বাঙালি সংস্কৃতি এবং হিন্দি ভুতের আছর
বাঙালিদের কোন অনুষ্ঠান টনুষ্ঠানে যাওয়া অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি আমি। হৈ হট্টগোল বা বেশি লোকের ভীড় ভাট্টা এমনিতেই সাধারণত এড়িয়ে চলি। নিরিবিলি নিজের মতো থাকাটাই আমার কাছে দারুন তৃপ্তিময়, অন্তহীন আনন্দের উৎসভূমি। বাঙালিদের অনুষ্ঠানে অন্য অনেক কিছুর কমতি থাকলেও হই হট্টগোলের যে কোন কমতি থাকে না সেটা সবাই খুব ভাল করেই জানে।
ছুটির দিনগুলোতে অন্য বাঙালিরা যেখানে এর ওর বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে বা দূরে কোথাও হই হই করে দল বেধে পিকনিক করতে অথবা বেড়াতে যায়, সেখানে ঘরকুনো আমি কুনো ব্যাঙের মতোই হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কল্পনার মায়াবী জগতে হারিয়ে যাই। অন্তর্জালের বিশাল সমুদ্রের ঢেউ এর ভাঁজে ভাঁজে কলম্বাসের মত অজানা কোন জগত আবিষ্কারের নেশায় পাল তোলা নৌকা ভাসাই আমি। এ কারণে আন্নার গঞ্জনাও কম সহ্য করতে হয় না আমাকে। তবে, ওই সমস্ত অনুষ্ঠানে যেয়ে মন মেজাজ খিঁচড়ানোর চেয়ে আন্নার লাঞ্ছনা-গঞ্জনা হজম করাট সহজতর বিবেচনা করে আমি কানে তুলো দিয়ে কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে নির্বিকার ভংগিতে অন্তর্জালে আমার নাও ভাসানি চালিয়ে যেতে থাকি অবিরাম। সহজ সত্যি হচ্ছে, রবি ঠাকুর যতই ঘর হতে দুই পা বাইরে বের হয়ে দেখতে বলুক না কেন, একান্ত ঠেকায় না পড়লে বাড়ী থেকে দুই পা তো দূরের কথা এক পাও বাইরে ফেলি না আমি।
তবে এই সপ্তাহান্তে দুই পা না একেবারে ছয় পা বের করেই এক অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছিল আমাকে। তবে ভাগ্য ভাল যে সেই অনুষ্ঠান বাঙালিদের একক কোন অনুষ্ঠান ছিল না। প্রতি বছর হোমস্টিড এর ফ্রুট এন্ড স্পাইস পার্কে থাই-আমেরিকান এসোসিয়েশন অব সাউথ ফ্লোরিডা, দ্য এশিয়ান-আমেরিকান এডভাইজরি বোর্ড এবং মায়ামি-ডেড কাউন্টি পার্ক এন্ড রিক্রিয়েশন এর উদ্যোগে দুই দিন ব্যাপী এশিয়ান কালচারাল ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়। এশিয়ান দেশগুলোর পারস্পরিক ভাব বিনিময় এবং তাদের সংস্কৃতিকে আমেরিকান সমাজে পরিচিত করানোই এর মূল উদ্দেশ্য। এশিয়ার নানান দেশের স্টল সাজানো হয় তাদের নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী জিনিষ পত্র দিয়ে। বিভিন্ন দেশের খাবারের দোকানে বিক্রি হতে থাকে তাদের বৈচিত্র্যময় খাবার দাবার। মেলার মাঝামাঝি জায়গায় বিশাল প্যান্ডেলের নিচে মঞ্চে সারাদিন ধরে চলতে থাকে ওই সকল দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রদর্শনী।
