বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২১

বাসুন,

আজ থেকে মাত্র আটমাস আগে আমি তোকে এই চিঠিটা লিখতে শুরু করেছিলাম। সেদিন যে ভাবনা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো আজ আমি সেই দুঃশ্চিন্তা থেকে অনেকটাই মুক্ত। জীবনকে চালানোর শক্তির জায়গায় আমি  আপাতত নিঃশ্বাস নিতে পারি কিন্তু সোনা, ভাবনা আমাকে মুক্তি দেয়নি। সারাক্ষন আমার মনটা ঘিরে থাকে তোর ভবিষ। এখন সকাল পৌনে নয়টা। তোকে স্কুলে পাঠিয়ে শুন্য বাড়িতে আমি। আজকে সকালের এই দুঘন্টা বাসায় থেকে তারপর বের হবোএখন অপেক্ষা করছি, বাংলাদেশ থেকে আমার ফোন আসবেবাবু, তুই কি কোনদিন উপলব্ধি করবি সেই তোর আট মাস বয়স থেকে তোকে নিয়ে আমি কেমন করে সময়গুলো পার করলাম? হয়তো শুনবি, জানবি, কিন্তু উপলব্ধি কি করা যায় ? কেমন করে তুই অনুভব করবি আমার অতিক্রম করে যাওয়া অনন্ত মুহুর্তকে? দেশ থেকে চলে আসার আগে একটা ছোট সংগঠন গড়ে তুলেছিলোম আমরা কয়েকজন মিলে। আমরা সবাই কাজ করতাম নানান জায়গায়, জীবন জীবিকার সব চাহিদা মেটাবার পর আমরা কিছু সমমনা মানুষ একত্রিত  হতাম। দীর্ঘদিন নিজেদের ভিতর মতবিনিময়ের পর আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে, আমরা নিজেদের মতো কাজ করবো। তুই তখন মাত্র দুই বছরের শিশু। তোকে তোর নানীআপুর কাছ রেখে ছুটির দিনগুলো ছুটে বেড়াতাম সেই রংপুর, মাগুরা, নোয়াখালি। এভাবে কখন চলে গেছে তিন বছর আমি টের পাইনি সোনা নিজেদের মতো করে  কাজ করবো, স্বাধীনভাবে সমাজের উন্নয়নে অংশগ্রহন করবো এই চিন্তা আমাদেরকে  প্রায় পাগল করে ফেলেছিলো। দিনরাত আমরা ছুঁটেছি কজের পিছনেবাবু তোকে একটা কথা বলে রাখা দরকার, খুব জরুরি কথা। তুই বড় হলে হয়তো বাংলাদেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে নানান বিভ্রান্তিকর কথা শুনবি। কিন্তু সত্যটা কি জানিন সোনা? বাংলাদেশেই আমি খুঁজ়ে পেয়েছিলাম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে। সারা বিশ্বের মানুষকে তো গত কয়েক বছর ধরে দেখছি। উন্নত দেশগুলো নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছে সিস্টেম নামক এক মহা যন্ত্রের কাছে যা আমাদের মতো দেশগুলোতে আমরা  এখনো গড়ে তুলতে পারিনিআর সেই অর্থে তুলনা করলে আমাদের দেশের সাধারন মানুষের ভিতর আমি যে সততা এবং দেশের জন্য  ভালোবাসা দেখেছি  সেটা আজ পর্যন্ত অন্য কোন দেশের মানুষের ভিতর পাইনিওই যে কথায় বলে, ”দুধের ভিতর চোনা পড়ে পুরো দুধটাই  নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি আমাদের দেশের মাত্র গুটিকয়েক মানুষের জন্য আজ নির্বাসিত এই জীবনকে বয়ে বেড়াচ্ছিযা হোক, আমাদের সেই  ছোট সংগঠন আজকে আলোর মুখ দেখেছে। আমরা কাজ করছি, দেশের অন্য দুএকটা প্রতিষ্ঠানও আমাদের সাথে কাজ করছে।  অথচ বাবু আজ আমি কতদূরে বল? এই তো তোকে নিয়ে মাত্র দেড়বছর আগেও বাংলাদেশে ঘুরে এলাম সেই সবগুলো এলাকাসেই প্রতিষ্টান দিগন্তের ডাক আমাকে টানে সোনা, ভীষনভাবে টানে। আমি আজ এই বিদেশ বিভুইঁ এ নিবিষ্ট হয়ে কাজ করতে পেরেছি কারন আমার একটা ভরসার জীবন আছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে জানিস, সেই সংগঠন এর সহর্কমীদের ফোনের অপেক্ষাই করছিলাম  সকাল থেকে আর তোকে চিঠিটা লিখলাম, কেমন করে নিজেকে প্রবোধ দেই আমি যখন একদল মানুষ আমাকে বলে আপা চলে আসেন আমরা একসাথে কাজ করবো,দেখবেন দেশে কতকিছু করার আছে। আপনাকে ভীষন দরকার।কেমন করে এই আহবান অতিক্রম করি আমি বাবু? শুধু কি তোর মুখের দিকে তাকিয়ে, নাকি নিজের এই জীবনের ভার আর কোথাও বইতে দেবো না বলেই টরোন্টো শহরের র্নিভাবনার এই জীবন বেছে নিয়েছি আমি? জীবনের সোজাসাপটা কোন  উত্তর নেই। আমি জানি বাবু, তবুও খুঁড়ে খুঁড়ে ছিড়ে ছিড়ে দেখা তোকে আদর

তোর মা

৫ ফেব্রুয়ারী, ২০০৮

Email:[email protected]

পর্ব ২০                                                                           পর্ব ২২