চতুর্থ পর্ব

আমার চোখে একাত্তর

ইরতিশাদ আহমদ 

(পঞ্চম পর্ব)  

নির্বাচনের ফলাফল ছিল অকল্পনীয়। আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা পাবে এ নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবকটি আসনই তারা পেয়ে যাবে এমন কল্পনা আ ওয়ামী লীগের নেতারাও করেন নি। ভোটের ফলাফল সামরিক সরকারের হিসাব নিকাশ ওলট-পালট করে দিল। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আওয়ামী লীগের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে এটা ঠিক তাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। ইয়াহিয়া সরকারের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন ছাড়া সরকার গঠন করতে পারবে না; আর না পারলে আওয়ামী লীগকে বশ মানানো এমন কোন কঠিন কাজ হবে না।  

পশ্চিম পাকিস্তানেও নির্বাচনের ফলাফল ছিল অপ্রত্যাশিত । আইয়ুবের পদত্যাগকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনীতিতে নবাগত ভুট্টোর নেতৃত্বে মাত্র তিন বছর আগে গঠিত পিপলস পার্টি এতগুলি আসন পেয়ে যাবে তাও ছিল অনেকেরই ধারণার বাইরে। কিন্তু যা ওয়ার তাই হলো।  

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা বিজয়ের আনন্দে বিভোর হয়ে রইলো কয়েকটা দিন। কিন্তু মাত্র কয়েকটা দিনই। সম্বিত ফিরতে খুব একটা দেরী হলো না। সবার মনেই একধরনের অস্বস্তির ভাব। সংকট ঘনীভূত হচ্ছে, সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে দেশটা এমনই সবার মনে হচ্ছিল। 

ভুট্টো এবং শেখ মুজিবের মধ্যে পত্রপত্রিকা আর সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বাদানুবাদ শুরু হলো। বাদানুবাদ না বলে একে হুমকি-পাল্টা-হুমকি বলাটাই ঠিক হবে। ভুট্টো নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা হিসাবে জাহির করতে থাকলেন। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের যতটা পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর ততটা জনপ্রিয়তা ছিল না। পাঞ্জাব আর সিন্ধুতে ভূট্টোর পার্টির প্রভাব ছিল বেশি, বেলুচিস্তান আর উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ছিল না বললেই চলে। কিন্তু ভুট্টো জানতেন ইয়াহিয়া তাঁকে সমীহ করে চলতে বাধ্য থাকবেন। সরকার এবং সামরিক বাহিনীতে ভুট্টোর সাথে ঘনিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ছিলেন। এটা শেখ মুজিবেরও অজানা ছিল না। ইয়াহিয়া ভুট্টোকে তাঁর চেয়ে বেশি পাত্তা দিচ্ছেন এ নিয়ে শেখ মুজিবের ক্ষোভ ছিল।  

শেখ মুজিবের কথাবার্তায় হার্ডলাইনের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি ঘোষনা দিলেন, ছয় দফা এখন জনগণের সম্পত্তি। তাঁর উপর আওয়ামী লীগের হার্ডলাইনারদের এবং ছাত্রলীগের জঙ্গী অংশের চাপও ছিল, আগেই উল্লেখ করেছি। এরাও তাঁর জন্য দুশ্চিন্তার কারণ ছিল ।  

বোঝা যাচ্ছিল শেখ মুজিব নিশ্চিন্ত নন যে সামরিক জান্তা সুবোধ বালকের মতো ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেবে। ভয় ছিল চক্রান্ত হবে, ষড়যন্ত্র হবে, লোভ দেখানো হবে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভাগিয়ে অন্য দলে নেওয়ার চেষ্টা হবে। (তখন ফ্লোর-ক্রসিং বা দল পরিবর্তন করলেও সদস্যপদ রাখা যেতো।)  

