহুদিন ধরেই শিশুশ্রমকে অবৈধ করা হয়েছে, সামাজিক বৈষম্যকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, শ্রমিকদের গুনগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে, কায়িক শ্রম এবং দৈনিক শ্রমের সময় কমে এসেছে, মজুরী, ভাতা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধা অনেক বৃদ্ধি পেয়ছে, নারীরা বাইরে কাজ করছে। পার্কেস সেই ষাটের দশকেই বলেছিলেন –
‘Low wages, long hours and child labor have been characteristic of capitalism not, as Marx predicted, in its old age, but in its infancy’
পুজিবাদকে যে সমস্যা পোহাতে হয় না তা নয়। ভালই হয়। এই তো এখন আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুঁজিবাদের বিপর্যয়ই বটে। ফেনি মে, ফ্রেডী ম্যাক, লেহম্যান ব্রাদার্স, মেরিল লিঞ্চ, ওয়াসিংটন মিউচুয়াল আর ওয়াকোভিয়ার কথা তো সবারই জানা। পরিস্থিতি সামলাতে সরকারকে ‘বেইল আউট’ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হয়েছে। এতে অনেকে ‘সমাজতন্ত্রের আজান’ শুনলেও আমার তা মনে হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে রাষ্ট্র এখানে নিজেই একটা ব্যবসায়ী পক্ষ সেজে বাজারকে সহযোগিতা করছে - নিজেই বাজারে চলনসই পুঁজির যোগান দিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাটিকে টিকেয়ে রাখছে। একে আর যাই হোক “সমাজতন্ত্রের আজানের” সাথে তুলনা করা যায়না। পুঁজিবাদ স্বীয় বৈশিষ্ট্যেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজেকে অভিযোজন করে টিকে থাকতে পেরেছে দীর্ঘদিন ধরেই, পার করেছে মহামন্দা, পার করেছে বিশ্বযুদ্ধ। এই বিবর্তন অস্বীকার করে গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলে আর হেকে হেকে ‘পুঁজিবাদ মুর্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়ে ব্লগ কাঁপিয়ে এর পতন দাবী করা বোকামিই। ইন্টারনেটের আধুনিক যুগে এখন আর ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান পুরোন নিয়মে চলে না। জিনিসপত্র এখন অনেক জটিল এবং গ্লোবাল। এখানে ব্যাবসার মালিক, শ্রমিক এবং কজুমাররা সকলেই নিজ স্বার্থ আদায়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে এক ধরনের ‘উইন-উইন’ ক্ষেত্র তৈরি করে অনেক ক্ষেত্রেই। ‘আর্নল্ড ব্রাউন সম্প্রতি তার “দ্য কনজুমার ইজ দ্য মিডিয়াম’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, কনজুমাররা ভবিষ্যতে সিইও-র মত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে। এই ট্রেন্ড না বুঝে কেবল পুরোনো লাল বইগুলো থেকে তুলে তুলে বস্তা-পচা উদ্ধৃতি আর আদর্শ কপচিয়ে সমাজকে আর ব্যাখ্যা করা যাবে না।
