বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩০

বাসুন,

এখন সকাল, ছুটির দিন বলেই এখন বেশী সকাল, চারিদিকে আলো ফুঁটে গেছে, আমার  ঘড়িতে সকাল সাতটা, ঘুম ভেংগে গেছেতুই কাঁদা হয়ে শুয়ে আছিস, আমি আবার বসলাম তোকে লিখতে ইংরেজীতে একটা কথা আছে--জাজ অনলি হাউ ফার আই হ্যভ ক্যেম, নট হাউ লং ইট টুক টু গেট দেয়ারমেজার দ্যা স্যাকরিফাইজ ভাসের্স রিউয়ার্ডস, এভ্যরি টিয়ার ওয়াজ ওয়ার্থবাবু, তোর আর আমার এই বাড়িটা আমরা ছেড়ে যাবো নতুন করে বাসা ভাড়া নিয়েছি, আমরা সেখানে চলে যাবো আগামী সপ্তাহে তোকে লেখা এই পর্বটাই হয়তো আমার এই বাড়িতে বসে শেষ লেখামাত্র ১৪ মাস আগে যখন এই বাড়িতে এসেছিলাম তখন আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতো, পাশাপাশি দুটো বড় ঘর, আমার বেডরুমের সাথে ছোট ওয়াশরুম, নিপাট পরিপাটি করে সাজানো আমাদের সংসার, তোর মনে আছে বাবু? প্রথম যখন আসলাম, সেটাও সামার ছিলো, তোকে এই বাসুন লেখার প্রথম দিনগুলো? তুই আর আমি শুধু মাঠে চলে যেতাম, আমাদের নিজেদের সংসারে থেকেই আমাদের মন ভরতো না, তুই শুধু বলতি, মা আমরা কোনদিন এই বাড়ি ছেড়ে যাবো না, আমারও যাবার কোন পরিকল্পনা ছিলো না আইওনভিউ রোডের এই বাড়িতে গত একবছরে যত মানুষ এসেছে সবাই বলেছে তোমাদের বেজমেন্টা খুব সুন্দর, তোর স্কুলটা লাগোয়া, বাড়ি থেকে ১০ মিনিটের হাটা পথের ভিতর বাজার, ব্যাংক, অফিস, ফার্মেসী সব পাওয়া যায় মানুষের জীবনে কত দরকার হয় বাবু? এই যে তোকে নিয়ে এতটা পথ আমি হাটলাম, খুব বেশী কি চেয়েছিলাম জীবনের কাছে? হ্যাঁ, ওই যে প্রবাদ বাক্য, লেখার শুরুতে বললাম এভরি টিয়ার ওয়াজ ওয়ার্থ, আসলেই সোনা, প্রতি রাতে যখন তোকে পাশে নিয়ে ঘুমাতে যাই দেখি তুই একটু বড় হয়ে গেছিস, তোর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি বাবু , আমি জানি এই তো মাত্র আগামী সাত দিন, নতুন এপার্টমেন্টে উঠে তোকে পাশে নিয়ে আর ঘুমাবো না আমি,  তোকে একা ঘুমাতে হবে, তোকে সেলফ ডিপেনডেন্ট হতে হবে, জীবনের জন্য তৈরী হতে হবে, হয়তো সবার কথাই সত্যি বাবু, মানুষের জীবনে সবই লাগে, সবইচাকরি পাবার সাথে সাথেই বদলে যেতে থাকলো চাওয়া পাওয়া, এখন নতুন বাসা নেয়া দরকার, একটু ভালো থাকা দরকার, গাড়ি কেনা দরকার, তোমরা অনেক কষ্ট করেছো এবার বেজমেন্ট থেকে উপরে উঠো, এই তো বাবু, এর নাম সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলাগত রাতে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম একটা বিশাল শপিং মলে, কামউনিটির একটা প্রোগাম ছিলো, ফেরার পথে তোকে নিয়ে  ঢুকেছিলাম মলের দোকানগুলোতে, থরে থরে সাজোনো পণ্য, পুজিঁর প্রসার আর চোখ ধাধাঁনো চমক, তুই কি যেন একটা খেলনা কিনতে চাইছিলি আমি তোকে কিনতে দেইনি, আমি তোকে বলেছি, পৃথীবিতে ৬৫% মানুষ এখনো শুধু খাবারের জন্য যুদ্ধ করে, তুই আমার কথা শুনেছিস, একটু খাবার খেয়েই  বাড়িতে চলে এসেছি আমরাবাবু, আমি অনেকবার বলেছি, তোর নানভাই গরীব কলেজ শিক্ষক ছিলেন, বাবাকে কোনদিন কখনই একটা বাড়তি জিনিস কিনতে বা ব্যবহার করতে দেখিনি, জানিস সোনা, বিয়ের