তাই শেখ মুজিব আয়োজন করলেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানের। রেসকোর্সের ময়দানে একাত্তরের জানুয়ারীর তিন তারিখ ছিল এই শপথ অনুষ্ঠানের দিন। এই অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা দিলেন ছয়দফার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হবে। এটা ছিল এক ধরণের শোডাউন। শেখ মুজিব দাবী করলেন পনেরই ফেব্রুয়ারীর মধ্যে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের।  

দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা শেখ মুজিবের সাক্ষাকার নেওয়ার জন্য ভিড় করতেন তার ধানমন্ডির বাসভবনে। শেখ মুজিব তখন কি ভাবছিলেন বোঝা মুস্কিল। নানামুখী চাপের মধ্যে ছিলেন সন্দেহ নেই। মানুষ যে শুধু পাকিস্তানী রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ছয়দফার বাস্তবায়নের জন্যই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় নি তা নিশ্চয়ই তিনিও বুঝতে পারছিলেন। পরিস্থিতি যে তাঁর নিয়ন্ত্রণে নাও থাকতে পারে হয়তো তারও আশংকা করছিলেন।  ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের জন্য বিব্রতকর ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইয়াহিয়া সরকারের দহরম-মহরম। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক। (মার্কিন সামরিক জোটে পাকিস্তানের যোগ দেয়ার পক্ষে সোহরাওয়ার্দীর ছিল অকুন্ঠ সমর্থন। মুলতঃ এ নিয়েই বিরোধ হওয়ায় ভাসানী তাঁর নিজের গড়া দল আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ন্যাপ গঠন করেন পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে।) বাঙ্গালীর স্বাধিকার আন্দোলনে মার্কিন সরকারের সমর্থন যে পাওয়া যাবে না তা শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমেরিকান সরকারের বোঝা উচি বিশ্বের এই অঞ্চলে ভিয়েতনামের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা একমাত্র তিনিই ঠেকাতে পারেন।   

একাত্তরে আওয়ামী লীগ যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারতো, কেমন হতো সেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি? আমার বিশ্বাস শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের মতো জোটনিরপেক্ষ বা সোভিয়েতঘেঁষা না হয়ে মার্কিনপন্থী হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল বেশি। যদিও তাজুদ্দীনের মতো বামধারার নেতারা আওয়ামী লীগে তখন প্রভাবশালী ছিলেন, তবুও আমার মনে হয় শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত ঝোঁক ছিল বিপরীতমুখী। তাঁর এই ঝোঁকটা একাত্তরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্তিমিত ছিল বলেই আমার ধারণা। একাত্তরের পরে বাংলাদেশে তাজুদ্দীন ও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল তার কারণ অনুসন্ধান করলে আমার ধারণার পেছনে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে।       

ইয়াহিয়া খানের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। ইয়াহিয়া নাকি ছয়দফা ভাল করে পড়েই দেখেন নি, নির্বাচনের পরে পড়ে দেখে নাকি তাঁর চোখ কপালে উঠেছিল। এ তো দেখছি পুরোদস্তুর স্বাধীনতার দাবী। শেখ মুজিব নাকি তাকে নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ছয়দফা নিয়ে অহেতুক চিন্তিত না হতে ছয়দফা আল্লার বাণী নয়, মানুষের লেখা দলিল, তাঁর ভাষ্যানুযায়ী এইধরণের কথাই নাকি শেখ মুজিব তাঁকে বলেছিলেন।  

হয়তো বলেছিলেন। ইয়াহিয়ার কথা সত্যি না মিথ্যা তা ইয়াহিয়াই জানেন, তবে একজন অকর্মণ্য, মদ্যপ এবং ওম্যানাইজার হিসাবে তার কুখ্যাতি ছিল। ছয়দফা ভাল করে পড়ে না দেখার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তিনি যে একজন অপদার্থ এবং অপরিণামদর্শী প্রশাসক ছিলেন তারই প্রমাণ দিলেন।    

