বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১০
বাসুন,
রাত মাত্র সোয়া নয়টা, লং উইক্এন্ড এর মাঝের দিন অর্থাৎ আজ রবিবার। এই শহরের বেশীরভাগ মানুষের কাছেই “নাইট ইজ স্টিল ইয়াং।“ মানুষ ছুটছে- বন্ধু, প্রেমিক, প্রিয়জন, এক শহর থেকে অন্য শহরে কারন আনন্দ করতে হবে, ছুটি উপভোগ করতে হবে --- নর্থ আমেরিকান কালচার------।
কি লিখতে গিয়ে উপরের লেখাটুকু গতরাতে তোকে লিখেছিলাম বাবু সেই প্রসংগ এখন আর মনে পড়ছে না। এখন সকাল পৌনে সাতটা, চারিদিকে ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই আজ ঘুম ভাংগালো তোর ক্যানব্যেরার এক নানীর ফোনে। ওর নাম উর্মি । হঠাৎ দেখি ভোর পাচটায় আমার সেল ফোন বেজে উঠেছে, ওপাশ থেকে স্বজন কন্ঠস্বর । উর্মি সর্ম্পকের দিক থেকে তোর নানী, আমার খালা কিন্তু বয়সে অনেক ছোট। তোর নানীআপুর আপন মামাতো বোন। দীর্ঘদিন পরে ফোন করেছে ও । বাসুন, তোর বয়স যখন নয় দশ মাস তখন তোর এই ইয়াং নানী আমাদের ঢাকার বড়িতে যাওয়া আসা করতেন। সেইসময় উর্মি ভীষন আদরও করতো তোকে। তাই আজ এতদূর থেকে বার বার জিজ্ঞেস করছে তোর চেহারা একইরকম আছে কিনা ? তুই কেমন আছিস ? কেমন হয়েছিস দেখতে, ইত্যাদি নানান প্রশ্ন। মানুষ ভীষন ভালোবাসে তার পিছে ফেলে আসা সময়কে ঘুরে ফিরে দেখতে। আমরা যখন ছোট ছিলাম মানে এই ধর তোকে বলছি ২০ বছর আগের কথা, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ এই সময়কালের কথা। আমরা ঢাকা থেকে কখনো কখনো বিভিন্ন উপলক্ষকে সামনে রেখে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। আহ কি যে সোনার দিনগুলো ছিলো তখন । মাগুরা শহরের সেই ছায়াঘেরা উর্মিদের বাড়িটাই আমার ছোটবেলার অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। উর্মির বাবা যিনি আমাদের ছোট নানা তিনি শুধু ইংলিশ গ্রামার ধরতেন । বাড়িতে উপস্থিত হবার সাথে সাথেই লম্বা মাটির ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় পাটি পেতে বসে যেতেন নানা। তারপর আমাদের সবাইকে ডাকতেন, এই তোরা এদিকে আয়। পিল পিল করে এগিয়ে আসতাস আমরা। ছোটনানার চারছেলে (সুজা, দ্বারা, আড়ং, মুরাদ আর সব ছোট মেয়ে উর্মি)। এদিকে আমরাও চারবোন । সবাই সমবয়সী আমরা। কত হবে আমাদের সবার বয়স তখন? ১২ থেকে ২১ এর ভিতর। নয় জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে নানা আসন গেড়ে বসতেন । তারপর শুরু হতো ইংলিস টেনস, সেন্টেন্স মেকিং, ম্যাথ। আমার সময় সময় মনে হতো নানাকে আমি খুন করি, কেন উনি পড়া ধরেন? কিন্তু কোন উপায় নেই, এই বৈতরনী পার হতেই হবে, তবেই মিলবে নানীর হাতের সকালের তৈরী দুধ চিতই পিঠা, পালং শাক দিয়ে চিতই পিঠা বা দুধ লাউ । সেই সাধ আর তৃপ্তি বাকী জীবনে আর মেলেনিরে সোনা। কেন সময় চলে যায়? কেন বয়ে যায় জীবনের বেলা? কেন ফেরাতে পারি না অল্পকিছু স্মৃতি বা আনন্দময় অতীত? প্রশ্নটা আমার যতবার মনে হয় ততবার আমার চোখের কোনা ভিজে উঠে বাবু। ভীষন স্মৃতি আক্রান্ত মানুষ আমি । সেই যে তের চৌদ্দ বছর বয়সে ঢাকা থেকে বাসে করে মেঘনার বুকে ছোট ছোট লঞ্চ ভিড়িয়ে নিয়ে আমরা নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম, সেই আনন্দ আর উত্তেজনার কথা লেখার শক্তি আমার নেই। শুধু আছে প্রচন্ড ভালোলাগার আর আনন্দের অনুভুতি । আমরা চার বোন, বাবা, মা মিলে সেই ভরা কেজলি নদীতে, নৌকায় ভেসে ভেসে ঘুরতাম গ্রামের পর গ্রাম । শ্রীপুর, বরিষাট, পারনান্দুয়লী আর সারা গ্রাম ভেঙ্গে আমাদের কে দেখতে আসতো। সারা গায়ের লোকেরা ভোরের আলো ফোটার আগেই হাজির হতো নানীবাড়িতে/দাদিবাড়িতে ।
সেই ভোর আর আজকের টরোন্টো শহরের ভোর, আমার জীবনের আজকেও একটি ভোর। এখন সকাল সাতটা। লিখতে লিখতেই আমার ছোট জানালার বাইরে দিয়ে আমি আইওণভিউ রোডটা দেখতে পাচ্ছি । আজ থেকে মাত্র দেড়মাস আগে সামারের এই বন্ধে তোকে চিঠি লেখা শুরু করেছিলাম। এই তো শেষ। আবার চলে আসবে অন্ধকার করা বরফের দিন। আমি হয়তো আজকের এই ফেলে যাওয়া সময় এর জন্য আকুল হয়ে পড়বো কোন একদিন।
বাসুন আমার, আগামীকাল থেকে তোর স্কুল শুরুর ভোর হবে। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে চায় সোনা। আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা আমার হারিয়ে যাওয়া সময়। “কে হায় হদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে চায়?” আমি চাই, আমি চাইবো, আজন্ম চাইবো বেদনা জাগাতে। ভালোবাসা এবং বেদনার রং নীল, সোনা। তেমনি আমার জীবনের নীল আকাশ ভরা থাকবে আনন্দময় স্মৃতি দিয়ে ।
তোর মা,
৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৭
টরন্টো, কানাডা। Email:[email protected]