আমার খুব প্রিয় মানুষের একজন হচ্ছেন ইরতিশাদ ভাই, ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান। মুক্তমনাতে নিয়মিতই চমৎকার সব লেখালেখি করেন তিনি। ইরতিশাদ ভাই এবং তার স্ত্রী শিরিন ভাবী বেশ কয়েক বছর ধরেই এশিয়ান কালচারাল ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের স্টলের দায়িত্ব করে চলেছেন নিয়মিতভাবে। তবে এ’বছর ভাবীর অসুস্থতা এবং উনার নিজের ব্যস্ততার কারণে স্টল বরাদ্দ নিতে চান নি। কিন্তু আমি এবং আমার এক করিৎকর্মা বন্ধুর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে তিনি স্টল দিতে রাজী হয়েছিলেন। আমার করিৎকর্মা বন্ধুটি বেশ কিছুটা সাহায্য সহযোগিতা করলেও সত্যি কথা বলতে কি এই অকর্মন্য আলসেকে দিয়ে ইরতিশাদ ভাইয়ের তেমন কোন কাজ হয়নি। বলতে গেলে ইরতিশাদ ভাই এবং শিরিন ভাবীকে একা একাই সবকিছু করতে হয়েছে। সেজন্য অবশ্য একটু আধটু অপরাধবোধে যে ভুগছি না তা কিন্তু নয়। যাই হোক, এই ইরতিশাদ ভাইয়ের কারণেই দীর্ঘ শীতনিদ্রা অকালে ভেঙ্গে সপরিবারে আমার অনুষ্ঠানে গমন।
চিত্র ১: এশিয়ান কালচারাল ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ স্টল
ফেস্টিভ্যালে যেয়ে অবশ্য আশ্চর্যজনকভাবে দারুন মজা পেয়ে যাই আমি। বিশাল প্যান্ডেলের নীচে বিরাট মঞ্চে নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী রং বেরং এর পোষাক পরে একের পর এক নাচ গান করে যাচ্ছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা। অসম্ভব গর্ব আর ভালবাসা দিয়ে দর্শকদের সামনে ফুঁটিয়ে তুলছে তাদের নিজের দেশের সংস্কৃতিকে। দেখে মন জুড়িয়ে যায়। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ঘোষিকা ঘোষনা দেয় যে একটি জনপ্রিয় গানের সাথে নৃত্য পরিবেশন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মেয়েরা। বুকের মধ্যে রিনিরিনি আনন্দ আর গভীর আগ্রহ নিয়ে আমি অপেক্ষা করতে থাকি বঙ্গ ললনাদের নাচ দেখার জন্য। দু’পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দন্ডায়মান দর্শকদের মাথার উপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করি আরো ভালভাবে। অবশ্য খুব বেশি দেরি করতে হয় না। অচিরেই স্কিন টাইট প্যান্ট, রঙীন খাটো শার্ট আর মাথায় হ্যাট পরে চার তরুনীর আগমন ঘটে মঞ্চে। তারপরই আমাকে রীতিমত বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিয়ে হিন্দি এক চটুল রিমিক্স গানের সাথে শরীর ত্রিভঙ্গ চতুর্ভঙ্গ করে মঞ্চ কাঁপিয়ে উদ্দাম দাপাদাপি শুরু করে দেয় তারা। আমার গভীর আনন্দ এক নিমেষেই পরিনত হয়ে যায় নিদারুন বিষাদে। লজ্জিত, অপমানিত আমি দারুন ক্ষোভে চোখ নামিয়ে নেই মাটির দিকে। সমস্ত শরীরের রক্ত ঝা ঝা করে উঠে আসে কানের ভিতরে। নিজেকে বড় নিঃস্ব আর রিক্ত মনে হয়। মনে হয় মেলার সমস্ত লোক বুঝি বিদ্রুপের হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার ক্ষুব্ধ অবস্থা দেখে আরেক বাঙালি ভদ্রলোক স্বান্তনা দিয়ে বললেন যে, এটা উনার কাছে খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। প্রতি বছরই বাংলাদেশের বাঙালিরা এই কাজ করে থাকে। ফলে, দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গেছ উনাদেরে। কুয়োর ব্যাঙ আমি প্রথমবার দেখছি বলে হয়তো ধাক্কাটা বেশি খেয়েছি।
চিত্র ২: হিন্দি চটুল গানের সাথে মঞ্চ দাপাচ্ছে বাঙালী তরুনীরা
