পরিকল্পিত মহাবিশ্ব?

স্টিভেন ওয়েইনবার্গ

অনুবাদ : দিগন্ত সরকার

[বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ ১৯৭৯ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার বিজেতা ওনার এই লেখাটা নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস প্রকাশিত হয়েছিল ২১শে অক্টোবর, ১৯৯৯ সালে নিয়ে উনি কিছু আলোচনা করেছিলেন ম্যাগাজিনের সাইটে আপাতত আমার এই লেখাটা ফিজিক্সলিঙ্কের সাইট থেকে অনুবাদ করা। এটা দ্বিতীয় পর্ব। ]

পূর্ববর্তী পর্বের পর ...

অনেক পদার্থবিদের দাবীমতে আমাদের মহাবিশ্বের মহাজাগতিক ধ্রুবকগুলোর মান রহস্যময়ভাবে ঠিক এমনই (সূক্ষ-সমন্বয়), যাতে আমাদের মহাবিশ্বে প্রাণের সঞ্চার হওয়া সম্ভব। তাদের দেখলে মনে হয় যে যেন কোনো পরিকল্পনাকারী মানগুলো এমন ভাবেই সাজিয়েছেন যাতে পরবর্তীতে তিনি প্রাণের সঞ্চার করতে পারে। আমি এই সূক্ষ-সমন্বয় তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। কার্বন নিউক্লিয়াসের বহুল প্রচারিত উদাহরণই বেঁছে নেই। বিশ্বসৃষ্টির প্রথম কয়েক মিনিটে সৃষ্ট মৌলগুলো ছিল হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম। এর মধ্যে কার্বন, নাইট্রোজেন বা অক্সিজেনের তখনো কোনো নামগন্ধই ছিল না। এই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ভারী মৌলগুলো তৈরী হয়েছে প্রথম যুগের কিছু নক্ষত্রের মধ্যে, আর তারপরে তারার বিস্ফোরণের পরে ছড়িয়ে গেছে মহাবিশ্বে। এরকমই কিছু মৌল-সমৃদ্ধ অংশেই পরে সৌরজগত গঠিত হয়েছে।

এই হালকা মৌল থেকে ভারী মৌল তৈরী হবার প্রথম ধাপ হল তিনটি হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে একটা কার্বন পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠন। কিন্তু তিনটে হিলিয়াম পরমাণুকে জোড়া দেওয়া তো সহজ কাজ নয়। নক্ষত্রের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে তেজস্ক্রিয় কার্বন সংশ্লেষ হতে গেলে তার শক্তি মাত্রা  হতে হবে তিনটে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের শক্তি মাত্রার সমান - সাধারণের তুলনায় ৭ থেকে ৭.৭ মিলিয়ন ইলেক্ট্রিক-ভোল্ট (MeV)এর মধ্যে। একবার তেজস্ক্রিয় কার্বন গঠন হয়ে গেলে সেখান থেকে সহজেই তা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে সাধারণ কার্বনে পরিণত হতে পারবে - যা আমাদের পৃথিবীতে আমরা পাই। কিন্তু সবই নির্ভর করে ওই তিনটে হিলিয়াম থেকে একটা তেজস্ক্রিয় কার্বন নিউক্লিয়াস গঠনের ওপর।