মার্চে কি এপ্রিলে আমাদের এইচ, এস, সি পরীক্ষা হওয়ার কথা, কিন্তু আমার পড়াশোনায় মন নেই। কেন যেন মনে হচ্ছিল পরীক্ষা হওয়ার মতো পরিবেশ দেশে থাকবে না। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আমি আরো বেশি করে জড়িত হয়ে পড়ছিলাম। প্রায় প্রতিদিন দলের (বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন) কার্যালয়ে যেতাম। তখন আমি কলেজের চত্ত্বর ছাড়িয়ে দলের শহর শাখায় (চট্টগ্রাম) সক্রিয়ভাবে সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছি।  

নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বামপন্থীরা বসে ছিল না। নির্বাচনের ফলাফল যে দেশকে সংকটের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না, বরং আরো গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে, তা তারা সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় যে শুধু আওয়ামী লীগ ও ছয়দফার প্রতি জনগণের সমর্থন নয় বরং সমাজতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি জনগণের রায় এই বোধটা বামপন্থীদের জন্য গৌরবের কারণ ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চেতনা, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী, আর অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা একইসাথে এই নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। বামপন্থীদের তাই লক্ষ্য ছিল এই অর্জনকে ধরে রাখার এবং আওয়ামী লীগের উপরে যে সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী শ্রেণীটির প্রভাব ছিল তা থেকে দলটিকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা।

মৌলানা ভাসানী শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে সতর্ক করে বলেছিলেন, বাংলার মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম শুভ হবে না। সাথে সাথে এও বলেছিলেন যে, শেখ মুজিবই হচ্ছেন জনগণের নির্বাচিত নেতা এবং মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি তার আস্থা রয়েছে। 

একাত্তরের বিশে জানুয়ারী আসাদ দিবসে আমাদের ছাত্র সংগঠন (পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন) দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিলো। আওয়ামী লীগের নেতারা বিরক্ত হলেও উচ্চবাচ্য করেন নি। আমাদের দলের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীকে সামনে নিয়ে আসা। হরতালের প্রস্তুতিকালীন সময়ে, খুব সম্ভবতঃ জানুয়ারীর পনের কিংবা ষোল তারিখের এক প্রচার মিছিল ও পথসভায় আমিও অংশ নিয়েছিলাম। এই কর্মসূচীতে আমরা ছিলাম মাত্র দশ-বারো জন। চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় জনাকীর্ণ সিরাজুদ্দৌলা রোড ধরে সন্ধ্যার কিছুটা পরে আমরা শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময়ে চারপাঁচ জন পুলিশের একটা দল আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা অবস্থা বেগতিক দেখে যে যেদিকে পারি ছুটে পালিয়ে গেলাম। শুধুমাত্র শহিদুল্লা ধরা পড়েছিল। শহিদুল্লা চট্টগ্রাম কলেজে আমার একবছরের সিনিয়র ছিল। হরতালের কিছুদিন পরে শহিদুল্লা ছাড়া পায়।

হরতালের আগের রাতে সারারাত জেগে রাস্তায় রাস্তায় ব্যরিকেড দেওয়া এবং হরতালের দিনও পিকেটিং ইত্যাদি নিয়ে আমরা বেশ ব্যস্ত ছিলাম। পুলিশের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক, কিন্তু কেন জানিনা তাদের আচরণ ছিল সংযত। তারা তেমন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে নি। হরতাল সারা পূর্ব বাংলায় সাফল্যের সাথে পালিত হয়েছিল। নিজেদের সাফল্যে আমরা খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। সাথে আনন্দ-উত্তেজনা তো ছিলই। আমার যতটুকু মনে পড়ে শুধুমাত্র একটা ছাত্র সংগঠনের একক আহবানে দেশব্যাপী হরতাল পালন পূর্ব বাংলার ইতিহাসে ছিল সেই প্রথম। বলা দরকার, আমাদের মুল দলের নামে হরতালের ডাক দেয়া তখন সম্ভব ছিল না। হরতাল সফল হওয়ার পেছনে কারণ ছিল স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের দাবীর জনপ্রিয়তা আর শহীদ আসাদুজ্জামানের জন্য সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও আবেগানুভুতি।  

জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে ইয়াহিয়া ঢাকা আসলেন শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে। কি কথা হয়েছিল তাদের মধ্যে তখন?   জানা সম্ভব ছিল না। কেননা এসব আলোচনা হতো রুদ্ধদ্বার কক্ষে এবং কেউই এসব নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতেন না। সাংবাদিকদের সাথে কথা বললেও দায়সারা গোছের জবাব দিতেন। তবে পরবর্তীতে প্রকাশিত অনেকেরই লেখা এবং কথাবার্তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে।  

ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের আগেই পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাদের, বিশেষ করে ভুট্টোর সাথে সমঝোতায় আসতে বলেন। আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল, সব আলোচনা-সমঝোতা হবে জাতীয় পরিষদেই। এমন কি ছয়দফা নিয়েও আপোষরফা হতে পারে, কিন্তু তা হতে হবে জাতীয় পরিষদে। কিন্তু তবুও ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে রাজী করালেন ভুট্টোর সাথে কথা বলতে।  

আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি করা। আর এই কৌশলের অংশ হিসাবে শেখ মুজিব তাঁদের মধ্যকার একান্ত আলোচনার সময়ে ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। (Sisson and Rose, War and Secession ) খুব সম্ভবতঃ ইয়াহিয়া সেই প্রস্তাব সাথে সাথেই গ্রহণ করেন নি কিংবা প্রত্যাখানও করেন নি, পরে দেখা যাবে গোছের উত্তর দিয়ে আলোচনা শেষ করেছিলেন। তবে মুজিবের সাথে আলোচনার ফলাফলকে সন্তোষজনক ভেবে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের বললেন, শেখ মুজিব দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী  

কিন্তু দুদিন পরেই ভুট্টোর লারকানার জমিদার বাড়ীতে গেলেন ইয়াহিয়া পাখী শিকারের দাওয়াত রক্ষা করতে। শেখ মুজিব মনক্ষুন্ন হলেন। ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর মধ্যকার ব্যাক্তিগত সম্পর্ক যে তাঁর আর ইয়াহিয়ার সম্পর্কের চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ট এই বোধোদয় মুজিবের জন্য সুখকর ছিল না। বুঝলেন ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টির কৌশল হয়তো কার্যকরী হবে না। ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথাই শুনবেন।  

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া ভুট্টোকেও রাজী করালেন ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে। জানুয়ারীর শেষের দিকে দলবল নিয়ে ভুট্টো ঢাকা আসলেন। এসেই শেখ মুজিবের সাথে দেনদরবার শুরু করলেন। কিন্তু ছয়দফার ব্যাপারে তারা খুব একটা কথাবার্তা বললেন না। ভুট্টোর উসাহ ছিল ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে কথা বলায়। ভূট্টো সরকারে অংশীদারিত্ব চেয়েছিলেন। বিরোধীদলের আসনে বসার আগ্রহ ভুট্টোর ছিল না। তিনি নিজের জন্য উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ চেয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন নিজের দলের জন্য চারটি মন্ত্রীপদ। আওয়ামী লীগ রাজী হয় নি। ভুট্টো শেষে নাকি প্রেসিডেন্টের পদ চেয়েছিলেন। নাম উল্লেখ না করে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ওটা একজনকে দেয়া হয়ে গেছে 

আওয়ামী লীগ আর পিপলস পার্টির মধ্যে এই আলোচনা নিয়ে পরে একেকজন একেক রকম কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন আলোচনা সন্তোষজনকভাবেই শেষ হয়েছিল, আবার কেউ বলেছেন দুইপক্ষই একে অপরের উদ্দেশ্য নিয়ে আরো বেশি সন্দিহান হয়ে, একে অপরের উপর আরো বেশি অবিশ্বাস নিয়ে আলোচনা শেষ করেছিলেন।     

অবশেষে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করলেন। অধিবেশন বসবে ঢাকায় মার্চের তিন তারিখে।  