আজাহার সাহেব আবেগময় ভাষায় আমাকে জ্ঞান দিয়েছেন মার্ক্সিজমকে ‘পুরোপুরি বাতিল’ করা আমার উচিৎ হয়নি। তিনি রুশোর দৃষ্টান্ত হাজির করেছেন এ প্রসঙ্গে। বলেছেন, ‘রুশো মানুষ সম্পর্কে যে বিশুদ্ধতাবাদী ধারণা উপস্থিত করেছিলেন সেটা কি ভুল ছিল না?... আর ভুল বলে তার সবটাই ভুল এ কথা কি বলা যাবে?’। এর উত্তরে আমি বলব, ‘পুরোপুরি বাতিলের’ কথা আসছে কেন? কোন কিছুর সমালোচনা করা মানেই সেটাকে স্রেফ ‘নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলা’ ভাবলে ভুল হবে। আমি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুরোধা এরিস্টটল সম্পর্কে পেট্রাস রেমাসের মন্তব্য –‘এরিস্টটল যা শিখিয়েছিলেন তা সবই মিথ্যা’। পেট্রাস রেমাসের কথাটি অনেকের কাছে অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে, কিন্তু বার্ট্রান্ড রাসেল তার ‘History of Western Philosophy’ বইয়ের ব্যাখ্যা পর হয়ত অনেকেরই তা মনে হবে না, যেখানে রাসেল দেখিয়েছেন এরিস্টটল পরবর্তী বিজ্ঞানের ইতিহাস মূলত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে এরিস্টটলের মতবাদকে উৎখাত করার ইতিহাস –
‘Ever since the beginning of the seventeenth century, almost every serious intellectual advance has had to begin with an attack on some Aristotelian doctrine; in logic, this is still true at the present day.’।
এমন নির্দয় সমালোচনার পরও কি হলফ করে বলা যাবে, ইতিহাসে এরিস্টটলের কোন স্থান নেই? তার নাম কি ইতিহাস থেকে মুছে গেছে? না যায় নি। মার্ক্সের কথাও একই ভাবে বলা যায়। আমি সমালোচনা করি আর নাই করি, মার্ক্সের একটি আলাদা আসন ইতিহাসে সবসময়ই থাকবে। তারপরও আজাহার সাহেবকে বুঝতে হবে, একাডেমিয়ায় কারো তত্ত্ব কিংবা প্রতিটি বাণীকে ‘পবিত্র জ্ঞানে’ পুজা করা হয় না। একাডেমিয়ায় কোন ‘ধর্মগুরু’ বা ‘পয়গম্বর’ নেই। এখানে নতুন নতুন জ্ঞানের আলোকে প্রতিদিনই বিভিন্ন তত্ত্বের সমালোচনা করা হয়, সমালোচনা হয় বিভিন্ন মতাদর্শের – তা সেই মতাদর্শ মার্ক্সেরই হোক, এরিস্টটলেরই হোক, রুশোরই হোক, কিংবা হোক রবীন্দ্রনাথের। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ডঃ হুমায়ুন আজাদ তার নারী বইয়ে নির্দয়ভাবে সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্র-ভাবধারার। বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ, যাকে মনে করা হয় নিজের সময়ের থেকে অনেক অগ্রসর, আসলে পিছিয়ে ছিলেন নিজের সময়ের চেয়ে হাজার বছর।’ ডঃ আহমদ শরীফ তার ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ নামক গ্রন্থে ব্যক্ত করেছিলেন কাঙাল হরিনাথের উপর ঠাকুরবাড়ির আক্রোশের কথা; অধ্যাপক আবুল হাসান চৌধুরীর পত্র উল্লেখ করে ডঃ আহমদ শরীফ জানিয়েছিলেন, শিলাইদহ জমিদারীতে চরের মুসলমান প্রজাদের ঢিঁঢ করবার জন্য নমঃশূদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্প্রদায়িক-বুদ্ধি যে রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল, তা প্রকাশ করেছিলেন (সে সমস্ত কিছু প্রবন্ধ আমাদের মুক্তমনা সাইটেও রাখা আছে –‘Tagore without Illusion’ দ্রঃ।) রবীন্দ্র সমালোচনায় অতীষ্ট হয়ে কোন কোন রবীন্দ্র-পুজারী নিশ্চয় তখনো আজাহার সাহেবের মত হাহাকার তুলে বলেছিলেন – ‘রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ভাল কিছু কি ডঃ হুমায়ুন আজাদ আর আহমদ শরীফেরা দেখেন না?’ নিঃসন্দেহে হুমায়ুন আজাদ বা আহমদ শরীফেরা রবীন্দ্র মতাদর্শের ভাল দিকগুলো সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তারপরও তারা সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের – কারণ, রবীন্দ্রনাথের সকল বানী ধ্রুব সত্য নয় কিংবা তাঁর মতাদর্শকে পুজা করার কিছু নেই। মূলতঃ, হুমায়ুন আজাদ এবং আহমদ শরীফদের সমালোচনাই পরবর্তীতে তৈরি করেছিলো নতুন জ্ঞানের ক্ষেত্র, খুলে দিয়েছিলো রবীন্দ্র মানসের নতুন এবং অজানা দুয়ার।
কাল মার্ক্স সম্বন্ধেও সেটি বলা যায়। তাই মার্ক্সকে ‘উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেও আমি সমালোচনা শুরু করেছি এই বলে, ‘তারপরও কিছু জিনিস আমাদের সবসময়ই মাথায় রাখতে হবে। মার্ক্সের প্রতিটি কথাই কিন্তু অভ্রান্ত নয়।’ এটা তো ঠিক কথাই- মার্ক্সের তত্ত্বের নানা অসঙ্গতির সমালোচনা বহুদিন ধরেই হচ্ছে একাডেমিয়ায়। যেমন, পশ্চিমে যখন মার্ক্সের বহুল প্রত্যাশিত ‘ইনএভিটেবল রিভলুশন’ হল না, তখন মার্ক্সের তত্ত্বের অসঙ্গতি খুঁজতে এন্টোনিও গ্রামসি হেজিমনি (Hegemony) তত্ত্বের অবতারণা করেন। তিনি তার তত্ত্বে দেখান যে, শুধুমাত্র শ্রেনী সংগ্রামকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মার্ক্স সাংস্কৃতিক বিবিধ উপাদানই অস্বীকার করেছেন। মার্ক্সের এই ভ্রান্তি তাকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছিলো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদের (economic determinism) দিকে। গ্রামসি দেখান যে, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং বাহ্যিক শক্তি (economic and physical force) সামাজিক পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়, সাংস্কৃতিক উপাদানকে গোনায় ধরা অপরিহার্য। এরপর ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সাথে যুক্ত পোস্ট মডার্নিস্ট চিন্তাবিদেরা – এডোর্নো, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মার্কুস, ম্যাক্স হর্কেইমার, জার্গেন হ্যাবারম্যাস সহ অনেকেই মার্ক্সবাদের ‘ভবিষ্যদ্বানী’র ব্যর্থতার পেছনে অভিযুক্ত করেন সংস্কৃতিকে গুরুত্ব না দেওয়াকে। এডোর্নো তো স্পষ্ট করেই বলেন – ‘Marx’s failure to see this arose because of his failure to take culture seriously’। লুইস এলথুজার আবার মার্ক্সের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাবাদকে বাতিলের পাশাপাশি মার্ক্সের ‘হিউম্যানিজম’কেও প্রত্যাখ্যান করেন যা সূচিত করে মার্ক্সের অপরিহার্যতাবাদের (Marx’s essentialism) বিনাশ।