পর পরই, তোর বাবা আর আমি মিলে তোর নানভাই এর জন্য আড়ং থেকে একটা পান্জাবী কিনেছিলাম আমরা দুজনেই তখন এনজিওতে চাকরি করতাম, সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি , কয়টাকাই বা বেতন পেতাম তবুও শখ করে তোর বাবা শ্বশুড়ের জন্য কাপড় কিনবেআব্বু, গিফট-টা  হাতে পেয়ে বললেন, তোমরা কি টাকা চুরি করো যে আড়ং থেকে জিনিস কেনোএই তো ১৯৯৫ সালের কথা, মাত্র ১৩ বছর, আমার বাবা আজো একই রকম আছেন, আমরা তিনবোন আজ দেশের বাইরে, ঢাকাতে ছোটবোন সাদাকালো নামে একটা ফ্যাশান হাউজের কর্নধার, একদিন যে কলেজ শিক্ষক বাবা চারবোনের ভাত/ কাপড় আর পড়াশোনাকে নিশ্চিত করতে দিনরাত অফিস করেছে, দূর দুরান্তে একটা ক্লাস নিতে গেছে, ছুটির দিনে গড়ে ৯/১০ ঘন্টা করে পরীক্ষার খাতা দেখেছে , মা সারা মাসের বেতন পেয়ে টাকার হিসেব মেলাতে না পেরে বিহবল হয়েছে, সেই পরিবারের মেয়ে হয়ে আজ আমরা অনেকটা পথ চলে এসেছি বাবুজীবনের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠে বাবু, বার বার চোখ মুছতে হয় কিন্তু সত্যিকার  অর্থে আমরা সেই  স কলেজ শিক্ষক বাবার সফল মেয়েবাবা বলতেন, বড় হতে হলে কষ্টকে অর্জন করতে হবেআজ নাকি আমার ছোটবোন ঢাকাতে স্টার, নর্থ আমেরিকায় সবাইকে বলতে শুনি সাদাকালো তো খুব নামকরা, আপনার বোন? হ্যাঁ আমারই ছোটবোন, জামাবকাপড় বা সেলাই করে শাহিন ওর গোটা বাল্যকাল কাটিয়েছে, ক্লাস সেভেন থেকে শাহিন কোনদিন বাবা/ মায়ের কাছ থেকে এক পয়সা নেয়নি, অসীম আত্মশক্তি আর জীবনের প্রতি চ্যালেঞ্জ শাহিনকে এতদূর এনেছেআজকে তোর যে খালা ডালাসে বড় আইটি ফার্মে কাজ করে সেই খালাকেও পড়াবার জন্য তোর নানী আপু হাতের চুড়ি বেঁচে দিয়েছিলো পানির দামে, কোন কষ্টই বৃথা  যায়নি বাবু, তোর যে বড়খালা এখন ফ্লোরিডাতে নিজের ব্যবসা চালায় আমার বড়বোন, একটা কথার পিঠে কথা বলতে পারতো না , চোখ দিয়ে টস টস করে পানি পড়তোএখন নাকি বড়পা একা  একা ড্রাইভ করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায়এই তো বাবু জীবন, জীবন তো এভাবেই ভরে উঠে, খুব সহজভাবে পথ পার হইনি বলেই আমি জীবনকে উপভোগ করি প্রতি মুহুর্তে,কোন ক্ষোভ নেই আমার, পুরোনকে ছেড়ে যাবার বেদনা আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দেয় কিন্তু ঠিক ততখানি সত্য যে আমাকে  নতুন করে বাঁচতেই হবেবাবু, আমার আর তোর এই স্মৃতিময় বাড়িটা আমাদের  টরোন্টোর জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে--এই বাড়িতেই  আমার প্রথম প্রফেশনাল চাকরি হয়েছে, তুই গ্রেড ৩ শেষ করেছিস, এই বাড়িতে আমরা প্রথম গাড়ি কিনেছি, এখন তুই আর আমি একটা এপার্টমেন্টে উঠবো, আমাদের প্রথম উঁচু ফ্ল্যাটে থাকা হবে, এই তো সোনা, পুরোন পথ ধরেই জীবন বয়ে যাবে আগত সময়ের দিকে, বেলা শেষে আমি স্মৃতির পাখিদের সাথে কথা বলবোতোর মুখের দিকে তাকিয়ে ফেলে আসা সময়কে মনে করবো আরো একবার, বার বার 

তোর মা ,

২৪  শে অগাষ্ট ২০০৮, টরোন্টো 

Email:[email protected]

পর্ব ২৯                                                                             পর্ব ৩০