কার্বন নিউক্লিয়াস এমনই একটি তেজস্ক্রিয় অবস্থা আছে যাতে সে সাধারণের তুলনায় ৭.৬৫ MeV এনার্জি লেভেল-এ থাকে। এই মান মাত্র আরো এক শতাংশ (৭.৭০ - ৭.৬৫ = ০.০৫) বেশী হলে কিন্তু তারায় আর কার্বন সংশ্লেষ হত না। ঝট করে দেখলে মনে হবে যেন এই মান কার্বন পরমাণু তৈরী হবার জন্যই সাজানো। কিন্তু আরো গভীরে গেলে বোঝা যায় ব্যাপারটা মোটেও এমনকিছু সাজানো নয়। আমাদের দেখতে হবে ঠিক কেন সাধারণের তুলনায় ৭.৭ MeV উচ্চ এনার্জি লেভেল দরকার হয় তারায় কার্বন সংশ্লেষের জন্য। কারণ, দুটো ধাপে তেজস্ক্রিয় কার্বন সংশ্লেষ হয়। প্রথথম ধাপে, দুটো হিলিয়াম নিউক্লিয়াস একজোট হয়ে গঠন করে বেরিলিয়াম ৮ বলে একধরণের আইসোটোপ, যা পরের ধাপে আরেকটি হিলিয়াম পরমাণুকেও সাথে নিয়ে তেজস্ক্রিয় কার্বন গঠন করে। তাহলে এখন আমরা কার্বনকে আর তিনটি হিলিয়ামের সংযুক্তি না ভেবে একটি বেরিলিয়াম আর একটি হিলিয়ামের সংযুক্তির ফলে প্রস্তুত হয়েছে বলে মনে করতে পারি। সাধারণ অবস্থায়, একটি বেরিলিয়াম আর একটি হিলিয়ামের মিলিত এনার্জি লেভেল ৭.৪ MeV। তাহলে, আসল ফ্যাক্টর হল এই অতিরিক্ত ০.৩ MeV শক্তি, যা নক্ষত্রের মত তাপমাত্রায় পাওয়া দুষ্কর। তাহলে আসল ফ্যাক্টর দাঁড়ায় এই ০.২৫ MeV অতিরিক্ত (৭.৬৫-৭.৪০=০.২৫) শক্তি, যা কিনা আরো ০.০৫ MeV বেশী হলেই তারায় কার্বন সংশ্লেষ দুরূহ হয়ে যেত। তাহলে ফ্যাক্টর হল এক শতাংশ নয়, প্রায় কুড়ি (০.০৫/০.২৫ = ২০%) শতাংশ - যা মোটেও মুখের কথা নয়। তাই কার্বন সংশ্লেষ নিয়ে সাজানো মানের দাবী বিতর্কিত।

 

চিত্রঃ ত্রিপ আলফা বিক্রিয়ায় কার্বনের উদ্ভব

কিন্তু এমন একটা ধ্রুবক আছে যার মান একদম জীবন সৃষ্টির উপযোগী করেই সাজানো বলে মনে হয়। সেটা হল মহাজাগতিক ধ্রুবক বা কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট - যা আসলে শূন্যস্থানের এনার্জজি-ডেনসিটি। এর মান এর মান ধনাত্বক বা ঋণাত্বক হতে পারে, বড়ো বা ছোট হতে পারে। যদি বড় ও ধনাত্বক হত তাহলে বিশ্বসৃষ্টির পরের মুহূর্ত থেকেই সব পদার্থকে একে অপরের থেকে দূরে সরিয়ে দিত, যার ফলে পদার্থ একত্র হবার কোনো সুযোগই পেত না, পরে তা থেকে নক্ষত্র, গ্রহ বা প্রাণ তৈরীও হত না। আবার যদি এর মান বড় ও ঋণাত্বক হত, তাহলেও মহাকর্ষকে প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতাই তৈরী হত না, এবং মহাবিস্ফোরণে সৃষ্টির কিছুক্ষণের মধ্যেই তা আবার চুপসে একে অপরের ঘাড়ে এসে পড়ত - জীবন সৃষ্টি হবার পর্যাপ্ত সময়ই পেত না। পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেছে, আমাদের মহাবিশ্বের কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট-এর মান যথেষ্ট কম, যার ফলে উপরোক্ত কোনো ঘটনাই ঘটে না। অথচ, প্রাথমিক সূত্র থেকে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে এর মান যথেষ্ট বড় হওয়া সম্ভব।

চিত্রঃ মহাজাগতিক ধ্রুবক বা কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট কি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সূক্ষভাবে সমন্বিত?

 

এখনো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে কেন কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট-এর মান এত কম - কোনো সূত্র এখনো অবধি এর মান কম হবার ব্যাখ্যা দেয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় প্রকাশিত তথ্য থেকে কিছুটা অনুমান করা সম্ভব কেন আমাদের মহাবিশ্বে ধ্রুবকগুলোর মান এত নিখুঁতভাবে সজ্জিত। আন্দ্রেই লিন্ডের "ক্যাওটিক ইনফ্লেশন" তত্ত্ব অনুসারে আমরা যে গ্যালাক্সির সমষ্টিকে মহাবিশ্ব বলে জানি তা হয়ত আসল মহাবিশ্বের একটা অংশমাত্র আর যে মহাবিস্ফোরণে আমাদের দৃশ্যমান বিশ্ব তৈরী, সেরকম অসংখ্য বিগ-ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ এরকম বহু সংখ্যকক মহাবিশ্বে তৈরী করে চলেছে। আর প্রতিটি মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট অন্যান্য মহাবিশ্বের মহাজাগতিক ধ্রুবকগুলোর মান ভিন্ন ভিন্ন মানের

