বাসুনকে, মা
লুনা শীরিন
পর্ব ৩১
বাসুন,
ফেলে আসা সময়কে মনে করে বর্তমানকে আনন্দের সাথে গ্রহন করতে না পারার বেদনা কি শুধুই মানুষকে পিছু টেনে ধরে, নাকি নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য এটা একটা অন্যতম উপকরন। যেখানে মানুষ সহজেই নিজেকে নতুন করে উপযোগী করবার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে, নিজেকে বোঝায়, যা ফেলে এসেছো তা কেবলি অতীত, এই যে বর্তমান, এই যে নতুন, এই যে নতুনের হাতছানি এই নতুনকে গ্রহন করার নামই জীবন।
অনেক ছোটবেলায়, যখন বাবা বিদেশে পড়া শেষে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে এলেন, আমাদের সবাইকে ঢাকায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হলো, আমরা আমাদের নানাবাড়ি রংপুর ছেড়ে রাজধানী শহরে আসবো, সেকি সাজ সাজ রব চারিদিকে, মনে আছে, মামা/খালারা জিনিসপত্র বাধাছাদা করছে, আসে পাশের আত্মীয় স্বজনরা আমাদেরকে আদর করছে আর বলছে, যাও ঢাকায় যাও, আমরাও বেড়াতে আসবো, আমাদেরও একটা যাবার জায়গা হলো, কিন্তু আমি যে চিরতরে আমার ছোটবেলাটা হারিয়ে ফেলবো সেকথা একবারও বললো না কেউ। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, আমি নানাবড়ির আনাচে কানাচে ঘুরছি,কখনো আমগাছে, পিছনের আইল দেয়া সব্জী ক্ষেতে, কখনো নানা/নানীর মাটির ঘরটাতে যেখানে একটা মাচার উপর অমার নাড়ু আর আমস্বত্ব লুকানো থাকতো, আমার প্রিয় ভাংগা দেয়ালের উপরে গিয়ে বসি, তার দুদিন পরেই আমরা ঢাকা যাবো কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছে, আমি এই পরিবেশ ছেড়ে যাবো কি করে? কি করে আমাকে ছাড়া আমার বন্ধুরা ঈদ করবে? কি করে আমি না থাকলে বিকেলে ছি বুড়ি খেলা হবে? দুপুর রোদে পাড়ায় পাড়ায় নানীর হাত ধরে কিভাবে ঘুরবো আমি?
ঢাকাতে আজিমপুরের সেই কলোনীটাকে আমার রংপুরের চেয়ে অনেক বেশী অনা-ধুনিক মনে হয়েছিলো, খেলার মাঠ নেই, মাটির সাথে আমার ছোঁয়া লাগে না, পেয়ারা গাছ নেই, ইমাদের বাড়ির মতো সেই ভাংগা দেয়াল নেই, এমনকি বিকেল হলেও আজিমপুরের খেলার মাঠে কোন মেয়েরা আসে না, কিচ্ছু, নেই,একদম কিচ্ছু করার নেই। আমার মনে আছে এই কষ্টগুলো আমি বহন করেছি দীর্ঘদিন। এক একটা পরিবেশে আমি যতবেশী থাকতাম আমার মায়া ততবেশী বেড়ে যেতো, আমি কিছুতেই মানতে চাই না কেন বার বার পিছু ফেলে আসার, চলে আসার, ছেড়ে থাকবার বেদনা আমাকে বহন করতে হবে, এই কষ্ট কি আমার একার বাসুন?
