বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২০
বাসুন,
আজ ঠিক কতদিন পরে তোকে এই ধারাবাহিক চিঠিটা লিখতে বসলাম জানিস তুই? একমাস তো হবেই, কেমন ফুরুৎ করে জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহটা চলে এলো। সেই ভোর সাতটায় তোকে নিয়ে বের হই আর প্রায় সন্ধ্যা ৬টায় বাড়ি ঢুকি। কি আনন্দের এক জীবন আমাদের তাই না বাবু? তুই তোর ডে কেয়ারেই সব হোমওয়ার্ক শেষ করে ফেলিস বলে বাকিটা সময় আমারও তোকে নিয়ে আর কোন চিন্তা থাকে না। জানিস সোনা, ঠিক এরকম একটা জীবনের ছবি এঁকেছিলাম আমি গত তিন বছর।
আজ দু’টো সপ্তাহ গড়িয়ে গেলো, দুধকুচি বরফ দিয়ে ছেয়ে আছে শহর। তোকে লিখতে বসলাম এইবেলা, সাপ্তাহিক ছুটির আমেজ তোর আর আমার ছোট সংসারে। তুই যখন আর একটু বড় হবি তখন একটা ইংরেজী শব্দের সাথে তোর পরিচয় হবে, শব্দটার নাম ”পারসিসটেন্স” বাংলা অর্থ হলো লেগে থাকা । একবার এক বিশ্বখ্যাত সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করেছিলো খুব এভ্যারেজ একজন মানুষকে,অনেকে বলে মেয়েটির তুলনায় নাকি ছেলেটি ছিল বিলো এভ্যারেজ। কিন্তু তার পরও মেয়েটি ওই ছেলেটিকেই বিয়ে করেছিলো এবং যথারীতি মিডিয়া মেয়েটিকে জেঁকে ধরেছিলো। বলেছিলো সারা পৃথিবীর এত মানুষ আপানার জন্য পাগল ছিলো, এত ভালো ভালো অফার আপনার, আপনি সব রেখে এই মানুষটাকে বেছে নিলেন কেন? মেয়েটি উত্তরে কি বলেছিলো জানিস? বলেছিলো, এই মানুষটা শেষ পর্যন্ত আমার পিছে লেগে ছিলো। শত বিপদ বা শত বাধা দিয়েও আমি ওকে ঠেকাতে পারিনি, ও কিছুতেই আমার পিছু ছাড়েনি । বাবু, এই প্রতীকি গল্পের মতোই ঘুরেছে আমার গোটা জীবন। আমার জীবনে কোন কিছু, খুব সামান্য কিছুও চেষ্টা ছাড়া আসেনি। একেবারেই না । সেই যখন ছোট ছিলাম, এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে পাশ করে মানে শুধু তেত্রিশ পেয়ে পাশ করতে আমার অসম্ভব কষ্ট হতো। এরপর যেখন মেট্রিক /ইন্টারমিড়িয়েট পাশ করলাম আমার বড়মামা মানে তোর কালো নানাভাই এর একটা ছোট কথা আমাকে গভীর ভাবে টেনেছিলো। আমি সেবার এইচএসসি পাস করেছি। দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়াতে ভীষন মন খারাপ, তখন মামা বললেন, তুই এম এ পাশ করে শুধু চাকরি করবি অথাৎ জীবনের শেষ পর্যন্ত যাবার চেষ্টা করবি তাহলেই দেখবি তোর পিছনে অনেক তুখোড় ছেলেমেয়েরা পড়ে থাকবে। কথাটা কিন্তু সত্যিই তাই বাবু। কে কার পিছনে বা সামনে আছে সেটা নয় বরং জীবনের নানান বৈরী পরিবেশে মানুষ খুব সহজেই হাল ছেড়ে দেয়। আমি আমার এই গত ১৫ বছরে এরকম বহু ছেলে এবং বিশেষভাবে মেয়েদেরকে দেখেছি যাদের সাথে ছোটবেলায় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলার মতো সুযোগ মিলতো না আজ তারা শুধু শুয়ে/বসে সময় কাটাচ্ছে। দেশ দশের চিন্তা তো দূরের কথা শুধুমাত্র নিজের জীবনটা নিজে চালাবে বা নিজে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে এমন মেয়ের সংখ্যা একেবারেই কম। অনেকের সাথে কথা বলতে গেলে প্রথমেই মেয়েরা আমাকে যেটা বলে সেটা হচ্ছে “না আপা, এই সংসার বাচ্চা নিয়ে আর কোনদিনও কিছু করা হবে না”। অথচ আমি অনেক গ্রামের অঁজ পাড়াগায়ে দেখেছি যেখানে মেয়েরা আজো কাঠ /খড়ি দিয়ে রান্না করে। সেইসব মেয়েরা এক একটি এলাকাকায় বা গ্রামে সাবির্ক কার্যক্রমে অংশগ্রহন করছে। আবার ঢাকার অনেক বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে যাদের বাবা/মায়েরা মেয়েকে শখ কার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে সেইসব মেয়েরা বলেছে, “জানেন না আপা, বিয়ের আগে যখন প্রেম করতাম তখন কত কথা বলতো। এখন যেহেতু ও(স্বামী) অনেক ভালো কাজ করে তাই সহজেই বলে ফেলে, তোমার কাজ করার দরকার কি? খামোখা কষ্ট করবে তারচেয়ে সংসার সামলাও”। পাশাপাশি আমি অনেক মিডিওকার মেধার মেয়েদের দেখেছি নিজের পায়ে দাড়াবার আপ্রান চেষ্টা থেকে ওরা আজ অনেকক্ষেত্রেই রীতিমতো ঈর্ষনীয় জীবনের অধিকারী হয়েছে।
ওই যে বাবু, তোকে বলা শুরু করেছিলাম পারসিসটেন্স এর কথা। গত কয়েদিন আমি তোকে নিয়ে ঘোর অন্ধকার থাকতে বের হয়ে যাই। বেলা সাড়ে আটটার দিকে এই টরন্টো শহরে আমার অফিসে বসে যখন সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের সাথে টানা সাত ঘন্টা সোশ্যাল কাউন্সিলিং করতে হয়, তখনই মনে পড়ে ছোটবেলায় ইংরেজীতে শুধু তেত্রিশ পাবার জন্য আমার গোটা বাল্যকালটা অন্ধকার থাকতো। আমার আজকের এই জীবন তাই আমাকে আরো সামনে যাবার জন্য অদম্য শক্তি দেয় । কোন এক গল্পে পড়েছিলাম ”বাধাই নাকি মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় রাজতিলক”। তোকে আদর সোনা।
তোর মা
২৬ জানুয়ারী, টরোন্টো।
Email:[email protected]