পরিকল্পিত মহাবিশ্ব?

স্টিভেন ওয়েইনবার্গ

অনুবাদ : দিগন্ত সরকার

[বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ ১৯৭৯ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার বিজেতা ওনার এই লেখাটা নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস প্রকাশিত হয়েছিল ২১শে অক্টোবর, ১৯৯৯ সালে নিয়ে উনি কিছু আলোচনা করেছিলেন ম্যাগাজিনের সাইটে আপাতত আমার এই লেখাটা ফিজিক্সলিঙ্কের সাইট থেকে অনুবাদ করা। ]

শেষ পর্ব

পূর্ববর্তী পর্বের পর ...

আরো অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশার চেয়ে জীবনটা আরো অনেকটা সহজ হলে একে না হয় ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে মেনে নেওয়া যেত। এখানে  আনন্দ কিংবা সুখানুভূতির কথা ভাবলে মনে রাখতে হবে, মানুষের বা যেকোনো জীবের সাধারণ অনুভূতিগুলোর অনেক কিছুই কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের বৈশিষ্ট্যে স্থান করে নিয়েছে। কারণ বেঁচে থেকে নিজেদের জিন পরবর্তী প্রজন্মে বহন করে নিয়ে যাবার জন্য খাদ্যগ্রহণ বা প্রজনন করতেই হয়। হয়ত এটা প্রত্যাশার বাইরে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অন্য কোনো গ্রহে একদল জীব সৃষ্টি হবে যারা আমাদের মত অবসর সময়ে জটিল বিজ্ঞান-চিন্তায় মগ্ন থাকবে।  এক্ষেত্রে একদল খুব ভাগ্যবান কিছু ব্যক্তি সংকীর্ণ নমুনা থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেরা সৃষ্টিকর্তার নকশার কথা ভেবে বাহবা দিচ্ছে। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে 'সিলেকশন এফেক্ট'।

 

আমাদের মহাবিশ্ব অনেক অনেক বড়, হয়ত বা অসীম। এটাতে অবাক হবার কিছু নেই যে অধিকাংশ গ্রহেই কোনো প্রাণ নেই এবং যাদের মধ্যে আছে, তারাও হয়ত বেশীরভাগই অনুন্নত প্রকৃতির। খুবই অল্প ভগ্নাংশের জীবের হয়ত এই সৃষ্টিকর্তা সংক্রান্ত চিন্তা করার মত ক্ষমতা আছে। কোনো লটারি বিজেতাকে ইন্টারভিউ নিতে গেলে মনে হতে পারে যে কোনো বিশেষ দৈববলে সে এই লটারীটা পেয়েছে কিন্তু প্রশ্নকর্তার মনে রাখা উচিত যে আরো  হাজার জন টিকিট কেটেও পুরস্কার জিততে পারে নি। তাই শুধু সাদামাটা প্রাকৃতিক নির্বাচনে আমরা যতটা উন্নত হতাম, তার চেয়ে সত্যিই আমরা বেশী উন্নত কিনা - এটা ভাবার পাশাপাশি এই পক্ষপাতের কথাও মনে রাখতে হবে যে আমরা নিজেরা কিন্তু নিজেদের সংকীর্ণ অভিজ্ঞতালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সমস্যার কথাটা ভাবছি।

 

এই প্রশ্নের উত্তর নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। এর উত্তর পেতে পদার্থবিদ্যা আমাকে সাহায্য করবেনা। আমার জীবনে আমি খুবই সুখী, বোধহয় আমি মানবসমাজের সবথেকে সুখী ০.০১%এর মধ্যেই থাকব। তাও, আমি এক মা কে দেখেছি ক্যান্সারে মারা যেতে, বাবাকে অ্যালজাইমারসে ভুগে স্মৃতিশক্তি খোয়াতে আর অনেক তুতো ভাইবোনকে গনহত্যায় মারা যেতে। মঙ্গলময় ঈশ্বর তখন  কোথায় লুকিয়ে ছিলেন কে জানে।

