বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১৩
বাসুন,
বাবু, আজকে তোকে জীবনের কিছু সম্ভাবনার কথা বলবো, আমাকে বলতেই হবে কারন তোর কাছে দুঃখের প্যাচাল পাড়া আমার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে অথচ প্রতি মূহুর্তে জীবনে যে বিপুল অভিজ্ঞতা আর আলোকিত হবার মতো গল্পকে নিয়ে আমি পথ চলছি সেগুলোও তো তোকে বলা দরকার। নইলে তুই জানবি কি করে যে, প্রচন্ড প্রতিকূলতা আর ঝুঁকিই শুধু মানুষকে সফল করে তোলে । ২০০১ সালে আমি বাংলাদেশে একটি আন্তর্জতিক সংস্থায় কিছুদিন কাজ করেছিলাম। প্রতিষ্ঠানের নাম ”দি হাংগার প্রজেক্ট, বাংলাদেশ।“ মাত্র ছয়মাসের অভিজ্ঞতা আমার জীবনের মোড়কে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, আমি বিশ্বাস করেছিলাম মানুষের অসীম সম্ভবনা আর সফলতার কাছে তার ব্যর্থতার পরিমান নেহায়েতই সামান্য আর এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ ব্যক্তি নিজেই। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে আমরা একটা দল ট্রেনিং করে বেড়াতাম। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ঘুরেছি আমি। সেই সময় এক সেশনে বড় বড় করে একটা লেখা আমার চোখে পড়ল, ”আপনি যদি দ্যাখেন সম্ভাবনার সব আলো নিভে গেছে তবুও জানবেন আপনার জন্য নিশ্চয়ই কোন না কোন জানালা খোলা আছে, আপনি শুধু একাগ্র চেষ্টা করুন।“ পৃথিবীর সব সাফল্যর পিছনেই এই সত্য কাজ করে । তুই কি জানিস শুধু তোকে নিয়ে কানাডা আসার জন্য কি কি করেছি আমি ? তোকে একটু বলি, শোন তাহলে। আমি শুধু ইমিগ্রেশন ফি জমা দেবার জন্য একটা পারমানেন্ট কাজ ছেড়ে সেভ দ্য্ চিলড্রেন এর একটি কন্ট্রাক্ট কাজে জয়েন করেছিলাম। তোর আর আমার জন্য চার বছর ধরে টাকা গুছিয়েছিলাম, মাত্র তিনবার আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবং শেষমেষ যখন তোকে নিয়ে রওনা হই তখন আমি একটা নিশ্চিন্ত চাকরি যা হয়তো ৬০ বছর পর্যন্ত করতে পারতাম তা ছেড়ে এসেছিলাম। আজ এই কথাগুলো বলছি এই কারনেই যে, আমি কানাডা এসে দেশ উদ্ধার করেছি বা নিজেকে উদ্ধার করেছি তা নয় বরং ৩৬ বছর বয়সে যে আবার শুন্য থেকে শুরু করার মতো সাহস আর যে অদম্য ইচ্ছে আমার আছে তা হয়তো আমার নিজের দেশে বসে থাকলে বুঝতেই পারতাম না। সেই যে সম্ভাবনার শেষ আলো দেখার তীব্র ইচ্ছে আমার ভিতর তৈরী হয়েছিলো, সেই একাগ্রতার কাছে আমি হার মানিনি আজো। জানিস সোনা, একটা ফুলটাইম ভালো কাজ আমাকে পেতেই হবে, এই চেষ্টাকে সাথে নিয়ে গত দুই মাসে আমার এই পার্টটাইম কাজের পাশে যে কাজগুলো আমি করছি তা ভাবলেই আমার নিজের কাছেই অবাক লাগে। কেবলি মনে হয়, আমি কি সেই মেয়ে যে একজন সামান্য কলেজ শিক্ষকের ঘরে জন্মেছিলাম, বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র্য এলাকা রংপুরে, যেখানে খাবারের