এখন টরোন্টো শহরে অন্ধকার, ভোরের আলো ফোঁটেনি বাবু, আমাদের নতুন এপার্টমেন্ট, বড় রাস্তার সাথে লাগোয়া সাততালা বিল্ডিংয়ের আমরা একদম টপফ্লোরে উঠেছি। গত দুটো দিন বাবু, তুই আর আমি শুধুই ঘর গোচ্ছাছি, মাত্র একবেডরুমের বাড়ি কিন্তু তোর আর আমার জন্য অনেক বড়। এই ভোর অন্ধকারে আমি দাড়িয়ে আছি খোলা বারান্দাতে, সামনে উঁচু উঁচু গাছ, রাস্তায় গাড়ি চলার অবিরাম শব্দ আর আমার স্মৃতিতে আমার সেই ছোট বেজমেন্ট যেখানে আমরা কোন শব্দ শুনতাম না, কি শুনশান নীরবতা ছিলো আমাদের সেই মাটির নীচের ঘরটাতে, এই বারান্দাতে দাড়িয়েই আমার মানে হচ্ছে কেন এলাম এই নতুন বাড়িতে? কেমন আছে আমার প্রিয় সেই ছোট ঘরটা? মাত্র দুদিন আগেও যে ঘরের স্বাচ্ছন্দতা আমাকে শুধু ঘরেই টানতো, সেই ঘরটাতো এখনো ফাঁকা, আমি কি আবার চলে যেতে পারি না? আবার সেখানে থাকতে পারি না? সেই চলে আর যাওয়া হয় না। এই নতুন বাসা থেকে পুরোন বাড়ি মাত্র পাঁচ মিনিটের হাটা পথ, ঢাকা থেকেও রংপুর মাত্র ৮ ঘন্টার পথ ছিলো, টরোন্টো থেকে বাংলাদেশ মাত্র দুদিনের জার্নি। কিন্তু ”যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে কাজ কি আর? ” এখন বেলা বাড়বে, আমি আবার নতুন করে নতুন বাড়ি গোছাবো, সেই পুরোন জিনিস দিয়ে, সবই পুরোন বাড়ি থেকে আনা। এই মাত্র ২৫ বছর আগে মা যখন রংপুর থেকে ঢাকায় আসে, নানী মা-কে অনেক কিছুর সাথে এক টোপলা ডালের বড়ি দিয়ে বলেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে রোদে দিস তারপর রান্না করিস। আমার মা দ্রুত ঢাকার প্যাক করা ফুডে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন বলেই অনেকদিন ডালের বড়ার টিন খোলা হয়নি, মা একদিন টিন ঝাড়পোছ করতে গিয়ে বললেন, কোথায় রোদ পাবো আমি এই ছোট বাড়িতে?
বাবু, আমরা এপার্টমেন্টে এসেছি ঠিকই কিন্তু, এখানেও সেই একই কথা ছোট বাড়ি, আগের বাড়িটা বেজমেন্ট হলেও এক সিড়ি উঠলেই আমরা মাঠ পেতাম, বাড়ির পিছনে ঘাস দেয়া একচিলতে নীরব মাঠ পেতাম, কি সুন্দর ছিলো বাড়িটা বাবু, তোর মনে পরে সোনা? বাড়িওয়ালারা প্রায় সারাদিনই থাকতো না, আমি আর তুই বার বার বাইরে যেতাম, স্কুল মাঠে যেতাম, ব্যকইয়ার্ডে গিয়ে আমি ছোট টেবিলটাতে বসতাম আর তুই মাঠে সাইকেল চালাতি। আর আজকে এই উঁচু ফ্লাটে আমরা বন্দী বাবু, হুট করে তুই সাইকেল নিয়ে বের হতে পারবি না, সারাদিনই কেবল সাজানো ঘরের ভিতর ঘোরাফেরা। আর এর নাম নাকি প্রাইভেসি? নিজের ঘরে নিজের মতো থাকা,বেজমেন্টে নাকি প্রাইভেসি নেই, হ্যা আমরা যখন নানাবাড়িতে থাকতাম তখন আমার মা কে সবাই বলতো নিজের সংসারের স্বাদই আলাদা, কই আজ যে এত বছর পরেও বুকের ভিতর ফেলে আসা সময়ের জন্য হাহাকার উঠে? গতকাল বিকেলে গিয়েছিলাম বাবু, আমাদের পুরোন বেজমেন্ট এর বাড়িতে, তোর সাইকেলটা নিয়ে এলাম, পিছনের ব্যাকইয়ার্ড এ আমি কিছুক্ষন বসলাম, হঠাৎ মনে হলো, না এই বাড়ি তো এখন আমার না। যদি বাড়িওয়ালা দেখে ফেলে? ১৭৭৯ সালে রংপুর ছেড়ে আরার পর আমি বহুবার ফিরে গেছি আমার নানাবাড়িতে কিন্তু প্রতিবারই স্মৃতি আমাকে তাড়িত করেছে, আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে বর্তমানে, তেমনি এই লেখা শেষ করবার আগেই আমার চোখের পানি শুকিয়ে যাবে তারপর একদিন এই বাড়িও স্মৃতি হবে, এই ফেলে আসা আর মেনে নেয়া যেন এক অমোঘ চক্র জীবনের এই দোলাচল থেকে মুক্তির জন্য প্রাণপাত কিন্তু নিশ্চিত জানি যে মুক্তি মিলবে না। বাবু, নতুন বাড়ি আমাদের জন্য আনন্দের হবে এইটুকু প্রার্থনা, তোকে আদর ।
তোর মা,
২ সেপ্টেম্বর২০০৮, টরোন্টো।
Email:[email protected]