 

যারা সর্বশক্তিমান ও মঙ্গলময় ঈশ্বরে বিশ্বাসী তারা অনেক সময়েই এই দুঃখ-কষ্ট দেখে বিস্মিত হন। আবার অনেকসময়ে 'ফ্রি উইল'-এর কথা বলা হয়। মিল্টন তার প্যারাডাইস লস্ট-এ লিখেছেন :

"আমি তাদের বন্ধনহীন সৃষ্টি করেছি আর তারা তাই থাকবে যতদিন না তারা আমার দাসত্ব স্বীকার করে, নাহলে আমাকে তাদের প্রকৃতি পরিবর্তন করতে হবে আর আমার আগের আইন স্বাধীনতার নীতি পরিবর্তন করতে হবে - এভাবে তারা নিজেদের পতন ডেকে আনবে।"

আমার ভাইবোনেদের জার্মানদের হাতে মৃত্যু কি তাহলে জার্মানদের 'ফ্রি উইল'-এর প্রভাব? তাও অন্যের হাতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া যায়, ক্যান্সারে মৃত্যু কি টিউমারের ফ্রি উইলের ফল?

 

এইসব দুঃখদুর্দশা সৃষ্টিকর্তার অস্ত্বিত্বের সাথে জড়িত কিনা সে নিয়ে আমি চিন্তিত নই, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে সে ধরণের সৃষ্টিকর্তা কখনই মঙ্গলময় নন। অ্যাস্ক্যাইলাস বা ইউরিপিডিসের প্রাচীন গ্রীক নাটকে তারা অনেককাল আগেই দেখিয়েছিলেন যে ঈশ্বর স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির কিন্তু মানুষের কাছ থেকে ভাল ব্যবহারই আশা করেন। ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বরও একইরকম ভাবে আমাদের নির্দেশ দেন অবিশ্বাসীদের মেরে ফেলতে, এমনকি তার নির্দেশে নিজের সন্তানকে বলি দিতে বলেন। খ্রীষ্টান আর ইসলাম ধর্মে ঈশ্বর আবার আমাদের সারাজীবনের জন্য পরিত্যাগ করবেন যদি আমরা তাদের ঠিকঠাক আরাধনা না করি। এটা কেমন ব্যবহার হল? আমি জানি হয়ত ঈশ্বরকে মানুষের মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না কিন্তু এখানে সমস্যা হল, যার অস্তিত্ব নিয়েই এত সংশয় তার মঙ্গলময় দিকটা তুলে ধরার জন্য আমরা তাহলে কোন্‌ মাপকাঠি ব্যবহার করতে পারি?

 

উইলিয়াম প্যালের এই 'আর্গুমেন্ট ফ্রম ডিজাইন' এখন আর মানুষের মাথায় সেরকম ভাবে নেই। ধর্মের সম্মান এখন নৈতিকতার উৎস হিসাবে। আমি এখন কষ্ট করে এই লেখাটা লিখছি কারণ আমি মনে করি নৈতিকতা প্রসঙ্গে ধর্মের অবদান মোটেও খুব একটা ভাল নয়। এখানে একটা বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন থেকেই যায়। একদিকে দেখলে ধর্মের জন্য মানবসভ্যতার ইতিহাসে কুসংস্কার, জিহাদ আর ক্রুসেডের মত ঘটনা ঘটেছে। আমাদের এই শতকেই একজন মুসলিম ধর্মান্ধ হত্যা করেছে সাদাতকে, ইহুদী ধর্মান্ধ হত্যা করেছে র‌্যাবিনকে আর হিন্দু ধর্মান্ধ হত্যা করেছে গান্ধীকে। হিটলারকে খ্রীষ্টান ধর্মান্ধ বলাটা হয়ত বাড়াবাড়ি হবে, কিন্তু এটাও ঠিক যে খ্রীষ্টীয় সংস্কৃতিতে যুগ-যুগান্তরের ইহুদীবিদ্বেষ না থাকলে হিটলার হয়ত ইহুদীনিধনে উদ্যত হতেন না। আবার অন্যদিকে দেখলে অনেক ধার্মিক ব্যক্তিই সমাজে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। যেমন পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন তার ইম্যাজিনড ওয়ার্ল্ড বইতে লিখেছেন দাসপ্রথার বিরুদ্ধে ধর্মের কল্যাণময় সমর্থনের কথা।  

