এই মহাবিশ্ব কি কারো পরিকল্পনা কিংবা হাতের নকশায় তৈরী বলে আমার মনে হয় কিনা – এ নিয়ে আমায় কিছু লিখতে বলা হয়েছে। কিন্তু নকশাকারী সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলে এ নিয়ে কি ভাবে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা সম্ভব? যে কোনো মহাবিশ্বই সাদা চোখে কারো না কারো নকশা কিংবা পরিকল্পনায় তৈরী বলে মনে করা যেতে পারে। যদি সেই মহাবিশ্বে কোনো সূত্র না খাটে আর সেটা একেবারে বিক্ষিপ্ত আর এলোমেলো হয় – তাহলে সেটা হবে হয়ত কোনো মূর্খের তৈরী মহাবিশ্ব।
বরং যেটা নিয়ে কিছু আলোচনা চলতে পারে, সেটা হল আমাদের মহাবিশ্ব কি আমাদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যেমন ভাবে বর্ণিত হয়েছে - সেরকম কোন ঈশ্বরের বা শক্তিমান কোনো ব্যক্তির সৃষ্টি? প্রশ্নটা আমাদের বুদ্ধির অগম্য নয় বলেই আমি মনে করি। আমাদের এই মহাপরিকল্পনাকারী পোপের বাসস্থান সিস্টাইন চ্যাপেলের ছাদের খোদাই করা ভাস্কর্যের মত না হলেও এক ধরনের ব্যক্তিত্বময়, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সৃষ্ট জীবনের প্রতি, বিশেষত মানব জীবনের প্রতি করুণাময় হবেন বলে ভাবা যেতে পারে। আমি মনে করি আপনাদের অনেকেই এখানে নিখিল বিশ্বের এরকমের একজন নকশাকারীর চিরন্তন প্রতিমূর্তিতে আস্থাশীল নন। আপনার মানসপটে হয়ত রয়েছে আরো বিমূর্ত কিছু - প্রকৃতির সুষম এবং সামঞ্জস্যময় নিয়মের মধ্যে ব্যপ্ত এক মহাজাগতিক বিমূর্ত সত্ত্বা - অনেকেটা আইনস্টাইন যেমন কল্পণা করেছিলেন। আপনি অবশ্যই আপনার চিন্তার লাটাইকে এরকম অসীম নীলিমায় নিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু সেরকম বিমূর্ত একটি ধারণাকে কেন ''নকশাকারী' কিংবা 'ঈশ্বর' হিসেবে অভিহিত করতে হবে, তা আমার সত্যই বোধগম্য নয়।
যে কোনো জীবের কিছু অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে মনে হয় এই সৃষ্টিকর্তা জীবনের ব্যাপারে বেশীই উৎসাহী। আগুন, বৃষ্টি বা ভূমিকম্পও কি সেই ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণে? আজকের জগতে আমরা এসব প্রাকৃতিক শক্তির মূলে যে সূত্রগুলো কাজ করে তার অনেকটাই জেনে ফেলেছি। তাও, আরো পরম কিছু সূত্র আর আমাদের জানা সূত্রগুলোর ক্রিয়াকলাপের নিখুঁত পরিমাপ করে ভবিষ্যতবাণী করাও আমাদের পক্ষে এখনও সম্ভব নয়। আমরা জানি বৃষ্টি কি ভাবে হয়, কোন কোন প্রাকৃতিক শক্তি একে নিয়ন্ত্রণ করে – কিন্তু আজ থেকে ঠিক এক মাস পরে বৃষ্টি পড়বে কি না, সেটা আমরা সঠিক ভাবে বলতে পারি না। মানুষের মনও এরকমই কিছু দুর্বোধ্য সূত্রে চলে, যা আমরা কিছু কিছু জানি – কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ভবিষ্যতবাণী করার মত অবস্থায় আসি নি।
এই সমস্ত বিষয়ে আমাদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা একটা বিষয়ে স্থিরনিশ্চিত যে মূল প্রাকৃতিক সূত্রাবলীর কোনো ব্যতিক্রম হয় না – অন্যভাবে বললে, অলৌকিক কিছু ঘটে না। যা ঘটে তাকে কোনো না কোনো প্রাকৃতিক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব – আজকে সে সূত্র না জানা থাকলে কালকে তা আবিষ্কৃত হবেই। সেখানে অধিকাংশ ধর্মই দাঁড়িয়ে আছে এই ধরণের কিছু অলৌকিকতার ওপর – যেমন মৃত যীশুর বেঁচে ওঠা বা কোনো এক দেবদূতের মহম্মদের কাছে এসে উপদেশ পড়ে শোনানো – এ সবই বাস্তব বা লৌকিকতার ঊর্ধ্বে। এই সব অলৌকিক গল্পকথারা বিজ্ঞানের চোখে রূপকথার পরীর গল্পের মতই শোনায় – আর আমরা আজকের দিনে রূপকথায় বিশ্বাস রাখি না। আমরা এমন কি বুঝে গেছি যে মনুষ্যজাতি হাজার হাজার বছরের ক্রমবিবর্তনের ফসল – প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটু একটু করে পরিবর্তিত হতে হতে এই অবস্থায় এসেছে।
এই অবস্থায় আমি পরম কিছু সূত্র ছাড়া আর কোথাও তো কোনো সৃষ্টিকর্তার নকশা থাকার সম্ভাবনা দেখতে পাই না – বাকি সবই তো প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী। এই পরম সূত্রগুলোকে বলা যেতে পারে শেষ ও পরম সত্য – যার ওপর ভিত্তি করে সমগ্র প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শক্তিগুলো পরিচালিত হয়। আমরা সেই সূত্রগুলো এখনো সঠিকভাবে জানি না বটে, কিন্তু এটুকু অনুধাবন করার মত জায়গায় পৌঁছেছি যে এর মধ্যে জীবন বা জীবের কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই। রিচার্ড ফেইনম্যান বলেই গেছেন –