মোটা দাগে সনাতন মার্ক্সবাদীরা বিপ্লবকে যে ‘নিশ্চয়তাবাদের’ মোড়কে পুরে রেখে ‘অবশ্যাম্ভাবী’ বলে ভাবতেন, যেভাবে সমাজকে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্র, আর সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদের দিকে ধাবমান হিসেবে দেখতেন, পোস্ট মডার্নিস্টরা সমাজের সেরকম কোন প্যাটার্ন দেখেন না। তারা আজ সমাজকে দেখেন বিভিন্ন সঙ্ঘাত বা ‘এন্টাগনিজম’ এ সমৃদ্ধ বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের সমাবেশে ভরপুর এক জটিল সিস্টেম হিসেবে। মার্ক্সের ‘দ্বান্দ্বিকতা’র বদলে সমাজের চালিকা শক্তি তাদের কাছে ‘এগ্নোস্টিক প্লুরালিজম’। আর ছোটবেলার গরু রচনার মত শুধু শ্রেনী দিয়েই সবকিছু ব্যাখ্যা করার প্রবণতাও বাতিল হয়েছে। মার্ক্স যেভাবে একসময় বলেছিলেন – ‘মানুষের ইতিহাস হচ্ছে শ্রেনীসংগ্রামের ইতিহাস’, সেটি সার্বিকভাবে সত্য নয় বোঝা গেছে। শ্রেনী ছারাও ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত বিভিন্ন সঙ্ঘাত আছে। ইতিহাসে ঘটা ব্যাপক আকারে ধর্মযুদ্ধগুলোই তো মার্ক্সের অনুকল্প - ‘ইতিহাস হচ্ছে শ্রেনীসংগ্রামের ইতিহাস’-এর বিপক্ষে রায় দেয়। আমি আমার মূল প্রবন্ধের আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম - 'ক্লাস' বা শ্রেনীকে এখন কোন বেসিক ইউনিট হিসেবে দেখা হয় না। একই ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিভিন্ন মানুযের চাহিদা এবং সংগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন হয় তা দেখা গেছে। আবার সঙ্ঘাত বা কনফ্লিক্ট – যাই বলা হোক না কেন - এগুলো একই মানুষে অবস্থাভেদে পরিবর্তিত হয়। যেমন, আমেরিকার একজন 'ব্ল্যাক ওয়ররকিং ক্লাস ওম্যান' এর উদাহরণ দিয়েছিলাম। এর মধ্যে এন্টাগনিজম তিনটি – ব্ল্যাক, ওয়ররকিং ক্লাস, এবং ওম্যান। কোন এন্টাগনিজম যে অন্যটার চেয়ে যে কম গুরুত্বপূর্ন তা বলা যায় না। যেমন একই শ্রেনীগত অবস্থায় থাকার পরও চাহিদা, পছন্দ এবং বিভিন্ন অপশন যাচাই বাছাই এর ধরণ ধারন এবং সিদ্ধান্ত অবস্থাভেদে পরিবর্তিত হয়। একই ওয়ররকিং ক্লাসে থাকার পরও কোন ব্ল্যাক ওম্যান হয়ত ওবামার দিকে ঝুকে, কেউবা হিলারীর দিকে, কেউবা ম্যাকেইনের দিকে - কোন্ এন্টাগোনিজম কখন কার কাছে বড় হয়ে উঠে তার উপর ভিত্তি করে - অনেকাংশেই আবার ওগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। এ ধরনের এন্টাগোনিজমের আরো উদাহরণ দেয়া যায়। আজকের ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ এর যুগে পরিবেশ সচেতনতা একটি বিরাট ইস্যু। ধরা যাক কোন দেশে একটি কারখানায় ৫০০০ শ্রমিক কাজ করছে। কিন্তু কারখানাটি নিউক্লিয়ার বর্জ্য তৈরি করে প্রতিবছর পরিবেশের নিদারুণ ক্ষতি করে চলেছে। এলাকার মানুষজন রোগাক্রান্ত হচ্ছে। এখন কারখানাটির ভবিষ্যত নিয়ে দুজন সোশ্যালিশট কমরেড দুটো ভিন্ন মত দিতে পারেন, কার কাছে কোন্ এন্টাগোনিজম বড়, তার উপর ভিত্তি করে। যে সোশালিস্ট কমরেডটি পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত সে হয়ত কারখানা বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে রায় দেবে। আর যে সোশালিস্ট কমরেডটি কারখানার শ্রমিকদের চাকরী নিয়ে বেশি চিন্তিত, সে হয়ত কারখানা চালু রাখার পক্ষে