নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় কোন সম্পদ নেই
ফরিদ আহমেদমুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে, “সাহস মাপার কোনো সহজ নিয়মের কথা আমার জানা নেই, তবে আমার ধারণা যে-মানুষ যত সহজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, তার সাহস তত বেশি। সেই হিসেবে এই দেশের সবচেয়ে সাহসী মানুষদের একজন নিশ্চয়ই কর্নেল তাহের। জিয়াউর রহমান ষড়যন্ত্রের একটা বিচার করে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন। কর্নেল তাহের যেভাবে তাঁর মৃত্যুদন্ডটি গ্রহণ করেছিলেন, তার কোনো তুলনা নেই। ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে পরিষ্কার কাপড় পরে নিজের প্রিয় কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, কাউকে তাঁকে স্পর্শ করতে দেননি, ফাঁসির দড়িটি নিজের গলায় পরে নিতে গিয়ে একবারও তাঁর হাত কাঁপেনি। গল্প-উপন্যাস বা রূপকথার নায়কদের থেকেও তাঁর সাহস আর বীরত্ব অনেক বেশি ছিল”। ফাঁসির পূর্ব মুহুর্তে কর্নেল তাহের উচ্চারণ করেছিলেন তার সেই অমর বানী “নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর বড় কোন সম্পদ নেই, আমি তার অধিকারী, আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই”।
কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর এতো বছর পর আমাদের অতি প্রিয় দেশ যখন একদল হরিণের চামড়া পরা নেকড়ের হিংস্র থাবার নীচে অসহায়ভাবে ছটফট করছে, তখন তারই ছোট ভাই, তারই মতো আরো এক অসমসাহসী ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ডঃ আনোয়ার হোসেন, মিথ্যা মামলার আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে নিঃশঙ্ক চিত্তে অবলীলায় উচ্চারণ করেছেন কিছু কঠিন সত্য। ইতিহাসের কি আশ্চর্য পূনরাবৃত্তি! সেই সত্য এমনই কঠিন যে চোখের চামড়া খাওয়া এই সরকারের লজ্জ্বা নিবারণের জন্য যেটুকু শেষ কাপড় ছিল তাও খড় কুঁটোর মত উড়ে গেছে তার সুতীব্র আঘাতে। বস্ত্রহীন রাজার মত দখলকারীরা এখন দিগম্বর হয়ে দ্বিধাহীন চলাফেরা করছে যত্রতত্র নির্লজ্জ্বভাবে। বেহায়ারা লজ্জ্বা না পেলেও অন্যেরা যারা দেখছে তারা কিন্তু ঠিকই চোখ ঢেকে নিচ্ছেন গভীর লজ্জ্বায়।
আমার অন্তরের সবটুকু শ্রদ্ধা চশমা পরা আপাত নিরীহ দর্শন কিন্তু অদম্য সাহসী এই বীরপুরুষের জন্য। অনেকেই যেখানে এখনো সাহস পাচ্ছেন না সত্যি কথাগুলো বলার বা লেখার, বেশিরভাগ পত্রপত্রিকাই যেখানে স্বেচ্ছা সেন্সরের নামে জলপাইদের পদলেহনে ব্যস্ত, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিরীহ শিক্ষক হয়ে তিনি যে ইস্পাত কঠিন ঋজুতা দেখিয়েছেন, দৃঢ় প্রত্যয়ে যে কঠিন সত্যগুলো উচ্চারণ করেছনে, গভীর বিশ্বাসে আবেগময় কন্ঠে যে স্বপ্নের কথা বলেছেন, তার কথা একদিন ইতিহাসে লেখা থাকবে একথা নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যায়।
