বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১৫
বাসুন,
মাত্র এক সপ্তাহ আগে তোর ছোটখালা মানে শাহিন আমাকে বেশ কিছু প্রিয় সিডি পাঠিয়েছে। সেই সিডির একটা, শচীন দেব বর্মন চলছে আমার ঘরে। ”তুমি চলে যাইবা রে বন্ধুরে দূর কোন পরবাসে”। বাবু , তোকে এই চিঠি লেখার শুরুতে বলেছিলাম, জীবনে অনেক কিছু শুধু তোকেই বলে যাবো। আজ এই গভীর রাতে তোকে নিজের জীবনের একান্ত কিছু কথা বলতে ভীষন ইচ্ছে করছে রে সোনা । কেন এমন করে হঠাৎ হঠাৎ জীবনটা এলোমেলো লাগে বলতে পারবো না, কিছুতেই বলতে পারবো না। তবে সব মানুষেরই এমন হয়, গভীর কোন রাত, নীরব একাকী মুহুর্ত। এই যে বাবু মাথার কাছে গান বাজছে, ”পদ্মার ঢেউ রে,আমার শুন্য -” কি অপূর্ব গান জানিস সোনা তুই? কোনদিনই কি জানবি তোরা ? না জানলেই মনে হয় ভালো থাকবি আজীবন। আমার ঘড়িতে এখন রাত দেড়টা, আমার এমন হয় না, বেশীর ভাগ দিনই আমি ঘুমিয়ে পড়ি তোর সাথেই। কিন্ত কিছু কিছু রাতে এমন হয় নিজেকে সামাল দিতে পারি না, গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। জীবনের হিসেব মেলাতে চেষ্টা করি, ফিরে যাই অতীতে। অনেক গভীর দূর অতীতে ফিরে যাই আমি। তোকে একা একা বড় করে তুলছি সোনা। প্রতিটা দিন অপেক্ষা করি আরো বেশী নিশ্চিত ও নিরাপদ সময়ের জন্য। তোর অনাবিল শিশু মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে থাকি, তোকে নিয়ে সময় বয়ে যায়। কিন্তু জানিস বাবু এর ভিতরই কখনো কোন কোন গভীর রাতে হাহাকার লাগে, ভীষন হাহাকার সোনা। না পাবার হাহাকার, আমার অতৃপ্ত জীবন ও সময় আমাকে মনে করিয়ে দেয় হয়তো কোন পরম ভালোবাসার ছোঁয়া পাবার মৌলিক অধিকার আমার ছিলো। আমি জানি সোনা, যেদিন তুই এই লেখা পড়বি সেদিন আর আমার জীবনের সময় থাকবে না, সেদিন হয়তো তুই আমাকে বলবি – ”কেন মা তুমি আমার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছো? কেন তুমি এভাবেই সময়টা বইয়ে দিলে? ” আমি জানি সোনা যে প্রশ্ন আজ আমার চারপাশের মানুষ করে, একদিন তুইও সেই প্রশ্নই করবি। আমার এই মুহুর্তের আবেগ আমার নিজের কাছেই খুব হালকা মনে হবে। সকাল হবে দিনের আলোয় আমি আমার নিত্য ব্যস্ততায় ভরা আরো একটা দিন শুরু করবো। আমি ছুটে বেড়াবো বাঁচার তাগিদে। তোকে ভালোভাবে গড়ে তোলার নেশায় বয়ে যাবে আমার জীবনের আরো দু-দশ বছর যেমন গিয়েছে গত ছয় বছর। কিন্তু সোনা আমি তো বহুবার ভেবেছি, নিজেকে বলেছি তোকে নিয়ে আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি তবুও এই নিঃশব্দ রাত গুলো আমাকে আলোড়িত করে কি করে? কেন এই মুহুর্তে অনুভতি গুলো দলা পাকিয়ে আসছে মনের ভিতর ? না পাবার কি তীব্র আকুলতা, কিসের অপূর্নতা সোনা? কেন মনে হচ্ছে শুন্যতায় ভরা আমার গোটা জীবন? এই যে ছোট মানুষটা, তুই আমার পাশেই ঘুমিয়ে আছিছ কাদা হয়ে, আমি গিয়ে উত্তাপ নিয়ে কাটিয়ে দিচিছ। সেই তোর বয়স যখন আট মাস তখন থেকেই তো তোর ওই তুলতুলে পবিত্র শরীরটাকে অবলম্বন করেছি আমি। তবে আর কিসের অপূর্নতা আমাকে এমন মাতাল করে সোনা?
জানি বাবু সব উত্তর জানি আমি। আমার এই মুহুর্তটাই যে সব না তাও জানি আমি, আমি এও জানি কতটুকু উষ্ণতা পেলে বরফ গলে যাবে । কিন্তু আমার জীবনের সব সিদ্ধান্তই আমার। আমিই নিয়ন্ত্রন করবো আমার বাকী জীবন। আমার সবচেয়ে শক্তিশালী ও দূর্বল হিসেব । সবার জীবনের হিসেব অনেকটা এমনই, সব পাওয়া মানুষকেও কোন কোন একাকী সময়ে উথাল / পাতাল হয়ে ভাবতে দেখেছি আমি। নীল যন্ত্রনা ছাড়া কি কোন জীবন হয় কখনো ? আদর সোনা তোকে, অনেক গভীর আদর।
মা, ৯ নভেম্বর, ২০০৭।
Email:[email protected]