রায় দেবে। এমন নয় যে দুজন কমরেড পরিস্থিতির জটিলতা বুঝতে পারছেন না, বরং তারা ব্যাপারটি পুরোপুরি বুঝেই নিজ নিজ এন্টাগনিজমের প্রাবল্য এবং গুরুত্বের ভিত্তিতে বিপরীতধর্মী সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন। এন্টাগনিজমের সঙ্ঘাত কিংবা মিল আধুনিক জটিল সমাজে একই শ্রেনীর অথবা একই ভাবধারার বিভিন্ন মানুষের মধ্যে তৈরী করে কখনো শত্রুতা, কখনো বা তাদের বানায় ‘স্ট্রেঞ্জ বেডফেলো’। মার্ক্স এই সমস্ত জটিলতাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করেননি। আর তা ছাড়া মার্ক্সের তত্ত্বে যে ফলসিফায়াবিলিটির অভাব ছিলো, সমস্যা ছিলো ফলসিফিকেশনের ক্ষেত্রেও তা আগেই দেখিয়েছি। মার্ক্স সমাজের বিবর্তনের নিশ্চয়তাবাদী এক প্যাটার্ণ হাজির করেছিলেন, যা আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতার সাথে মেলেনি। আমি সামাজিক বিবর্তনকে জৈববিবর্তনের সাথে মেলাতে চাই না, তবুও এক্ষেত্রে একটি এনালজি দেখাতে বাধ্য হচ্ছি। জৈববিবর্তনের ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যা আর প্যাটার্ণ আমদানীর কারণে ল্যামার্কিজম যেমন অপাংক্তেয় হয়ে গেছে (বিবর্তন বিজ্ঞানের ইতিহাসে ল্যামার্কের অসামান্য অবদান থাকা সত্ত্বেও), তেমনি সামাজিক বিবর্তনের তাত্ত্বিক আলোচনাতেও মার্ক্স আজ দাঁড়িয়ে আছেন ল্যামার্কের কাছাকাছি জায়গাতেই। বস্তুতঃ পশ্চিমে মার্ক্সের দেখানো পথে ‘অবশ্যাম্ভাবী’ বিপ্লব না হওয়া এবং রাশিয়া এবং চীন সহ পুর্ব ইউরোপের দেশগুলোর রাতারাতি কমিউনিজমের পতনের পর মার্ক্সিজমের ব্যাবহারিক ব্যার্থতাকে দিনের আলোর মতই স্পষ্ট করেছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে মার্ক্সিজমের মূল ‘বৈজ্ঞানিক’ নীতি গুলোকেই।
আজাহার সাহেব তার শেষ হাতিয়ার হিসেবে ‘বিপ্লবের মাহাত্ম্য’কে পুঁজি করেছেন। বিপ্লবের মাহাত্ম্য দিয়েই তিনি মার্ক্সবাদকে বৈধতা দিতে চান - অনেকটা ডুবন্ত মানুষ যেমন খড় কুটো আঁকরে ধরেন - সেরকম। আর তা করতে গিয়ে আমাকে বানিয়েছেন ‘বিপ্লবের শত্রু’। নিজের আবেগের আবেদনকেই ভেবে নিয়েছেন অভ্রান্ত যুক্তি, যদিও এ ধরণের (কু)যুক্তি হাজির করে দর্শনের ভাষায় হয়েছেন ‘Appeal to Emotion’ নামক ফ্যালাসির শিকার। আসলে আজাহার সাহেব ভুলভাবে ভেবে নিয়েছেন যে, আমি বোধ হয় সর্বক্ষেত্রেই বিপ্লবের বিরোধিতা করেছি। না তা করিনি। আমি ব্রিটিশ শাসনামলে সন্ন্যাস বিদ্রোহ, বারানসী বিদ্রোহ, ওহাবী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, মোপলা বিদ্রোহ, পাবনার কৃষক বিদ্রোহ, দাক্ষিনাত্যের কৃষক বিদ্রোহ, মাদ্রাজের রূম্পা বিদ্রোহ, উরিষ্যার খোন্দ বিদ্রোহ, বীরসা ভগবানের নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ সহ আরো অনেক বিদ্রোহের উদাহরণ নিজেই আমার প্রবন্ধে হাজির করেছি। বলেছি কানসাট (২০০৬ সালের এপ্রিলে কানসাট বিদ্রোহের পর আমি নিজ উদ্যোগে একটা সাইটও করেছিলাম) আর ফুলবাড়ির কথা। কিন্তু বিপ্লবের মাহাত্ম্য অস্বীকার না