ফেব্রুয়ারীর শেষ দুই সপ্তাহ ঢাকা ছিল রাজনৈতিক নাটকের রঙ্গমঞ্চ। একদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্র রচনায় ব্যস্ত, অন্যদিকে তরুণ ছাত্রকর্মীরা স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার। জয় বাংলা বাহিনী নামে একটা সংগঠন পনেরই ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার দেয়। এই অনুষ্ঠানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখা যায়। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রভাবশালী একটা অংশ তখনই (ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে) স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে শেখ মুজিবের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। পরে মার্চের দুই তারিখে (জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিক ভাবে এই পতাকাকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে ঘোষণা দেয়।) আজকের পতাকার লাল বৃত্তের মাঝখানে তখন বাংলাদেশের মানচিত্র সোনালী রং-এ আঁকা থাকতো।  

ওদিকে ভুট্টোও বসে ছিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করার কাজে তিনি এইসময়ে খুবই সক্রিয় ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থন লাভের জন্য মরিয়া হয়ে ছোটাছুটি শুরু করলেন। সামরিক বাহিনীর অন্যান্য প্রভাবশালী অফিসারদের কাজে লাগাতে চেষ্টা করলেন ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। তাঁর দলের সদস্যদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নিয়ে রাখলেন। অন্যান্য দলের সদস্যদের হুমকি দিলেন, ঢাকায় গেলে পা ভেঙ্গে দেয়া হবে বলে।   

ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠালেন। বার বার তাগাদা দেয়া সত্বেও মুজিব গেলেন না, ইয়াহিয়া খুবই নাখোশ হলেন। ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভূট্টোর সাথে সমঝোতায় আসার জন্য মুজিবের উপর চাপ সৃষ্টি করা। শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য।  

ভুট্টোর চাপে শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। মার্চের এক তারিখে ঘোষণা দিলেন তিন তারিখের অধিবেশন স্থগিত করা হলো আনির্দিষ্ট কালের জন্য। পূর্ব বাংলা ফেটে পড়লো বিক্ষোভে। ফুঁসে উঠলো জনগণ। সেদিন থেকেই মানুষ কার্যত বাংলাদেশকে স্বাধীন হিসাবে ভাবতে শুরু করলো। সেদিনই যেন সবাই একযোগে সিদ্ধান্ত নিল - আর নয়, পাকিস্তান আর নয়। শেখ মুজিবের মুখ থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটাই শুধু শোনার অপেক্ষা মাত্র

________________________________________________________________________

এই জাতীয় লেখার বেশির ভাগই স্মৃতিচারণমূলক। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার চাইতে নিজের মত এবং পছন্দের রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে সাফাই গাওয়ার একটা প্রবণতা এসব বইতে দেখা যায়। যারা লিখেছেন তারা তখনকার ঘটনাবলীর সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত ছিলেন। অনেকের লেখায় আবার গুরুত্বপূর্ণ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাকারও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। স্বভাবতই এদের লেখা এবং যারা সাক্ষাকার দিয়েছেন তাদের বক্তব্য পুরোপুরি না হলেও অংশতঃ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। তাই এইসব বইতে লেখা তথ্য এবং তথ্যের ব্যাখ্যা গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে পাঠকদেরই, নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করে সতর্কতার সাথে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে একাডেমিক গবেষণা এবং লেখালেখি প্রায় হয় নি বললেই চলে। তবে ব্যতিক্রম আছে। এদের মধ্যে একটা হচ্ছে War and Secession: Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh, by Richard Sisson and Leo E. Rose, University of California Press, 1990। আমি আমার এই লেখায় এই বইটা থেকে অনেক তথ্য নির্ভরযোগ্য মনে হওয়ায় ব্যবহার করেছি। তবে শুধু তথ্যই, মতামত এবং বিশ্লেষন আমার নিজস্ব।  

অক্টোবর ২৯, ২০০৮

(চলবে)


ড. ইরতিশাদ আহমদ ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারপার্সন। তিনি জার্নাল অব ম্যানেজমেন্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর সম্পাদক।    ইমেইল : [email protected]