বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১৪
বাসুন,
টরোন্টো শহরে এখন বেলা ছোট হয়ে আসছে। তুই স্কুল থেকে ফিরিস সাড়ে তিনটার দিকে, আমিও ফিরে আসি কাজ থেকে তার মধ্যেই। আমরা মা বেটা দু’টো ভাত খেয়ে একটু হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতেই দেখি কেমন ঝপাত করে রাত নেমে আসে । আজ তবুও তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম কালকের জন্য হ্যালোইন ড্রেস কিনতে। কাল কানাডায় এই দিবস পালিত হবে । ফেরার পথে তুই বললি টিমবিটস খাবি। তাই তোকে নিয়ে বসেছিলাম টিম হর্টনে। সেখানে বসেই ভাবছিলাম বাড়িতে এসেই তোকে চিঠিটা লিখবো। সারাদিন নানান কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার মাথার ভিতরে পোকার মতো কথাগুলো ঘুরছিলো, কেমন করে আমরা একটি মেরুদন্ডহীন জাতি হয়ে গিয়েছি? সকালেই মুক্তমনাতে ফরিদ আহমেদ এর “কনফিউজড এক জাতির গল্প” লেখাটা পড়েছিলাম । ফরিদ দেশের চলমান রাজনীতিতে সম্প্রতি জামাতের অবস্থান এবং আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে আলোচলা করেছেন। আসলে কি জানিস বাবু, আমার এখন মনে হয় এ ধরনের আলোচনা যথেষ্টই হয়েছে গত ৩৬ বছরে। এবার সরাসরি কথা বলা উচিত। কারন লেবু বেশী কচলালে যেমন তিতা হয় তেমনি দেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে তুলে না ধরে আমরা কথা বলছি বেশী বেশী। যার কারনে আমাদের সামনে তৈরী হয়েছে এক অন্ধকার প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একটি শক্তিকে দেশের ক্ষমতা কাঠামোতে দেখলো জন্মের পর পরই। যে শক্তি (মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি) আমাকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করেছে তাদের এই করুন পরিনতির জন্য কিন্তু আজকে প্রথমত তারাই দ্বায়ী। অর্থাৎ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই আজকের এই বাংলাদেশকে তৈরী করেছে ।
বাবু, আমার এখনো মনে পড়ে বিশ্বদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি শিবিরের ছেলেমেয়েদের দেখেছি কি সাংগঠনিকভাবে পথ চলতে। ওরা প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতো হিসাব করে করে। আর এই আমরাই প্রগতিশীলতার নামে বার বার পরাজিত হয়েছি নিজেদের নীতি এবং সীমাবদ্ধতার কাছে। আমাদের সময় থেকে আজকে পর্যন্ত বাংলাদেশে জামাত বা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছেলেমেয়েরাই বছরশেষে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় বিশ্বাবদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ঢুকেছে। তিলে তিলে খুব পরিকল্পনা করেই রাষ্ট্র কাঠামোতে ওরা নিজেদের আসন পাকা করেছে। তাই যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার এই রাজাকার আলবদরদের সাথে কথা বলার সময় মাথা নুয়েছে। একটু রয়ে সয়ে তাদেরকে হ্যান্ডেল করেছে, যার ফলাফল আজকের এই বাংলাদেশ। “ছোট ছোট চারাগাছ আজ মহীরুহ হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছে”, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের বড় গলা শুনে শুধু এই কথাটাই মনে পড়ে।
বাবু, আমার মা আমাকে তার জরায়ূতে ধারন করে এই পৃথিবীতে এনেছে আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। আমার কাছে তাই মা ও মাটি দুইই সমান সন্মানের দাবীদার। বাংলাদেশ থেকে যত দূরেই থাকি না কেন, যারা একদিন আমার আত্মপরিচয় মুছে দিতে চেয়েছিলো, যারা আমার ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো তাদেরকে কোন দিন মাফ করবো না, কোন দিনই না।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শামীম আপার বাড়িতে যাওয়া আসা করতাম। আপার জমজ ছেলেমেয়ে ছিলো- প্রমা ও জিস। ওদের জন্য একদিন সেজান জুস নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা তখন ৭ বছর বয়সি হবে। ওরা আমাকে বলল, “তুমি জানো না লুনা খালা, আমরা পাকিস্তানী তৈরী কোন জিনিস খাই না।” আজকের বাংলাদেশে আমি এরকম প্রজন্মের স্বপ্ন দেখি। অথচ কোন অন্ধকার সময়ে দাড়িয়ে আছি আমরা? আজকে সেই পাকিস্তানী মৌলবাদী চক্র দেশে মন্ত্রীর পদ অলংকরণ করে বসে আছে। যতভাবে একটি জাতি নিজের আত্মসন্মান বিসর্জন দিতে পারে তার সবগুলোই আমরা ইতোমধ্যেই করেছি।
বাবু, তোকে কথাটা শুরুতেই বলতে চেয়েছিলাম, এবার সরাসরি বলছি, সময় এসেছে আরো একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার। আরো একটি মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তৈরী হতে হবে আমাদের এই বাংলাদেশে। আদর।
তোর মা,
৩০ অক্টোবর, ২০০৭
Email:[email protected]