আমি আমার ব্যক্তিগত কিছু মন্তব্য করব এই দাসপ্রথা নিয়ে। হয়ত কিছু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি সত্যিই দাসপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন - যেমন ইংল্যান্ডে উইলিয়াম উইলবারফোর্স বা আমেরিকায় উইলিয়াম এলেরি চ্যানিং। কিন্তু এটাও সত্যি যে আর অনেক ধর্মের মত খ্রীষ্টান ধর্মও কয়েক শতক ধরে দাসপ্রথাকে মেনে নিয়েই চলছিল। দাসপ্রথার উল্লেখ নিউ টেস্টামেন্টেও পাওয়া যায়। তাহলে উইলবারফোর্স বা চ্যানিং-এর ক্ষেত্রে আলাদাটা কি হয়েছিল? এরা তো কোনো দৈবাদেশ পেয়েছেন বলেও দাবী করেন নি, আবার কোনো নতুন পবিত্র গ্রন্থও আবিষ্কার হয় নি। বরং অষ্টাদশ শতকে যুক্তিবাদ এবং মানবতাবাদ প্রসারের সাথে সাথেই অনেকেই দাসপ্রথার বিরোধিতা শুরু করেন - যেমন অ্যাডাম স্মিথ বা জেরেমি বেন্থেম। সমারসেটের যে কেসের রায়ের সাথে সাথে ইংল্যান্ডে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে (যদিও উপনিবেশগুলিতে জারি ছিল) , সেই রায় যিনি দিয়েছিলেন, সেই ধর্মপ্রাণ লর্ড ম্যানফিল্ড কিন্তু তার রায়ে ধর্মের কথা একবারের জন্যও উল্লেখ করেননি। ধর্মীয় নৈতিকতা আমার মতে যুগের সাথে তাল মিলিয়েই চলে, বরং ধর্ম দ্বারা যুগ কমই প্রভাবিত হয়।

 

আমি তো বলব, ধর্ম বরং দাসপ্রথার স্বপক্ষেই বেশী কথা বলেছে। অনেকবারই ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি ব্যবহার হয়েছে দাসপ্রথাকে আদালতে সমর্থন জানাতে। মার্ক টোয়েন তার নিজের মা সম্পর্কে বলেন যে তিনি নাকি অসম্ভব দয়ালু ছিলেন কিন্তু সর্বদা দাসপ্রথা সমর্থন করে এসেছেন। কারণ, উনি সবসময় ধর্মীয় বাণীতে শুনে এসেছেন যে দাসপ্রথা ঈশ্বরের ইচ্ছায় চলে। ধর্ম থাকুক বা না থাকুক - সব সময়ই ভাল লোকে ভাল কাজ করবে আর খারাপ লোকে খারাপ কাজ করবে। কিন্তু ভাল লোককে দিয়ে খারাপ কাজ করানোতে ধর্মের জুড়ি নেই।

 

কদিন আগে একটা ই-মেল পেলাম আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স থেকে। তাতে একটা কনফারেন্সের কথা ছিল - যার বিষয়বস্তু হল ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা। আমিও ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে আলোচনা চাই কিন্তু 'গঠনমূলক' নয় । বিজ্ঞানের একটা বড় অবদান হল যে বিজ্ঞান বুদ্ধিমান মানুষকে অন্তত ধার্মিক হতে দেয় না। আমার মনে হয় না আমরা এ থেকে পিছিয়ে আসব।

 

 মার্চ ৩১, ২০০৭
 


দিগন্ত সরকার, কম্পিউটার প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞান লেখক।  ইমেইল : [email protected]