এই অবস্থায় আমাদের বুঝতে অসবিধা হবার কথা নয় য, অসংখ্য  মহাবিশ্বের মধ্যে  আমরা সে মহাবিশ্বেই বাস করি সেটায় জীবনের উপত্তি হতে পেরেছে কারণ এর মহাজাগতিক ধ্রুবকগুলোর মান হয়তো জীবন গঠনের উপযোগী। আরো অনেক মহাবিস্ফোরণের ফলে  উদ্ভুত অন্য মহাবিশ্বের মহাজাগতিক ধ্রুবকগুলোর মান হয়ত তেমন উপযোগী নয় - তাই সেখানে প্রাণের বিকাশও হয় নি। আমরা নাহয় বাসযোগ্য অংশে বসে আধ্যাত্মিকতার ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে কল্পিত সৃষ্টিকর্তাকে প্রশ্ন করতে পারি যে কেন এখানে জীবন আছে, কিন্তু আরো হাজারটা মহাবিশ্বের কিংবা এই মহাবিশ্বের অধিকাংশ স্থানে  এ ধরণের প্রশ্ন করার মত কেউ থাকবেও না। যদি এধরনের কোনো তত্ত্ব স্বীকৃতি পায়, তার পরেও মহাজাগতিক ধ্রুবকগুলো নিয়ে এই রকমের প্রশ্ন করার অর্থ হবে একটাই - "ঈশ্বর আমাদের পৃথিবীতে স্থাপন না করে যদি শুক্র বা প্লুটোতে স্থাপন করতেন আমাদের কত না সমস্যা হত। আমরা এখানে জল, মাটি, বাতাস আর অভিকর্ষের কল্যাণে কত ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারছি। সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া আর কোনো জায়গায় কি আমরা এভাবে বাঁচতে পারতাম ?"

 

চিত্রঃ মাল্টিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের কল্পিত চিত্র

এই রকমের যুক্তিকে বলা হয় নৃ-কেন্দ্রিক বা এন্থ্রপিক। এর বক্তব্য এরকম, প্রকৃতির সূত্রগুলো আমাদের ঠিক ঠাক মত বেঁচে থাকার জন্যই অমন ভাবে তৈরি। আমরা যাতে বেঁচে থাকতে পারি - সে জন্যই সূত্রগুলো অমন- এছাড়া তাদের কাছে আর কোনো ব্যাখ্যা নেই।  এ গুলো আমার চোখে একগাদি আধ্যাত্মিক জবর জং ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। অথচ উল্টোদিক থেকে ভাবলে,  হাজারো মহাবিশ্বের ভীরে যে জায়গাটায় সূত্রগুলো এরকম, সেখানেই জীবন গঠিত হতে পেরেছে - আর সেজন্যই আমরা এখানে - সেরকম ভাবে বোধ হয় ভাবতে চাই না। আর অনন্ত মহাবিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন মহাজাগতিক ধ্রুবক থাকলে সমগ্র মহাবিশ্বের বাসযোগ্য অংশেই আমরা কেন আছি এই প্রশ্ন করা আর সৌরজগতের প্লুটো বা নেপচুনে না থেকে কেন পৃথিবীতে আছি - একই ব্যাপার। কসমোলজিকাল কনস্ট্যান্ট -এর মান এত ক্ষুদ্র যে তা নক্ষত্র গঠনে কোনো বাধাদান করে না। কিন্তু আমরা সত্যি জানি না কেন এর মান এরকমই - এর মান অন্য কিছু হওয়া আদৌ সম্ভব ছিল কিনা। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, মাধ্যাকর্ষণের কোয়ান্টাম  তত্ত্ব এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতে দিতে পারবে।

তৃতীয় পর্ব পড়ুন...

 

 

 

 মার্চ ২৩, ২০০৭
 


দিগন্ত সরকার, কম্পিউটার প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞান লেখক।  ইমেইল : [email protected]