বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১৭
বাসুন,
আজ সোমবার ২৬ শে নভেম্বর। সকাল সাড়ে দশটার দিকে বিবিসি নিউজটা কাভার করছিলো ঠিক এইভাবে ” বালাদেশে প্রলয়ংকারী ঘুর্নিঝড়ের ১১ দিন পরে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন, টানা তিনমাস খাবার সরবরাহ করতে হবে, ১৪০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন এবং ৩,৫০০ মানুষ মারা গেছে। দেশটির প্রতন্ত্য অঞ্চলে সহায়হীন মানুষ মানেবতর জীবন যাপন করছে।”
বাবু, তোর আর আমার জীবনে আরো একটি সপ্তাহ শুরু । তুই স্কুলে গেছিস, ঘরে কয়েকদিনের কাজ জমে আছে। বিশেষ করে আমাদের ফ্রিজে সপ্তাহের কোন রান্না নেই। তাই আজ সকালের দিকেই আমি সব কাজ সারবো বলে মনস্থির করেছি। বিকেলে যেতে হবে কাজে সেই চিন্তাটা মাথায় নিয়েই দিনের শুরু। আমার আর তোর এই ছোট সংসারে একটা টেলিভিশন আছে। বাড়িওয়ালা প্রথমদিনই বলেছিলেন যে ওনাদের বাড়িতে হোম থিয়েটার আছে বলেই এই টিভিটার প্রয়োজন হয় না। টিভিতে বাংলা কোন চ্যানেল নেই। তাই তোর প্রিয় চ্যানেল কাটুর্ন আর আমার বিবিসি।
আজ সকালে বিবিসি চলছে আর আমি রান্না করছি। কানে ঢুকছে ইংরেজী কিন্তু মন জুড়ে রয়েছে ”ব্যাক হোম ”। এই দেশের বিভিন্ন অফিসের অথরিটিরা কথাটা খুব জোরের সাথে বলে ”ওহ, ইউ আর টকিং এব্যাউট ইয়োর ব্যাক হোম। জাস্ট ফরগেট ইট, ট্রাই টু বি এ ট্রু ক্যানাডিয়ান ” এমনকি চাকরি যদি পেতে হয় তাহলেও নাকি পুর্বশর্ত হচ্ছে দেশের চিন্তা একদম পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে হবে মাথা থেকে। মনে করতে হবে আমি কানাডায় থাকবো, কানাডা আমার শেষ গন্তব্য এবং জীবনে মরনে কানাডায়ই আমার সব। মানসিক ভাবে এই জায়গায় যতদিন না আসবো ততদিন ধুঁকে ধুঁকে নাকি মরতে হবে। এরকম নানান তত্ত্ব কথা এই দেশে যারাই সেটেল করতে আসবে তাদেরকে শুনতে হবে সেইসব মহান অগ্রজদের কাছ থেকে যারা শেষপর্যন্ত (অন্তত ৫/৬ বছরের চেষ্টায়) কানাডায় একটা চেয়ার টেবিলে বসে কাজের সুযোগ পেয়েছেন । সুতরাং আমার রাস্তা এখনো অনেক বাকী। আমি এখনো প্রতি ঘন্টায় অন্তত কয়েক লক্ষবার আমার ব্যাকহোমে ফিরে যাই, সবকিছুর সাথে নিজের দেশের তুলনা খুব আপনাতেই চলে আসে। এই তো একঘন্টা আগে জোরে জোরে পানি ছেড়ে বাথটাবটা পরিস্কার করার সময় ভেসে উঠলো বিবিসির নিউজ যেখানে দেখাচ্ছিলো সার বেধে মানুষ দাড়িয়ে আছে পানির জন্য। কারো হাতে বালতি, বোতল আর নানান মাপের পানি ধরে রাখার ভান্ড। এছাড়া তো আছেই আমার দেশের গরীব মানুষের দুঃস্থ চেহারা। জানিস বাবু, আমার এই কানাডার জীবনের অল্প কিছুদিনেই আমার একটা তুলনা খুব সহজে মনে আসে। সেটা হলো---ধর, ঢাকাতে বড় হওয়া একটা পরিবার যারা ছোটবেলা থেকেই শহরটাকে তাদের নিজেদের মনে করে, সেই শহরের হয়ে স্বপের জাল বোনে। সেই পরিবারেই যদি মাঝবয়সী কোন মানুষ গ্রামের দারিদ্র এবং কষ্টকে মানতে না পেরে শহরের সেই পরিবারটির কাছে এসে আশ্রয় খোঁজে তাহলে শহরের পরিবারটি সেই মানুষটাকে কি বলবে ? প্রথমেই বলবে, ঠিক আছে এসেই যখন পড়েছো কোন একটা ব্যবস্থা হবেই --- এরপর গ্রামের সেই মানুষটির যুদ্ধ শুরু হয়, অবর্ননীয় নানান কষ্ট অতিক্রম করে সেই পোড় খাওয়া মানুষটা যেদিন সোজা হয়ে দাড়ায় তখন তার সেই ফেলে আসা গ্রাম তার কাছে সবচেয়ে মমতা আর ভালোবাসার স্মৃতি -- সেই ফেলে আসা জীবনই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিন্তু সময় এর আবর্তে সেই গ্রাম তার কাছেই শুধুই দূর অতীত, ফেরার আর কোন পথ নেই। এতদিনে সে আধা শহুরে। শহরে টিকে থাকার উপায়ও তার রপ্ত হয়ে গেছে। এবার মানুষটা শহরের সেই পরিবারটির কাছে আরো ভালো জীবনের জন্য আবেদন জানায় কিন্তু এবারও তাকে জানানো হয়, কি বলছো তুমি ? এই সেদিন গ্রাম থেকে এসেছো, এখুনি তুমি চাকরি চাও? জানো, তোমার চেয়ে কত যোগ্য মানুষ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
না,বাসুন এই গল্পের শেষ পরিনতি তোর জীবনের সাথে মিলবে না। কারন কানাডা তোর শহর --- আমি এখনো ব্যাকহোমের মানুষ, উপড়ে ফেলা শিকড় নিয়ে আমি পথে পথে ঘুরবো। আমি চাকরি পেয়েছি,আরো একটু ভালো চাকরিও পাবো হয়তো কোন একদিন। কিন্তু ”ব্যাক হোম” সীল পিঠে নিয়ে ঘুরতে হবে বাকী জীবন। কিন্তু বাবু, জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য কি জানিস ? আত্মবিশ্বাস, যে বিশ্বাস নিয়ে আমার বাবা আমাদেরকে শহরে শিকড় গড়ে দিয়েছিলেন। সেই একই শক্তি দিয়ে আমি তোকে তুলে দিলাম পৃথিবীর হাতে --জয়ী হবার পথ যে রচনা করে সেই আসল যোদ্ধা -- যে বীর শুধু হেটে যায় সেই পথ ধরে তার কৃতিত্ব খুবই সামান্য। আমার আজকের এই কালো আধাঁর যেদিন কাটবে সেদিন তুই হবি ট্রু কানাডিয়ান। আমি থাকবো তখন দূরে, বহু দূরে । তোর পথ কন্টকমুক্ত হোক। আদর।
মা, ২৬ নভেম্বর, ২০০৭
Email:[email protected]