উচ্চাভিলাষী এই নেকড়ের পাল যখন হরিণের ছদ্মবেশে ক্ষমতা দখল করেছিল তখন খুব অল্প সংখ্যক লোকই ধরতে পেরেছিল এর আসল তাৎপর্য। বেশির ভাগ লোকই বুঝে অথবা না বুঝে সমর্থণ জানিয়েছিল এই সরকারকে। পত্রপত্রিকায় কত বন্দনা, কত প্রশংসা, কত নৈবদ্য সাজানো হয়েছিল তাদের জন্য। আকাশ ফুঁড়ে নাকি স্বয়ং ফেরেশতারা নেমে এসেছে মর্তলোকে ক্ষণকালের জন্য। দেশবাসীর আর কোন চিন্তা নেই। ক্ষণস্থায়ীভাবে নয়, কেউ কেউ চিরস্থায়ীভাবেই তাদের থেকে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল পর্যন্ত। সেই আবেগে আপাতত কিছুটা ভাটা পড়লেও একেবারে যে কমে যায়নি তা জাতীয় পত্রপত্রিকা পড়লেই বোঝা যায়। মুক্তমনাতেও আমরা যখন কেউ কেউ কঠোর সমালোচনা করেছিলাম এই অবৈধ সরকারের, বলেছিলাম যে এটা আসলে সামরিক সরকার, তখন কারো কারো কাছে তা ভাল লাগেনি। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তারা আমাদের সমালোচনার। আমাদের বলেছিলেন ধৈর্য্য ধরতে। ধৈর্য্য ধরলেই নাকি দুধের নহর বয়ে যাবে দেশের পথে ঘাটে। মানুষ মহা সুখে থাকবে তারপর থেকে। দুধের নহরতো দূরের কথা, সামান্য মোটা চাল কিনতেই দরিদ্র মানুষের এখন নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার উপক্রম। তারপরও তার প্রতিবাদ করা যাবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যাবে না। জরুরী আইন নামের এক অদ্ভুত আইনের শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সব উপায়কে। হীরক রাজার দেশের মত পেটে ভাত নেই তবু দাঁত বের করে হাসতে হবে, সুখে আছি বলে রাজার নামে (পড়ুন জলপাই বাহিনীর নামে) আনন্দ সংগীত গাইতে হবে বাচ্চাদের মত হেলে দুলে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই দূর্নীতিবাজ সে বিষয়ে আমার কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু তারপরেও রাজনীতিবিদদের ঢালাওভাবে দূর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে সামরিক বাহিনী বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষমতা দখল করে নেবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না কোনভাবেই। আর সামরিক বাহিনীর লোকজনেরা যে কতখানি সাধু সন্ন্যাসী সেটা জানতেও আমাদের খুব একটা বেশি বাকী নেই। দূর্নীতির কাজগুলো যে রাজনীতিবিদদের চেয়ে আরো ভালভাবে, আরো সুচারু দক্ষতার সাথে তারা করতে পারেন সেটাও আমরা এখন সবাই জানি। এই সরকারের অর্ধেক উপদেষ্টাই এর মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের পর তাদের দূর্নীতির যে কেচ্ছা-কাহিনী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার সঙ্গে রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রী মিনিস্টারদের দূর্নীতির কি কোন পার্থক্য আছে? যদি নাই থেকে থাকে তাহলে কেন সব ধরণের জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত সরকারকে সিন্দাবাদের দৈত্যের মত ঘাড়ের উপর বসে থাকতে দেওয়া? সব আমলের সব রাজনৈতিক সরকারেই সবসময়ই কিছু না কিছু নিষ্ঠুর অনুভূতিহীন ধরণের লোকজন থাকে। যাদের কাজ হচ্ছে নির্মম ধরণের কথাবার্তা বলে মানুষকে যতখানি পারা যায় মানষিক কষ্ট দেয়া। এই সরকারেও তেমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন যারা নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের সেই সব ব্যক্তিদের চেয়ে খুব একটা কম ছিলেন না। হৃদয়হীন কথাবার্তায় তারাও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। এই সরকারের মূল কাজ ছিল অতি দ্রুত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কিন্তু তারা নির্বাচনের কাজটুকু বাদ দিয়ে আর সব কিছুই করে চলেছেন দিব্যি মহানন্দে। অবশ্য নির্বাচন ছাড়া আর একটা কাজ তাদেরকে দিয়ে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি, সেটা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ।
