বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ১৮
বাসুন,
খুব অবিশ্বাস্য গতিতে বছরটা শেষ হয়ে এলো। এত দ্রুত যে মনে হচ্ছে যেন এক চোখের পলকের মতো সময় একটা বছর চলে গেলো। এই হাড্ডি কাঁপানো বরফের সময়টাও তো তোকে আর আমাকে পার করতে হচ্ছে, তাই না রে সোনা? এই যে, আজকে ছুটির দিনে তুই তোর ঘরে ইন্টারনেটে খেলছিস আর আমি আমার ঘরে ইন্টানেটে, সারা দুনিয়াটা আমার সামনে । কি নেই বল এই যন্ত্রের ভিতর?
আমি দুদিন হলো দেখছি আফসান চৌধুরির সাক্ষাৎকার - দ্যা রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক নামে একটা চ্যানেলের এই লিংক টা আমার মেইল একাউন্টে আসার পর থেকে আমি মোট দশবারের বেশী দেখে ফেললাম ৮ মিনিটের এই ক্লিপটা । জনাব চৌধুরী বাংলাদেশের একজন পরিচিত মানুষ বিশেষ করে প্রাইভেট ও মিডিয়া সেক্টরে। জনাব চৌধুরীর শেষ কথা থেকে আলোচনাটা শুরু করতে ইচ্ছে হচ্ছে, উনি বললেন "দ্যা সায়েন্স ইজ রাইট বাট দ্যা পলিট্যিকাল সায়েন্স ইজ ভেরী রং।" আজকের বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের ভিতর এককোটি মানুষ এই সত্যটা জানে না, এবং এই ১ কোটি মানুষের ভিতর হয়তো ৫০ লাখ মানুষও ঠিকমত আজকের পৃথিবীর গ্লেবাল ওয়ার্মিং কনসেপ্টটা বোঝে না। তাহলে এই যে সাড়ে ১৩ কোটি মানুষ, যারা জানে না যে তারা কেন বছরের পর বছর এই বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষের শিকার হবে তারা তো তাদের নিয়তিকেই সংগী করে বেঁচে আছে কয়েকশো বছর ধরে। তাহলে জনাব চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী এই বাস্তবতা মেনে নেয়াই কি বাংলাদেশ সহ আরো কয়েকটি দেশের একমাত্র পথ? সাক্ষাৎকারে আরো একটি বিযয় পরিস্কার যে, বাংলাদেশে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগেও ছিলো এবং পরবর্তিতে আরো ভয়াবহ রূপে আসবে এবং বালাদেশের মানুষ এটা বিশ্বাস করে যে "নোবোডি ইজ গোয়িং টু লিসেন টু দেম।" তার মানে এই সত্যই আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি গত ৩৬ বছর ধরে ? তাহলে কি পৃথিবী মানে ওয়েস্ট বা উন্নত দেশ গুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষাতেই বেশী ব্যস্ত মানব জাতিকে রক্ষা করার চেয়ে? জনাব চৌধুরীর এই সাক্ষাৎকারে আরো বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গরীব মানুষ ইত্যাদি সমস্যাকে উপেক্ষা করা খুবই সহজ, কারন এই গরীব মানুষেরা বছরের পর বছর এভাবেই টিকে আছে এবং থাকবে। খুব সম্প্রতি প্রচারিত সাক্ষাৎকারটা শুনে আমার জানতে ইচ্ছে করে, তাহলে কি পৃথিবীতে গরীব দেশগুলোকে সচেতনভাবেই টিকিয়ে রাখা হবে ধনী দেশগুলোর স্বার্থে ? পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি গরীব মানুষ আছে বলেই কি অল্প কিছু ধনী মানুষের এই অঢেল সম্পদ? তাহলে কি মানব সভ্যতা নিয়ে এই সব আয়োজন কেবলই উলংগ নোংরামী? উত্তরগুলো এই লেখা যারা পড়বেন তারা সকলেই জানেন, এমনকি আমিও জানি। কিন্তু বাসুন, ওই যে বোধ "ভালো আর মন্দের" "কম আর বেশ" "আলো এবং অন্ধকার" এইসবই আমার মতো মধ্যবিত্তের যার কানাকড়ি মুল্য হয়তো বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ধোপে টেকে না-- সেই বোধ দ্বারা তাড়িত হই প্রতিমুহুর্ত । বাংলাদেশেরই একজন মানুষ যখন ফিল্ম বানায় "ডাজ এনিবডি কেয়ার ইফ বাংলাদেশ ড্রন?" তখুনি আমার মনে হয়, কি হবে আমার দেশের গরীব মানুষের ? কি লাভ বেঁচে থাকার এই আয়োজনের যদি সত্যি মেনে নিতে হয় কিছু আরোপিত সত্যকে ? কেন বলতে পারবো না কিছু মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে কিছু মানুষ উল্লাসময় জীবনকে যাপন করতে পারে না, কিছুতেই না।
এই পৃথিবী সবার, সবাইকে সমানভাবে বাঁচতে দিতে হবে। আমি জানি বাবু তোকে নিয়ে একটা সেফটি জোনে বাস করে আবেগ দেখানো সহজ, কথা বলাও সহজ, শুধু সহজ না ওই জীবনটা মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা । সৌভাগ্য শুধু এটুকুই যে, বাংলাদেশের গরীব মানুষেরা জানে না "প্রকৃতিও নিয়ন্ত্রিত হয়, ভাগ্যও নির্ধারন করা থাকে" ----- কিছু মানুষ শুধু মেনে নেয়। এই মেনে নেয় বলেই তারা গরীব, তারা অসহায়।
আদর,
তোর মা, ৯ ডিসেম্বর,২০০৭
Email:[email protected]