করেও বলা যায় বিপ্লব মানেই মার্ক্সবাদী বিপ্লব নয়। মার্ক্স তত্ত্ব দেওয়ার আগেও বিপ্লব হয়েছে, পরেও হয়েছে। এমনকি কমিউনিজমের পতনের পরও সময়, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন বুঝে বিপ্লব হচ্ছে। অধিকার আদায়ের দাবী মানুষের মজ্জাগত। আজাহার নিজেই স্পার্টাকাসের উদাহরণ দিয়েছেন। আরো উদাহরণ দেয়া যায়। একসময় নারীদের ভোটাধিকার ছিলো না, তারা আন্দোলন, বিদ্রোহ করে ভোটাধিকার আদায় করেছে। এক সময় কালোমানুষদের অধিকার ছিলো না কোন সাদা চামড়ার মানুষের পাশে বসে যানবাহনে চলাচলের কিংবা একই রেস্তারায় বসে খাবার খাওয়ার। তারা একটা সময় সে অধিকার আদায় করেছে নিজেদের প্রয়োজনেই। মার্টিন লুথার কিং কিংবা রোসা পার্ক্সের মত নেতারা মার্ক্সিস্ট ছিলেন না, কিন্তু তারা অধিকার আদায়ের দাবীতে নেতৃত্ব দিতে পারেছিলেন। নব্বইয়ে গণ-অভুত্থানে এরশাদের পতন কি মার্ক্সবাদী আন্দোলনের ফসল ছিলো? একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম কি কোন শ্রেনী সংগ্রামের ফসল ছিলো? কিছু উপাদান প্রচ্ছন্ন ভাবে থকেলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সার্বিকভাবে কোন মার্ক্সীয় সংগ্রাম ছিলো না, ছিলো আমাদের অধিকারের লড়াই। সে জন্যই একাত্তরে নেতৃত্বে ছিলো আওয়ামিলীগের মত মধ্যপন্থি একটি দল। আজকে সারা বিশ্ব জুড়ে সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে কোনভাবে মার্ক্সিস্ট আন্দোলন বলা যায়? যায় না। আসলে আজকের বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যাই স্থানীয়। স্থান, কাল, পরিবেশ এবং সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাধান আসছে। কোথাও কোথাও বিপ্লবীরাও ক্ষমতায় যাচ্ছে – নেপালে কিংবা ভেনিজুয়েলায় – কিন্তু মার্ক্সীয় বিপ্লবের বদলে শেষ পর্যন্ত ‘পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতেই নির্বাচিত হয়ে। মার্ক্সের তত্ত্ব আগা-গোঁড়া মেনে সেই সনাতন বিপ্লব হচ্ছে – তা মোটেই বলা যাবে না। আবার কোথাও কোথাও বিপ্লব খুব বাজে ভাবেও শেষ হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। কখনো বা বিপ্লব করতে গিয়ে উলটো প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ভারতে নকশাল কিংবা বাংলাদেশে ‘সর্বহারা পার্টি’র অব্যাহত সন্ত্রাসের কথা বলা যায়। কাজেই আজাহার সাহেবের ‘বিপ্লবের অ্যাপিল’ সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমি সার্বিকভাবে বিশ্বজুড়ে মানুষের অধিকার আদায়ের দাবী অবশ্যই সমর্থন করি, কিন্তু সেজন্য আমাকে মার্ক্সিস্ট হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। আজাহার সাহেব তার লেখায় বলেছেন, শোষকের রক্তচক্ষু থেকে মুক্তির কোন সমাধান দেইনি, কেবল কমিউনিজমের খুঁত ধরেছি। তার মতে আমি আমার লেখায় শেষ পর্যন্ত ‘শোষণের স্থিতাবস্থা’ বলবৎ রাখার পক্ষেই কথা বলেছি। আসলে আজাহার সাহেব আমার অবস্থান মোটেই বুঝতে পারেননি। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা করা আর কমিউনিস্ট বনে যাওয়া এককথা নয়। কমিউনিস্ট না হয়েও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা করা যায়। পশ্চিমা বিশ্বে নোয়াম চমস্কি, এডওয়ার্ড সাঈদ, তারিক আলী, রবার্ট ফ্রিস্ক সহ অনেকেই সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করেন, কিন্তু কমিউনিজম প্রমোট করেন না। আমি নিজেও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের উপর এন্তার লিখেছি (আপনি ইচ্ছে করলে পড়তে পারেন ‘অলস দিনের ভাবনা’ নামের এই প্রবন্ধটি, কিংবা সিতাংশু গুহকে দেওয়া আমার সাম্প্রতিক উত্তরটি। এ ধরনের আরো লেখা আমাদের মুক্তমনা সাইটটি খুঁজলেই পাবেন)। আমি যদি সাম্রাজ্যবাদের দোসর হতাম তবে নিজ থেকে ‘এশিয়া এনার্জির’ কুকীর্তির উল্লেখ করতাম না আমার প্রবন্ধে। আমি নিজেকে মানবতাবাদী বলে মনে করি। যে কোন মানুষের মৃত্যু আমাকে আহত করে, ব্যাথিত করে - তা সে সাম্যবাদের নামেই হোক, আর পুঁজিবাদের নামেই হোক। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আজাহার সাহেবরা কমিউনিজম বন্দনায় আর সাম্রাজ্যবাদের নিন্দায় যতটা অন্তপ্রাণ ঠিক ততটাই নিরব থাকেন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার নামে সারা দুনিয়া জুড়ে লক্ষ কোটি মানুষের মৃত্যুতে। আমি আমার প্রবন্ধে রেফারেন্স সহ উল্লেখ করেছি যে, কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে ২ কোটি লোক, সাড়ে ৬ কোটি লোক চীনে, ১০ লাখ লোখ ভিয়েতনামে, ২০ লাখ লোক উত্তর কোরিয়ায়, ২০ লাখ লোক কম্বোডিয়ায়, ১০ লাখ লোক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে, দেড় লাখ লোক পূর্ব ইউরোপে, ১৭ লাখ লোক আফ্রিকায়, ১৫ লাখ লোক আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনামলে নিহত হয়। এছাড়া ক্ষমতার বাইরে থাকা 'সর্বহারা বাহিনী', 'নকশাল' টাইপের দলগুলোর কমিউনিস্ট মুভমেন্টে সাড়া দুনিয়া জুড়ে মারা গেছে অন্ততঃ ১০ হাজার মানুষ। এতগুলো মানুষের প্রাণ কি সব বানের জলে ভেসে এসেছে? এদের জন্য আপনাদের কখনোই উৎকন্ঠা প্রকাশ করতে দেখা যায় না, দেখা যায় না কোন কৈফিয়ৎ দিতে। আপনারা এই সংখ্যা নিয়ে চিন্তিত নন; কারণ, এই লক্ষ-কোটি মানুষের মৃত্যু তো ভাল উদ্দেশ্যে – ‘সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য’। ঠিক একইভাবে বিন লাদেনের অনুসারীদেরও কোন কষ্ট হয়না, বুক কাঁপে না ইসলামের নামে মানুষ হত্যায়, কিংবা ৯/১১-এর মত বিভৎস ঘটনা ঘটাতে। কারণ তারা 'ইসলাম কায়েমের' জন্য লড়ছে। সারা বিশ্ব জুড়ে ‘ইসলাম কায়েম’-এর চেয়ে ভাল কাজ আর কী হতে পারে। তাই না? একই ধরনের মনোভাব আমি দেখেছি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের আচরণেও। তারা ইরাকের উপর নগ্ন হামলা আর সেখানে লক্ষ লোকের মৃত্যুকে স্রেফ বৈধতা দিতে চান এই বলে – ‘আমেরিকা সেখানে গণতন্ত্র কায়েম করে দেবে’। এভাবেই আদর্শবাদের নামে হত্যা, ধ্বংস ও আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে যুগে যুগে। অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের একটি চমৎকার প্রবন্ধ আছে মুক্তমনায় – ‘আদর্শবাদ ও মানুষের সংকট’ শিরোনামে। প্রবন্ধকার দেখিয়েছেন, আদর্শবাদ কিভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আর মানবিকতাবোধকে পঙ্গু করে ফেলে। নিজ নিজ আদর্শ রক্ষা করতে গিয়ে তখন লক্ষ কোটি মানুষের মৃত্যু তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচিত করে না। তারা হয়ে পড়ে আদর্শ রক্ষার মৌলবাদী সৈনিক। আদর্শবাদকে ড.গোলাম মুরশিদ দেখেছেন আধুনিক সভ্যতার সম্ভবতঃ সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে। আদর্শবাদ আঁকড়ে না থেকে তাকে বরং সমালোচনার দৃষ্টিতে গ্রহণ করাই হতে পারে আজাহার সাহেবদের জন্য আজ সংকট থেকে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ।
আজাহার সাহেব আজকের যুগে মার্ক্সের মূল অর্থনৈতিক বা সামাজিক তত্ত্বের প্রায়োগিক ব্যার্থতা উপ্লব্ধি করে এখন শুধু এশিয়া এনার্জির মত রক্তশোষকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেই মার্ক্সবাদের সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত করতে চান। তাতে অবশ্য আমার আপত্তি নেই। এ প্রসঙ্গে দেরিদা তো স্পষ্ট করেই বলেন, ‘What is left to Marxism to offer organized resistances to sate power and global capitalist economics?’। আমি তো নিজেই আমার প্রবন্ধে খুব ভাল ভাবেই বলেছি – বঞ্চিত মানুষের অধিকারের প্রতি সচেতন হওয়া, দুঃস্থ, নিপীড়িতদের পাশে এসে দাঁড়ানো –এটা মার্ক্সিজমের চর্চার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়। আমার মনে হয় মার্ক্সিজমের এই পরিবর্তন – ‘সায়েন্টিফিক সিস্টেম থেকে মরাল সিস্টেমে’ উত্তরোনের ব্যাপারটা আজ সকল মার্ক্সিস্টদের মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। সেজন্যই আমি আমার মূল প্রবন্ধ শেষ করেছিলাম এই বলে – ‘মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান হবার তার দরকারও নেই। কিন্তু মার্ক্সবাদ থাকুক হাজারো নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে’। আজাহার সাহেব যদি বিবিধ বিশেষণে সজ্জিত করে আমার প্রতি আক্রমণাত্মক না হয়ে সমাজতন্ত্রের পতনের কারণগুলো অনুসন্ধাণ করতেন, যদি ঠান্ডা মাথায় খোঁজ করে দেখতেন সভ্যতার বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে সমাজতন্ত্র কেন বিপন্ন প্রজাতির প্রাণির মত বিলুপ্তির পথে, তা হলেই তিনি আমার প্রবন্ধের সার্থকতা বুঝতে পারতেন।
অক্টোবর ২৬, ২০০৮
ড. অভিজিৎ রায়, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ ও ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ – ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’। সম্প্রতি 'বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?' শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত। ইমেইল : [email protected]