যুগে যুগে সশস্ত্ররা ভেবে বসে থাকে যে তাদের অস্ত্রের ভয়ানক শক্তি। অস্ত্রের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্যাতন করে বিকৃত সুখ পায়। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে যে, সশস্ত্রের এই অহংকার সাময়িক। নিরস্ত্র মানুষের সম্মিলিত শক্তির কোন তুলনা নেই। তবে বেশিরভাগ সময়ই সেই শক্তি থাকে ঘুমিয়ে, সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত। যখনই অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় মানুষের, তখন সেই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ খুলে বের হয়ে আসে প্রতিবাদের জ্বলন্ত লাভা। পাহাড়ী ঢলের মত ভেসে আসা লাভার সেই স্রোতে ভেসে যায় সব আত্মম্ভরি সশস্ত্র অত্যাচারীরা। ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সকল অন্যায়, অত্যাচার আর নির্যাতনের পালা।
আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি যে, আমাদের দেশে সামরিক বাহিনীর কোন প্রয়োজনই নেই। যদিও জুজুর ভয় আর মিথ্যা দেশপ্রেমের কথা বলে বছরের পর বছর শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে এর। গরীব মানুষের রক্ত ঘামে দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় আমরা দিনের পর দিন রাজকীয়ভাবে পুষে চলেছি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই বাহিনীকে। যেখানে দেশের অধিকাংশ মানুষকে সামান্য একবেলা ভাতের জোগাড় করতে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়, সেখানে পরগাছা বাহিনীর লোকজনেরা দুই আনা চার আনায় ঘি মাখন খেয়ে মোষের মত তাগড়া হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই নিজ জাতির রক্তে রঞ্জিত এই বাহিনীর হাত। বাঙালি, চাকমা, মারমা, গারো কেউ রেহাই পায়নি এদের রক্তপিপাসু হাত থেকে। হাসি পায় যখন দেখি কেউ সামরিক বাহিনীকে দাবী করে দেশপ্রেমিক বাহিনী হিসাবে। সামরিক বাহিনী আর রাজাকার বাহিনী যদি দেশপ্রেমিক হয় তাহলে দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটাই পালটে ফেলা দরকার বোধ হয় অতি দ্রুত।
আমাদের সামনে এখনই সময় এসেছে এই রক্তখেকো দাম্ভিক বাহিনীর হাত থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়ার। তা না হলে পাকিস্তানের বর্তমানে যে করুন দশা আমাদের অবস্থাও তার মতই হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র তার জন্মের ষাট বছর পরেও মুক্ত হতে পারেনি সামরিক বাহিনীর নাগপাশ থেকে। অদূর ভবিষ্যতে যে হতে পারবে সেটাও মনে হয় না খুব একটা। আমরা নিশ্চয়ই যুদ্ধ করে পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা হইনি পাকিস্তানের মত আরেকটি সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য। আমরা নিশ্চয়ই চাই না রূঢ় সামরিক সংস্কৃতি এসে গ্রাস করে ফেলুক আমাদের হাজার বছরের কোমল সংস্কৃতিকে। যদি তাই না হয়, তবে এখনই সময় প্রফেসর আনোয়ারের মত গ্রীবা উঁচিয়ে নিঃশঙ্ক চিত্তে সমস্বরে চিৎকার করে বলা, আমরা কোন যুদ্ধবাজ সামরিক রাষ্ট্র নই, আমাদের কোন সামরিক বাহিনীর দরকার নেই।
নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে যে আর কোন বড় সম্পদ নেই।
মায়ামী, ফ্লোরিডা। [email protected]
===============================================
মুক্তমনার কো-মডারেটর, 'মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে' গ্রন্থের লেখক।