অভাবে আজো মানুষ গলগন্ড রোগে আক্রান্ত হয়? আমি সম্প্রতি একটি জব সার্চ প্রোগামে কাজ করছি। মাত্র তিন সপ্তাহের এই কাজে কত বিচিত্র ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচয় হলো তারই কিছু নমুনা বলি তোকে। ৫১ বছর বয়সী মিখেলার মূল বাড়ি ইতালীতে, কানাডায় ও এসেছিলো ৫ বছর বয়সে। প্রায় ২০ বছর একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর ওর চাকরি চলে গেছে। তাই মিখেলা আবার নতুন করে ওর ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য যুদ্ধ করছে। কালো মেয়ে পলিন এসেছে জ্যামাইকা থেকে। গত চারবছর ও একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই তা জোটাতে পারছে না। তাই যেদিন আমি পলিন কে বললাম পড়া শেষ করার দেড় মাসের মাথায় আমি একটা পার্টটাইম কাজ পেয়েছি এবং ফুলটাইম কাজ খুঁজছি তাই শুনে পলিন বলল, “গো হোম এনড টেক রেষ্ট।“ চাইনিজ ছেলে ফ্রাংক টরোন্টোতে এসেছে তিন মাস হলো। চায়নাতে ও একটি কোম্পানীতে একাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করতো। পরিচয়ের শুরুর দিন বলল, ও স্বপ্ন দ্যাখে ও একদিন পুরোদমে ইংরেজী বলবে। আমার ঠিক পাশের চেয়ারে বসে ছিল ফর্সা সুন্দর ফুটফুটে ফিলিপিনো মেয়ে লিসা (ওর আসল নাম ফেং, কানাডায় এসে ওরা নাম বদলে ফেলে)। ওর ইচ্ছে ও একদিস লোটো খেলে মিলিয়ন ডলার জিতবে। চাকরি, পড়াশুনা সবকিছুর বাইরে এই স্বপ্ন লিসাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। শ্রীলংকা থেকে বছর পাঁচেক আগে এসেছে ৩৪ বছরের তরুন ছেলে সিভা। ওখানে ও একটি কলেজে পড়াতো। এখানে এসে প্রথম দুবছর শ্রমিক এর কাজ করেছে একচি ফ্যাক্টরিতে। এখন হাত পা ব্যাথা করে তাই নতুন করে চাকরি করার জন্য নিজেকে উপযোগী করছে। সবচেয়ে অবাক হলাম সাউথ আফ্রিকান ব্লাক মেয়ে জোয়ানকে দেখে। ও আমাকে বলেছে জব নেই তাই কষ্ট পাচ্ছো, কেন? এটা তোমার সমস্যা না, সরকারের সমস্যা। তুমি আনন্দ করো। দ্যাটস ইয়োর লাইফ, এনজয় ইয়োর সেলফ, বলেই লাঞ্চ আওয়ারে বন্ধু ব্রায়ান এর কোমর পেঁচিয়ে বেরিয়ে যায় সে। ৪২ বছর বয়সী জোয়ানের এটা চতুর্থ বয়ফ্রেন্ড।
আর না সোনা, আজকে আর না। রাত প্রায় দেড়টা, কাল আবার একটা দিন শুরু করবো তোকে নিয়ে। ঘুমিয়ে আছিস তুই। কি পবিত্র আর মোহনীয় লাগছে তোকে দেখতে। আমি তোকে নিয়ে ভালো আছি সোনা, খুব ভালো আছি। তুই সুস্থ্য আছিস, আমি কর্মক্ষম আছি, জীবনে আশা আছে/দুঃখ আছে, সুন্দর আগামীর হাতছানি আছে, আর কি চাই এই জীবনে, বল সোনা ?
তবে সফল আমাকে হতেই হবে। কোন একদিন ঠিকই তোকে নিয়ে আমি পৌঁছে যাবো সেই সম্ভাবনার দরজায়, যেখানে যাবার জন্যই আমার আজকের সব আয়োজন। তোকে অনেক আদর সোনা, সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠ তুই।
তোর মা,
১৬ অক্টোবর, ২০০৭
Email:[email protected]