বাঙালির এই হিন্দি প্রীতি রোগ শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। দেশের বাইরে এই রোগের প্রকোপ আরো বেশি। সারাদিন ধরে বলিউডের অখাদ্য সিনেমা দেখা আর হিন্দি চটুল গান শোনা রীতিমত বাতিকে পরিনত হয়েছে অনেক বাঙালির কাছে। ভারতীয় বা পাকিস্তানীদের সাথে সোৎসাহে হিন্দি- উর্দুতে বাতচিতও করছে আজকাল অনেকেই । বাংলাদেশি শুনলেই ওই দুই দেশের লোকজন, বিশেষ করে পাকিস্তানীরা কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই উর্দুতে কথা বলা শুরু করে দেয়। আমি হিন্দি বা উর্দু জানি না শুনলে ভারতীয় এবং পাকিস্তানীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। এদের অনেকেই বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলেও ফেলেছে যে তাদের দেখা আমিই একমাত্র বাংলাদেশি যে কিনা হিন্দি কিংবা উর্দু কিছুই জানি না। বাঙালির এই হিন্দি এবং উর্দু প্রেম ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলে আমার তেমন কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু ওই সমস্ত লোকেরা তাদের ভিন্ন ভাষার এই নয়া প্রেমকে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারছে না আর কিছুতে। অন্যদেরকে দেখানোর জন্য দারুনভাবে উতলা হয়ে পড়েছে তারা। বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দি গান বা গানের সাথে নাচ এখন পরিবেশিত হচ্ছে বেশ উৎসাহের সাথে, মহা আড়ম্বরে। লোকজন হাততালি দিয়ে এদেরকে উৎসাহ উদ্দীপনাও দিয়ে চলেছে বেশ ভালভাবেই। তবে সবচেয়ে মজার দিক হচ্ছে এই লোকগুলোই আবার সারাক্ষণ তারঃস্বরে চিৎকার করছে নিজস্ব সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য। হায়রে বাঙালি! এরাই নাকি সারা দুনিয়ার একমাত্র জাতি যারা প্রাণ দিয়েছে ভাষার জন্য।
আমার আগের এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে পৃথিবীতেই আমরাই বোধহয় একমাত্র কনফিউজড জাতি। আজকে বলছি, আমরা শুধু কনফিউজডই নই, খুব সম্ভবত একমাত্র আত্ম-মর্যাদাহীন জাতিও বটে। সামান্যতম আত্ম-মর্যাদাবোধ থাকলে, মেরুদন্ড সামান্য একটু শক্ত হলে কোন জাতির লোক অসংখ্য দেশের মানুষের সামনে নিজস্ব সংস্কৃতি বাদ দিয়ে শুধুমাত্র হাততালি পাওয়ার লোভে ভিনদেশি ভাষায় বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রদর্শনী করে? অন্য কোন দেশের লোককে কেউ কখনো করতে দেখেছেন এরকম কাজ? আমি নিশ্চিত কেউ দেখেননি। শুধুমাত্র আমরাই এই ধরনের অপকর্ম করে যাই বিনা লজ্জ্বায়, দ্বিধাহীন চিত্তে। অথচ ফেব্রুয়ারী মাস এলে বা বৈশাখ এলে ভাষার জন্য, দেশের সংস্কৃতির জন্য মায়াকান্না করে কত না ভন্ডামিই করি আমরা।
কবে যে এই সকল ভন্ডামিকে ঝেড়ে ফেলে প্রবল আত্ম-মর্যাদায় মেরুদন্ড শক্ত করে ঋজু ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়াবে বাঙালি, কে জানে?
মার্চ ২, ২০০৮
মায়ামি, ফ্লোরিডা।
===============================================
মুক্তমনার কো-মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।