“এই সুবিশাল বিশ্বব্রম্ভান্ড দেখে ও তার সূত্রগুলো বুঝে ওঠার পরে এটা মেনে নেওয়া খুবই শক্ত যে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টিই করেছেন মানুষের ভাল-মন্দ বিচারের জন্য।”
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স যখন প্রথম বিজ্ঞানীমহলে আলোচিত হত, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন যে এরই মাধ্যমে প্রাকৃতিক সূত্রে আবার মানুষের স্থান ফিরে এল – কারণ, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রগুলো অনেকটাই পর্যবেক্ষক নির্ভর। কিন্তু গত চল্লিশ বছরে হাফ এভারেট (Hugh Everett) থেকে শুরু করে তার পরবর্তী বিজ্ঞানীদের অনেকেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে আবার অন্য এক মাত্রা দান করেছেন – এখন তাই আর বিজ্ঞানীরা মানুষ-পর্যবেক্ষকের ধারণা নিয়ে কাজ করেন না, তারা পর্যবেক্ষককে আর দশটা প্রাকৃতিক বস্তুর মতই মনে করেন।
এটা পদার্থবিদ হিসাবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে পরম-সূত্রে পৌঁছবার পরেও পদার্থবিদেরা মহাবিশ্বের সমস্ত কার্যকলাপের সঠিক ব্যাখ্যায় পৌঁছতে পারবেন না। কারণ তখন একটা নতুন প্রশ্ন উঠে আসবে বারবার – “কেন এই সূত্রই সব ব্যাখ্যা দিতে পারে – অন্য কোনো সূত্র যা পারে না?” কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কথাই ধরা যাতে পারে কারণ এর সূত্রগুলো এখন মোটামুটি পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। খুব সম্ভবত এগুলোও পরম সূত্রেরই অংশ হিসাবে স্থান করে নেবে। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রগুলোর মত কোনো নিশ্চিত ভবিতব্য বলে কিছু নেই – সব ফলাফলেরই কম হোক, বেশি হোক- কিছু না কিছু সম্ভাবনা থেকে যায়। সুতরাং বিজ্ঞানে কিছুটা রহস্যময়তা সব সময়ই হয়তো থেকেই যাবে – যাকে আরো নিখুঁত ভাবে ভবিতব্য আকারে প্রকাশ করাই সম্ভব হবে না। কিছু ‘কেন’ পরম সূত্র আবিষ্কারের পরও অজানা রয়ে যাবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখলে ধর্মভিত্তিক সব ব্যাখ্যারও একই সমস্যা। একটা মাত্রার পরে আর ‘কেন’-র উত্তর মেলে না। যদি ঈশ্বরকে কোনোভাবে নির্দিষ্ট না করা যায় তার আচরণ দিয়ে তবে সেই ব্যাখ্যার তো কোনো মানেই দাঁড়ায় না – সেখানেও প্রশ্ন আসে কেন ঈশ্বরের আচরণ নির্দিষ্ট নয়? আর যদি মনে করা হয় ঈশ্বর মানুষকে ভালবাসেন, বা ঈর্ষাপরায়ণ বা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন – সেখানেও সেই একই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে – কেন? ধর্মে বলা থাকতে পারে মহাবিশ্ব ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং সেই ঈশ্বর মানুষকে ভালবাসেন, কিন্তু কোনোভাবেই জবাব দিতে পারে না যে কেন এমন ঘটে।
এই আলোচনা থেকে আমার মনে হয়েছে যে বিজ্ঞান এই সব ‘কেন’র উত্তর কিছুটা হলেও দিতে পারে, ধর্ম তা-ও পারে না। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো হয়ত বলতে পারে না যে কেন এগুলো একেবারে সম্পূর্ণ আলদা কেন হল না – কিন্তু সামান্য কিছুটা আলাদা কেন নয় তা সহজ অঙ্কের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব। যেমন কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে সামান্য কিছু পরিবর্তিত রূপে বিশ্লেষণ করলে কিংবা আপেক্ষিকতার সাথে সমন্বিত করতে চাইলে সমীকরণগুলো অবাস্তব, অসীম বা ঋণাত্বক সম্ভাবনার ফলাফল দেয়। একদম ঠিকঠাক ভাবে না সাজালে এই সূত্রগুলো কিছু অবাস্তব ভবিষ্যতবাণী করতে থাকে। অন্যদিকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা সর্বদাই পরিবর্তনক্ষম – যুগে যুগে কতবার যে এদের ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হয়েছে তার শেষ নেই – ভবিষ্যতেও হবে। ধর্মীয় ব্যাখ্যা অনুসারে কালকেই হয়ত পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরা বন্ধ করে দিতে পারে কোনো অদৃশ্য ঈশ্বরের ইচ্ছায় – বিজ্ঞানের তত্ত্ব মেনে তা পারে না।
২য় পর্ব পড়ুন ...