বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ২৯
বাসুন,
আজো আনেকদিন পরে তোকে লিখতে বসলাম। গত কয়েকদিন হলো একটা ছোট বিযয় মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে । একজন বৃদ্ধ লেকের পাড়ে বসে মাছ ধরছিলো। এক বিশাল বিজ্যনেস ম্যাগনেট এসেছে একই লেকের পাড়ে একটু চাংগা হতে। ব্যবসায়ী লোকটি খেয়াল করে দেখলো যে, বুড়া যতবরাই ছিপ ফেলছে ততবারই মাছ পাচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষন পড়েই বুড়ো উঠে চলে যাবার আয়োজন করছে। ব্যবসায়ী তো অবাক হয়ে বলল, কি করছো তুমি? চলে যাচ্ছো কেন ? বুড়ো উত্তরে বলে, কি করবো? ও বলে, কেন তুমি আরো মাছ ধরো। তারপর বাজারে বিক্রি করো, আরো টাকা বানাও। তোমার তো লাক অনেক ভালো । বুড়ো বলে, আরো মাছ আর আরো টাকা দিয়ে কি করবো ? ও বলে কেন তুমি মাছের ব্যবসা করো, লোক রাখো, ট্রলার কেনো,অনেক কর্মচারী রাখো। বুড়ো বলে, অনেক টাকা হলে কি করবো আমি ? ব্যবসায়ীটা অবাক হয়ে বলে, তোমার অনেক টাকা হলে তুমি অনেক সম্পত্তি করবে তারপর যখন বৃদ্ধ হবে তখন তোমার বউকে নিয়ে এসে নিশ্চিন্তে লেকের পাড়ে বসে মাছ ধরবে। বুড়ো বলে, আমি এখন কি করছি ? মাছ ধরছি এবং নিশ্চিন্তেই ধরছি।
লেখক বোঝাতে চেয়েছেন জীবনে সুখের উপলব্দি বা আনন্দে থাকার জন্য অর্থটাই প্রধান শর্ত না। কিন্তু আধুনিক সময়ে কি এ কথা ধোপে টেকে? আবার না টেকারই বা কি আছে? আমার নিজের জীবনের ঘোর এখনো কাটে না আমার কাছে, মানুষ কি চায় ? কতটুকু পেলে সে বলবে যে আমি আর চাই না ?
আজ বিকেলে, টরোন্টো শহরের সামারের অপূর্ব আলোতে তুই তোর বাইক চালাচ্ছিলি আর আমি নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে হাটছিলাম। ঠিক গতবছর এই সময়টা আমি মনপ্রাণ দিয়ে যা চেয়েছিলাম তাই আমি এবছর পেয়েছি, কিন্তু আমার ভিতরের অতৃপ্তি তো যায়নি? বরং গতবছর অনেক বেশী আনন্দ নিয়ে সামার কে এনজয় করেছিলাম। এবছর চাকরির সাথে সাথে আরো কিছু হিসেব নিকেশ, জীবনের পাওয়া না পাওয়া যেন আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে। এই যে তোকে বলে যাই অর্নগল একান্ত কিছু ব্যক্তিগত কথা, এই কথাগুলোও আগে যেমন গুছিয়ে বলতে পারতাম এখন তেমন পারিনা। আগে একটা প্রবল অপেক্ষা ছিলো, মনে হতো চাকরি পেলে কতকিছু করে ফেলবো, কিন্তু কই বাবু? ইদানিং যেন মনে হয়, সময় বয়ে যাচ্ছে, কাজের কাজ তেমন কিছু কি করছি? গত কয়েকদিন আগে প্রথম আলোতে শাহাদুজ্জামান চিরকুট নামে ছোট একটা লেখায় ফিলানথ্রপি শব্দটা ব্যাখা করতে গিয়ে বাংলাদেশের নওগাঁতে এক তালবুড়াকে উদহারন দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ভিক্ষার সাথে সাথে একটি করে তালের সাস চেয়ে নিতেন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে। তারপর সেই তালের আঁটি পুতে দিতেন শহরের বড় রাস্তার দুপাশে। এখন নাকি নওগাঁ শহরের দুপাশে শুধু সার সার তালগাছ। শাহাদুজ্জামান সেই ভিক্ষুককে ফিলানথ্রপিষ্ট আখ্যা দিতে চেয়েছেন। লেখাটা পড়ে আমি অভিভুত হয়েছিলাম কয়েকটা দিন, তাহলে কিসের আয়োজনে এই জীবন? বিশ্ববিখ্যাত এক লেখক বলেছিলেন, অন্যের চোখে যে জীবন সফল সেখানেই নাকি জীবনের পুর্নতা। তাহলে তো তালবুড়ার কাছে বিফল হয়েছে আজকের সভ্যতা, বৃদ্ধ সেই ফিসারম্যান জীবনকে উপভোগ করছে অল্পপ্রাপ্তি দিয়ে, যে হিসেব মেলাতে পারেনি বিশ্বখ্যাত বিজ্যনেস ম্যান। আমি কি করে মেলাবো এই তুচ্ছ সাধারণ মানবজীবনের হিসেব? গোটা জীবনতো পার করে দিলাম শুধু ব্যক্তিগত সুখ আনন্দের হিসেব কষে। বাবু, তুই কি বের হতে পারবি এই গোলকধাঁধা থেকে?
আদর,
তোর মা
২১ শে অগাষ্ট ২০০৮
Email:[email protected]