বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১১
বাসুন,
আজ তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম রয়েল অন্টারিও মিউজিয়ামে । ছুটিরর দিন, আগে থেকেই সব প্রন্তুতি ছিলো আমাদের, তবুও ভিতরে ভিতরে আমার বেশ উত্তেজনা ছিলো। কারন কানাডা আসার পর আমিও আজই প্রথম এরকম মিউজিয়ামে যাচ্ছি । আসলে সোনা, সেদিন হঠাৎ করেই কথাটা তুলেছিলো আমার নতুন চাকরির জায়গার সহকর্মী নিরু মির্সা। ও আমাকে পথঘাট দেখিয়ে দিলো, কি করে কমখরচে আমি তোকে এরকম মিউজিয়ামে নিয়ে যেতে পারি । সেই কথামতোই আমি আর তুই কাঁধে হ্যাভারস্যাক ঝুলিয়ে রওনা করেছিলাম। আমাদের সঙ্গী হলো তোর সেরিন খালা ও তার বাচ্চারা । এখন টরোন্টোতে সামারের আমেজ শেষের দিকে, তবুও আজ ঝকঝকে রোদ ছিলো চারিদিকে । মিউজিয়ামের গেটে ঢুকতেই যদিও আমি ফিরে গিয়েছিলাম ন'বছর আগে। ১৯৯৮ সালে আমি ঘুরেছিলাম বৃটিশ মিউজিয়াম, তোর বাবা আর আমি। এরপর আজকে এই ২০০৭ সাল। হায়রে সময়। আজ সারাদিন তাই মনের ভেতর তোলপাড় করেছিলো সেই ফেলে আসা সময় । সময় জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক, এ কথাটা তোর বাবাই বলতো বার বার।
তোকে নিয়ে মিউজিয়াম চত্বরে ঘুরছি আর চোখের সামনে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে সব পুরোন পুরোন সংগ্রহ, বিশাল বিশাল কাচের ঘরে শোভা পাচ্ছে ইতিহাস । কোনটা রেখে কোনটা দেখবো? কত কি জানার আছে, বোঝার আছে। পৃথিবীর তাবৎ সব সামগ্রী যেন জড়ো হয়েছে এক বিশাল ছাদের নীচে। প্রতিটি দেশ দিয়ে, সীমানা দিয়ে, ছবি দিয়ে, সামগ্রী দিয়ে আলাদা করা হয়েছে ঘরগুলোকে। মিউজিয়াম এর ভিতর একজন মহিলা সবাইকে ঘুরে ঘুরে ছবি সামগ্রী এবং বিযয়বস্তুর বর্ননা করছিলেন। সেরিন এর মেয়েটা ছোট বলেই আমি তোকে চোখে চোখে রাখতে পারিনি। আবার রাখতেও চাইওনি বলতে পারিস । বাইরে গেলে আমি সবসময় চাই তুই একা একা দায়িত্ব নিয়ে চলতে শিখবি। ( এই ফাঁকে তোকে বলে রাখি বাবু সেই চৌদ্দমাস থেকে তোকে ঢাকায় রেখে আমি ফিল্ডে যেতাম। তখনো তোকে নিয়ে আমার কষ্ট হতো না সোনা।) তাই সত্যিকার অর্থেই এই বয়সেই তুই বেশ সাবধানী হয়ে গেছিস বাবু । যাই হোক, আমি বর্নমালা, মানে সেরীন এর মেয়েকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন ব্যস্ত থাকাতেই তোকে খেয়াল করতে পারিনি। বেশ অনেকক্ষন পরে দেখি তুই সেই টীম এর সবচেয়ে পুঁচকে মেম্বার হয়ে ওদের সাথে ঘুরছিস আর বিজ্ঞের মতো হা করে ওই মহিলার কথা গিলছিস। হ্যাঁ রে সোনা, ১৯৯৮ সালে আমি আর তোর বাবা যখন প্রথম বৃটিশ মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম তখন আমাদের সংগী ছিলেন বাংলাদেশের প্রবীণ শিক্ষাবীদ প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ। পরিচয়ের শুরু থেকেই আমরা তাকে নানা ডাকতাম। সেবার নানা আমাদেরকে বুঝিয়েছিলেন। গোটা বৃটিশ মিউজিয়াম এর একটি অংশ দেখতেই আমাদের প্রায় সারাদিন লেগে গিয়েছিলো । আজ নয় বছর পর তোর অবাক হওয়া চাউনিগুলোতে যেন আমি নিজেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম বার বার । ইতিহাস নাকি ঘুরে ঘুরে আসে? সত্যিই কি তাই হলো সোনা? ১৯৯৮ সালের সেই দিনটাতেই কি আমার নিয়তিতে লেখা হয়েছিলো যে, একদিন তোকেই আমার হাত ধরে ধরে ঘোরাতে হবে ইতিহাসের দরজায় দরজায়? তোকে নিয়ে আজ আমার খুব সুন্দর সময় কেটেছে বাবু। তুই আমার কতলক্ষ্মী ছেলে হয়েছিস, জানিস সোনা তুই। বাইরে গেলে তোকে নিয়ে আমার কোনদিন কোন অসুবিধা হয় না, কোনদিন তুই আমাকে বিরক্ত করিস না। এই যে আজকে গোটা দিন তোকে নিয়ে কাটলো, কতকিছু বুঝতে চাইলি তুই, আগ্রহ নিয়ে শুনতে চাইলি। আমি কি আর সব কিছু গুছিয়ে বলতে পারি সোনা ? আমিও তো তোরই মতোই নতুন। তবুও সোনা আমি তোর হাত ধরে ধরেই একদিন এই পৃথিবী চিনে নেবো। তোকে সংগে নিয়েই অচেনা এই ভুবনকে ইতিহাসের মতো আলোকিত করে তুলবো আমি। এই তো আর অল্পকয়েকটা দিন বাসুন। তোকে পাশে নিয়েই আমি বিশ্বের সব বড় বড় মিউজিয়াম এর তীব্র আলোর নীচে দাড়াবো। তোর আজকের এই অবাক করা চাউনিতে আমি খুঁজে ফিরবো নিজেকে। আমার আজকের এই ফেলে যাওয়া দিনই সেদিন ইতিহাস হবে। নিঃশব্দ রাতে তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর যে ডলারের হিসাব মেলানোর জন্য আমাকে বিহবল হতে হয়, আরো একটা দিনের নিরাপত্তা খোঁজার জন্য যে দুঃশ্চিন্তাকে আমি সঙ্গী করি, এই কষ্টগুলোই, এই দিনগুলোই একদিন আলোর মতো ঝলমলে হয়ে উঠবে। আমার আর তোর জীবন ভরে উঠবে সোনার আলোয় বাবু। আদর তোকে।
তোর মা,
১৬ ই সেপ্টেম্বর , ২০০৭।
Email:[email protected]
টরন্টো, কানাডা।